লোকসমাগমের পাশাপাশি মেলা শিক্ষা-সংস্কৃতিরও প্রসার ঘটায়
প্রদীপ কুমার দাস
মেলা কথাটার অর্থ হল কোন একটা জায়গায় বহু লোকের সমাবেশে একত্রে মিলিত হয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করা।মেলা মানে মহামিলন। মানুষের আনন্দ-উচ্ছাসের প্রকাশ ঘটে মেলার মাধ্যমে। এছাড়া ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উপরে উঠে মেলা সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। মেলা ঐতিহ্যবাহীও বটে। বাংলার বারো মাসে তের পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মেলার আকর্ষণ। মেলার জায়গাগুলো হয় কোন বড় গাছতলায়, ধর্মীয় মন্দির-মসজিদের আশপাশে, নদীর পাড়ে কখনো বা সাধু-সন্ন্যাসী-পীর-ফকিরদের আস্তানায়। রাজ্যে বহু আনুষ্ঠানিক মেলা হয়। যেমন মকর সংক্রান্তিতে জয়দেবের কেন্দুলী মেলা যে মেলায় লোকেরা সারা রাত ধরে আকড়ায় ঘুরে ঘুরে বাউল গান শোনেন আর সময়মত কোন একটা আকড়ায় বসে গরম গরম খিঁচুড়ী খেয়ে নেন। ভোর রাতে পাকা কলা কিনে খুশি মনে বাড়ি ফেরেন। ঐ একই সময়ে বর্ধমানের প্রান্তিক অঞ্চল পান্ডবেশ্বরে একদিনের মেলা বসে। সেখানকার মেলার বৈশিষ্ট্য হল মেলা শেষে লোকেরা ডিম খেয়ে বাড়ি ফিরে। এছাড়া প্রতিটা জেলায় জেলায় বিভিন্ন সময়ে গ্রন্হমেলার আয়োজন করা হয় যেখানেও বহু লোক সমাগম হয়। হুগলী জেলার শ্রীরামপুর, কোন্নগর, উত্তরপাড়া, সিঙ্গুর, চন্ডিতলা, চন্দননগর, চুঁচুড়া, তারকেশ্বর ইত্যাদি জায়গায় প্রতি বছর বইমেলার আয়োজন করা হয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বইপ্রেমিকরা ছাড়াও অন্যান্য মানুষের ঢল দেখা যায় বইমেলায়। বইমেলা ছাড়াও পুষ্পমেলা, গানমেলা, ধর্মীয় মেলার প্রচলন আছে এ রাজ্যে। শহর অঞ্চলে আবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞানমেলা, বাণিজ্যমেলা, শিল্পমেলা, মোবাইলমেলা, কম্পিউটার মেলা, আবাসন মেলা, আইটি মেলার আয়োজন করা হয়। হুগলীজেলার তারকেশ্বরে গোটা শ্রাবণমাস উপলক্ষে বহু লোকের সমাগম হয়। এই উপলক্ষে শ্রাবণী মেলার আয়োজন করা হয়। শ্রীরামপুরে একমাস ধরে রথমেলা রথযাত্রা উপলক্ষে সূচনা করা হয়। চাতরা শীতলাতলায় শীতলাপূজা উপলক্ষে সাতদিন ধরে শীতলামেলার আয়োজন করা হয়। বহুদিন ধরে এই মেলা চলে আসছে হুগলী জেলায়। মেলার দিনগুলোতে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয় বিশেষ করে মহিলারা জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির হন শীতলা মন্দিরে জল ঢালার জন্যে। এছাড়া শিবচর্তুদশীর দিনে একমাসব্যাপি ক্ষেত্রশাহের মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলা শুরু হয়েছিল আঠারোশো সাতানব্বই সালে পরম শিবভক্ত, দানবীর, কর্মবীর, শিক্ষানুরাগী, সত্যদ্রষ্টা বাবু ক্ষেত্রমোহন সা-র একক প্রচেষ্টায়। এই মেলার উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী। জনসমাগম, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো, ধর্মীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানো, সেইসঙ্গে পুরাতন ও নতুন চিন্তা ভাবনার মেলবন্ধন ঘটানো মানুষের মনে। এরই সঙ্গে শুরু হয় মেলার মাধ্যমে ছবি, কলা ও শিল্পের প্রদর্শণী। কৃষিমেলার মাধ্যমে হরেক রকম সব্জির প্রদর্শণী চাষিভাই তো বটেই, সাধারণ মানুষের মনে কৃষিকাজের উৎসাহ-প্রেরণার যাদুকাঠি তো বটেই। এরই মাঝে এক বিশাল কর্মযোগের সূচনা করেন ক্ষেত্রমোহন সা। সেই থেকে মানুষের মুখে মুখে মেলার নামকরণ হয়ে যায় ক্ষেত্রসা'র মেলা। এই মেলার আয়োজনের মধ্যে একাধারে মিলন উৎসব, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির উত্তরোত্তর প্রসার ও নিত্য নতুন শিক্ষা সংস্কৃতির উত্তরণে এই মেলা আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে আমাদের সকলের মনে। সাধারণভাবে মেলাগুলোর আয়োজনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ধর্মীয় ভাবাবেকে জাগিয়ে তোলার জন্যে ধমাীয়মেলা,কৃষিজাত সামগ্রীকে উৎসাহিত করার জন্যে কৃষিমেলা, ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ লোকজনকে পুস্তকপাঠে আগ্রহী করার লক্ষে গ্রন্হমেলা, বিভিন্ন ঋতূভিত্তিক পালা-পার্বনকে মনে রাখার জন্যে থতুভিত্তিকমেলা, জাতীয় জীবনে বরণীয় ব্যক্তিদের স্মরণ করার জন্যে স্মারকমেলা ও সাংস্কৃতিকমেলা, বানিজ্যিক পন্য সামগ্রীকে লোকসমাজে বিশেষভাবে প্রচারের লক্ষে বিক্রয়মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলাগুলো উপলক্ষে চিত্ত বিনোদনের জন্যে নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুলনাচ,যাত্রাপালা, কবিগান, কীর্ত্তনের আসর, লটারিখেলা, বায়োস্কোপের আয়োজন করা হয়।মেলা বা উৎসবের একটা সর্বজনীন রূপ আছে যেখানে জাত-পাত-ধর্ম, ধনী-গরিব এর শ্রেণী বিভাগ কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরঞ্চ সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে আর এই কথাগুলোর প্রতিধ্বনী শুনতে পাই রবি ঠাকুরের লেখায়: "প্রতিদিন মানুষ দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ"।
যাত্রা আজও মানুষের মনে দাগ কাটে। গ্রামীন শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বটে। আজও গ্রাম বাংলায় যাত্রাপালা গ্রামীন মানুষের কাছে বিনোদনের বড় মাধ্যম। কয়েকদিন আগে হুগলী জেলার নসিবপুর গ্রামে দুদিন ধরে যাত্রাপালার আয়োজন করেন নসিবপুর যাত্রাপালা কমিটি। সামাজিক যাত্রাপালা দেখতে আসা এক প্রত্যক্ষদর্শী দিলীপ কুমার দাসের মুখ থেকে জানতে পারা যায় গ্রামের মানুষ শীতকালে কিছুটা অবকাশ পায় কেননা মাঠের ধান উঠে যায় খামারে, তখন স্বভাবত মনটা চায় কিছু বিনোদন। তাই শীতকালে গ্রামীন যাত্রার আসর মানুষকে অনেক বেশি একাত্ম হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এছাড়া সামাজিক ও ঐতিহাসিক যাত্রাপালায় গ্রামীন মানুষের সমাগম বেশি হয় যেমন করে আজকের যাত্রাপালায় বহু লোক সমাগম হয়েছে। কোন কোন জায়গায় কোন মেলা বা উৎসবকে কেন্দ্র করেও যাত্রার আয়োজন করা হয়। ওই যাত্রা উপলক্ষে উপস্হিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও গ্রাম প্রধানের অভিমত হল এই এলাকায় লোকেদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হল যাত্রাপালা। সিনেমার চল এখানে খুব একটা নেই। নাটক পরিবেশনের কোন ভাল মঞ্চও নেই। তাই যাত্রার আয়োজন করা হলে লোক সমাগম ভালই হয়। রাতজেগে লোকে যাত্রা দেখেন। অনেক দূর দূরান্ত গ্রাম থেকেও লোকে আসেন ট্রেনে-বাসে চেপে। যাত্রাপালা কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা কার্তিক আদক যিনি পেশায় একজন চিত্রকর ও স্হানীয় ছেলে-মেয়েদের আঁকা শেখানোর জন্যে একটি স্কুল চালান তাঁর মতে যাত্রায় যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরা প্রত্যেকেই একজন শিল্পী। চিত্রকর যেমন চিত্র এঁকে শৈল্পীক কৃষ্টি ফুটিয়ে তুলতে পারেন তেমনি যাত্রাপালার অভিনেতা-অভিনেতৃরা তাঁদের অভিনয় নৈপুন্যের মাধ্যমে বাংলার লোক-সংস্কৃতি ও শিল্প- সংস্কৃতির ধ্বজাকে নীল আকাশের পানে মেলে ধরতে সক্ষম হন। ছোটবেলায় যাত্রা দেখতে গিয়ে বাবার কানমলা খেয়ে যাত্রার আসর থেকে ফিরতে হয়েছিল বেজার মনে, কষ্ট পেয়েছিল অন্তিম তরবারির লড়াইটা দেখা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল বলে। সেই কষ্টটা উসুল করে নিয়েছিলেন শ্রীরামপুর থেকে নসিবপুরে গিয়ে সরাসরি যাত্রার আসরের মঞ্চে বসতে পেয়েছিলেন উদ্যোক্তাদের আমন্ত্রণে শ্রীরামপুরের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী তাপস মুখোপাধ্যায়। তাঁর অভিমত হল ফাঁকা মাঠে চট দিয়ে ঘেরা মাথায় ত্রিপলের ছাউনি ও চটের আসনে বসে চারদিক খোলা মঞ্চে অভিনয় দেখা সত্যিই এক নস্টালজিক অনুভূতি। ছোটবেলার সব স্মৃতিকে উসকে দিয়ে মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে তুলেছে। তাঁদের গ্রামের চন্ডীমন্ডপে যে যে সামাজিক ও ঐতিহাসিক যাত্রাপালা হতো তাতে মন্ডপ ভরে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে লোকে যাত্রা দেখতো। আজ অবশ্য চিত্রটা বদলেছে। চন্ডী মন্ডপের জায়গায় স্কুল বাড়ি, কাছারি মাঠ, খেলার মাঠে এইসব যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়।কখনো কখনো ধান খেতে মঞ্চ বানিয়ে যাত্রাপালার আসর বসানো হয়। তবে যেখানে হোক না কেন আজও যাত্রা আমাকে টানে নিশি পাওয়া ভূতের মতন। নসিবপুরে যাত্রার আসরে বসে যেটা নজরে এসেছিল যাত্রার যে মূল আকর্ষণ কনসার্ট বা প্রারম্ভিক যাত্রার আসর মাতিয়ে তোলা বাঁশি, কাঁশি, ঢাক-ডোল, ক্ল্যারিওনয়টের সুমধুর স্বর যার আওয়াজ শুনে পড়িমড়ি করে ছুটে আসেন গ্রামীন পুরুষ-মহিলা থেকে বাচ্চা-যুবক-যুবতীরা। প্রতিযোগিতার ধূম পড়ে যায় কে আগে এসে জায়গা দখল করে নিতে পারে। আসরের গায়ে সাজঘর থাকে যেখানে অভিনেতা-অভিনেতৃরা তাঁদের সময়মত সাজগোজ করে নিতে পারেন। আগেকারদিনে মহিলা আভিনেত্রীর আকাল ছিল বলে পুরুষেরাই মহিলার সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয় করতেন আর সেইসব দেখে লোকেরা হা হয়ে অভিনয় দেখতেন আর শুনতেন। কালের প্রবাহে ও প্রযুক্তির উন্নতিতে এখনও কনসার্ট বসে তবে আধুনিক যন্ত্রের যন্ত্রনায় নব্য যাত্রাপালা আর তেমন দাগ কাটে না মনে। আগেরকার যাত্রাপালাকারকেরা যে যে যাত্রাপালা রচনা করতেন সে সামাজিক, ঐতিহাসিক কিংবা ধর্মীয় হোক না কেন, যাত্রা দেখতে দেখতে লোকে আবেকতাড়িত হয়ে কখনো চোখের জলে ভেসে যেতেন অথবা মূর্ছা যেতেন আসরের মাঝে। এমনই একাত্ম হয়ে পড়তেন যাত্রাপালা দেখে। এখন পালাকারদের মধ্যে স্বকীয়তার অভাব বেশ দেখা যাচ্ছে। কিছুটা বেতার, কিছুটা দূরদর্শন আবার কিছুটা আধুনিক নাট্যমঞ্চের পাঁচমিশেলি প্রভাবে এখানকার যাত্রাপালাগুলো ততটা মনকে নাড়া দিতে পারছে না ঠিকই, তবুও মানুষ বিশেষ করে গ্রামের মানুষ ভীড় জমাচ্ছেন যাত্রার আসরে। বিবেকের গানে দ্রবীভূত হয়ে রুমাল কিংবা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মূছছেন। গ্রামীন যাত্রাপালা তাই প্রাণের পরশ, হৃদয়ের আকুতি ও অনুভবের স্পন্দন যা আজও মানুষের মনে গেঁথে রেখেছে। বিনোদনের মাধ্যম ত বটে, সেইসঙ্গে ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের কথা অনুযায়ী লোক শিক্ষের সোপান অবশ্যই। এছাড়া লোকসমাগম, ব্যবসায়িক লেনদেন, মিলনোৎসব ও সম্পৃতির চরম নিদর্শণের ছোঁয়ায় ভরিয়ে তোলে গ্রামীন যাত্রাপালা।
লোকগান লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক- শ্রীরামপুরে গত তিন বছর ধরে শিকড় উৎসবকে ঘিরে বাংলা লোকগানের মেলা চলে আসছে। এই লোকগানের মিলন উৎসবে দেখতে পাওয়া যায় বড় বড় লোকশিল্পীদের সমাবেশ। কলকাতা তথা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকশিল্পীরা আসেন এই মেলা উপলক্ষে। প্রাণ ভরে গান গেয়ে লোকেদের মনোরঞ্জন করেন। সেইসঙ্গে লোকগানের চর্চা যারা করেন সেইসব উদীয়মান ছাত্র-ছাত্রীরা তারাও প্রাণিত হয়। নবীন-প্রবীনের মেলবন্ধনে লোকগানের আসর বেশ জম-জমাট হয়ে যায়। শুধু শ্রীরামপুরের নয় বড়া, বেগমপুর, শিয়াখালা, বালি-বেলুড়, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, শেওড়াফুলি, বৈদ্যবাটি সহ হুগলী জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা চলে আসেন শীতের ভ্রুকটি গ্রাহ্য না করে। গভীর রাত পর্যন্ত লোকশিল্পীদের গান শুনে বাড়ি ফেরেন ভোর রাতে। লোকগান কেন এখনো এত মানুষকে টানে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায় এই গান লোকেদের জন্যে, লোকই এই গান বাঁধে আর লোকই এই গান গায়। এসব গান গায় গরীব লোকে, মাঠের চাষাভুষো মানুষ, ক্ষেত-খামারে কাজ করা শ্রমিক, গাঁয়ের বধু ও সাধারণ লোকে। মুখে মুখে গান রচনা হয়। গানের বিষয়ও খুব সাদামাটা। সাংসারিক জীবনের টানাপড়েন, কোন অনুষ্ঠান বা লৌকিকতার ব্যঞ্জনাময় বর্ণনা, বিভিন্ন ঋতু -বৈচিত্র্যের ঘটনা, দিন-রাত্রির কাহিনী, শাশুড়ী, শ্যালিকার সঙ্গে রসবোধের সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয় লোকগান।এই গান রচনা সতস্ফূতিতে হয়। কোন ওস্তাদ বা পন্ডিতের দরকার হয় না। প্রয়োজন পড়ে না বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের। সঙ্গে থাকে শুধু একতারা কিংবা দোতারা, বাঁশি, ঢাক, কাঁশি। লোকগান গাওয়া হয় সহজ সরল ভাষায়। গানের সুর বাঁধা হয় মনকে ছোঁয়ার জন্যে। লোকগান যে লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক সেটা পরিস্ফুট হয় যখন একজন চাষী মিঠে ধান রোপন করছে কিংবা কোন গৃহবধু পাড় দিয়ে ধান ভাঙছে অথবা কোন বিয়ের কনেকে গায়ে হলুদ মাখিয়ে স্নান করানো হচ্ছে কিংবা কোন আসরে ভগবৎ আলোচনা হচ্ছে সেইসব পরিস্হিতিতে চটজলদি গান রচনা করে নেওয়া হয় মুখে মুখে। আবার নদীর বুকে মাঝি চলেছে মাঝদরিয়ায় মাছ ধরতে, নিজের মনের কষ্ট, প্রিয়াকে অদর্শনের কষ্ট কিংবা নদীতে একাকীত্ব ভুলে মাঝি গেয়ে চলে আপন মনে লোকগান। তাই তো লোকগানের স্হানভেদে নামকরণ হয়ে যায় কীর্তন যখন স্বয়ং ঈশ্বরের উদ্দ্যেশে গাওয়া হয়। কখনো কখনো গুরুকে স্মরণ করে গাওয়া হয় যেমন বাউল, আবার নদীর বুকে মাঝি গেয়ে চলে ভাটিয়ালি।করুণ সুরে মনের অব্যক্ত ব্যথা ব্যক্ত করে চরাচরে। যেখানে শোনার লোক বলতে সে নিজে ও বিশ্বচরাচরের অসীম শৃন্যতা। সেই ভাটিয়ালি গান যখন একসঙ্গে অনেকে গায় যার সূত্রটা ধরা থাকে নেতার হাতে আর অন্যান্য দলের লোকেরা নদীর বুকে জলের মধ্যে দাঁড় টানতে টানতে দাঁড়ের শব্দ ও জলের শব্দের মধ্যে অপূর্ব ছন্দে একসঙ্গে গাইতে থাকে যাকে বলে সারি গান। শাশুড়ী-জামাই অথবা জামাই- শালিকার মধুর সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে মজার মজার রসসিক্ত যে ধরণের লোকগান রচনা করা হয় তার নাম 'ভাওয়াইয়া' যেটা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও বাংলাদেশের রাজশাহীতে খুবই জনপ্রিয় লোকগান। পারিবারিক অনুষ্ঠান অথবা সামাজিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে যে লোকগান তৈরী করা হয় বিশেষ করে বাঁকুড়ায় "ভাদু" উৎসব কিংবা পুরুলিয়া জেলার বৈষ্ণবধর্মকে কেন্দ্র করে ঝূমুর গান বিশেষ প্রচলিত ও বহুল জনপ্রিয়। মালদহ জেলায় চড়ক কিংবা গাজনের মেলায় 'গম্ভীরা' লোকগান খুবই মনোগ্রাহী। লোকগানের মধ্যে বাউল গান খুবই জনপ্রিয়। বাউল গানের মাধ্যমে সহজ সরল ভাষায় ও ভাবে আত্মা ও পরমাত্মার কঠিন ব্যাপারগুলোকে সকলের গোচরে আনা সেইসঙ্গে নাচের মাধ্যমে একতারা কিংবা দোতারা সহযোগে সুরমাধুর্য তৈরী করে লোকের মনোরঞ্জন করা হয়। এ রাজ্যেও বীরভূম, পূরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্দ্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপোরের বেশ কয়েকটি জায়গায় লোকগান হিসেবে সাঁওতালী গান তৎসহ নৃত্য গ্রামীন লোকসংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের মনে। এই লোকগান আমাদের বাংলা গানের অমূল্য সম্পদ। যুগ যুগ ধরে অদ্যাবধি চলে আসছে। কিন্তু চর্চার অভাবে কিছুটা বিস্মৃতমান। তবে ইদানীংকালে জেলায় জেলায় বিভিন্ন মেলা, উৎসবের আয়োজনের মাধ্যমে লোকগানের চর্চা চলছে। ক্রমবর্ধমান লোকগানের চর্চার মাধ্যমে লোকগানের উত্তোরত্তর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেয়ে লোকসংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক এটাই আমেদের একমাত্র প্রার্থণা। কেননা লোকগানই পারে বাংলা গান তথা বাংলা লোকসংস্কৃতির ধ্বজাকে আগামীদিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
=================
ডাঃ প্রদীপ কুমার দাস
শ্রীরামপুর, হুগলী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন