Featured Post
প্রবন্ধ ।। বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ ।। কেয়া মাইতি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ
কেয়া মাইতি
বিশেষ বিশেষ ঋতুর সঙ্গে সাজুজ্য রেখে বাঙালিরা মেতে ওঠে নানা ঋতু উৎসবে। বছরের শুরুতেই নববর্ষ উদযাপন হয় নানা রকম ভাবে বাংলার মাটি বাংলার হাওয়া, বাংলার ভাষা বাংলার গান, বাংলার উৎসবে যেন মোতে ওঠে বাঙালীর প্রাণ ---
মানব হৃদয় চির আনন্দ পিপাষু। রবি ঠাকুর লিখেছেন—” আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে”। বৈশাখের প্রথম দিন থেকে চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত্য ঊৎসবের ঘনঘটায় বাঙালীর ‘বারো মাসে তের পার্বণ। উৎসবের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গন্ডী থেকে মিলনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হয়।
বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম সামাজিক উৎসব। পয়লা বৈশাখে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শুভ হালখাতার আয়োজন করে তারা। ভক্তা এবং গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করানো শুভ হালখাতার অন্যতম লোকাচার। নববর্ষের শোভাযাত্রা, মেলা, হালখাতা,পান্তা ভাত খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাক্য হল ‘শুভ নববর্ষ’।
বাংলার ইতিহাসে নবান্ন ও পৌষ পার্বণ দুটি উল্লেখযোগ্য
পার্বণ।
“ জননী তোমার শুভ আহ্বান গেয়েছে নিখিল ভুবনে, নতুন ধানে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে”--- নবান্ন উৎসবের কথা কবির কলমে এভাবেই ব্যপ্ত হয়েছে। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্নের উৎসব। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় –“নিউ রাইস ফেস্টিভ্যাল” গ্রাম বাংলার লোকেদের এক প্রাণীর উৎসব ‘নবান্ন।‘ এই নবান্ন শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। এই. নবান্ন একটি ঐতিহ্যবাহী সস্য উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণে নতুন ধান পাকার পর এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।এর সঙ্গে সম্প্রীতি ও সংস্কৃতি মিশে আছে। বাঙালীর জীবনের একটি নতুন ঋতু কেন্দ্রিক উৎসব। হেমন্তের নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়।
প্রধানত বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। অতীতে পৌষ সংক্রান্তির দিন নবান্ন উৎসব পালিত হতো। যদিও এই উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন উৎসব। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষদের কাছে অন্নের প্রার্থনা করা হয়। তাদের আশীর্বাদে অন্ন উৎপাদিত হয়। হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী এই অন্ন তাদের পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে তারপর এই অনুষ্ঠান হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন না করে নবান্ন অনুষ্ঠান করলে পাপের ভাগী হতে হয়। তাই কাককে নিবেদন করে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এটি একটি বিশেষ লৌকিক পদ্ধতি। কাকের মাধ্যমে এই অন্ন পূর্বপুরুষদের মৃত আত্মাদের কাছে পৌঁছায়। এই নৈবেদ্যকে ‘কাকবলী’ বলা হয়। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু।
নবান্ন হলো হেমন্ত ঋতুর এক খুশির বার্তা। গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে ধান আর ধান ভাঙ্গার ঢেঁকির আওয়াজে এক সময় মুখরিত হয়ে থাকতো গ্রাম বাংলার পরিবেশ। নবান্নের প্রাতে নতুন ধুতি পরে মাঠে গিয়ে ধান কাটা, ঢেঁকিতে সেই ধানকোটা চালের মাধ্যমে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। কৃষকের ঘর ভরে ওঠে গোলা ভরা ধানে। নতুন ধানের চাল থেকে তৈরি হয় পিঠে পায়েস , হরেক রকমের খাবারের আয়োজন। পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে তা ভাগাভাগী করে নেয়। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের গন্ধে ম ম করতে থাকে।
কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় বলেছেন---“ আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ি নদীর তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে”।
এই ঐতিহ্যপূর্ণ নবান্ন উৎসব প্রায় বিলুপ্ত। বিভিন্ন রাইস মিল, উন্নত ধান ঝাড়ার মেশিন আর আধুনিক যন্ত্রের আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঢেকির আওয়াজ। তবু গ্রাম বাংলার মানুষের মুখে একটা কথাই ভেসে আসে— “ এসো মিলি সবে নবান্ন উৎসবে”।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বীরভূম মুর্শিদাবাদে এই নবান্ন উৎসব পালিত হয় আড়ম্বরের সঙ্গে।নানারকম অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন ঐতিহ্যময় উৎসবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নাচ, বাউল সঙ্গীত, লাঠিখেলা, লোকসংগীত প্রভৃতি নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশের ঢাকা শহরেও এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। বিভিন্ন ঐতিহ্যপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-“ কান্নাহাসির দোলানো পৌষ ফাগুনের মেলা, তারই মধ্যো চিরজীবন রইলো গানের মালা”। লোককথা অনুযায়ী মকর সংক্রান্তির দিন মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। এইদিন দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ঐদিন দেবতাগণ অশুরদের মুন্ডু কেটে মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলে। আক্ষরিক অর্থে ঐদিন সূর্য কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে পদার্পণ করে তাই এই দিনটাকে ‘মকর সংক্রান্তি’ বলা হয়। এই দিনে প্রাচীন হিন্দুরা নতুন ধানের চালের পিঠা বাস্তু দেবতা বা পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করত। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান ও আয়োজন করে থাকে তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো অন্যতম। ভারতে বীরভূম জেলার কেন্দুলী গ্রামে ওই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান ওই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। এই দিন দক্ষিণ 24 পরগনার সাগর দ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পূণ্য স্নান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা ‘গঙ্গাসাগ মেলা’ নামে পরিচিত।ঐ দিন বাড়িঘর আলপনা দিয়ে সাজিয়ে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।
বাড়িতে রাখা নতুন ধানের শীষ দিয়ে বিনুনি তৈরি করে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বাঁধবার রীতি রয়েছে। যা আউনি বাউনি নামে পরিচিত। পিঠে পুলি মানে মা দিদিমার হাতের স্বাদ ও স্নেহ ভালবাসার জাদু সত্যিই অমলিন।এছাড়াও বিভিন্ন মেলা হয়, মেলার আনাচে-কানাচে অন্যতম সেরা লোকমাধ্যম টুসু ও ভাদুর গানের আসর বসে। সব মিলিয়ে এই সংক্রান্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাঙালির সংস্কৃতি যা বাংলার ‘পৌষ পার্বণ’ নামে পালিত হয়।
পৌষমেলা--
জানা যায়, বারো শ পঞ্চাশ সালের ৭ই পৌষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামচন্দ্রবিদ্যা বাগিস এর কাছে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে উৎসব ও মেলার ভাবনা ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। পরে ১৩০২ বঙ্গাব্দে ৭ই পৌষ ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে ডিসেম্বর এই মেলার সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর থেকেই হয়ে এসেছে এই পৌষমেলা শান্তিনিকেতনে। প্রথম পৌষ মেলা হয়েছিল উপাসনা গৃহের উত্তর দিকের মাঠে। আস্তে আস্তে মেলা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিধি বাড়ায় ভুবন ডাঙার পূর্বপল্লী মাঠে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান আসর বসে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশের মাঠে। এখানে ব্রহ্ম সাধনার মাধ্যমে মেলা শুরু হয়। আশ্রমিকদের মতে এটা পৌষ উৎসবের সপ্তমী। বক্তৃতা স্মৃতি তর্পন যেমন চলে তেমনি চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভিন্নরাজ্য ও বাংলাদেশের শিল্পীরা থাকে। থাকে বাউল গান ও ফকিরের গান এই মেলার বিশেষত্ব তার হস্তশিল্প ও গ্রামীণ সৃষ্টিতে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে প্রতিটি দ্রব্য বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেনাবেচা চলে প্রায় পক্ষকাল ধরে। বহু ভিনদেশী পর্যটক মেলা উপলক্ষে অস্থায়ী বাসাও বাঁধেন।
বাঙালির উৎসবের মধ্যে রাস উৎসব অন্যতম। মানব রূপী
ভগবান বিষ্ণুর সর্বোত্তম লীলা ছিল রাসলীলা। কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে পালিত
হয় রাসলীলা। ‘রাস’ হচ্ছে এখানে স্বাদ,নির্যাস, আনন্দ ,আহ্লাদ ও অনন্ত ব্রম্ভ
কে বোঝানো হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরেই এই রাস উৎসব পালিত হয়। তাই
কার্তিক পূর্ণিমার অপর নাম রাস পূর্ণিমা। বৈষ্ণবদের কাছে রাস হল ভগবান ও ভক্তির
একটি মিলন উৎসব।
আবার রাস উৎসবের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা হল—শ্রীকৃষ্ণ
নরকাসুর কে বধ করার পর নরকাসুর দ্বারা অপর্হিত যাদব কুলের রমণীদের তিনি
রক্ষা করেছিলেন। এইসব অপহৃত নারীদের তিনি সামাজিক স্বীকৃতি দেন। তাই
রাস পূর্ণিমার দিনটি এই ঐতিহাসিক কারণেও উদযাপিত হয়। হর্ষচরিত এর টিকাকার
শঙ্করের মতে রাস হল এক ধরনের বৃত্তাকার নাচ, যেটি মূলত ৮,১৬,৩২
জন জন সম্মিলিত ভাবে উদযাপন করেন। পদ্মপুরাণে সারদ রাসও বাসন্তী রাসের
উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীধর স্বামী বলেছেন বহু নর্তকীযুক্ত নাচ বিশেষত যার
নাম রাস। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাই রাস
উৎসবের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করেন। ভারতবর্ষের উত্তরপ্রদেশের মথুরাও
বৃন্দাবনে, উড়িষ্যায় রাস উৎসব পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে ও শান্তিপুরে
ও উৎসব পালিত হয়।
আরো একটি পার্বনের কথা আমরা বলব চড়ক পূজা বা চড়কের
মেলা। চড়ক পূজা হলো বাঙ্গালী হিন্দু ধর্মের একটি লোকো
উৎসব। চৈত্র মাসের শেষে সাধারণত এই পূজা পালিত হয়। জনশ্রুতি আছে ১৪৮৫
খ্রিস্টাব্দে সুরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই পূজার প্রচলন করেন। তবে এই পূজা
কখনো রাজাদের ছিল না। সমাজের নিচু শ্রেণির লোকেদের এই পূজা। তাই
কোন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হতো না এই পূজায়।
শিব আরাধনাই এই পূজার মূল কেন্দ্রবিন্দু। শিবকে
সন্তুষ্ট করার জন্য চৈত্র মাসের শেষে কোথাও এক মাস, কোথাও সাত দিন, কোথাও তিন দিন
যাবত হবিস্যির ভাত খেয়ে তারা ব্রত পালন করে। বেল কাষ্ঠ নির্মিত
মহাদেব কে স্নান করিয়ে পিভিসিন্ধু ও সরিষার তেল মাখিয়ে তারপর তাতে লালসালু
দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে তাতে বেলপাতা ও আকন্দের মালা দিয়ে ভালো
করে সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, তরকারি, ও প্রণামি টাকা সংগ্রহ করে।
চড়ক গাছের ক্ষেত্রেও চড়ক গাছটিকে আগের দিন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা
হয় তারপর সেই গাছটিকে মাটিতে পুঁতে তার গোড়ায় একটি পাত্রে শিবলিঙ্গ
রেখে তার পূজা অর্চনা করা হয়।
এই পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল কুমির পূজা, জ্বলন্ত
আগুনের উপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটা ও ছুরির উপর দিয়ে লাফানো, মানফোঁড়া,
শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, চড়ক গাছে দোলা, খেজুর ভাঙ্গা। চরক গাছে সন্ন্যাসীকে
লোহার হুক দিয়ে বিদ্ধ করে তাকে ঘোরানো হয়। কোথাও কোথাও আবার সন্ন্যাসীর
পায়ে, জিভে, হাতে ও শরীরের অন্যান্য অংশে বানশালাকা বিদ্ধ করা হয়।
১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই কঠিন নিয়ম বন্ধ করলেও আজও কোথাও
কোথাও এই নিয়ম অনুযায়ী চড়ক উৎসব পালিত হয়।
জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে জামাইষষ্ঠী অনুষ্ঠিত
হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন উপকরণ লাগে ,সেগুলি হল আম্র পল্লব, তালপাতার
পাখা, ধানদূর্বা, নানারকমের ফল, ফুল, বেলপাতা ,সাথে সাদা সুতো,ও
হলুদ। জামাই এলে তাকে বসিয়ে শাশুড়ি মা তার হাতে সুতো বেঁধে দিয়ে পাখার
হাওয়া করেন । তিনবার ষাট ষাট ষাট উচ্চারণ করেন এবং সাথে ধান ও দুর্বা
দিয়ে আশীর্বাদ করেন। এবং নতুন জামা কাপড় বিনিময় হয়।
একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো রথযাত্রা। এটি একটি প্রধান
ধর্মীয় অনুষ্ঠান। রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এবং দেশের
সমস্ত মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি সর্বসমক্ষে বের করা
হয়। তারপর তিনটি সুসজ্জিত রথে বসিয়ে পূজো করা হয়।
তারপর রথ টানা হয় পুজো করার পর। পুরীতে প্রতিবছর লক্ষাধিক দর্শকের
সমাবেশ হয়। দেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ
মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদনীপুরের মহিষাদলে, হুগলির মাহেশের রথ,
কলকাতা এবং বাংলাদেশের ধামড়ার রথ, ইসকনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য পূজা মনসা পূজা। মনসা সাপের
দেবী। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পুরান মতে মনসা দেবীর পিতা
শিব এবং স্বামী জড়ৎকারু। সাধারনত মনসার মূর্তি পূজো হয় না। সিজ
বৃক্ষের শাখায় ও ঘটে সর্প অঙ্কিত করে ঝাপিতে মনসার পূজো করা হয়। কোথাও
কোথাও মনসার মূর্তিও পূজিত হয়।I
জন্মাষ্টমী----
হিন্দু পঞ্জিকামতে সৌরভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের
অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয় তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। পার্বণের
মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনটি পালিত হয়।। জন্মাষ্টমীর রেস বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বরকা
ছাড়িয়ে আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে পড়েছে। পূজা পার্বণ এর সঙ্গে রয়েছে নানা আচার
অনুষ্ঠান এবং লোকাচার। যেমন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, নাড়ীকাটা ইত্যাদি পূজা
শেষ হয় গভীর রাতে। হিন্দু পঞ্জিকামতে সৌরভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী
তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয় তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। পার্বণের
মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনটি পালিত হয়।। জন্মাষ্টমীর রেস বৃন্দাবন, মথুরা, দ্বরকা
ছাড়িয়ে আসমুদ্র হিমাচলে ছড়িয়ে পড়েছে। পূজা পার্বণ এর সঙ্গে রয়েছে নানা আচার
অনুষ্ঠান এবং লোকাচার। যেমন শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, নাড়ীকাটা ইত্যাদি পূজা
শেষ হয় গভীর রাতে। জন্মাষ্টমীর বিশেষ ভোগে থাকে- তালের বড়া লুচি
সুজি, পায়েস, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি। পরের দিন সারম্বরে পালিত হয় নান্দোৎসব।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সারাদিন নাম সংকীর্তন, রুপোর তৈরি বিভিন্ন রকম খেলনা দেয়া
হয়। 1008 টি তুলসী পাতা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।
বিশ্বকর্মা পূজা—
ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মার পূজা
করা হয়। শিল্পী বিশ্বকর্মার আশীষ কামনায় এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তার আকৃতি অনেকটা
কার্তিকের মত। বিশ্বকর্মাকে পৃথিবীর সৃষ্টি কর্তা রূপে পূজা করা হয়। যাঁরা
শিল্পকর্মে পারদর্শিতা লাভ করতে চান তারা বিশ্বকর্মার অনুগ্রহ কামনা করেন। কথিত আছে যে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরও বিশ্বকর্মা
নির্মাণ করেন।
দুর্গা পূজা----
দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনে একটি শ্রেষ্ঠ পূজা। আশ্বিন
মাসের শুক্লপক্ষে দূর্গা পূজা করা হয়। এটি শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দশম থেকে দ্বাদশ দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত
হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী ,মহা অষ্টমী, মহা নবমী
ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যা টির নাম মহালয়া।
দিনটিতে হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দেবিপক্ষের শেষ তিনটি হলো কোজাগরি পূর্ণিমা। দুর্গা পৌরাণিক দেবী। তিনি আদ্যা শক্তি মহামায়া,
দশভূজা, সিংহবাহিনী, শিবানী, ভবানী ইত্যাদি নানা নামে অভিনীত। দুর্গা
‘দুর্গম’ নামের দ্বৈত্যকে বধ করেন বলে তাঁর নাম দুর্গা। জীবের দুর্গতি নাশ করেন
বলেও তার নাম দুর্গা।
ব্রহ্মার বলে অবাধ্য মহিষাসুর নামে এক দৈত্য স্বর্গরাজ্য
দখল করলে সর্বহারা দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণুর নির্দেশে
সকল দেবতার তেজপুঞ্জ থেকে যে দেবী আবির্ভূত হন তার নাম দুর্গা। দেবতাদের
শক্তিতে তিনি শক্তিময়ী। তার দশটি হাতে তিনি দশটি অস্ত্র নিয়ে মহিষাসুর বধ
করেন তাই তিনি মহিষাসুরমর্দিনী।দূর্গাপূজার পরেই আসে লক্ষ্মীপুজো । বাঙালির ঘরে
ঘরে লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে। এটি সর্বজনবিদিত পূজো। এই দিন সারা গৃহে আলপনা
দেয়া হয়। লক্ষীর বেদিতে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মী দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে ফুল,
ফুলমালা, ধূপ, চন্দনসহ ঘট প্রতিস্থাপন করে ধান্য, দুর্বা, বেল পাতা, তুলসী পাতা,
আম্র শাখা, ঘটে ডাব বসিয়ে পূজা করা হয়। মিষ্টি, ফল, চিড়া, গুড় ও নাড়ু
সহযোগে পূজা সম্পন্ন হয়। লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করে পূজা শেষ হয়।
ভাইফোঁটা আমাদের দেশের একটি প্রচলিত উৎসব। কার্তিক
মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে এই অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে
এই উৎসব ‘ভাইদুজ’ নামে পরিচিত। কথিত আছে এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তাঁর
বোনের হাতে ফোটা নিয়েছিলেন। নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বদ করার পর
কৃষ্ণ তার বোনের কাছে এলে কাকে ভাইফোঁটা দেয়। এইভাবে ভাইফোঁটা উৎসব
প্রচলিত। ঐদিন বোনেরা ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোটা পরিয়ে ছড়া কেটে বলে-“
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা, যমুনা দেয় জলকে
ফোটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা”।
সরস্বতী পূজা—
প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে
স্বেতশুভ্র কল্যানময়ী দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। সরস্বতী দেবী স্বেত শুভ্র
বসনা। একহাতে বেদ অন্য হাতে বিনা, এজন্য তাঁকে বীণাপানীও বলা হয়। শিক্ষার্থীরা
এই পূজায় বেশি মনোযোগী হয়। স্কুল, কলেজ, বিদ্যালয় এবং ঘরে ঘরে
সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
দোলযাত্রা---
এটি একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। এই উৎসবের অপর নাম
বসন্তোৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
বৃন্দাবনে কৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে গোপিনীদের সঙ্গে দোল খেলায় মেতে উঠেছিলেন।
এই ঘটনা থেকে দোল যাত্রার উৎপত্তি। দিন রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির
ও গুলাল স্নাত করে কীর্তন গান সহকারে শোভাযাত্রা করা হয়। এই পূর্ণিমা তিথিতে
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলেএকে গৌর পূর্ণিমা নামেও অভিহিত
করা হয়।
কল্পতরু উৎসব—
‘ তোমাদের চৈতন্য হোক’—এই কথাটি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের
মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। ঐদিন শ্রী রামকৃষ্ণদেব
কল্পতরু অবতারে অবতীর্ণ হন। তারপর থেকে এই দিনটিতে বিশেষ প্রার্থনা
ও পূজা পাঠ চলে আসছে। পালিত হয়ে আসছে ‘কল্পতরু উৎসব” যা আজও অব্যাহত।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই সময় দুরারোগ্য গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত
হয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। উত্তর কলকাতার কাশিপুর
অঞ্চলের একটি বাগানবাড়িতে চিকিৎসার সুবিধার জন্য তাকে নিয়ে আসা
হয়। সেদিন রামকৃষ্ণ দেব একটু সুস্থ ছিলেন। তিনি বাগান বাড়ির উদ্যানে হেঁটে
বেড়াচ্ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে। তিনি তাকে বললেন
–“তুমি আমাকে কি রূপে দেখো?” গিরিশ ঘোষ বললেন—“ তুমি আর কেউ নও নবরূপধারী
পূর্ণব্রহ্ম ভগবান। আমাদের মত পাপী তাপী দের মুক্তির জন্য নেমে
এসেছে”। পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষ এই কল্পতরু উৎসবের দিন সমবেত
হন এই কাশিপুর বাগানবাড়িতে।
এছাড়া কিছু উল্লেখযোগ্য পূজা পার্বণ হলো শিবরাত্রি, নীল পুজো, ত্রিনাথের পুজো, বেলপুজো, ভাটি পুজো।
জাতীয় উৎসব— ‘আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করি সেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন
মনীষীদের জন্ম দিবস--- রবীন্দ্র জয়ন্তী, গান্ধী জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী
এবং বিশেষ কিছুদিন যেমন--- স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস যা সারা ভারতবাসী
যথাযথ মর্যাদাস সঙ্গে উদযাপন করে।
বর্তমানে ফুল উৎসব একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব বিভিন্ন
ফুলের সমারোহে ঘটে থাকে। সঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে
থাকে। উৎসব মানব জীবনে আনন্দের বাণী নিয়ে আসে। তাই উৎসব
মিলনের সুখ আর প্রানের আনন্দের অভিব্যক্তি।
তাই কবির ভাষায়----
“ উৎসব মানে এক মিলনের মেলা,
কিছু দেওয়া কিছু নেওয়া জীবনের খেলা।”
=====================
কেয়া মাইতি
Dilshad Garden.New Delhi.Delhi
Pin—110095
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন