রথ টানাটানি
------------------
একটা বড়ো হাই তুলে শর্মিমালা ড্রইংরুমের দেয়াল থেকে আঠারোর ক্যালেন্ডারটা নামিয়ে দিলো। অফিস থেকে ফেরার সময় অনির্বান উনিশের একটা নতুন ক্যালেন্ডার এনেছে । কিন্তু হাতে নিয়ে দেয়ালে টানানোর মুহূর্তে শর্মিমালা গার্ডারটা খুলেই ঝাঁঝিয়ে উঠলো, 'ধ্যাৎ এ আবার কী ? শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রা ? এই সব ছবি এখন কেউ দেয়ালে টানায় নাকি অ্যাঁ ? ' মুখে বিরক্তি থাকলেও ছবিটা কিন্তু ড্রইংরুমের দেয়ালে রাখলো শর্মিমালা শেষ পর্যন্ত ।
বাথরুম থেকে ফিরে অনির্বান দিনের ক্লান্তি নরম তোয়ালেতে মুছতে মুছতে শর্মিমালার বিরক্তির উত্তর না দিয়ে পারলো না, ' দ্যাখো মেলা ককিয়ো না, ফার্নিচারের দোকানের ছেলেটা ডেকে দিলে, তাই...। তাছাড়া রথযাত্রা যেন এযুগে এক্কেবারে অচল ! কেন এই যে সব এতো তক্কো বিতক্ক চলেছে, তুমি আছো কোন কালে ?' শর্মিমালা দিন দিন ধ্যাতরা হয়ে যাওয়া এই পঁয়তাল্লিশের লোকটার ক্লিশে কথায় তেমন গুরুত্ব দেয় না।বরং 'ভ্রমর কইয়ো শ্রীকৃষ্ণ-বিচ্ছেদের অনলে' গানের লাইনে হালকা সুর চড়িয়ে এক কাপ গরম কফি এনে সামনের টি টেবিলে রাখে। পাশে থাকা বোতলের জল খানিক ঢক ঢক করে গিলে অনির্বান প্লেট থেকে বিস্কুট নিয়ে চিবোয়। টি টেবিলে পড়ে থাকা সকালের কাগজের প্রথম পাতায় মোটা হরফে ছাপার অক্ষরে স্পষ্ট ফুটে রয়েছে, 'শবরীমালায় ব্যর্থ হলো বিদ্রোহী রমণী ' ।
ততক্ষণে অবশ্য শর্মিমালা পৌঁছে গেছে টিভির ঘরে বাবা লোকনাথের টানে। এই সময়টা সে শিশু লোকনাথের অধ্যাত্ম কার্য কলাপ দেখে। মোবাইলটা তাই চার্যে বসানো থাকে । ছেলে হোস্টেলে যাওয়ার পর থেকে শর্মিমালার রাতে রান্না নেই। সন্ধ্যা বেলায় চারটে আটার রুটি সেঁকে রেখেছে ক্যাসেরোলে। লোকনাথের সিরিয়ালটা শেষ হলেই শর্মিমালা সোফায় বসে অনেকক্ষণ ফেসবুক করবে। উত্তেজনা বেশি হলে কবিতার মতো দুটো চারটে লাইন লিখে বাঁকা চাউনির একটা শেলফি সহ পোস্টাবে ।
কফি খেতে খেতে অনির্বান সিগারেট খুঁজবে, বাক্স ফাঁকা দেখে সেটা ছুড়ে ফেলবে ডাস্টবিনে । এরপর ঘরের ড্রয়ার থেকে বিড়ি নিয়ে এসে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াবে । কিছুটা দূরে নীচে সামনের রাস্তায় একটা জটলা না কি গন্ডগোল বেধেছে । চুপচাপ বিড়ির ধোঁয়া গিলতে গিলতে যতটুকু দেখার দেখবে। কয়েকবার চিৎকার আর চাপা খিস্তি শোনা যাচ্ছে বুঝে ব্যালকনি ছেড়ে ফের ঘরে। এবার তার খবর দেখার রুটিন মনে পড়বে। খবরের চেয়ে বিজ্ঞাপন বেশিতে তার এলার্জি, তবু চোখটা হঠাত্ আটকে যাবে একটা ব্রেকিং-এ, ' সরকারি কর্মচারীদের ডি এর খবর' ।
এমনিতে খবরাখবর নিয়ে তেমন কৌতূহল না থাকলেও রাতে বিছানায় শুয়ে শর্মিমালা অনির্বাণকে বলবে ,সে ফেসবুকে দেখেছে গ্যাসের দাম কমছে। অবশ্য সে খবর কল্কে পাবে না । কারন ততক্ষণে অনির্বান নাক ডাকছে।
অনির্বান কিন্তু নাক ডাকানো ঘুমে দিব্যি হাঁকিয়ে দেয় স্বপ্ন, নতুন বছরে প্রমোশন তার ভগবান এসেও আটকাতে পারছে না। সত্যি সত্যি একটা সোনালি রঙের মহাভারতীয় রথ তার সাড়ে নশো বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে । যার সামনে কোনও রাজকীয় টগবগানো ঘোড়া নেই । একটা স্করপিয়র ইঞ্জিন সামনে লাগানো । একমাত্র ছেলে অনিন্দ্য ধরেছে স্টিয়ারিং । অনির্বান শর্মিমালাকে রীতিমতো ধাতানি দিচ্ছে, 'আরে তোমার গোছানো হলো ? রথ কিন্তু আমেরিকা যাবে ,বাথরুম পেলে যেখানে সেখানে থামবে না মনে রেখো '।
শর্মিমালা রথে পা দিয়েই বলে, এ যে বড্ড পুরানো ! একটু রং করে নিতেই তো পারতে,শেলফি তুলতে হবে না '। অনির্বান খ্যাকখেকিয় হেসে শীত কম্বলের গহনে তীব্র টান দিলো শর্মিমালাকে। অন্ধকার দেয়ালে ব্যারোমিটার ঝুলে থাকলো চোদ্দ ডিগ্রির দাঁত মেলে।
ঠিকানা:
সুব্রত বিশ্বাস (অ-নিরুদ্ধ সুব্রত)
গ্রাম ও পোস্ট-ধর্মপুকুরিয়া
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন