Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

ছোটগল্প ।। আলোকবর্তিকা ।। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

            

  আলোকবর্তিকা
 গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়



ট্রেনটা যে এতখানি ভিড় হয়ে যাবে ভাবতেও পারেননি রেণুবালা। শান্তিপুর থেকে যখন উঠেছিলেন তখনতো বেশ ফাঁকাই ছিল। বসার একটা জায়গাও মিলেছিল । তারপর কোথা থেকে একটা দমকা ভিড় এসে মুহূর্তের মধ্যে জমাট বেঁধে একেবারে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি আকার নিয়ে বসল। বছরে অন্তত পাঁচ-ছ বার শান্তিপুরে রাধামাধব মন্দিরে যান রেণুবালা । প্রতিবার এই ট্রেন ধরেই ফেরেন। আজ তো প্রথম নয়, কতবছর ধরেই যাচ্ছেন। কিন্তু এমন অসময়ে এত ভিড় আগে কখনো দেখেছেন কিনা মনে করতে পারেন না। নিরেট ভিড়টাকে আরেক ঝলক দেখলেন। বুকটা কেঁপে উঠল তার। 
দুটো সীটের  মাঝেও চাপাচাপি ভিড়। দন্ডায়মান সেই ভিড়ের ফাঁকফোকর গলে তার দুটো মরিয়া চোখ ঠিক কোন স্টেশন এল ঠাহর করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। অবশেষে সেই চেষ্টায় ইতি টেনে মুখ খুললেন ---
"কোন স্টেশন এল দয়া করে একটু বলবেন।"
"টিটাগড়।"
তারমানে মাঝখানে খড়দা তারপর সোদপুর। মনেমনে  ভাবলেন রেণুবালা। এখনই না উঠলে আর নামতে পারা যাবেনা। রেণুবালা উঠতে না উঠতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তাকে একপ্রকার ধাক্কা মেরেই ঝাঁপিয়ে পড়ে দখল নিল তার সীটটার । অন্যকেউ হলে দুটো কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু তেমন ধাতের মানুষ নন রেণুবালা। পথেঘাটে বেরোলে অতটা অসহিষ্ণু হলে কী চলে!

চারপাশ থেকে একেবারে টুঁটিটিপে ধরা ভিড়ে যেন দমবন্ধ হয়ে এল রেণুবালার। ভিড় তো নয়, যেন নিরেট পাথরের পুরু প্রাচীর! একে ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার কতটুকুই বা সামর্থ্য আর অবশিষ্ট থাকে এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সে? কিন্তু দমলেন না। দমলে চলবেনা। অটল মনবলে ভর করেই নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে ঠিক দরজার সামনে এনে ফেললেন।

ট্রেনটা থেমেছে কী থামেনি, আচমকা গলায় একটা ঝটকা অনুভব! সাথেসাথেই পিছন থেকে কে একজন চিৎকার করে উঠল --- "হার ছিনতাই করল .... হার ছিনতাই করল ....।"
ঠিক তার পরপরই আরেকটা কন্ঠস্বরে উচ্চকিতে বেজে উঠল, "এই তো ধরেছি শালাকে, ধরেছি .... ধরেছি, ধরেছি ...."

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনটা থামল। 

একটা প্রবল ধাক্কা নাকি দুরন্ত কোন ঢেউ --- অচমকা ঝটকায় অনেকটা দূরে ছিটকে দিল রেণুবালাকে। পড়ে যেতে যেতেও কোনোরকমে সামলে নিলেন নিজেকে। কিন্তু দুদন্ড দম নেবার আগেই ভাবনায়  চকিতে চিকুর হানল আশঙ্কাটা। অব্যক্ত উত্তেজনার কোনো এক বিশেষ প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই যেন তার গলা স্পর্শ করল হাতটা। সঙ্গেসঙ্গেই থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা শরীর। রক্ত হিম হয়ে গেল। চোখের সামনে আর কোন কিছুই যেন স্পষ্ট নয়। 
"আমার হার .... আমার হার ...." নিজেও জানেন না কীভাবে পারলেন ওই কটাকথা উচ্চারণ করতে!

একটুপরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে উদভ্রান্তের মত খুঁজতে শুরু করলেন। এখানে-ওখানে, এপাশে-ওপাশে, কাপড়ের ভাঁজেভাঁজে, এমনকি আলগা খোঁপাটা খুলে ঝাড়াঝাড়ি করেও। কিন্তু কোথায় হার?  নেই নেই, কোথাও নেই ! তাহলে?  তার হারটাই ছিনতাই হয়ে গেছে! হাল ছেড়ে শূণ্যদৃষ্টিতে অপলক চেয়ে রইলেন রেণুবালা। সম্বল বলতে তো ঐ হারটুকুই ছিল। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বাবা দিয়েছিলেন বিয়েতে। বিপদে-আপদে, নানান প্রয়োজনে ক্রমশ হালকা হতে হতে শেষপর্যন্ত ওইটুকুই রয়ে গিয়েছিল। স্বামী, সন্তান, সংসার, বাড়িঘর একএক করে সবই গেছে। হারটাও চলে গেল আজ। নিজের বলতে নিজের অস্তিত্বটুকু ছাড়া আর কিছুই রইলনা।

অনেকক্ষণ চারপাশের কোনো হুঁশ ছিলনা রেণুবালার। আকস্মিক বিপর্যয়ে এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে টেরই পাননি নাকের ডগায় কী ঘটছে। অনেকমানুষের ভিড়। উত্তেজনা। হৈচৈ। গালাগাল। মারধোর। কিছু যে একটা ঘটছে --- সচকিত হয়ে টের পেলেন ঠিক তখনই যখন ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, "ওই তো .... ওই তো .... উনি,উনি .... ওনারই হার .... আমি নিজে চোখে দেখেছি ...." বলতে বলতে উত্তেজনার বশে লোকটা এমনভাবে রেণুবালার দিকে ছুটে এল, যেন পারলে রেণুবালাকে টানতেটানতে নিয়ে যায়। 
"আসুন আসুন মাসীমা, ওই যে ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছেন..." লোকটা ভিড়ের মধ্যে আঙুলনির্দেশ করে দেখাল রেণুবালাকে, " ...ওই ছেলেটাই আপনার হার ছিনতাই করেছে।"
হতচকিত রেণুবালা ফ্যালফ্যাল করে লোকটার মুখের পানে চেয়ে রইল। চোখেমুখে একটা তীব্র বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে লোকটা বলে উঠল,"দেখছেন কী চলুন চলুন।"

কয়েকপা এগিয়ে যা দেখলেন --- শিউরে উঠতে হল রেণুবালাকে। এ কী ভয়ঙ্কর! ক্রোধে উন্মত্ত একদল মানুষ বছর আঠারো-উনিশের রোগাপাতলা একটা ছেলেকে নৃশংসভাবে যেখানে খুশি, যেমন খুশি এলোপাথাড়ি মেরে চলেছে। কিল, চড়, ঘুঁষি, লাথি  --- কোনকিছুই বাদ যাচ্ছেনা। শুধু কী তাই,  চারপাশ থেকে বৃষ্টিরমত আছড়ে পড়ছে গা-ঘিনঘিন করা অশ্রাব্য সব গালিগালাজ। একদল টপ-টু-বটম ভদ্দরলোক ছেলেটার বাপ-মা-চোদ্দপুরুষ তুলে এমনসব রগরগে শব্দ উচ্চারণ করছিল যে ওদের পরনের পোশাকগুলো বড়ই বেমানান ঠেকেছিল রেণুবালার চোখে। কোন কস্মিনকালে যারা কখনো ছিনতাই-পকেটমারির শিকার হয়েছিল তারাও এই সুযোগে পুরোনো স্মৃতির ঢেঁকুর তুলে আচ্ছা করে হাতের সুখ মিটিয়ে নিতেও পিছিয়ে নেই।

এইবার ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল রেণুবালার। শিউরে উঠলেন। দলবদ্ধ প্রতিহিংসার পাশবিকতায় থেকেথেকেই আর্তনাদ করে উঠছিল ছেলেটা। জামাটা ছিঁড়ে ফালাফালা।গালের কশ বেয়ে গড়িয়ে নামছিল রক্তের ধারা। চোখের কোল ফুলে উঠেছিল। আঘাতের পর আঘাতে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল তার শরীরটা। হাত-পা সর্বাঙ্গ কেটে-থেঁতলে ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত।

যে লোকটা রেণুবালাকে ডেকে এনেছিল,  রাগে দাঁত কিড়মিড় করে আবারো বলে উঠল, "এই জানোয়ারটাই আপনার হার ছিনতাই করেছে.." বলেই তেড়ে গেল ওর দিকে। ছেলেটা হাতজোর করে সক্রন্দনে আর্তনাদ করে উঠল, "আমাকে আর মারবেন না,  মরে যাব আমি.... আর মারবেন না।"

চমকে উঠলেন রেণুবালা। তার সমগ্র ভিতরটা প্রবল একটা বিস্ফোরণে থরথর করে কেঁপে উঠল। মাথায় তোলপাড়। দুচোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা। একটা হিমশীতল স্রোত সাপের মত কিলবিলিয়ে শিরা-উপশিরা বেয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তার অনুভবের আনাচে-কানাচে। চেতনার বাইরে কোথাও যেন হারিয়ে গেলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর ভীষণ আঁতকে উঠে আবার ফিরে পেলেন নিজেকে। তার দুটো চোখ স্থির ওই ছেলেটার মুখে। এ তিনি কার মুখ দেখছেন?  এ যে অবিকল বিশুর মুখ! হ্যাঁ-হ্যাঁ, রেণুবালার কোনো সন্দেহ নেই, ও মুখ বিশুর না হয়ে যায় না। বিশুরই। বিশু তার ছেলে। পনের বছর আগে ভয়ঙ্কর এক দু:স্বপ্নের রাতে হারিয়ে গিয়েছিল অকালে। এরকমভাবেই একদল ক্রোধান্ধ হিংস্র মানুষ অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর উপরে। আত্মরক্ষার এতটুকুও সুযোগ দেয়নি ওকে। তারপর .... তারপর .... । রেণুবালার অনুভবে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়েগেল তার চারপাশের বেবাক বর্তমান। তার আপাদমস্তক সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিল পনের বছর আগের এক ভয়ানক অতীত ... সেই বীভৎস রাত... ।



অন্যদিনের মতই একশ টাকার রোজে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এসে সেদিনও সবেমাত্র খেতে বসেছিল বেচারি। হঠাৎ দুমার-দুম দুমার-দুম দরজায় লাথি মারার শব্দ।হতচকিত রেণুবালা। বিশুও। কারা ওরা?  কী চায় ?  কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দুজন দুজনার মুখে হাঁ করে চেয়েছিল। ততক্ষণে দরজার ওপাশে শুরু হয়ে গেছে কান গরম করা বাছাবাছা খিস্তির ধারাবর্ষণ।
"দরজাটা খোল, শা..." তারপরে আর যা বলেছিল তা যেন কানে শোনা নয়, কানে কেউ গলন্ত লাভা ঢেলে দিল। 

খাওয়া ফেলে উঠে দাঁড়াল বিশু। 
"তুই যাস না বাবা। দরজা খুলিস না ...।" বিপদের আঁচ টের পেয়েছিলেন রেণুবালা। "... আমার ঠিক ভাল ঠেকছেনা।"
"দরজাটা না খুললে ওরা ভেঙে ঢুকবে মা।" 
রেণুবালা হাত বাড়িয়ে একটা দুর্বল বাঁধা দেবার চেষ্টা করলেও দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল বিশু। 
দরজাটা খোলামাত্রই সপাটে ঝাপট মারল চোলাইয়ের ঝাঁজাল কটুগন্ধ।তারপর হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল একদল উত্তেজিত মানুষ। বন্যপশুর মত হিংস্র। ওদের চোখগুলো আগুনের ভাটার মত জ্বলছিল। আকণ্ঠ চোলাই গিলেছিল সবকটা। হিতাহিতজ্ঞানের কোন বালাই ছিলনা কারো। ঘরে ঢুকেই সবাই মিলে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিশুর উপরে। রেণুবালার চোখের সামনেই তাকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারতে লাগল। ওদের কারো হাতে হকিস্টিক,  কারো হাতে মোটা লোহার রড। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছিল বিশু। 
"ওরা আমাকে মেরে ফেলবে মা, তুমি কিছু একটা কর... । আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও মা...।" 
এতগুলো পশুর হাত থেকে কেমনকরে তাকে বাঁচাবেন রেণুবালা! পাগলের মত একবার এর কাছে, একবার ওর কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন,"দোহাই তোমাদের, ছেড়ে দাও ওকে, মেরো না অমনকরে..।" জনেজনে দুটো-পা জড়িয়ে ধরেছিলেন ওদের। জানোয়ারগুলো সবাই লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছিল তাকে। তবুও দমেন নি। ছুটে গিয়ে জাপ্টে ধরেছিলেন ছেলেকে। ওদের আক্রমণ থেকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাকে। পারেন নি। ওরা তাকে হিড়হিড় করে টেনে-হিঁচড়ে ঘরের বাইরে এনে নিক্ষেপ করেছিল ঘন অন্ধকারে। প্রচন্ড আঘাতে সমস্ত শরীর যেন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। যন্ত্রণায় দুমড়ে গেলেন। কিন্তু তার যা হয় হোক,  ছেলেটাকে যে যেমন করেই হোক বাঁচাতেই হবে। ওই পশুগুলো যে নির্ঘাত ওকে মেরে ফেলবে! অস্থির হয়ে উঠলেন পাগলের মত। কীভাবে বাঁচাবেন ছেলেকে?  শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তার সবটুকু শক্তি দিয়ে আর্তচিৎকারে যে-যেখানে আছে সবার কাছে অসহায়ভাবে সাহায্যভিক্ষা চেয়েছিলেন ---
"তোমরা কে কোথায় আছো, তাড়াতাড়ি এসে বাঁচাও আমার ছেলেটাকে... ওরা সবাই মিলে মেরে ফেলছে ওকে... দয়া করে বাঁচাও, বাঁচাও আমার বিশুকে...। তোমাদের পায়ে পড়ছি...।"
অসহায় কাকুতিতে ডাকতে-ডাকতে, কাঁদতে-কাঁদতে বুক তার শুকিয়ে গেল। তবু কেউ এলনা। একটা  জনপ্রাণীও না। অথচ এই নয়াবস্তির মানুষগুলো বিশুর কাছে কতই না আপন, কতই না ভালোবাসার! আপদে, বিপদে, প্রয়োজনে সবসময়ে ওদের পাশে থেকেছে এতকাল। কানে শুনলেই নাওয়া-খাওয়া ফেলে ছুটে চলে গেছে। ক্লান্তিহীনভাবে রাতের পর রাত জেগেছে হাঁসপাতালে। নিজে না খেয়েও আহার তুলে দিয়েছে ওদের মুখে। রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। নিজের জীবন বিপন্ন করে আগুন থেকে তুলে নিয়ে এসে ফিরিয়ে দিয়েছে ওদের জীবন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার হয়ে দোরেদোরে গিয়ে সাহায্য চেয়েছে। কারো প্রতি এতটুকুও অন্যায় দেখলে নির্ভীকচিত্তে রুখে দাঁড়িয়েছে। এহেন মানুষটার এমন জীবন-মরণ দুর্দিনে মনুষ্যত্বের আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা তো দূরে থাক, কৃতজ্ঞতার খাতিরেও এগিয়ে আসার এতটুকু সাহস ওরা নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাই নি সেদিন। প্রাণের ভয় যে বড় বালাই! তাই নয়াবস্তির যে ক'টা ঘরে তখনো আলো জ্বলছিল --- পটাপট নিঁভে গিয়েছিল নিমেষে।

অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোক্রমে তার বিধ্বস্ত শরীরটাকে ঘরে টেনে এনেছিলেন রেণুবালা। ততক্ষণে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল ঘাতকের দল। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে তার বিশু। তার ছাব্বিশ বছরের জোয়ান ছেলে। নিথর। নিস্পন্দ। চারপাশে চাপচাপ তাজা রক্ত। টলতে-টলতে এগিয়ে গিয়ে বিশুর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত মুখটার উপর ঝুঁকে পড়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়েছিলেন। তারপরে তার দুহাতের মাঝখানে মুখটাকে চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিতেদিতে উদ্ভ্রান্তের বলে উঠেছিলেন, "বিশু, বাবা আমার কথা বল.... কথা বল বাবা.... চোখ খোল....।"   
তার বাছা যে আর কোনদিনই কথা বলবে না --- আশঙ্কা যতই তীব্র হোক না কেন,  এমন অবিশ্বাস্য সর্বনাশের কথা ভাবতে পারেননি রেণুবালা,  বোধহয় মা বলেই। কিন্তু আচমকাই বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতই উপলব্ধি করেছিলেন যে তার বিশুর গোটা শরীরটা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। উ: কী বীভৎস উপলব্ধি! মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন --- যেন কোনো প্রস্তরমূর্তি। তার বিস্ফারিত দুটি চোখে তখন পাতলপুরীর হিমশীতল অন্ধকার। ক্ষণকালমাত্র! রেনুবালা বিশ্বাস করতে পারলেন না --- নাকি কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না যে তার বিশু খুন হয়ে গেছে!                                                              
কিন্তু একসময়ে তাকে বিশ্বাস করতেই হয়েছিল যখন নিস্পন্দ ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অতর্কিতেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছিলেন নিজের ভিতরে। শুধুই ধূ ধূ বিবর্ণতা। মুছে গেছে জীবনের সব রঙ। চেতনার সবটুকু জুড়ে খাঁ খাঁ মরুভূমির শূন্যতা। বুকটা ভেঙেচুড়ে, দুমড়েমুচড়ে, তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। প্রলয়ংকর শোককে আর চেপে রাখতে পারলেন না। চূর্ণবিচূর্ণ হতেহতে প্রখর প্রচণ্ডতায় হাহাকারে ফেটে পড়লেন ---
"বিশুরে, আমি আর কী নিয়ে বাঁচব রে বাবা...."
রেণুবালার বুকফাটা বিলাপধ্বনি শাণিত ফলার মত সেই রাতের আদিম নৈ:শব্দকে ফালাফালা করে দিয়েছিল। কেন খুন হতে হল বিশুকে? একটা অশরীরী প্রশ্ন ল্যাম্পপোস্টের অলৌকিক ক্ষীণ আলোয় নয়াবস্তির গা-ছমছমে আনাচেকানাচে গোটা রাতধরে বৃথাই খুঁজে ফিরেছিল অসম্ভব উত্তরটা।

বিশু কোনো দাগী অপরাধী ছিলনা। সমাজবিরোধীও নয়। ছিলনা কোনো রাজনৈতিক সংস্রবেও। একদম শৈশবে চোখ বুঝেছিলো বাপ। কঠিন দারিদ্রের সংসারে আধপেটা খেয়েই বড় হতে হয়েছিল। সহ্য করতে হয়েছিল নিদারুণ দু:খ-কষ্ট। ইচ্ছা থাকলেও উপায় হয়নি লেখাপড়া শেখার। তবু কী করে যেন খুব ছেলেবেলাতেই ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদরেখাটা খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার চোখে। ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত --- এইসব মূল্যবোধগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল একটা আপোষহীন বিচারশক্তি, যা ছিল তার জীবনের কোনোকিছুকে দ্বিধাহীন গ্রহণ-বর্জনের একমাত্র মানদন্ড। তাই অন্যায়ের মসৃনপথে সহজে বেঁচে থাকার চেয়ে কঠিন জীবন-সংগ্রামের কন্টকিত পথ অনেক বেশি গ্রহণীয় হয়েছিল। অন্যায় তার সহ্য হত না। রুখে দাঁড়িয়ে  প্রতিবাদ করতেও বুক কাঁপত না। জীবন দিয়েই হয়তো তাকে তার মাশুল দিতে হয়েছিল। 

এলাকার দাপুটে জননেতা প্রহ্লাদ সাহা। ক্ষমতা প্রতিপত্তি যার এতটাই যে নাম শুনলেই বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। তার এক হাঁকে হাজির হয়ে যায় কয়েকহাজার লোক। যারা বিনা বাক্যব্যায়ে, না জেনে না বুঝে মাইলের পর মাইল মিছিলে হাঁটে। জনসভায় গাদাগাদি ভিড় করে। বিক্ষোভে সামিল হয়। প্ররোচনায় মারমুখী হয়ে ওঠে। নির্বিচারে ভাঙচুর করে। প্রতিবাদের নামে পথ অবরোধ করে। 'বনধ' এর ডাক শুনে জনগণের হয়ে বারো-চব্বিশ-আটচল্লিশ যত ঘণ্টা চাইবে জনজীবন শ্মশানের মত স্তব্ধ-নি:শব্দ করে দেবে। যে নেতার এত দাপট, এত প্রতাপ তার ক্ষমতার হাত যে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে তা' বলে বোঝাবার আর কী কোনো অবকাশ রাখে? প্রহ্লাদ সাহা তাই পার্টির সম্পদ। পার্টি তাকে তোবাতোবা করে মাথায় করে রাখে। মারদাঙ্গা-বোমাবাজি-ভীতিপ্রদর্শন যাই করুক না কেন --- সাতখুন মাপ। পুলিশ তাকে সমঝে চলে। প্রশাসন নিরব দর্শক। সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত। প্রহ্লাদ সাহা তাই বল্গাহীন। বেপরোয়া। অপ্রতিরোধ্য। নেতাগিরির পাশাপাশি দালালি, প্রমোটারি, তোলাবাজি থেকে শুরু করে বোলবোলা চোলাইয়ের কারবার কী নেই তার! নয়া-বস্তির প্রতিও সে এতটুকুও অনুদার ছিলনা। খুলে দিয়েছিল রমরমা চুল্লুর ঠেক যা দিনেদিনে হয়ে উঠেছিল এলাকার সবরকম অসামাজিক কাজকর্মের আঁতুড়ঘর। মারামারি, গোলমাল ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নিরাপদ ছিলনা মেয়ে-বউদের সন্মান। ভয়ে সব কিছু দেখেও মুখবুজে থাকত সবাই। তবুও তো কারো কারো সহ্যের শেষ একটা সীমা থাকে!  যেমন বিশুর মত ছেলেদের যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসটুকু রাখে। পুলিশি সাহায্য চেয়ে খুব স্বাভাবিক কারণেই হতাশ হয়ে একদিন তারই মত কয়েকজনকে জুটিয়ে নিয়ে চড়াও হয়েছিল প্রহ্লাদ সাহার চোলাইয়ের ঠেকে। পরিণতি আশঙ্কা করে আঁতকে উঠেছিল সবাই। আর এভাবেই তাদের আশঙ্কা সত্যি হতেও সময় লাগে নি। না, এখানেই শেষ নয়।

মা ভিন্ন বিশুর এই দুনিয়ায় আর কেউ ছিলনা। তাই ছেলের সৎকার মাকেই করতে হয়েছিল। 
ছেলেকে দাহ করে ঘরে ফিরেছিলেন রেণুবালা। কিন্তু কোথায় তখন তার ঘর? দাউদাউ জ্বলছে! গনগনে সেই আগুনের লেলিহান শিখা সীমাহীন ঔদ্ধত্যে আকাশ ছুঁতে চাইছে। চোখের সামনে তিলতিল করে গড়া ঘর-সংসার জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তবুও অদ্ভুতভাবে নির্বিকার ছিলেন রেণুবালা। শুধুই চেয়ে রইলেন নির্বাক-সম্মোহিতের মত। এক লহমায় যেন সবকিছু শেষ হয়েগেল। একটু আগে নিষ্প্রাণ বিশু জ্বলে ছাই হয়েগেছে। এখন তার ঘর জ্বলছে! ভয়ে ঘরের কোণে সিঁটিয়ে আছে গোটা নয়াবস্তি। হয়ত ওদের নজরেও আসেনি --- বেবাক বস্তির আকাশ ছেয়ে ফেলেছে থিকথিকে কালো ধোঁয়া! ওদের মনে আছে তো --- বিশু আর নেই! আর দাঁড়ান নি রেণুবালা। চোখমুছে চিরকালের মত চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন। যাবার কোনো ঠিকানা ছিলনা, তবু থেমে থাকেন নি।



ছেলেটার জামার কলার ধরে টেনে তুলে রেণুবালার পায়ের কাছে ধাক্কা মেরে ফেলল লোকটা।
"এই শালাই আপনার হার ছিনতাই করেছে। তাকিয়ে দেখুন একবার..."
মাটিতে মুখগুজে, হাত-পা দুমড়ে, দলা পাকিয়ে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল রক্তাপ্লুত ছেলেটা। বেশ খানিকক্ষণ। তারপর অনেক কষ্টে মাথাটা তুলতে পারল কিছুটা। দুটো চোখ কী ভীষণ ফুলে গেছে! টকটক করছে লাল। কথা বলারও ক্ষমতা ছিলনা। শুধুই সকরুণ আর্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রেণুবালার দিকে।

লোকটা আবার পাশবিক ক্রোধে মারমুখী হয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। 
গর্জে উঠলেন রেণুবালা,"খবরদার, ওর গায়ে একদম হাত দেবে না। তোমরা মানুষ! এতগুলো লোক মিলে একজনকে মারছ?"

লোকটা স্তম্ভিত। বিমূঢ়। এতটাই যে স্তব্ধবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল রেণুবালার দিকে। রেণুবালার চোখে তখন এমন কিছু ছিল যাতে লোকটার হিংস্র ক্রোধ পোষা বাঘের মত সুড়সুড় করে খাঁচায় ঢুকে গিয়েছিল। অনেকটা সময় নিয়ে মিনমিনে গলায় কোনক্রমে বলতে পেরেছিল, "আমি নিজে চোখে দেখেছি ও-ই আপনার হার ঝেড়ে দিয়েছে....."

"কোথায় সেই হার?" শান দেওয়া তলোয়ারের মত ঝনঝন করে বেজে উঠল প্রশ্নটা।

লোকটা থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, " মানে...পাওয়া যায় নি। সরিয়ে দিয়েছে আর কী! ওর দলে আরো লোক ছিল......"

"তার মানে নিছক সন্দেহের বশে..."

"বিশ্বাস করুন, আমি নিজে চোখে দেখেছি।"

রেণুবালা বেশ খানিকক্ষণ লোকটার  দিকে চেয়ে থেকে মাথা ঝাঁকালেন।

"ওই চোখেতো অনেক ভাল কিছুও দেখ, তখন কী কর? তখন তো ভাল কিছু করার ইচ্ছা জাগে না! যেই কারো কোনো মন্দ দেখলে অমনি মাথার পোকা ক্ষেপে উঠল --- আরো কত মন্দ করে তার জবাব দেবে, তাই না? একা না পারলে অন্যদের তাতাবে।"

থামলেন না রেণুবালা। এবার আঙুল তুলে চারপাশের মানুষগুলোকে ইঙ্গিত করে বললেন,"তুমি যে ওদের তাতিয়েছ, চেন ওদের? ওদের নিজেদের কোনো চোখকান নেই। অন্যের চোখে দেখে, অন্যের কানে শোনে। ওদের যদি কেউ বলে কাকে কান নিয়ে যাচ্ছে, ওরা নিজেদের কানে হাত দিয়েও দেখবে না, কাকের পিছন-পিছন দৌড়াবে। যেখানে দেখবে নিজেদের গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগবে না সেখানে গিয়ে বীরত্ব দেখাবে আর যেখানে বীরত্ব দেখানোর প্রয়োজন সেখানে লেজ গুটিয়ে পালাবে। তোমাদের বিবেকে বাঁধল না --- তোমরা এতগুলো লোক একজোট হয়ে অতটুকু একটা ছেলেকে এভাবে মারতে মারতে মেরে ফেলতে বসেছ। ও যদি কোন অপরাধ করেই থাকে তার জন্য থানা পুলিশ আইন আছে, তোমরা বিচার করার কে?"

এবার লোকটা রেণুবালার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল, " মাসীমা হারটা কিন্তু আপনারই ছিনতাই হয়েছে।"  

রেণুবালা বলল,"সে কী আমি এত অল্পসময়ের মধ্যেই ভুলে যাব? আমার হার গেছে কষ্ট হলেও সয়ে নিতে পারব কিন্তু সারা জীবনধরেও সইতে পারব না যদি ওই হারের জন্য একটা আস্ত জীবন চলে যায়।"

সংখ্যায় অল্প হলেও এবার এগিয়ে এল তারা,যারা এই ভিড়ের মধ্যেই মিশেছিল কিন্তু যা ঘটছিল তাকে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসও নেই।

"ঠিক বলেছেন আপনি। এদের পুলিশেই দেওয়া উচিত। এরা মানুষ! মানুষের রক্ত গায়ে থাকলে কেউ কাউকে এভাবে মারতে পারে?"

রেণুবালা কটমটকরে তাকালেন ওদের দিকে।

"তোমরাও তো ছিলে বাপু। ভেবে যখন কিছু করতে পারবে না তখন দেখে শুধুশুধু ভাবা কেন? না ভেবে ঠিক কাজটা যদি করতে তাহলে তো এ বেচারির এমনদশা হত না।"

এমন চিরতাগোলা স্পষ্ট কথাগুলো যেমন সোনামুখ করে মেনে নেওয়াও বেজায় কষ্টকর তেমনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে মুখ খোলাও চরম নির্বুদ্ধিতা। তাই তারা মানেমানে কেটে পড়াই শ্রেয় বোধ করল। সরে পড়েছিল সেই লোকটাও। সঙ্গে তারসাথে যোগ দেওয়া বীরপুঙ্গবদেরদলও। ভিড়টা বুদবুদের মত মিলিয়ে গেল। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। শুনশান অকুস্থল। এখন শুধু অভিযুক্ত ছিনতাইকারী আর যার হার ছিনতাই করার অপরাধে অভিযুক্ত সে -- সেই রেণুবালা।

ছেলেটা আগেরমতই মাটিতে মাথাগুঁজে, চার হাতপা এক করে কুঁকড়ে সিঁটিয়েছিল। রেণুবালা এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় আলতো হাত রাখল।
"এই ছেলে উঠতে পারবে?"

ছেলেটা অনেক কষ্টে কোনক্রমে মাথাটা তুলতে পারল। তারপর কঁকিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। চোখদুটো অস্বাভাবিক ফুলে গিয়েছিল, এতটাই যে খুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না। গোটামুখে, কপালে আঘাতের দগদগে চিহ্ন। কোথাও রক্ত ঝরছিল, কোথাও জমাট বেঁধে কালো হয়েছিল। 

রেণুবালা তার দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু ওই দুটো হাতকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু পর্যন্ত আর অবশিষ্ট ছিল না ছেলেটির। এইবয়সে রেণুবালারও ক্ষমতা ছিল না ওই জোয়ান ছেলেটাকে টেনে তোলার। ওদের অসহায়তা বেশ কয়েকজোড়া চোখে ধরা পড়েছিল। তাদের কয়েকজন স্বত:প্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে সাহায্য করল ওদের।

হাঁটার ক্ষমতা ছিল না ছেলেটার। সবাইমিলে কোনরকমে ধরেধরে নিয়ে গিয়ে সামনের একটা চায়েরদোকানের বেঞ্চে বসিয়ে দিল তাকে।

"একটু জল পাওয়া যাবে?"

দোকানি ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে। রেণুবালার জবাবে ছোট্ট করে বলল,"ওই ধারে জগ আছে।"

আবার প্রশ্ন রাখলেন রেণুবালা,"গরম দুধ হবে?"

--- হবে। 

--- একগ্লাস দিতে পার। 

--- বসুন দিচ্ছি। 

ছেলেটা কাত হয়ে একপাশে নেতিয়েছিল। চোখ বন্ধ। মাঝেমাঝে যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছিল মুখখানা।

রেণুবালা তার গায়ে হাত রেখে বললেন,"এই ছেলে একটু সোজা হয়ে বস দেখি। চোখেমুখে একটু জল দিয়ে দিই।

"আ!" ছেলেটা একটু চেষ্টা করেই কাতরে উঠল।

রেণুবালা তাকে ধরেধরে শুইয়ে দিলেন। ক্ষতস্থানগুলো ধুইয়ে দিলেন। চোখেমুখে ভালো করে জলের ছিটে দিয়ে বললেন,"একটু ভাল লাগছে বাবা? দুধটুকু খেতে পারবে?"

সামান্য চোখখুলে একটু তাকালো ছেলেটি। তারপর আপনাথেকেই যেন আবার বুজে গেল। রেণুবালা বুঝতে পারলেন ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। বললেন,"থাক বাবা, তুমি শুয়ে থাক। দুধটা না হয় একটু পরেই খেও।"

দোকানি এতক্ষণ হাতেরকাজটা সারার পাশাপাশি এদিকটাও লক্ষ্য রেখেছিল। এবার মুখ খুলল,"ও মাসীমা অত সেবাযত্ন ওকে করতে হবে না। ও শালা পকেটমারের জাত! এরকম ঘাপান খাওয়ার অভ্যাস ওর অনেক আছে। ও সব ঠিক হয়ে যাবে। একটুপরেই দেখবেন দিব্যি হেঁটে চলে যাচ্ছে। আপনি বাড়ি চলে যান।"

কথাগুলো খুব নিষ্ঠুরের মত কানে বাজলেও রেণুবালা শুনেগেলেন। পকেটমার হোক, ছিনতাইবাজ হোক রক্তমাংসের মানুষ বইতো নয়।  ওর কী যন্ত্রণা-কষ্ট থাকতে পারেনা। তার চেয়েও বড় কথা সবারবেলায় এক বিচার কই? দোকানির দিকে গনগনে চোখে খানিক চেয়ে থাকার পর তার মনে হয় যেন চিৎকার করে জানতে চায় --- স্বাধীনতাদিবসে নয়াবস্তিতে যখন পতাকা তোলে প্রহ্লাদ সাহা কিংবা মহান সমাজসেবী হিসেবে যখন তাকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন তো টুশব্দ করার সাহস দেখি না কারো, কোথায় থাকে তখন এদের মত মানুষগুলো? দোকানির কথার কোনো উত্তর না করে বেঞ্চের একপাশে ঠায় বসে রইলেন রেণুবালা।

এবার দোকানি তার ভিতরের সবটুকু বিরক্তি গলার স্বরে ঝরিয়ে বলল,"মাসীমা বেঞ্চটা ছাড়তে হবে, এবার আসুন।"

রেণুবালা উঠে দাঁড়ালেন।
"এই ছেলে উঠতে পারবে?"

কোনো হুঁশ নেই। চোখ খুলে এতটুকু তাকাল না পর্যন্ত। রেণুবালা তার কপালে হাত রাখলেন। কী তাপ! প্রমাদ গুণলেন। কী করবেন এবার ছেলেটাকে নিয়ে? আর যে-ই পারুক রেণুবালা কিছুতেই ছেলেটাকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে পারবেন না। কিছুতেই না। ও যদি কোনো ছিনতাইবাজ না হয়ে তার বিশু হত, পারতেন তিনি? না না, তিনি পারবেন না।

দোকানিকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,"ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে এখুনি ফিরে আসছি।"

দোকানি বিস্ময়ে এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল যে রেণুবালা অনেকদূর চলে যাওয়ার পরেও হাঁ করে তারদিকে চেয়ে রইল।

সারারাত জ্বরে বেহুঁশ হয়ে রইল ছেলেটা। ঠায় জেগে বসে রইলেন রেণুবালা। সমানে কপালে জলপট্টি দিয়ে যাওয়া। থার্মোমিটারে বারবার জ্বর দেখা। ওষুধ খাওয়ানো। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। শুশ্রূষার এতটুকু ত্রুটি নেই কোথাও। এই অজ্ঞতকুলশীল ছেলেটা কতকালের কত আপন যেন তার! আসলে ছেলেটার মুখে বারবার বিশুর মুখচ্ছবি ভেসে উঠছিল রেণুবালার চোখে। চোখদুটো জলে ভরে উঠছিল তার। বুকের ভিতরটাও চাপা দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় টানটান অস্থির। বিশু জ্বরে অচেতন হলে ঠিক যেমনটি হত তার।

অবশেষে ভোররাতে গিয়ে একটু স্বস্তি মেলে গোটারাত ধরে চলা একটানা উদ্বেগের। ছেলেটার জ্বর অনেকটাই কমে। চোখও মেলে। তবুও যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। বিকেলের দিকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল। উঠে বসল। কাছেই ছিল রেণুবালা। তিনি পরম স্নেহে একটি হাত তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,"আর জ্বর নেই তো?"

একটা নরম স্পর্শ আলতো ছুঁয়ে যায় ছেলেটির ললাটে। সমস্ত শরীর তার অদ্ভুত এক অনুভবে থরথর করে কেঁপে ওঠে। আজকের এই চকিত অনুভব তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অন্যরকম --- যার স্বাদ আগে সে কোনদিন পায় নি।

"না গা ঠান্ডা। আর কোনো ভয় নেই। গরম দুধ আর মুড়ি নিয়ে আসছি। এখন কিছু খেতে হবে। কাল থেকে তো কিছুই খাওয়া হয় নি।"
উঠে দাঁড়ালেন রেণুবালা।   

অনেক চেষ্টা করেও দমন করতে পারল না ছেলেটি --- হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। লোকচক্ষুর অন্তরালে নিশ্চুপে, চরম অবহেলায় নিকৃষ্ট কীটের মত বেঁচে এসেছে এতকাল। জন্মমুহূর্তেই তার পরিচয়ে তপ্ত লৌহশলাকায় খোদাই হয়ে গিয়েছিল একটি দুরপনেয় শব্দ --- বেজন্মা! এই পরিচয়ের বিষজ্বালার তিলার্ধমাত্রও ভাগ নেয় নি কেউ কোনোদিন। না তার গর্ভধারিনীও নয়। তাকে ফেলে একরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে কোন এক নাগরের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে হাতধুয়ে ফেলেছিল অবলীলায়। আর সেই রাত থেকে থকথকে পাঁকে ব্যাঙাচির মত কিলবিল করতে করতে শুরু হয়েছিল এক 'বেজন্মা' শিশুর বেঁচেথাকার প্রাণান্তকর লড়াই। মাথার উপর খোলা আকাশ। ফুটপাতের এককোণে কুকুরের সাথে ভাগাভাগিকরে থাকা। ভাল করে খুঁটে খেতে শেখার আগেই হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিল --- খিদে কাকে বলে! অত্যুগ্র খিদে! অতটুকু সে, তবুও এতবড় জগৎ-সংসারে তার খিদের দায় ভয়ঙ্কর নিষ্করুণভাবে যেন শুধুই তার। কী নির্মম তার পারিপার্শ্বিকতা! হাত পেতে খাবার চাইলে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেবে। কেড়ে খেলে মেরে হাত ভেঙে দেবে। চোখের জলে বুক ভাসালেও বুঝতে চাইবে না ওদের পেটের জ্বালাটা। পশুপ্রেমীর দল বিস্কুট ছুঁড়ে ছুঁড়ে যত্ন করে কুকুরকে খাওয়াতো। খিদের তাড়নায় যদি সে একটা কুড়িয়ে নেবার জন্য হাত বাড়াত, যতনা ঘেউ ঘেউ করে কুকুরগুলো তেড়ে আসত তার চেয়ে অনেকবেশি খেঁকিয়ে উঠত পশুপ্রেমীর দল। ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়ে, পেট ভর্তি খিদে নিয়ে জুলজুল করে কুকুরগুলোর খাওয়া দেখত। তার হাতে কেউ কোনদিন একটুকরো খাবার তুলে দেয় নি। একটুও আদর করে নি। দুটো মিষ্টি  কথা বলে কাছে ডাকে নি। জ্বরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকলেও কপালে হাত ছুঁয়ে কেউ কখনো তাপ দেখার প্রয়োজনবোধ করে নি। তবু ছেলেটি কোনদিন এতটুকুও কষ্ট পায় নি। দু:খ পায়নি। এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে নি। দু:খ-কষ্ট-আবেগ-যন্ত্রণা কিংবা স্নেহ ভালোবাসা মায়া মমতা --- এগুলো যে কী বস্তু কোনোদিনই তার জানার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। মার খেতেখেতে অসহ্য তাড়সে ভিন্ন আর কোনো কারণে যে কাঁদা যায় --- সে আজ পর্যন্ত কোনোদিন ভাবতেই পারে নি। আজই প্রথম জানল। কেউ যেন হাত ধরে নিয়ে গিয়ে আকস্মিকভাবেই তাকে এই প্রথম  চিনিয়ে দিল তার ভিতরের সম্পূর্ণ অচেনা, অদেখা আরো একটা জগৎকে। অলৌকিক আলোয় উদ্ভাসিত এমন একটা জগৎ --- সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ যে তার নিজেরই, শুধুই তার নিজের --- কথাটা ভাবতেই বিস্ময়ে, আনন্দে, উচ্ছ্বাসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। না না, এই জগৎটাকে আর সে কোনো নারকীয় অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেবে না। সব জড়তা, সব অবসন্নতা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে উঠে বসল। তারপর এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে যেন হওয়ায় মিলিয়ে গেল।

দুধের গ্লাস আর মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল রেণুবালা। 

"এটুকু খেয়ে নে বাবা...."

তার দুটো চোখ থমকে গেল বিছানায়। খাঁ খাঁ। শুনশান। বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কোথায় গেল ছেলেটা? বাটি- গ্লাসটা কোনরকমে রেখে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ঘরের চতুর্দিকে, এখানে-ওখানে পাগলের মত খুঁজে ফিরলেন। কিন্তু কোথায় কে?

হতাশ, বিমর্ষ রেণুবালা আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। বিছানার একপাশে ঝপাৎ করে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে স্থানুর মত নির্বাক বসে রইলেন। অনেকক্ষণ-অনেকক্ষণ ঐভাবে বসে থাকার পর বিড়বিড় করে বলে উঠেছিলেন,"কিছু না বলেই চলে গেলি বাপ....একটু সুস্থ হয়ে না হয়....আর কি কখনো ফিরবি না বাপ...."

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। রাতও গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। রেণুবালা ঠায় বসেই রইলেন। মুখে একটা দানাও কাটলেন না। দুচোখের পাতাও এক করলেন না। 

রাত তখন নিশুতি। হঠাৎ ভেজান দরজাটায় মৃদু টোকা মারার শব্দ। একবার...দুবার...। রেণুবালা উঠতে যাবেন আর ঠিক তখনই দরজাটা খুলে গেল।

যেন বিশ্বাস হয় না রেণুবালার! বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লেগেছিল তার। তারপর উচ্ছ্বসিত গলায় বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিলেন ---
"আমি জানতাম... আমি জানতাম, তুই আবার ফিরে আসবি..."

ছেলেটা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তা' দেখে রেণুবালা বলে উঠলেন,"দাঁড়িয়ে রইলি কেন, ভিতরে আয়।"

ছেলেটা ঘরে ঢুকেও সঙ্কুচিত হয়ে রইল। কেমন যেন সন্ত্রস্ত ভাব। দুচোখেও ভয় মিশে ছিল। অবাক হলেন রেণুবালা। গলায় উদ্বেগ ঝরিয়ে বললেন --
"কী হয়েছে বাপ? কোথায় গিয়েছিলি?"

ছেলেটা যন্ত্রচালিতের মত তার ডানহাতটা এগিয়ে দিল। আলগা করল তার হাতের মুঠো। রেণুবালার চক্ষু চড়কগাছ! এ যে তার সেই হারছড়াটা! 

"তার মানে কাজটা তোরই।"

ছেলেটা মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

রেণুবালা হতাশ সুরে বললেন,"আমার মনে হয়েছিল কাজটা তুই করিস নি..."

রেণুবালার কথা শেষ হল না। ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে রেণুবালার দুটো পা জড়িয়ে ধরে বলল,"তুমি আমাকে যা খুশি শাস্তি দাও, পুলিশে দাও, শুধু আমার একটা কথা বিশ্বাস কর -- এমন কাজ এজন্মে আমি আর কোনদিন করব না। এই তোমার পা ছুঁয়ে বলছি..."

"আমার পা ছুঁয়ে বললেই বা কী? আমি তোর কে?"

ছেলেটা মুখ তুলে রেণুবালার চোখে তাকাল। দুগাল বেয়ে তার অশ্রুধারা গড়িয়ে নামছিল।

"তুমি আমার মা।"

শোনামাত্রই গোটা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল রেণুবালার। মা! মা! কতদিন ওই নামে তাকে কেউ ডাকে নি। তীব্র আকুতিভরা দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলেটার দিকে। দুচোখ জলে ভরে উঠল।

"তুমি আমাকে তাড়িয়ে দেবে না তো?" কাঁদতে-কাঁদতে করুণ স্বরে বলে উঠল ছেলেটা।

উদ্গত অশ্রুকে অনেক কষ্টে সংবরণ করে কেবল মাথাটা নাড়ালেন মাত্র।

ছেলেটার কণ্ঠে নৈরাশ্যের সুর ঝরে পড়ল,"আমাকে বিশ্বাস করছ না, না?"

রেণুবালা স্নিগ্ধ হাসলেন। 

"তুই হারটা ফিরিয়ে এনেছিস, এরপরেও তোকে বিশ্বাস না করে থাকা যায়!"

তাকে বিশ্বাস করেছে! তাকে!! যে কিনা একটা বিশ্রী জানোয়ার -- একটা পকেটমার, ছিনতাইবাজ, বেজন্মা -- তাকে বিশ্বাস করেছে! নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না ছেলেটা। এই মানুষটা তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে। কপালে স্নেহের হাত বুলিয়েছে। ভালবেসে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে। নিখাদ মমতায় সারারাত জেগে সেবা করেছে। তার জন্য চোখের জল ফেলেছে। এখন আবার তাকে বিশ্বাসও করছে! এই নিষ্ঠুর, কঠিন দুনিয়ায় কোন মানুষ শুধু হাতে, নি:স্বার্থে আরেকজনকে এত মহার্ঘ কিছু দিতে পারে? পকেট মেরে টাকা ভর্তি ব্যাগ পেলে কিংবা ছিনতাই করে ভারী একটা গয়না পেলে ভাবত -- উ: কী না পেয়েছি! এর থেকে দামী কিছু পাওয়া বুঝি এই পৃথিবীতে আর কিছু হয় না! সে কতই না বোকা ছিল!! আজকের সত্যিকারের দামী জিনিসটা পাওয়ার বাঁধভাঙা আনন্দের উদ্বেলিত আবেগকে ধরে রাখতে পারল না সে। জলোচ্ছ্বাসের মতই যেন আছড়ে পড়ল। মাথাটা রেণুবালার পায়ে গুঁজে দিয়ে অঝোরে কাঁদতে-কাঁদতে বলল,"তুমি আমার মা -- তুমিই আমার মা। তোমার পায়ের কাছে আমাকে একটু জায়গা দিও...."

রেণুবালা তাকে দুহাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তার শূন্য বুকটা যেন কানায় কানায় ভরে উঠল। মুহূর্তের জন্য যেন তিনি সবকিছু বিস্মৃত হয়ে গেলেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, আমি তোরই মা --- তোরই মা। কেন তোকে থাকতে দেব না? কেন তোকে তাড়িয়ে দেব? বাবা আমার, এসব তুই কী বলছিস বিশু?"

বিশু!! নামটা কানে যেতেই ছেলেটা বুঝতে পারল মানুষটা কোথাও একটা ভুল করছে। মানুষটা বোধহয়   নিজের মধ্যেই নেই। কিন্তু কে বিশু? ছেলে? মানুষটা কি তাকে তার ছেলে ভেবে বসেছে? দারুণ একটা ভাললাগায় মনটা ভরে উঠল। কিন্তু সে আজ বদলে গেছে। কাউকে কোনভাবে আর ঠকাবে না।

"আমি তোমার বিশু নই। আমার দিকে তাকিয়ে দেখো।"

"হ্যাঁ রে বাবা তুই আমার বিশু। বিশুই। আমার ছেলে।"

ছেলেটা রেণুবালার বুকের ভিতর থেকেই নিজের মুখটা রেণুবালার চোখের সামনে তুলে ধরে আবারো বলল,"এই দেখ, চেয়ে দেখ..দেখ, আমি বিশু নই! আমি ভেকু। একটা ছিনতাইবাজ! পকেটমার! বেজন্মা! আমাকে এতটুকু রেখে পালিয়ে গিয়েছিল আমার মা...."

রেণুবালা আরো শক্ত করে তাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললেন,"কে বলল তোকে এসব? তুই ঈশ্বরের সন্তান রে ---- ঈশ্বরের সন্তান।" 

উছলে পড়া কান্নাকে সামাল দিতেই খানিক থামলেন। তারপর আবার বলে চললেন,"ছেলেটা আমার কোনদিন অন্যায় করেনি, কারো মন্দ করে নি, প্রাণ দিয়ে সবাইকে ভালবেসে ছিল। তবুও একদল শয়তান নিষ্ঠুরভাবে ওর প্রাণটা কেড়ে নিয়েছিল আমার বুক শূন্য করে। মানুষের বিচার অন্ধ হলেও ঈশ্বর কোনদিন কারো প্রতি অবিচার করেন না। তাই তো আমার শূন্য বুকে ভরিয়ে দিলেন আরেক সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়ে। তুই আমার ছেলে রে --- আমার ছেলে। আমার কাছেই থাকবি --- আমার কাছেই।"

পরিচয়ের অভিশাপমুক্তি, মাকে পাওয়া, নতুন জীবন --- ছেলেটা  বল্গাহীন খুশিতে যেন জ্ঞানহারা‌ হয়ে গেল। দুহাত তুলে উপরওয়ালাকে কৃতজ্ঞতা জানাল। শিশুর মত নানা অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল। কখনো কাঁদতে লাগল, কখনো হাসতে লাগল। আনন্দে যে কী করবে ছেলেটা যেন কিছুই ভেবে উঠতে পারল না।

রেণুবালা তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললেন,"অনেক হয়েছে বাবা, আর একটুও নয়। অসুস্থ শরীরটার উপর দিয়ে আজ অনেক ধকল গেছে। এবার শুয়ে পড়।"

সারা শরীর জুড়ে ভাললাগার কী অদ্ভুত স্নিগ্ধ আবেশ! মন চায় না ঘুমিয়ে গিয়ে তাকে হারিয়ে ফেলতে।   কিন্তু দুর্বল শরীরটা আর নিতে পারে না। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল। রেণুবালা তারপরেও সমানে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চললেন। চোখদুটো যখন তারও বুঝে আসতে চাইল তখন বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। রেণুবালা নড়েচড়ে টানটান হয়ে বসলেন। ঘুমলে আর চলবে না। সামনে অনেক বড় দায়িত্ব। আরো একটা বিশুকে গড়ে তুলতে হবে।। 

                               --- --- --- ---

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় 
 হৃদয়পুর, উত্তর ২৪ পরগণা


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩