নাহ্ , কিছুই হলো না।
চিরন্তন পাণ্ডুলিপিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বিছানার পাশে রাখা ফ্যাকাশে পলিথিন ব্যাগের মধ্যে চালান করে দিল। চোখ বন্ধ করে কপালের রগ দুটো চেপে ধরে বিছানায় বসে রইলো কিছুক্ষন। শুধুই বসে রইলো। কিছুই ভাবলো না।
বলা ভালো ভাবতে পারল না।
প্রায় মাসখানেক ধরেই চিরন্তন গল্পটা লেখার চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু পারছেনা। যেটা সে চাইছে সেটা হচ্ছে না কিছুতেই। অন্তত এমন লেখা হচ্ছেনা যাকে সে নিজেও গল্প বলে মনে করতে পারে। যেভাবেই লিখতে চায়, কবিতার ভাষা, কবিতার ধাঁচ চলে আসে, এবং শেষে একটা জগাখিচুড়ি হয়ে যায়। কিছুতেই গল্প হয়ে ওঠে না।
এমন নয় যে এ গল্পের বিষয়বস্তু তার অজানা। এমন নয় যে সে এর আগে কখনো গদ্য লেখেনি। তবু গল্প লেখার এই অসহ্য তাড়নার সময় সে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
হতাশায় চিরন্তন দুটো হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুড়ে দিলো। তার চোখে জল।
না সেই কান্নার ধারা এমন নয় যে তারা বিছানা ভেজাতে পারে, এমনও নয় যে তার মলিন পাঞ্জাবীটা কে আরো মলিন করে দিতে পারে। তবু সে কাঁদে। দু-এক ফোঁটা জল তার চিবুক পর্যন্ত এসে থেমে যায়। শব্দহীন অশ্রুপাত লাজুক মেয়ের মত কোথায় গুটিয়ে যায় চিরন্তন বোঝে না। বোঝার চেষ্টাও করে না।
চিরন্তন কি লোভী হয়ে গেছে? অথবা অহংকারী? না, হলে তার এত আপ্রাণ চেষ্টার সবটাই বিফল হচ্ছে কেন? সে তো শুধু কবিতাই লিখত। এখনো লেখে। খুব বড় পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত না হলেও, অনেক স্থানীয় এবং আধা শহুরে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই সব পত্রিকার পাঠকদের কাছে সে একজন কবি। তবে এখন চিরন্তন কবিতা থেকে সরে এসেছে। কবিতাকে সে তাড়াতে চাইছে, তার ভিতর এবং বাইরে থেকে। কিন্তু গল্পটাও লিখতে পারছে না।
এই গল্পটা তাকে লিখতেই হবে। চিরন্তন শরীরটাকে চৌকির শক্ত বিছানার উপরে এলিয়ে দেয়। বিগত প্রায় দশ বছর ধরে এই দশ বাই আটের ঘরটা তার ঠিকানা। বাবা মারা যাওয়ার পর দেনার দায়ে একতলা বাড়িটা বিক্রি করে সে যখন মাকে নিয়ে এই ভাড়া বাড়িতে এই ঘরটায় ওঠে তখন তার বয়স চব্বিশ ছাড়িয়েছে। কলা বিভাগে স্নাতক হবার পরও কোনো চাকরি জোটাতে পারেনি। যেটুকু টাকাপয়সা ছিল, তাতে বছর দুয়েক চলার পর হাত ফাঁকা। ততদিনে দু একটা টিউশনি করতে শুরু করেছিল চিরন্তন।
রমাকে পড়াতে যেত চিরন্তন। এই টিউশনটা তাকে দেখে দিয়েছিল মিনতি, রমার খুড়তুতো দিদি। মা'র কাছে আসতো, সোয়েটার বোনা শিখতে।
চিরন্তন তখন পঁচিশ আর রমা বারো ক্লাস।
রমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিরন্তন সমস্ত জীবন ভুলে যেত। কখন যেন চিরন্তনের কবিতার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠল রমা।
রমা বুঝতে পেরেছিল। ধরাও দিয়েছিল কবিতায়, মনে, শরীরে। বনেদিয়ানা এবং অর্থ-সম্পদে এলাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েটা তাকে পড়ার ঘরে পড়ার ছুতোয় অনেক দুপুরে উজাড় করে দিয়েছিল সব। রমার শরীরের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই চিরন্তন জয় করে নিয়েছিল। বইয়ের ফাঁকে রমার চিঠিগুলি তখন চিরন্তনের কবিতার খনি। এখনো।
রমাকে সে কবিতায় এঁকেছিল অসংখ্যবার। তবু তার জীবনে রমা এখনো দুর্বোধ্য কবিতা। কিছুতেই বুঝতে পারেনা চিরন্তন সেই কবিতার ভাষা।
রমা কবিতায় ধরা দিয়েছিল। শরীরেও। কিন্তু তার দশ বাই আটের ভাড়ার খুপরিতে ধরা দেয়নি। দিতে পারত না। যে মেয়ের বাবা তাকে সাতশ টাকা দিয়ে গৃহশিক্ষক করে রেখেছিল, সে কি করে সর্বসাকুল্যে আড়াই তিন হাজার উপার্জনের টিউশন মাস্টারের ঘরে জীবনটা জলাঞ্জলি দেয়?
রমাও দেয়নি।
রমা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বেশিদিন একলা ছিলনা। মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিল। পরিবারের প্রথা মেনে আঠারোতেই গৃহিণী। ইঞ্জিনিয়ার বরের সঙ্গে উড়ে গেছিল থাইল্যান্ড। নতুন বাসায়। নতুন গল্পের নায়িকা হতে।
শরীরে মনে অসংখ্য ক্ষত নিয়ে চিরন্তন তখন সর্বহারা। এমনকি তার চোখে জলও ছিলনা। তার সব কান্না, কষ্ট, পুঁজ হয়ে জমে ছিল মনে। কষ্টটা সময়ের মলমের যখন একটু ফিকে হয়ে এলো, চিরন্তন নিজের জন্য একটা সান্ত্বনা খুঁজে নিল। সে নিজেকে তখন বুঝিয়েছিল, রমা যা করেছে, ঠিক করেছে। নিজেও বেঁচেছে তাকেও বাঁচিয়েছে।
রমাকে ভোলেনি চিরন্তন, ভুলতে পারেনা কিছুতেই। কবিতা তাকে ভুলতে দেয়নি। রমা তার কবিতাতে রয়ে গেছে, যেমনটা ছিল তাকে ছেড়ে যাবার সময়। তার কবিতায় এখনো প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় রমার ছোঁয়ায়। প্রচন্ড তৃষ্ণা নিয়ে যখন সে কয়েকটা লাইন লেখে, তখন তার চোখে রমার শেষ দিনের সেই চুম্বন দৃশ্য ফুটে ওঠে ।
এইসবই চিরন্তনের একমাস আগের অতীত। এখনকার চিরন্তনের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। গত ত্রিশটা দিনে একটাও কবিতা লেখেনি, এমনকি একটা লাইনও না। তবু যতবারই সে গল্পটা লিখতে গেছে ততোবারই সেই গদ্য কবিতা হয়ে গেছে। রাতের পর রাত কেটে গেছে একটা পাতাও সে ভরাতে পারেনি একটা পাতা কখনো যদি বা লিখেছে, তার নিজের কাছেই সেটা এমন অপাঠ্য মনে হয়েছে যে, সে ছিঁড়ে ফেলেছে নতুবা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিয়েছে জানালা দিয়ে রাস্তার উপরে। আজও যখন চিরন্তন পাণ্ডুলিপিটা ছিঁড়ে ফেলল, তখন সবে ভোরের আজান শুরু হয়েছে। তারপর সকাল এগোতে থাকলো, কিন্তু চিরন্তন বিছানায় পড়ে থাকলো। দু'বছর হলো তার মা মারা গেছে। না কোনো অসুস্থতায় নয়, বাড়ির সামনে গাড়ির ধাক্কায়। খাবার জল আনতে রাস্তার কলে গেছিলেন সন্ধ্যেবেলা।
মা নেই, কেউ নেই। একা চিরন্তন ঘরকুনো বাউন্ডুলে। সারারাত ঘুম নেই, খাওয়া নেই, কেউ কিছু বলবার নেই। চিরন্তন এখন এভাবেই খুশি থাকে। এভাবেই এখন ভালো থাকে সে। গত এক মাসে তার চেহারা অনেকটাই খারাপ হয়েছে। টিউশনেও ডেট মিস করেছে। তবু এভাবেই যেন একটা যন্ত্রণার আনন্দ তাকে পেয়ে বসেছে। সে মাঝে মাঝে নিজেও বুঝতে পারে না, এটা তার কেমন সুখ ?
খিদে ক্লান্তি হতাশায় ঘুমিয়ে পড়েছিল চিরন্তন। হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। মাথায় বেশ যন্ত্রণা নিয়ে উঠে দেখল, রাত্রে দরজাটার ছিটকানি দেয়া হয়নি। দরজা হাট করে খোলা। টেবিলে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে এখনও। কিন্তু চিরন্তন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। তার স্নায়ুগুলো যেন বিবশ হয়ে গেছে। তার ইচ্ছার প্রাণশক্তি বলতে আর কিছু মাত্র অবশিষ্ট নেই। চিরন্তন যেমনি ছিলো তেমনি পড়ে রইল। একটা বিড়াল তার বিছানার নিচে একবার ডেকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এ ঘরে বিড়ালটার কিছুই জুটলোনা। চিরন্তন পড়ে রইল আগের মতোই, দিনের আলো ছাড়া সবকিছু রাত্রির মতই রইল।
[২]
মাসখানেক আগে এক বসন্তের দুপুর। দক্ষিণ কলকাতার শহরতলীর প্রান্তে একটা দোতলা বাড়ির একটা টুকরো ঘর। একটা বড় ঘরের মাঝখানে দেয়াল তুলে স্টোর-রুম করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল এই ঘরটা।
বেলা তখন প্রায় আড়াইটা। রোজকার মতো চিরন্তন রাস্তার পাশের কল থেকে স্নান করে এসেছে। একটা পায়জামা গলিয়ে নিয়ে কয়েকটা ফুল আর একটু জল দেওয়ালের তাকে রাখা ঠাকুরের ছবির সামনে দিয়ে একটু ভাত আর ডাল দিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাঠ চোকাবে রোজকার মত, এরকম ভাবছিল চিরন্তন। এমন সময় দোতলার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। চিরন্তনের ঘরে তেমন কেউ আসে না। তাই চিরন্তন অবাক হয়েছিল। দোতলার অন্য ঘরটা বন্ধই পড়ে থাকে। কাজেই যে আসছে, সে যে তার কাছেই আসছে, এ ব্যাপারে চিরন্তন নিঃসন্দেহ ছিল। ভাতের থালাটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু তাকে চমকে দিয়ে যে ঘরে ঢুকলো তার জন্য স্বপ্ন কেন দুঃস্বপ্নেও প্রস্তুত ছিলনা চিরন্তন।
ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো রমা। চিকন শরীরের রমা এখন বেশ পৃথুলা। তার সুন্দর মুখটা অনাবশ্যক গোলগাল হয়েছে। কোমরটাও স্থূল হয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে তবে রংটা আগের চেয়ে আরও হলুদ হয়েছে।
চিরন্তন কিছু বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কি বলবে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। রমার চোখে চোখ ছিল চিরন্তনের। রমা এতটাই কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে রমার নিঃশ্বাস চিরন্তনের মুখে, ঠোঁটের উপর পড়ছিল । বাকহীন চিরন্তনের নিস্তব্ধতা ভাঙার সুযোগ না দিয়ে রমা বলল ,
--" কিগো চিরুদা বেশ তো আছ স্বার্থপরের মত ! নিজের জন্য বেঁচে আছো! মনে পড়ে আমার কথা?
রমার গলায় রাগ। চোখে অসহায় দৃষ্টি। চিরন্তন রমাকে কখনো এত অগোছালো পোষাকে দেখেনি। বিহ্বল চিরন্তন ধাতস্থ হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল ---"এভাবে বলোনা সে একদিন ছিল যখন আমার সব স্বার্থের সঙ্গেই তুমি জড়িয়ে ছিলে। আর ভালো থাকার কথা বলছ! হ্যাঁ তা আছি! আমাকে ভালো রাখার জন্যই তো তুমি চলে গেলে! ভালো তো আমাকে থাকতেই হবে! দোমড়ানো-মোচড়ানো জীবনটা নিয়ে দিব্যি নিজের সুখ শখ-আহ্লাদ মিটিয়ে বেঁচে আছি! কিন্তু তুমি আবার এখানে এলে কেন? তোমার স্বামী সংসার নিয়ে তো প্রবাসে ছিলে, এখানে এলে কবে?"
বলতে বলতেই চিরন্তন তার চৌকির একটা কোণ ঝেড়ে মুছে রমাকে বসতে বলল। রমা তীব্র বিতৃষ্ণা মাখা দৃষ্টিতে চিরন্তনের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তার দুই বাহু খামচে ধরে বলল
---"চিরুদা, তুমি নিজেও শেষ হলে আর আমাকে এভাবে শেষ করলে! এভাবেই যদি বাঁচবে, তবে আমাকে জড়িয়ে ছিলে কেন? কেন বল?"
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো চিরন্তন। বললো,
--- "এভাবে তো বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু এভাবেই বেচে আছি। হয়তো থাকবো না।"
প্লাবিত জনপদের মত কঁকিয়ে উঠলো রমা।
-- "কিন্তু আমি কি করে বাঁচবো চিরুদা?"
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আকস্মিক এক রাগে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,
-- "লজ্জা করে না তোমার? আমাকে ভোগ করেছ, স্বপ্ন দেখিয়েছো! তারপর? অকর্মণ্য কাপুরুষের মত পালিয়ে বেঁচেছ! আমি এতই সস্তা ছিলাম না?"
সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল রমার। তার চোখে আগুন আর জল দুটোই ছিল। আবেগের অভিঘাতে চৌকির ওপর ধপ করে বসে পড়ল রমা।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে যখন রমা সেদিন চিরন্তনের দশ বাই আট এর ঘরটা থেকে বেরোল তখন চিরন্তন পক্ষাঘাতগ্রস্ত একজন মানুষের মতো বিছানার উপর বসে। তার সমস্ত চিন্তা বুদ্ধি স্মৃতি সব যেন সেদিন ধ্বংস করে দিয়েছিল রমা।
রমা সেদিন তার শাঁখা-সিঁদুরের জীবনের গল্পটা শুনিয়েছিল। রমার স্বামী এক বিকৃতকাম পুরুষ। বহু নারীর শরীর তার অবাধ চারণভূমি। একটা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে থাকার সুবিধা নিয়ে নিত্যনতুন নারী ভোগ করা তার কাছে অ্যালকোহল পানের মতই স্বাভাবিক। এমনকি একই বিছানায় অন্য মেয়ের সঙ্গে রমাকেও শুতে বাধ্য করেছে সেই মাংসাশী শয়তান। এই পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল রমা, মেনে নিয়েছিল ছেলে অর্ঘ্যর মুখ চেয়ে। কিন্তু যেদিন রমাকে কোম্পানির সর্বময় কর্তার বিছানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, সেদিন আর চুপ করে থাকতে পারে নি। কোন ভাবে ফ্ল্যাটের ধোপাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল বাবার কাছে। পুলিশের তৎপরতায় সে বেঁচেছে। কিন্তু ছেলেটা শেষ হয়ে গেছে। জানোয়ারটা তো ওই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েই রমাকে সব নোংরামিতে নামাত। এমনকি বেশ কয়েকবার নিজের ঔরসজাত সন্তানের শরীরে ব্লেড চালাতেও দ্বিধা করেনি। সেই ব্লেডেই শেষ করে দিয়েছে ছেলেকে।
বিকেল যখন প্রায় শেষ, চিরন্তন সেই নগ্ন ধ্বংসস্তূপের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। দুজনেই নিস্তব্ধ, শুকনো শূন্য দৃষ্টি।
চিরন্তনের চোখের সামনে কিছুক্ষণ আগে তার সমস্ত কবিতার খাতা ছিঁড়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে রমা। একদিন চিরন্তন রমাকে বলেছিল, "কবিতা তোমার সতীন, তোমাকে ছাড়তে পারবো না ওকেও না।" আজ রমা নিজের হাতে যখন তার শত্রুকে ধ্বংস করছে চিরন্তন কিছুই করতে পারে না। কিছু বলতেও পারে না।
এ ঘটনা ঘটে গেছে আজ থেকে ত্রিশদিন আগে। চিরন্তন প্রতিদিন চেষ্টা করেছে কবিতাকে গলা টিপে মারার। কবিতাকে ঘৃণা করার চেষ্টা করে গেছে অনবরত। কিন্তু কবিতা দুরারোগ্য রোগের মতো তার মস্তিষ্কে মিশে গেছে।
তাদের জীবনের গল্পটা লিখতে চেষ্টা করে চলেছে চিরন্তন। আর কয়েকদিন পরেই দোল। চিরন্তনের দক্ষিণের জানালার বাইরে ইলেক্ট্রিকের তারে একটা কাক তারস্বরে ডাকছে। এ বসন্তে চিরন্তন কি কোকিলের ডাক শুনেছে? মনে হয় না। তবে অন্যদিন হলে হয়তো সে কাগজ পুঁটুলি পাকিয়ে ছুড়ে কাকটাকে তাড়াতো, কিন্তু আজ আর তাড়ালো না। কর্কশ ডাকটা শুনতে শুনতে একসময় আর কর্কশ মনে হলো না তার।
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে চিরন্তন। অসংখ্য শব্দ কবিতার শরীর ছেড়ে তার বন্ধ চোখের ক্যানভাসে কয়েকটা পঙক্তি তৈরি করেছে আবার তারা ভেঙেচুরে পড়ছে। চিরন্তন এই ভাঙা-গড়ার মধ্যে কিছুক্ষণ ছিল, কিন্তু কি করছিল তা সে নিজেও জানে না। আজ একত্রিশতম দিন। বীর্যশুল্কা এক নারী চিরন্তনের মনে, শরীরে চূড়ান্ত ধ্বংস চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। চোখ বুজে চিরন্তন সেই ধ্বংসের মধ্যে এখনও এক টুকরো অতীত খুঁজে পাচ্ছে।
গল্পটা ঠিক এখানেই শেষ হতে পারত হয়ত কিন্তু তা হলো না। এখান থেকেই শুরু হলো আবার। শেষবার যখন পাণ্ডুলিপিটা ছিড়ে ফেলল চিরন্তন তারপর তার হাতে তিন টাকার ইউজ-এন্ড-থ্রো বলপেন এর বদলে উঠে এল একটা জং ধরা ছুরি। সেটাকে শক্ত করে ধরে ছুরিটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল চিরন্তন। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা ঘণ্টা। চিরন্তন আত্মহত্যা করার মত যথেষ্ট সাহসী হয়ে উঠতে পারল না।
বেলা তখন প্রায় এগারোটা। কাকটা ডেকে ডেকে চলে গেছে। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে চিরন্তনের এলো গায়। তবে তার কোন অনুভূতি নেই। সময় আস্তে আস্তে পাথরের মত টিপে ধরছি চিরন্তনের গলা।
হঠাৎ চিরন্তনের চোখ পড়ল দরজার চৌকাঠে। বিড়ালটা শুয়ে আছে। তার দিকেই তাকিয়ে আছে, নির্নিমেষ একটা অদ্ভুত ধারালো চাউনি, ঘেন্না আর বিদ্রূপের কোন কমতি নজরে এলো না চিরন্তনের। সেই তীক্ষ্ণ চোখ দুটোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কিছু একটা ঘটে গেল চিরন্তন এর মধ্যে। একটা ভয়ঙ্কর উথাল পাথাল। একটা বিধ্বংসী ভূমিধসের মত কিছু যেন ভেঙে পড়তে লাগল তারমধ্যে। ছুরি সমেত হাতটা উঠে এলো মাথার উপর। তারপর তীব্র গতিতে নেমে এলো একটা প্রায় মৃত শরীরের উপর।
কয়েক মুহুর্ত পর চিরন্তন যন্ত্রণা আর অদ্ভুত এক সুখের টানাপোড়েনে প্রায় সমান্তরাল, ঠিক তখনই তার চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত ছবি। যে ছবিটা দেখার জন্য সে এতদিন সব সময় প্রার্থনা করেছে । রমা তার দরজায়। তার হাতে ধরা একটা ট্রলি। বিড়ালটা যেখানে শুয়েছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে রমা। কিন্তু তার চোখ দুটো এখন সেই বেড়ালের মতোই ! ট্রলিটা দরজার বাইরে রেখে রমা তার কাছে এগিয়ে এল। ঝুঁকে চিরন্তনের মুখের ওপর মুখ রেখে বলল,
--" তোমার কাছে এসেছিলাম তোমার কবিতা হব বলে। কিন্তু তোমার মরা উচিত! তুমি মরেই যাও। মরে যাও তুমি!"
ঘেন্না আর কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস সেখানে রেখে আবার দরজার বাইরে চলে এলো রমা। চলে যেতে গিয়েও পিছন ফিরে চিরন্তনের দিকে তাকিয়ে তীব্র ঘৃণার চেঁচিয়ে উঠলো "কাপুরুষ !"
=============================
#আমার পরিচিতি // অনিন্দ্য পাল
======================
জন্ম ১৯৭৮ সালে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চম্পাহাটি তে। বাবা পরলোকগত বিশ্বনাথ পাল। মাতা অনিতা পাল। শিক্ষা - পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক স্নাতক, বি এড। পেশা - তাড়দহ হাইস্কুলের শিক্ষক। লেখা লেখি শুরু কলেজের দিনগুলোয় যদিও প্রকাশ অনেক পরে। স্থানীয় অনেক লিটল ম্যাগাজিন এ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, কৃত্তিবাস, প্রসাদ, তথ্যকেন্দ্র, নিউজ বাংলা, উৎসব, অপদার্থের আদ্যক্ষর, শ্রমণ , বার্ণিক, অন্বেষা, অর্বাচীন, মুখ, দেশিক, সূর্যকিরণ, রোদ্দুর, ব-দ্বীপ বার্তা, নবপ্রভাত, হিরণ্যগর্ভ, হৃৎস্পন্দন, লণ্ডন টাইমস, অভিব্যক্তি(নিউ জার্সি) দৈনিক বজ্রকণ্ঠ(ত্রিপুরা)ইবলিশ(বাংলাদেশ),অলীক পাতা, দক্ষিণের জানালা, কল্পবিশ্ব, বহুধা, প্রজনা, কথাকাহিনি, একলব্য, সিন্ধুলিপি, রা, সাহিত্য কালচার, TechTouchটক, নিকোটিন, ত্রিতাপহারিণী, আঁতুড়ঘর, অক্ষর সংলাপ, আখরকথা, কেয়াপাতা, কৃষ্ণকলি, নীলাঞ্জনা, আবাহনী, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, বিজ্ঞানভাষ, প্রভৃতি অনেক পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
"সুখবর" পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। "তোর মত হলে অন্ধকারকেও ভালোবাসি", "জলরঙের ওড়না " ও "সমুদ্রে রেখেছি সময়" ও " আমি এসেছিলাম " নামে চারটি কাব্যগ্রন্থ আছে।
সাপলুডো নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন