কুমারগঞ্জ থানার ভোঁওর গ্রামের খ্যাড়াপূজা
লালন চাঁদ
মেলা,পার্বণ বা উৎসব আসলে একটি মিলনস্থল। মহামিলনের প্রাণকেন্দ্র। মানুষ এসব স্থানে আসে আনন্দ উপভোগ করতে। এখানে অনেক চেনা অচেনা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হৃদ্যতা বিনিময় হয় পরস্পর। মন উজাড় করে মানুষ পরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে। হৃদয়ের ভালোবাসা বিলিয়ে দেয় মানুষের মধ্যে। তাই মেলা, পার্বণ বা উৎসব হয়ে ওঠে মানুষের মিলনের প্রাণকেন্দ্র। হৃদয়ের আকরভূমি।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত কুমারগঞ্জ থানার ভোঁওর গ্রাম। ছোটো বড়ো দশটি পাড়া নিয়ে এই গ্রাম। এখানে প্রতিবছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভোঁওর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে খ্যাড়াপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
খ্যাড়াপূজা বলতে পাতা খেলা। এটাও এক ধরনের খেলা। অনুষ্ঠানের আগের রাত ওই মাঠে ওঝা গুণিন বৈদ্যরা এসে উপস্থিত হন। নিশিরাতে দুটো জল ভর্তি মাটির হাঁড়ি মাঠের মাঝখানে রেখে তার সামনে নানারকম মন্ত্র উচ্চারণ করেন তারা। সঙ্গে কিছু জড়িবটিও ওই জলে ডুবিয়ে হাঁড়ি দুটোর মুখ কাপড় দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়।
ওঝা গুণিন বৈদ্যরা সে রাত্রে উপোস থাকেন। একটা দানাও দাঁতে কাটেন না। পরদিন সকালবেলা ঠিক মাঠের মাঝখানে দশটা কলাগাছ রীতিমতো মন্ত্র উচ্চরণ করে পোঁতা হয়।
বিকেল বেলা শুরু হয় মেলা বা উৎসব। শুরু হয় পাতাখেলা। ওই জলের হাঁড়িতে হাত দিলে হাত কাঁপতে থাকে আপনা আপনি। অনেকে মনে করে জলে সাপের বিষ মিশিয়ে দেওয়া আছে। আবার অনেকে মনে করে জলে বিছুটি পাতার রস মেশানো আছে। কারণ জলে হাত রাখলেই হাত জ্বলতে থাকে। অনেকেই সেই জ্বালা সহ্য করতে পারে না। ফলে কম্পিত হাতে সারা মাঠ তারা ছোটাছুটি করে। আবার জ্বালার কথা মুখে বলতেও পারে না।
এই পাতাদের নিজেদের বশে আনতে গুণিনরা দু তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। চলে উচ্চস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ। মন্ত্রশক্তির জোরে গুণিনরা দু চারটে করে পাতা টানেন। তখন পাতারা শান্ত। সাধারণ মানুষ। এভাবে গুণিনরা বাহবা কুড়ান।
আবার কারো কম্পিত হাত শান্ত না হলে গুণিনরা পাতাদের কানে বিড়বিড় করে মন্ত্র আউড়ে চলেন। মুহূর্তেই পাতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেয়া হয় মাটিতে। তার জ্ঞান ফিরে আসে কমপক্ষে আধঘন্টা পর।
আশপাশের দুই দশ গ্রামের লোক এসে ভিড় জমায় মেলার মাঠে। আসে বিভিন্ন খাবারের দোকান। শীতের আগেই চলে আসে নলেন গুড়ের তৈরি মিষ্টি, সন্দেশ, রসগোল্লা। গ্রামের কিছু লোক নিজেদের ঘরের তৈরি আটা দিয়ে বানায় ভাগা বা ঢুকি। সঙ্গে নারকোল কোরা আর ঝুরিঝুরি নলেন গুড়। অসাধারণ সুস্বাদু সেই ভাগা।
মাঠের একপাশে জমে ওঠে সাঁওতালি নাচ। মাইকে ঘোষণা হয় তাদের নাম। ঢোল ডাঙ্গর মাদল কাঁসি জুড়ি আর খোলের বাজনায় উত্তাল হয়ে ওঠে মাঠ। লোকে লোকারণ্য। ছোটো বাচ্চা হারিয়ে গেলে উদ্ধার করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন মাইকে ঘোষণা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
দোকানে বেচা বিক্রি হয় যথেষ্ট। যারা খ্যাড়াপূজো দেখতে আসে তারা মেলার আস্বাদ নিয়ে ফিরে যায় বাড়িতে।
আবার দূরে মিটমিট করে আলো জ্বলতে দেখা যায়। সেখানেও কিছু লোকের আগমন ঘটে। ওরা দারু হাড়িয়া আর পচানি পান করে। রুক্ষ মেজাজ শান্ত করতে এসব নাকি ওষুধের মতো কাজ করে। দারুখোরদের কথা শুনে অনেকে হাসে অনেকে আবার ঘৃণা প্রকাশ করে।
আবার মেলায় শান্তি রক্ষার জন্য থানায় লিখিতভাবে আগাম অনুরোধ বার্তা দেওয়া হয়। ফলে রাত বারোটার মধ্যে চৌকিদার ও পুলিশ চলে আসে। ওরাও ভাঙা মেলায় সামিল হয়।
রাত বারোটার পর মেলার আসর ভাঙার পালা। পুলিশের আগমনে বাকি লোকজন বাড়ি ফিরে আসার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এই সময় কেউ মাতলামি করলে পুলিশের ধাওয়া খেতে হয়। দোকানদার ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। মেলায় কতো কামাই হলো তা গুণে দেখার সময় থাকে না।
ঠিক এর আট দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় ছাতামেলা। এই মেলের বড়ো আকর্ষণ একটা লম্বা বাঁশের মাথায় ছাতা বেঁধে দেওয়া হয়। ছাতার উপরে থাকে একটা বড়োসড়ো লাল মোরগ। আর সমগ্র বাঁশটিতে ঘি মাখিয়ে দেওয়া হয়। এবার ওই বাঁশ বেয়ে যারা উপরে উঠে লাল মোরগটাকে ধরে আনতে পারে তাকে দেয়া হয় নগদ পাঁচ শ টাকা। এবং পুরস্কার স্বরূপ ধুতি, গেঞ্জি আর একটা গামছা। গ্রামের অনেক মানুষই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জেতে একজনই। আর সে-ই প্রাপক হয় ওই টাকা এবং কাপড়ের।
এই মেলাতেও বড়ো বড়ো দোকান পাট আসে। ব্যবসা ভালো হয়। মেলার আরেক আকর্ষণ ঘোড়া নাচ। বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি ঘোড়ার কাঠামো। তার উপরে রঙিন কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটা ঘোড়ার অবয়ব। এই অবয়বের ভিতর ঢুকে মানুষ ঘোড়া হয়ে নাচে। নাচ শুরু হয় দশটা ঘোড়া দিয়ে। খেলা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। খেলা শেষ হলে ঘোড়া মানবরা সবার কাছে টাকা পয়সা প্রার্থনা করে। এভাবে বেশ ভালো টাকা কামাই করে তারা।
এটা একটা প্রাচীন উৎসব। ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে বহুদিন ধরে। গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণে আজ এই মেলা হয়ে উঠেছে আরো জমজমাট। ভালো লাগে মেলায় আসলে। দশটা লোকের সঙ্গে কথা বললে মন হালকা হয়ে যায়। তাই অনেকেই আসেন এই মেলাতে। আনন্দ উপভোগ করেন। আনন্দ বয়ে নিয়ে যান নিজেদের ঘরে।
---------------------------------
লালন চাঁদ
গ্রাম + পোস্ট = কুমারগঞ্জ।
জেলা = দক্ষিণ দিনাজপুর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন