তিন নাথের মেলা
সৌভিক দে
যখন কোনও সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য কারণে একটা জায়গায় অনেক মানুষ একত্রিত হয়, তখন তাকে নাকি মেলা বলে। গুগল-এ অন্তত এমনটাই লেখা আছে। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মের মানুষের সমন্বয়। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণ, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক আকর্ষণ। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে শখের হাঁড়ি, বিভিন্ন ধরনের মাটির পুতুল বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ"। কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না; বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। বরং তা গ্রাম ছাড়িয়ে শহরে উপস্থিত। সেখানে কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেই যে মেলা বসে, এমনটা নয়।সমাজের বিভিন্ন জিনিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী অনেক সময় মেলা আয়োজিত হয়। যেমন – বইমেলা, লিটিল ম্যাগাজিন মেলা, হস্তশিল্পী মেলা, বাণিজ্য মেলা, মহিলা সমবায় সমিতির মেলা ইত্যাদি। মেলা মানেই মহামিলন – এমনটাই ভাবা হয়। তবে বর্তমানে শহুরে মেলাগুলোতে বিকিকিনি ও আত্মপ্রচার ব্যতীত আর কিছুই হয় না। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়।
কবে, কোথায়, কখন প্রথম মেলার প্রচলন হয়েছিল; তা জানা না গেলেও এটি যে আবহমান বিশ্বের এক প্রাচীণ ঐতিহ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মনে করা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। অতীতে রাজা-জমিদারেরা মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, বর্তমানে রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারকেও মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায়। তবে ধর্মীয় কোনও উপলক্ষেই মূলত প্রাচীনকাল থেকে মেলা বসত। তাই বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মেলা। বৈশাখ থেকে চৈত্র প্রতি মাসেই নানা উৎসব উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে মেলার সঙ্গে। কিন্তু তিন নাথের মেলা ঠিক তেমনটা নয়। এখানে তিন নাথ অর্থে বোঝানো হয়েছে তিন দেবতাকে। তাঁদের মিলন হওয়াকেই মেলা বলা হচ্ছে। বিশ্বসানুযায়ী সেই তিন দেবতার একই দেহে মিলন ঘটেছে –
মালা কমণ্ডলুরধঃ করপদ্মযুগ্মে।
মধ্যস্থপাণিযুগলে ডমরুত্রিশূলে।।
যন্ন্যস্ত ঊর্ধ্বকরয়োঃ শুভশঙ্খচক্রে।
বন্দে তমত্রিবরদং ভুজষট্ক যুক্তম্।।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে মার্গশীর্ষ পূর্ণিমা বা অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় "দত্তাত্রেয় জয়ন্তী"। পুরাণ অনুসারে, দত্তাত্রেয় হলেন ঋষি অত্রি ও তাঁর স্ত্রী অনুসূয়ার পুত্র। অনসূয়া ছিলেন ধর্মপ্রাণ নারী। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সমতুল্য পুত্র লাভ করার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব হিন্দু দেবমণ্ডলে ত্রিমূর্তি নামে পরিচিত। তাদের শক্তি সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী – এই ত্রিদেবী অনসূয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত হলেন। তারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে প্ররোচিত করলেন অনসূয়ার সতীত্ব পরীক্ষার জন্য। তিন দেবতা সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে অনসূয়ার সামনে এসে বললেন, অনসূয়াকে নগ্ন হয়ে তাদের ভিক্ষা দিতে হবে। অনসূয়া প্রথমে বিভ্রান্ত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মাথায় একটি বুদ্ধি এল। তিনি জল ছিটিয়ে মন্ত্র পড়ে তিন দেবতাকে শিশুতে রূপান্তরিত করলেন এবং নগ্ন হয়ে স্তন্যপান করালেন। অত্রি আশ্রমে ফিরে অনসূয়ার কাছে সব ঘটনা শুনলেন এবং ধ্যান বলে তিন সন্ন্যাসীর প্রকৃত স্বরূপের কথা জানতে পারলেন। তিনি তিন শিশুকে আলিঙ্গন করে তাদের একটি মাত্র শিশুতে পরিণত করলেন।
এই শিশুর তিনটি মাথা ও ছয়টি হাত হল। দেবতারা ফিরছেন না দেখে ত্রিদেবী চিন্তিত হয়ে অনসূয়ার কাছে ছুটে গেলেন। তারা অনসূয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের স্বামীদের ফেরত চাইলেন। অনসূয়া রাজি হলেন। তখন ত্রিমূর্তি অত্রি ও অনসূয়ার সামনে তাদের প্রকৃত মূর্তি ধরে দাঁড়ালেন এবং তাদের দত্তাত্রেয় নামে এক পুত্র দান করলেন। যদিও দত্তাত্রেয় ত্রিমূর্তির সম্মিলিত রূপ, তবু তাকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবেই গণ্য করা হয়। অত্রির পুত্র বলে এই শিশুর অপর নাম 'আত্রেয়'। আর "দত্ত" অর্থ যা দেওয়া হয়েছে। ভগবতী ললিতাত্রিপুরাসুন্দরী-র প্রধান ৩২ জন উপাস্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন দত্তাত্রেয়। তিনি ভাগবত পুরাণ অনুসারে শ্রী বিষ্ণুর অবতার। তিনি সুদর্শন চক্র, ত্রিশূল ও কমুণ্ডল ধারণ করেন। দত্তাত্রেয়-র ছয় হাত ষড়দর্শন, চারটি সারমেয় চতু্র্বেদ এবং গোমাতা "আগম" তন্ত্রের প্রতীক।
শ্রীমদ্ভাগবত ১১/৭/৩২-৩৪ শ্লোকে দত্তাত্রেয় মুনি বলেছেন যে, নিজবুদ্ধির দ্বারা শিক্ষাগ্রহনের জন্য তার ২৪ জন গুরু আছেন। তারা হলেন — পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি, চন্দ্র, সূৰ্য, কপােত, অজগর, সিন্ধু, পতঙ্গ, মধুকর, হস্তী, ভ্রমর, হরিণ, মৎস্য, পিঙ্গলা, কুররী (পক্ষী), বালক, কুমারী, শরনিৰ্মাতা, লোহাকার, সর্প , উর্ণনাভ (মাকড়সা) ও সুপেশকৃৎ (গুটিপােকা)। এর পরের শ্লোকগুলোয় তিনি বর্ণনা করেছেন এদের কাছ থেকে তিনি কি কি শিক্ষা করেছেন। যেমন — পৃথিবী থেকে অবিচলভাব ও ক্ষমা, জলের কাছে স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা ইত্যাদি।
এই দত্তাত্রেয়কে বিভিন্ন হিন্দু সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে পুজো করে। নাথ সম্প্রদায় তাঁকে দেবাদিদেব মহাদেবের অবতার মনে করে। আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৮/০১/১৩৬৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত উপেন্দ্রকুমার দেবনাথের লেখা 'নাথ সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' থেকে জানা যায় — আদিনাথ, মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ ও গোরক্ষনাথ — এই তিন জন নাথগুরুকে বলা হয় 'তিন নাথ' বা 'ত্রিনাথ'৷ তিন নাথের কৃপায় হলাহল জ্বালা দূর হয়, অমঙ্গল দূর হয়; ঘর-গৃহস্থ সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পূর্ণ হয়৷ এই তিন নাথ পরে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরে পরিণত হয়ে দত্তাত্রেয়তে রূপান্তরিত হয়, যা রচনার পরবর্তী অংশে আলোচিত হবে। তন্ত্রে দত্তাত্রেয়কে "যোগের ঈশ্বর" বলে মনে করা হয়। তিনি বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। লৌকিক বিশ্বসানুসারে, তিনি আদিগুরু। তাঁকে গুরু রূপে পুজো করলে আজও নাকি সাড়া মেলে। দত্তাত্রেয় অদ্বৈত বেদান্তের ভাষ্য 'ত্রিপুর রহস্য' রচনা করে পরশুরামকে দান করেছিলেন বলে নাথ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস। মতান্তরে, তিনি পরশুরামকে 'শ্রীবিদ্যা' দান করেছিলেন। তিনি অঘোর মার্গেরও পথপ্রদর্শক।
দত্তাত্রেয়র দু'টি মন্ত্র বিশেষ উল্লেখযোগ্য — ১) 'ওঁ আঁ হ্রীঁ ক্রোঁ এহি দত্তাত্রেয় স্বাহা' ২) 'ওঁ ঐঁ ক্রোঁ ক্লীঁ ক্লৌঁ হ্রঁ হ্রীঁ হ্রৌঁ সৌঃ দত্তাত্রেয়ায় স্বাহা'। এই দু'টি মন্ত্রেই শাক্ত প্রভাবের ছোঁয়া পরিলক্ষিত। জনমানসে বিশ্বাস, দত্তাত্রেয়কে পুজো করলে ত্রিদেবের আশীর্বাদ পাওয়া যায়। তাঁকে গুরু এবং ভগবান উভয়েরই রূপ বলে মনে করা হয়। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা ও গুজরাটে মহাসমারোহে 'দত্তাত্রেয় জয়ন্তী' পালিত হয়। কর্ণাটকের গঙ্গাপুরে দত্তাত্রেয় ক্ষেত্র অবস্থিত। সেখানে তাঁর মূর্তিসহ খড়ম নিত্য পূজিত। বঙ্গদেশে কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে দত্তাত্রেয় 'ত্রিনাথ ঠাকুর' বা 'তিন নাথ' নামে পরিচিত এবং পালাগান ইত্যাদি লোকাচারের মাধ্যমে তাঁর উপাসনা করা হয়ে থাকে। কথিত, তিন পয়সায় হয় তাঁর মেলা —
"এক পয়সার পান-সুপারি,
আরেক পয়সার তেল।
আরেক পয়সার গাঁজা
দিয়ে তিন কলকে সাজা।।"
তিন নাথের মেলাকে কেন্দ্র করে এমন নানান লৌকিক ছড়া শুনতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পূর্বভারতীয় জনগণের মধ্যে একদা অন্যান্য দেব-দেবীদের তুলনায় অনেক বেশী জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ছিল এই তিন নাথ। আদিনাথ, মীননাথ ও গোরক্ষনাথের মহাত্ম্য কীর্তনের সুরে গেয়ে বা পাঁচালীর সুরে পাঠ করে আনন্দ ও শান্তি লাভ করতো। বর্তমানে তিন নাথের মেলার আধিক্য বিশেষ করে বাংলাদেশের ময়মনসিং, ঢাকা, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট প্রভৃতি জেলায় দেখা যায়। আসামের কাছাড়ে এই মেলার প্রভাব ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে। মধ্য অসমেও এই মেলা দৃষ্টিগোচর হয়। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গীয় জনমানসের নিচতলায় এই তিন নাথের প্রভাব যথেষ্ট আছে। সন্ধাবেলায় মিঠাতেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে, পান, সুপারী, গাঁজা সাজিয়ে ফলমূলসহ নানারকম নৈবেদ্য দিয়ে ভক্ত প্রাণ মানুষ আজও কীর্তন করে —
''সাধুরে ভাই —
দিন গেলে তিন নাথের নাম লইও।
সারাদিন কৈররে ভাই সংসারের কাম,
সন্ধা হইতে লইও তিন নাথের নাম।
আমার ঠাকুর তিন নাথ যেবা করে হেলা,
গলায় হবে গলগণ্ড চোখে বার হয়ে ঢেলা।
মাধুরে ভাই ইত্যাদি ধূয়া —
আমার ঠাকুর তিন নাথ যার বাড়ী যায় সর্দিজ্বর মাথাব্যাথা তরাসে পলায়।
সাধুরে ভাই ধূয়া পূর্বব —
আমার ঠাকুর তিন নাথ যার বাড়ী যায়,
এক পয়সার গাঁজা দিয়া তিন কল্কি সাজায়।"
ত্রিপুরাতেও তিন নাথের মেলা যথেষ্ট পরিমাণে পালিত হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও এই একই গান সামান্য অদলবদল করে গীত হয় —
''তিন পয়সায় হয় যার মেলা,
কলিতে তিন নাথের মেলা।
এক পয়সার সিদ্ধি আনি তিল কলকি সাজায়,
গাঁজায় দিয়ে দম বলছে ববম ববম বম ভোলা;
সাধুরে ভাই কলিতে তিন নাথের মেলা।
এক পয়সার পান আনি তিন খিলি সাজায়;
সাধুরে ভাই কলিতে তিন নাথের মেলা
এক পয়সার তৈল আনি তিন বাতি সাজায়
বাতি জ্বালিয়া দিলে নিভে নারে এ করি আজব লীলা,
সাধুরে ভাই কলিতে তিন নাথের মেলা।''
নাথদের ব্যাপক প্রভাব ও তাঁদের প্রতি সর্বসাধারণের গভীর ভক্তি বা শ্রদ্ধা সেই মধ্যযুগ থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সহ্য হয় নি। নাথদের সমাজে হেয় করে, তাঁদের মঠ-মন্দির দখল করার একটা ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল দীর্ঘদিন ধরে তলে তলে চলে আসছিল। রাজা বল্লাল সেনের সহায়তায় কুচক্রী নাথ বিদ্বেষীদের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছিল। ফলে মঠ-মন্দির নাথদের হাতছাড়া হয়। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তাই এই সময় বাংলায় হিন্দুধর্ম রাজ-পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং সমাজে ব্রাহ্মণদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শোনা যায়, নব্য-ব্রাহ্মণদের শলা-পরামর্শে সেনযুগে নাথ সম্প্রদায়কে সমাজে পতিত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সময়ই তিন নাথের পুজোয় নাথদের নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণদের উপাস্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। দত্তাত্রেয় হয়ে যায় সেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মিলিত রূপের প্রতিনিধি। নাথ সম্প্রদায়ের তিন নাথের সঙ্গে দত্তাত্রেয়কে মিলিয়ে, মিশিয়ে একাকার করে নির্মিত হয় নব্য পর্যায়ের তিন নাথের পুজো বা মেলা। তারপর বঙ্গদেশের অধিকাংশ স্থানে আদিনাথ, মীননাথ ও গোরক্ষনাথ বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যায়; সাধারণ্যে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় তিন মাথা, ছয় হাতের দত্তাত্রেয়র মহিমা।
===================
তথ্যসূত্রঃ
১.) শ্রীমন্মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ, আচার্য্য পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স।
২.)নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ডঃ এন. সি. নাথ, আগরতলা প্রেস ক্লাব।
৩.) নাথ সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী, কল্যাণী মল্লিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
৪.) ইতিহাসে সাহিত্যে লোককথায় বাংলার প্রাচীন নাথধর্ম, নবাঙ্কুর মজুমদার, ইতিহাস তথ্য ও তর্ক (অন্তর্জাল পত্রিকা)।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন