Featured Post
নিবন্ধ ।। গোকর্ণী গ্রামে বিবিমার মাঙন ও হাজত ।। অরবিন্দ পুরকাইত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বিবিমার মাঙন ও হাজত
অরবিন্দ পুরকাইত
মাঘী পূর্ণিমায় মাঙন করে বিবিমার হাজত সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটি দীর্ঘদিনের আদত। জল-জঙ্গল অধ্যুষিত অফুরান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার সুন্দরবনের ভয়ঙ্করতার দিক বোঝাতে অনেকসময় এক কথায় বলা হয়ে থাকে— জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। অর্থাৎ মানুষের কথা যদি ধরা যায়, দেখা যাচ্ছে জীবন-জীবিকার টানে তাদের প্রধান দুই বিচরণের জায়গাতেই বিরাজমান দুই মূর্তিমান নরখাদক! মানুষের সভ্যতায় নগরের ধারণা বলতে গেলে অনেক পরের। সে ধারণা যখন বাস্তবায়িত হতে থাকল, এটাও বাস্তব হয়ে দেখা দিল যে যুগের পর যুগ মানুষের উন্নতি-প্রগতি মূলত নগরকেন্দ্রিক। গ্রাম-বনস্থলীর যতটা দেওয়ার, পাওয়ার ততটা নয়। নগর ভূমিষ্ঠ হয় না, নগর গড়ে ওঠে। মানুষই গড়ে তোলে নিজেদেরই প্রয়োজনে। সেখানে প্রকৃতির সমস্ত পূর্ব উপাদান ক্রমশ কমে আসে। প্রাধান্য পায় মানুষ এবং মানুষের প্রয়োজনীয় এবং সুখদা নানান সাজসরঞ্জাম, সামগ্রী। গড়ে ওঠে বাজার। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে, সুখের টানে দূর দূরান্তর থেকে মানুষ এসে বসত করে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে চাকরি-বাকরি জীবিকার নানান দরজা সেখানে খুলে যায়। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ে সেই স্থানের নিজেরই পূর্বাবস্থা থেকে, তার দূরবর্তী অংশের সঙ্গে তো বটেই। দূরে পড়ে থাকে আবহমান জনজীবন, বলতে গেলে সরাসরি প্রকৃতিরই ভাঙাগড়া ধ্বংস-সৃষ্টির নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। এই অরণ্যচর মানুষ, দেহাতি মানুষজন, এই অনেকখানি প্রকৃতির হাতে প্রতিপালিত— প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-মিলনে বয়ে চলে সেখানে জীবন। নাগরিক সুযোগসুবিধা, আয়োজন-উপাদান, ব্যবস্থানার অপ্রতুলতায় তার নানান বিপদ-আপদ, সমস্যা-সংকটে হাতের কাছের উপাদানকে বাধ্যত অনেক বেশি গ্রহণ করে থাকে, প্রকৃতির এক-একটা শক্তিকে ভয় করতে করতে, ভক্তির মোড়কে তাকে তুষ্ট করে জীবনকে নিরাপদ করার উপায় খোঁজে মানুষ সেই প্রকৃতিরই শক্তির মধ্যে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, বজ্র-বিদ্যুৎ থেকে প্রকৃতিরই অন্যান্য জীবজন্তুও বাদ যায় না তার থেকে। জীবনযাপনের সঙ্গে বিপদ-আপদ, রোগ-শোক-জরা-ব্যাধি প্রায় আজীবনের সঙ্গী যেমন, তার থেকে রেহাই বা উপশম পেতে মানুষের চেষ্টা তথা সন্ধানও অন্তহীন। ভয় থেকে যে ভক্তি, প্রাকৃতিক বিরূপ নানান শক্তির বিরুদ্ধে যে দেবকল্পনা, তাও নানান রূপ ধারণ করে। জলজীবী-জঙ্গলজীবী-কৃষিজীবী সেই সব মানুষদের কাছের হয়ে ওঠে নিজস্ব কল্পনার, মানসের কাছের নানান দেবদেবী, সেই কাছের দেবদেবীরা তাদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। লৌকিক দেবদেবী নামে আখ্যাত সেই কাছের দেবদেবীদের জনপ্রিয়তা কাউকে কাউকে স্থানিক থেকে বহুমান্য দেবতাদের সারিতেও পৌঁছে দেয়। সেই কাছের দেবদেবী যুগে যুগে কালে কালে জগৎজুড়ে নানান স্থানে নানান ভাবে ও রূপে গড়ে ওঠে, বিবর্তিত হয়; বিলীনও হয় কোনও কোনওটি, নতুন দেবদেবীরও আগমন ঘটে। এই দেহাতি মানুষজনের কাছের দেবদেবীকে অশাস্ত্রীয় বা অপৌরাণিক দেবদেবীও বলা হয়ে থাকে। শাস্ত্র বা পুরাণ কতদিনের, আর আবহমান মানবসমাজ! তাই শাস্ত্র হওয়ার আগে থেকে কত যে দেবদেবী কত জায়গায় প্রচলিত ছিল কোনও কোনও গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাবে, তার নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে কোথাও কোথাও প্রকৃতিপূজা তথা প্রকৃতির কোনও কোনও সজীব বা নির্জীব উপাদানের পূজায়। যেমন, নানান রূপে পাথরপুজো। এমনকি সে পাথর পরে ক্রমশ মূর্তির রূপ পেলেও, পাশাপাশি কোথাও কোথাও রয়ে যায় পাথরখানিও। লৌকিক দেবদেবী আজও বহু স্থানেই উঁকি মারেন বহু যুগের ওপার হতে!
বনবিবি বা বিবিমা : সুন্দরবন অঞ্চলের অন্যতম প্রধান লৌকিক দেবী— সর্বাধিক জনপ্রিয়— বনবিবি বা বিবিমা। সুন্দরবনের আর এক জনপ্রিয় লৌকিক দেব দক্ষিণরায়। দেখা যাচ্ছে এই দেবী ও দেব পরস্পরের প্রতিস্পর্ধী ছিলেন। পরস্পরের লড়াই এলাকা দখলের এবং এক সময় সমঝোতাসূত্রের মাধ্যমে এলাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার মধ্যে দিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থান। দক্ষিণরায় সুন্দরবনের অধিক আতঙ্কের নরখাদক ব্যাঘ্র ও কুমির— ভাঙা ও জলের দুই প্রধান শত্রুর দেবতা হিসেবে মান্য হয়েছেন (প্রধানত বাঘের, কুমিরের আলাদা লৌকিক দেবতা হিসাবে মান্য কালু রায়ও), আঠারো ভাটির অধীশ্বর তিনি; আর অন্যজন বাঘের দেবী হিসাবেও মান্য তো বটেই, আরও কাছের তিনি, কেন-না তিনি আঠারোভাটির সবাকার মা— তাঁকে মা বলে ডাকলে কারো নাকি আর কোনো বিপদ থাকে না।
সুন্দরবনের অঞ্চলে কাঠ কাটতে যাওয়া, মধু সংগ্রহে যাওয়া কিংবা মাছ বা মীন ধরতে যাওয়া মানুষদের কাছে বিপদ-আপদ, প্রাণসংশয়ের ভয় বরাবরই, আর তাই তারা বনে প্রবেশের আগে বনদেবী বা বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়ের পূজা করে যায় বনের মধ্যে।
বিবিমা বিষয়ে বিস্তৃতি বা বিশ্লেষণে যাওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, প্রাসঙ্গিক অল্প দু—একটি কথা বলে নিয়েই যাব আমাদের মূল বিষয়ে। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু বলেছেন যে বনবিবি আদিতে বনদেবী। 'বনবিবির স্বরূপ সম্বন্ধে লোকসংস্কৃতি বা লৌকিক দেবতা বিষয়ে গবেষক এবং তাঁর পূজ্য ধারণা'র কয়েকটি উল্লেখ করেছেন তিনি, যেমন, 'ইনি হিন্দুদেবি – বনদুর্গা, বনচণ্ডী, বনষষ্ঠী বা বিশালাক্ষী; মুসলমান প্রাধান্য কালে বনবিবি হয়েছেন।' 'হিন্দু-মুসলমান ধর্মচিন্তার সমন্বিত বা মিশ্রিত অরণ্যদেবী।' 'ইনি আদি পাঠান যুগের কোন মুসলমান সাধিকা ও ইসলামধর্ম প্রচারিকা অভিজাত মহিলা ছিলেন, সে কারণে প্রথমে মুসলমান সমাজে বহুজন পূজ্য হন, পরে ভক্তির প্রাবল্যে দেবি পদে উন্নীত হন।…' ইত্যাদি। তিনি এও লিখেছেন যে বনবিবির মূর্তি দু'রকম, মুসলমান ও হিন্দু অঞ্চলে আকৃতি ও বেশভুষায় পার্থক্য দেখা যায়। বনবিবিকে নিয়ে একাধিক কেচ্ছা বা কাব্য রয়েছে। মরহুম মুনশী মোহম্মদ খাতের প্রণীত বোন বিবী জহুরা নামা-তে বর্ণিত হয়েছে:
'বোন বিবী শাজঙ্গলি ভাই বহিনেতে ।। যে রূপে হৈলেন পয়দা বনের বিচেতে * যে রূপেতে মক্কা হৈতে গমন করিয়া ।। বাদাবনে ভাটি মধ্যে পৌঁছেন আসিয়া * যে রূপেতে নারায়ণীর সঙ্গে কিয়া রণ ।। আসিয়া ভুরকুণ্ড বিচে করেন আসন * যে রূপেতে ভাটিশ্বর ভ্রমিয়া আখেরে ।। হাট মধু বসালেন বনের ভিতরে * যে রূপেতে ধোনাই মোনাই দুই জনে ।। সপ্ত ডিঙ্গা লিয়া যায় মধুর কারণে * যে রূপেতে দুখেরে দক্ষিণ রায়ে দিয়া ।। কেঁদো খালি হৈতে আইসে মোম মধু লিয়া * যে রূপে বোন বিবী শুনে হয়ে দয়াবান ।। দুখের বিপদ কালে করেন আজান * যে রূপে দুখেরে পেয়ে ধন কড়ি দিয়া ।। কুম্ভীরের পীঠ পরে ছওয়ার করিয়া * দয়ার জননী দয়া কোরে নিজ গুণে ।। পৌঁছাইয়া দিল ঘরে দুখের কারণে * দুখে সে পাইয়া ধন হৈল দেশে রাজা ।। চালে চলে বসতি হইল সব প্রজা *।' এর পর বলছেন, 'বিপদে পড়িয়া বনে যেই জন ডাকে ।। মা বলিয়া বোন বিবী দয়ার মাতাকে * উদ্ধারে তাহার তরে আপনার গুণে ।। মায়ের জহুরা কত লিখিব এখানে * বয়ান করিয়া এই সব বিবরণ ।। লিখিব পিছেতে এবে শোন সর্ব্বজন *।'
স্বগ্রাম : সুন্দরবন অঞ্চলে মাঘী পূর্ণিমায় বাড়ি বাড়ি মাঙন করে বিবিমার হাজতের যে আদত, বৃহত্তর সুন্দরবনের অংশ হিসেবে আমাদের এই মগরাহাট থানা এলাকাও তার ব্যতিক্রম নয়। আজও খোলা আকাশের নিচে কোনও লৌকিক দেবস্থান দেখলে বহুদূরের জনজীবনের অস্পষ্ট আলোছায়া ভাসতে থাকে যেন চোখে! উজিয়ে গিয়ে বহু দূরের আমাদের তস্য অগ্রজদের সান্নিধ্য অনুভূত হয়। যদিও আজ অনেক স্থলে মাথার উপর ছাউনি বা ছাদ, মাটির ঢিবি থেকে মাটি-পাথর-ধাতুর মূর্তি, কিন্তু কোথাও কোথাও আজও রয়ে গেছে যেন অনেকখানি সেই আদিম আদল বা আদতের আভাস। মূর্তি হিসাবে পূর্ব বা পরিবর্তিত রূপে অথবা চালা বা মন্দির হিসাবে পরিবর্তিত রূপের মধ্যেও— আচার-পদ্ধতির রূপান্তর সত্ত্বেও— কোথাও কোথাও প্রাচীন চিহ্নাদি আজও অবলুপ্ত হয়নি একেবারে। আমাদের পুরকাইত পাড়ার পূর্বে মিস্ত্রিপাড়ার উত্তরে বিবিমার থান রয়েছে, রয়েছে পশ্চিমে জলমপুকুর— অন্য নামে, দখিনমাটান (মাঠান) বা দখিনপাড়ায়ও। রয়েছে গোকর্ণী বাজারের পশ্চিম পাশে। এই তিন জায়গাতেই বাৎসরিক বিবিমার গানও হয়। আমাদের পুরকাইত পাড়া থেকে মাঙন করে, প্রথমে এই বাজারের পাশের থানে এবং ফেরার পথে মিস্ত্রিপাড়ার থানে হাজত দেওয়া হয়।
মাঙনে বেরোনো : স্নান করে উপবাসী থেকে মাঙুনে বা মাঙুনীরা বের হন ছোটখাটো একটি দলে, তাতে বয়স্ক মহিলা থেকে অল্পবয়সি বধূ বা পাড়ার বালিকা-কিশোরী। গলায় খড় বেঁধে মাঙন করতে বেরোনো। এই খড় বাঁধা কিন্তু বাড়িতে নয়, উক্ত বাজার পার্শ্বস্থ বিবিমার থানে। ধোয়া কলাপাতার উপরে ধোয়া খড় কয়টি রাখা হয় বিবিমায়েদের সামনে। তারপর প্রণাম করে এক-একটি এক-একজন গলায় পরে নেয়। মাঙন করতে বেরোনোর সময় গলায় এই মালাটি থাকে না, কয়েক ঘর মাঙন করতে করতে থানে গিয়ে মালাধারণ পর্বটি সেরে নেয় সবাই। আবার কেউ এক-দুজন আগেভাগে চলে গিয়ে থানে ওইভাবে ঠাকুরের সামনে রেখে প্রণাম সেরে তুলে নিয়ে এসেও দলে ভিড়তে পারে। তারপর প্রত্যেকে একটি করে পরে নেওয়া। এই খড়ের মালা ধারণ করে সারাদিন উপবাসী থেকে মাঙুনেরা মাঙন করে ফেরে গোকর্ণী তো বটেই, প্রতিবেশী ঘনশ্যামপুর, মাখালিয়া, হংসগেড়িয়া, মাইতিরহাট ইত্যাদি গ্রামগুলোতে— যতটা হাঁটা সম্ভব আর কি। কষ্ট তো কম নয়— পথ হাঁটা, মাঙনের ধান-চাল বওয়া। আগে ধানও নেওয়া হত, পরে সাধারণত কেবল চালই নেওয়া শুরু হয়। ধান নেওয়ার কালে ধান ও চালের জন্যে আলাদা আলাদা খড়া নিয়ে বেরোতে হত। তা এসবের সঙ্গে সঙ্গে আছে সময়ে কুলিয়ে ওঠার ব্যাপার। শেষ বিকেল, সন্ধ্যার মুখে বা সন্ধ্যার ঠিক পরেপরেই তো ফিরতে হবে। কেন-না তার পরেই তো বাকি থাকে আসল কাজটি— বিবিমার থানে গিয়ে হাজত দেওয়া। সে কথায় আসছি।
প্রতিবেশী-মিলনের এ এক মাহেন্দ্রক্ষণ : ভাবা যায়, নিজেদের গ্রাম সংলগ্ন দু-তিনটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিচরণ এই সূত্রে! ওই যে সময়ে কুলানোর কথা বলা হচ্ছিল, তার অন্যতম এক কারণ হল পরস্পরের কুশল বিনিময়, খোঁজখবর ইত্যাদি। মাঙুনে দলের কারও কারও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব— ব্যক্তি, পরিবার বা পাড়াসূত্রে, যেমনই হোক— কোনও কোনও পাড়ায় থাকলে পর বাড়তি সময় সেখানে পারস্পরিক কুশল বিনিময়, গল্পগুজব, সংসার-পরিবার-পাড়ার খোঁজখবর। এ এক অনবদ্য প্রতিবেশী-সংযোগ! বিশেষত গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষেত্রে— ভাবলে ভাল লাগে বই-কি! ছোটবেলায় দেখেছি, কোনও কোনও বয়স্ক মহিলার ঘোমটা খসার ভয় থাকলেও, ঘরে ঘরে ঘোরা এবং খোঁজখবরে কার্পণ্য না থাকা। কোনও কোনও বাড়িতে শুধু মাঙন নিয়ে চলে গেলেই হবে না, সাদরে পেতে-দেওয়া ঝেঁদলা-মাদুরে একটু বসতে হবে। কত সংবাদ সংগ্রহ বা পরিবেশন! কার বাড়ির কে কেমন আছে, কার ছেলেমেয়ে কয়টি এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা-কাজকর্ম বা বিয়ে-থার খবর। শুধু ওই মাঙনকালীন সময়ে তা সীমাবদ্ধ থাকে না, বাড়িতে ফিরে সেসবের গল্পগাছা, আলাপ-আলোচনা— দীর্ঘ রেশ রেখে যায় তা। এতদঞ্চলের অনেক বিবাহিত মহিলার বাপের বাড়ির ও তার আশপাশের দু-একটি গ্রামের অনেকখানি স্মৃতি বিবাহ-পূর্ব তাদের মাঙনে-যাওয়ানির্ভরও।
মাঙনের কম-বেশি : পরিচিত মহলে মাঙন তুলনায় বেশি মেলে। আমার মা যেমন প্রায় প্রতি বছরই যেত মাঙনে, মাঙুনে দল বিশেষ করে চাইত মাকে, লাগোয়া ঘনশ্যামপুরে মায়ের বাপের বাড়ি এবং এ বাড়ি ও সে বাড়ি সূত্রে আরও একাধিক পাড়ায় মায়ের পরিচিতি। মায়ের দৌলতে মাঙন বেশি পাওয়া যেত বলে গল্প করত ঠাকুমা-জেঠিমা-কাকিমারা। প্রসঙ্গত, মাঙনের পরিমাণ অর্থাৎ মাঙন-সামগ্রী মেলার পরিমাণ এইরকম পরিচিতি, পথ হাঁটা, একটি পাড়া থেকে কয়টি দল বেরোলো এসবের উপর বেশ খানিক নির্ভর করে। সবাই যে খুব আদর করে মাঙন দেয় তা নয়, এই সময়টা একের পর এক দল ঢোকায় মনে মনে বিরক্তও হয় কেউ কেউ। অনেকের হয়তো আবার চাষ নেই, কেনা চাল। কারও কারও অবস্থা ভাল হলেও, কেবল সৌজন্য রক্ষা। অসৌজন্যও। মানসিকতা, বিশ্বাস ইত্যাদির ব্যাপার। কোনও কাজে ব্যস্ত বলে ঘুরে আসতে বলাও আছে। 'নয়াপয়সার দল' অর্থাৎ কেবল অল্পবয়সি মেয়েদের দেখলে মাঙন কম। কেউ কেউ আগত দলের পাড়া জেনে নিয়ে, তাদের পাড়া থেকে ইতিমধ্যে অন্য দল এসে থাকলে তা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না। মাঙন বেশি পাওয়ার জন্যে একটি দল দু-ভাগ হয়ে আলাদা আলাদাভাবে একই বাড়িতে মাঙন নিয়েও থাকে। দিনের শেষে একত্র করে বেচে, একসঙ্গে হাজত। একই পাড়ায় আলাদা আলাদা জ্ঞাতি-গোত্র থাকায় আলাদা দল বেরোনোও সম্ভব।
মাঙনে সব প্রতিবেশীই মান্য : এ মাঙনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সব রকম প্রতিবেশীর কাছ থেকে মাঙন নেওয়া। সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের— যেমন কাওরা, মুচি প্রভৃতি শ্রেণির বাড়ি থেকেও মাঙন নিতে হয়, নেওয়া হয়। মুসলমানের বাড়ি থেকেও অন্তত এক ঘর থেকে, বেশি হলে তো ভালই। এখানে পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় মানুষরা যেমন দল বেঁধে মাঙনে বেরোয় তেমনই কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, নাপিতরাও বেরোয় এবং সমাজের সব রকম বর্ণ বা শ্রেণির বাড়ি থেকে মাঙন সংগ্রহ করা হয়, অর্থাৎ কোনো ভেদাভেদ রাখার নিয়ম নেই। পির গাজি প্রভৃতি দেবদেবী তো হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়সাধক দেবতা হিসাবে পরিগণিত, মাঙন সংগ্রহের এই ধারা বা ধরন যেন তারই পরিপূরক।
অল্পবয়সের হুজুগ : অল্পবয়সি মেয়েরা অনেকেই মাঙনে যায় হুজুগে। অনেকসময় খানিক মাঙনের পরে বা মাঝ-মাঙনে হয়তো তাদের কেউ বা কেউ কেউ আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, তখন তাদের বাড়ি যেতে বলা হয় বা পরিচিত কাউকে দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়, কিন্তু নির্দেশ থাকে বাড়িতে না ঢুকে বাইরে খেলাধুলা করে সময় কাটানোর। বাচ্চা মেয়েরা উপবাস অত মানে না সবসময় কঠোরভাবে, তবে ভাতটা খায় না। মাঙুনেরা মাঙন সেরে এলে এরা তাদের সঙ্গী হয় এবং হাজতশেষে যথাবিধি যে-যার বাড়িতে প্রবেশ করে।
মাঙনে মানা : কারও বাড়িতে অশৌচ থাকলে বা 'মায়ের দয়া' অর্থাৎ হাম-বসন্ত হলে তাঁদের জ্ঞাতিগোত্রের মানুষরা মাঙনে বেরোয় না বা মাঙন দেয়ও না। মাসিক হলে মাঙনে বেরোয় না মহিলারা।
হিন্দু-মুসলমান ধর্মসমন্বয়ের বাস্তবচিত্র : বিবিমার এই হাজতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বলতে, যে ফকির হাজতের বন্দোবস্ত করেন তিনি বরাবরই মুসলমানদের মধ্যে কেউ একজন হন। তাঁকে হাজতের সময় নামাজ পড়তে হয়। এখানে পুরোহিত দিয়ে কোনোদিনই পুজো হয়নি। তার বাইরে, মুসলমানরা মাঙন করে হাজত দেয় না। কারও কারও মানসিক থাকলে, চিড়ে-মুড়কি-বাতাসা-সন্দেশ ইত্যাদির মালসা দেয়। প্রসাদ দেওয়ার সময় সংলগ্ন মুসলমান পাড়া থেকে অবশ্য অনেকেই তা নিতে হাজির হয়। একদা সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের থেকে নানান কারণে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল যারা, শিকড়বাকড়ের টান যেমন পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা, মুসলমান হওয়ায় মূর্তিপূজার বিষয়ে আগ্রহহীনতাও অস্বাভাবিক নয়।
মাঙন থেকে ফেরা : দিনশেষে মাঙুনীরা পাড়ায় ফেরে। প্রাপ্ত ধান, চাল, আলু ইত্যাদি কেউ কেউ কিনে নেয়। সেই পয়সা এবং মাঙনে প্রাপ্ত পয়সায় গোকর্ণী বাজার থেকে কেনা হয় হাজতের সামগ্রী। মূলত চিড়ে-মুড়কি-বাতাসা-সন্দেশ-পাটালি। এই হাজত-অভিমুখী দলটা তুলনায় ভারী হয়। ছোট-আমরাও সাগ্রহে সঙ্গী হয়েছি একাধিক বছর। এই সময় তো আর ছেলে বা মেয়ের ব্যাপার নেই! বলা বাহুল্য, দু-একটি নাছোড় ছোট ছেলের ব্যতিক্রম বাদ দিলে, মাঙনে মহিলা বা মেয়েরাই প্রধান। বাজার থেকে আমরা এবার পৌঁছাই অদূরের বনবিবি বা বিবিমার থানে।
থানে হাজত : থানে এই পক্ষকাল বিকেল থেকে উপস্থিত থাকেন ফকির। এক-একটি দল এলে, তিনি হাজতের বন্দোবস্ত করেন। সঙ্গে নিয়ে-যাওয়া সাতটি আঁচ কলাপাতা ধুয়ে, পরপর পেতে দিয়ে তার উপর রাখা হয় হাজত-সামগ্রী। এখানে শিরনি দেওয়ার চল নেই কোনোকালেই। তা হাজতের সামগ্রী আগে রাখা হত খোলা আকাশের নিচে ছোট-বড় ও গুঁড়ো ইটের অনুচ্চ লম্বাটে আয়তকার জায়গায়। এখন সেখানে ইট-বালি-সিমেন্টের বাঁধানো বেদি এবং তার উপর পাশাপাশি সিমেন্টের সাতটি অনুচ্চ থাম সাত বিবির। মাথার উপর চালা, চারদিক খোলা। গোছগাছ করে দেওয়া হয়ে গেলে, ফকির নামাজ শুরু করেন। দোয়া মাঙেন। নামাজ শেষে মাঙুনীরা তাদের খড় বা কুটোর মালা খুলে ফেলে। তারপর হাজতের জিনিস এবং আলাদা-করে-রাখা মিস্ত্রিপাড়ায় হাজত দেওয়ার চিড়ে-মুড়কি ইত্যাদি সামগ্রী নিয়ে বাড়ির পথে! বড়দের থেকে শুনে শুনে আমরাও হাজতের জিনিসই বলতাম বেশি, প্রসাদ সেইভাবে কোনোদিন বলেছি বলে মনে হয় না। অন্যান্য পূজার ক্ষেত্রেও, আমরা পুজোর জিনিসই বলেছি বেশি, প্রসাদ আর বলেছি কই! যাই হোক, দত্তদের পুকুরের পাশ দিয়ে এবার একটু পুবে গিয়ে বাবাঠাকুরতলার উলটো দিকের পথে অর্থাৎ দক্ষিণে একটু হেঁটে দলটা পৌঁছাবে মিস্ত্রিপাড়ার অদূরে অবস্থিত বিবিমার থানে।
পাড়াপার্শ্বস্থ বিবিমার থানে হাজত : এখানে আমরা বিবিমার মূর্তিই দেখে এসেছি। মৃন্ময়, পাশাপাশি সাত বোন। আগে মাটির দেওয়াল ও টালির ছাওন ছিল, এখন ছাদ দেওয়া পাকা ছোট্ট থান। নিজেরাই এখানে হাজত দেওয়ার চল, ফকির বা কোনো পুরোহিতের ভূমিকা থাকে না। এটিই তো আদতে একদা লৌকিক দেবদেবীর পূজার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, পরে দেখা দেয় পুরোহিতপ্রাধান্য। এখানে হাজতের পর মহানন্দে পাড়ায় ফেরা। মহানন্দ, কেন-না এবার শিগগিরই খেতে পাব আমরা হাজতের জিনিস!
জ্যোৎস্না-খামারে বিলি হাজতের জিনিস : হাজতের দলটা এসে বসবে আমাদের খামারে। সঙ্গে গেলে তো কথাই নেই, যারা যায়নি এমন ছেলেমেয়ে, বউ-ঝি, বয়স্করা কেউ কেউ এসে হাজির হবে সেখানে। উপস্থিত মাঙুনে বা মাঙুনীদের মধ্যে হাজতের জিনিস ভাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হবে তা উপস্থিত সবাইকে। মাঙুনেরা ওখানে বসেই খাওয়া শেষ করবে। শুক্লপক্ষ হওয়ায়, বেশির ভাগ সময়ে চাঁদের আলোয়। তার পরে যে-যার বাড়ি ঢুকতে পারবে। আমাদের তরুণ বয়স থেকেই অবশ্য বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাওয়ার চল শুরু হয়। সারাদিনের ধকলের পর দীর্ঘক্ষণ বাইরে বসে হাজতের শুকনো জিনিস চিবোনো কষ্টকর।
পরিবারের সবাই ঠিকঠাক আছে তো : মাঙুনেরা হুট করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে না। বাড়ির লোকেরা সদর দরজার সামনে কুলগাছের ছোট্ট একটি ডাল, পেতলের ঘটি, জগ বা গ্লাসে জল এবং একটি প্রদীপ জ্বেলে রেখে দেয়। সদর দরজার বাইরে থেকে মাঙুনে ও বাড়ির ভিতর থেকে কারও কথোপকথন হবে এইরকম :
মাঙুনে : দৈরে কেন কাঁটা?
বাড়ির লোক : গিন্নি গেছে বনভোজনে ছেলেরা সব লোহার ভাঁটা।
মাঙুনে : দৈরে কেন পেতল?
বাড়ির লোক : গিন্নি গেছে বনভোজনে সবাই আছে শেতল।
মাঙুনে : দৈরে কেন আলো?
বাড়ির লোক : গিন্নি গেছে বনভোজনে সবাই আছে ভাল।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে অনেক সময় কেবল 'ছেলেরা সব লোহার ভাঁটা' বা 'ছেলেরা লহার ভাঁটা'ও বলা হয়। আমরা জানি, কেবল ভাঁটার মতন চোখ নয়, কারও 'গাঁট্টাগোট্টা' চেহারা হলে পাড়া-গাঁয়ে ভাঁটার মতন শরীর বলার চল আছে। প্রশ্ন ও উত্তর শুনিয়েছেন মাঙনে-না-যাওয়া মায়া কাকিমা (পুরকাইত) ও এখনও-যেতে-থাকা কল্পনা কাকিমা (পুরকাইত); পেতল পর্বটি দীর্ঘদিনের মাঙুনে প্রয়াত আমার মা রেণুকার কাছ থেকে শুনে শুনে মনে রেখেছে আমার স্ত্রী সরমা। কল্পনা কাকিমা জানালেন যে সদর দরজার সামনে রাখা হয় কুলকাঁটা আর ঘরের দরজায় রাখা হয় প্রদীপ। যাদের সদর দরজা নেই, দুটিই রাখা হয় ঘরের দরজায়। সংক্ষেপ করার জন্যে তিনটি জিনিসই সদর দরজার সামনে রাখা হয়ে থাকে, বা ঘরের দরজায়।
এ গ্রামের জাতক (পরবর্তীকালে বারুইপুরের বাসিন্দা) মান্য সাহিত্যিক তথা দেবযান-সম্পাদক প্রয়াত সন্তোষকুমার দত্ত (১৯৩০—২০১৭) তাঁর "তরুণ বয়সে দেখা বিনিমা'র মাঙনের একটি অনুষ্ঠান"-এর কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন :
"মাঘ, ফাল্গুন মাসের কোন এক সময়ে পাড়ার বয়স্কা মহিলাদের গ্রামের বাড়ি বাড়ি মাঙন, সন্ধ্যায় বিবিমা'র থানে মৌলবীকে দিয়ে পূজার জিনিসপত্র অর্পণ। পূজা শেষে পাড়ার শান-বাঁধানো ঘাটে অথবা কোন গাছ তলায় বসে মহিলাদের দুধ-মুড়ি-কলা-মিষ্টি দিয়ে ফলার ভক্ষণ। সেই সময় পারস্পরিক খাদ্যের আদান-প্রদান। ভোজন শেষে ব্রতধারিণীদের দলবদ্ধভাবে পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে উপস্থিতি। সেই সব বাড়ির দরজায় রাখা হতো একটা বড় ঘটিতে জল, কুলগাছের এক টুকরো ডাল এবং একটি প্রজ্জ্বলন্ত প্রদীপ। মহিলাদের মধ্যে একজন প্রশ্নকর্ত্রী এবং তার উত্তরদাতা সেই বাড়ির কোন এক ছেলে বা মেয়ে।" এরপর প্রশ্ন ও উত্তর দিয়েছেন তিনি :
'"দোরে কেন আলো — ?
গিন্নি গেছে বনভোজনে সবাই আছে ভালো।
দোরে কেন পেতল — ?
গিন্নি গেছে বনভোজনে সবাই আছে শেতল।
দোরে কেন কাঁটা — ?
গিন্নি গেছে বনভোজনে সবাই লোহার ভাঁটা।"'
অর্থ দিয়েছেন এই বল, "শেতল অর্থে সংসারে শান্তি বিরাজমান এবং 'লোহার ভাঁটা' অর্থে পরিবারের সকলে সুস্থ।" 'এই পরিক্রমার পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি' জানিয়ে, 'তাৎপর্য' হিসাবে তিনি লিখেছেন, 'দানে ও গ্রহণে চিত্তের প্রসারতাই এর অন্যতম দিক। লোকসংস্কৃতির এই সুন্দর অনুষ্ঠান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে এক সম্প্রীতির জগতের সন্ধান দেয় — যে সম্প্রীতি একালে — অপ্রিয় হলেও সত্য — ক্রমশ অস্তাচলগামী।'
গ্রামীণ একেবারে তৃণমূল স্তরে বিভিন্ন বিষয়ে শব্দসংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণের মান্য এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বিমলেন্দু হালদার ছড়াটিকে দিয়েছেন এইভাবে :
'ঘরে কেন রে আলো?
গিন্নি গেছে বিলমাঙনে
সবাই আছে ভালো।।
পথে কেন রে কাঁটা?
ছেলেরা সব খেলা করতেচে
সবাই নোয়ার ভ্যাঁটা।
অথবা,
ছেলেরা সব নোয়ার ভাঁটা।।'
এটিকে তিনি 'উৎসবের ছড়া' বলে উল্লেখ করে লিখেছেন, "দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বিবিমার পুজো, পীরের পুজো 'জাত' ইত্যাদিতে ভক্তরা মাঙন করে। সারাদিন উপোস করে, মানুষের দোরে দোরে মাঙন করে চাল পয়সা পায়। চালগুলো বিক্রি করে দেয়। তারপর সমস্ত পয়সা নিয়ে হাজতের প্রসাদ কেনে। পীরতলাতে পীরের থানে সিন্নি দেয়। সন্ধ্যাবেলা যখন ব্রতীরা বাড়ি ফেরে তখন এই ছড়া বলে। একজন প্রশ্ন করে অন্য একজন উত্তর দেয়। সারাদিনের শেষে পুজো হয়ে গেলে বাড়ি ফেরার সময় গৃহিণীর মনে শঙ্কা জাগে— সবাই ভালো আছে তো? ছেলেরা কেমন আছে? দূর থেকে আলো দেখে, পথে কাঁটা ছড়ানো দেখে শঙ্কা দূর হয়। এগুলি ভালো থাকার সংকেত বা চিহ্ন।" 'বিল মাঙন' বলতে তিনি 'বড় ধরনের মাঙন' বলেছেন, কিন্তু 'বিল' সচরাচর 'বড়' অর্থ করে বলে মনে হয় না। বিল পুকুর, বিল মাছ উভয়েরই চল আছে। বিল পুকুর যখন বলা হচ্ছে, মূলত বিল মাছের পুকুরই বোঝায় তা। অর্থাৎ বিলের মাছ— মূলত বিল বা জলা জমি, পুকুর, ডোবা, খালের মাছ বোঝায়। এর বিপরীতে সচরাচর চল আছে পোনা পুকুর বলার— রুই-মৃগেল-কাতলা-কালবউস প্রভৃতি মাছের পুকুর। বিল মাছ বলতে বরং চুনোচানা ও 'ডেঙা' দিশি খুচরো মাছের দিকেই ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ 'রাঘব বোয়াল' নয়।
ব্যবস্থাপক, ফকির ও পাঁচালি গায়ক : বর্তমানে এই বিবিমার থানটির ব্যবস্থাপনা ও সংলগ্ন স্থানের পরিসর বৃদ্ধির দায়িত্বে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ গায়েন, নরেন্দ্রনাথ বায়েন ও কানাইলাল হালদার। বর্তমান ফকির আয়েন মিস্ত্রি (পিতা আমিন মিস্ত্রি)। পূর্বে দীর্ঘদিন ছিলেন ছোপান ফকির। মাঝে কিছুদিন ছিলেন ফয়জদ্দি ফকির। প্রতি বৎসরই এখানে পুর্ণিমায় শেষ হাজতের দিন বিবিমার গান হয়। গত দু-বছর বিবিমার গান গাইছেন দেওয়ানগঞ্জের গোবিন্দ শিকারী।
সুজিত কুমার মণ্ডল গোপেন্দ্রকৃষ্ণের মত প্রসঙ্গে লিখেছেন, "প্রথমত, 'মুসলমান-প্রধান অঞ্চল' ও 'হিন্দুপ্রধান অঞ্চল'-এর ধারণাটি স্বচ্ছ নয়। পূজা-হাজোত যদি ব্যক্তি বা পরিবারনির্ভর হয় তা হলে অঞ্চলভিত্তিক ভাগের ধারণা টেঁকে না। দ্বিতীয়ত, এই ধর্মভিত্তিক বিভাজন ও তার পাশাপাশি ধর্মসমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে বনবিবিকে দেখার তত্ত্ব পরস্পরবিরোধী। তৃতীয়ত, আমাদের পর্যবেক্ষণে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মূর্তি পূজার বদলে হাজোত দেওয়ার প্রবণতা বেশি। মানত বা ছলন পূজায় সে ক্ষেত্রে আলোচ্য পালাগানগুলির বদলে গাজির গান আচার ও অনুষ্ঠান হিসেবে অভিনীত হতে বেশি দেখা যায়।"
একদা বাধ্যত প্রাকৃতিক উপাদান, কল্পিত দেবদেবী, জাদু, মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদির উপর একান্ত নির্ভরশীল মানুষ আজ কেউ কেউ এসবে তেমন আস্থাশীল নয়, কেউ কেউ আধুনিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে যায় এসবও। আধুনিক চিকিৎসা যেখানে আজও ভাল করে পৌঁছায়নি, সেখানে আজও, অন্তত প্রাথমিকভাবে এসবের উপর নির্ভর করে অনেক মানুষ, চিকিৎসার সামর্থ্যে না কুলালে বা অচিকিৎস্য হয়ে পড়লে শেষ আশ্রয় হিসাবেও অনেকে আস্থা রাখতে চায় এসবে। অনেকসময় আশায় থাকে অত্যাশ্চর্য বা অলৌকিক কিছু ঘটার। প্রাকৃতিক উপাদান অবশ্য স্বতন্ত্র্য কারণ তার দ্রব্যগুণ অনেকসময়ই প্রত্যক্ষ্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানও তার থেকে রসদ সংগ্রহ করে।
যে-যার নিজস্ব বিশ্বাস ইত্যাদির ব্যাপার বাদ দিলেও, দীর্ঘ প্রথা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে একইসঙ্গে শিকড়ের স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক কিছু কিছু উপযোগিতার প্রবাহ চলতে থাকে কাল থেকে কালান্তরে। লৌকিক দেবী বিবিমার থানে নানান বিপদ-আপদ, রোগ-শোক-ব্যাধি ইত্যাদির জন্যেই পুজো-হাজত দিয়ে বা মুদো বেঁধে রক্ষা পাক আর নাই পাক, মানুষের সঙ্গে মানুষের বাৎসরিক এই সাক্ষাৎ, সংযোগ, মেলামেশা, পারস্পরিক আদানপ্রদানের গুরুত্ব কম নয়, বিশেষ করে ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক-আত্মসর্বস্ব হয়ে-ওঠার এই দিনে।
=====================
উল্লেখসূত্র ও ঋণস্বীকার :
কোনও কোনও তথ্য প্রাপ্তি এবং যাচাইয়ে যাঁদের কাছে ঋণী - শান্তিবালা পুরকাইত, শৈলেন্দ্রনাথ পুরকাইত, কল্পনা পুরকাইত, মায়া পুরকাইত, সরমা পুরকাইত, রবীন্দ্রনাথ গায়েন প্রমুখ।
লোকসংস্কৃতি ও স্বনির্বাচিত বাংলা কথাসাহিত্য — সন্তোষকুমার দত্ত, বঙ্গবাতায়ন, ১৫ আগস্ট ২০০৭
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কথ্যভাষা ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ (দ্বিতীয় খণ্ড) — বিমলেন্দু হালদার, প্রিয়নাথ প্রকাশনী, দ্বিতীয় প্রকাশ — বইমেলা, জানুয়ারি ২০১৯
বাংলার লৌকিক দেবতা— গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, প্রথম প্রকাশ— নভেম্বর ১৯৬৬, পরিবর্ধিত প্রথম দে'জ সংস্করণ— এপ্রিল ১৯৭৮, চতুর্থ সংস্করণ— জানুয়ারি ২০০৮
বনবিবির পালা— সম্পাদনা সুজিত কুমার মণ্ডল, গাঙচিল, মার্চ ২০১০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন