পয়লা বৈশাখ আর কালবৈশাখী
সোমা চক্রবর্তী
দু'টো হাত দু'দিকে সোজা করে ছড়ানো- মুখে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে ক্রমাগত। সেইভাবেই যত জোরে সম্ভব- দৌড়। হাওয়ার দিকে মুখ করে ছোটা।
মাঠটা বিশাল বড়। পাশে পাশে অনেকদিনের পুরনো, প্রকান্ড সব গাছ। তাদের মধ্যে বেশীর ভাগই আম গাছ। মাঠের একদিকে একটা ঘন বাঁশ বাগান। ভেতরটা কেমন আঁধার আঁধার। বাঁশ বাগানটা যেই দিকে, তার ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ মাঠের আর একটা প্রান্তে পুরোনো একটা ভাঙাচোরা পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশে আর একটা বাগান, তবে সেটা ফলের বাগান। লোকে বলে 'মালীর বাগান'। কে যে মালী, কারই বা বাগান, সেসব কিছুই আমরা তখন জানতাম না। শুধু এটুকু জানতাম যে, সেখানে ঢুকতে কারোরই বাধা নেই। এমন কোনো চেনা ফল নেই, যেই গাছ ওই বাগানে ছিল না! আম, জাম তো ছেড়েই দিলাম, আতা, পেয়ারা, বেল, লিচু, সফেদা, নারকেল, সুপারী, জামরুল, তাল, করমচা, কামরাঙা, কুল এমনকি আনারস গাছও ছিল। গাছের ঘন ছায়া পড়ে দিন দুপুরেও কেমন অন্ধকার হয়ে থাকতো বাগানটা। একটা শুধু ভাঙাচোরা পুরোনো দোতলা বাড়ি ছিল বাগানের মধ্যে। সেখানে কেউ থাকতো কিনা আজ আর মনে নেই। দলে ভারী হলে ভাঙা পাঁচিলের ভেতর দিয়ে মাঝে মাঝে শর্টকাট করতো অনেকেই- কেউ বারণ করত না।
মাঠের বাকি যে দু'টো দিক রইল, তারই একদিকে আমাদের বাড়ি। আর অন্য দিকটায় গাছের ফাঁকে ফাঁকে আরো অল্প কয়েকটা অন্য বাড়ি-ঘর। সেই সব বাড়িগুলোর টুকটুকে লাল টালীর চালের উপর সবুজ লাউ-কুমড়ো লতার জমজমাট আসর। প্রতিটা বাড়ির সামনেই মাটির একফালি তকতকে নিকোনো উঠোন আর তুলসী মঞ্চ। সন্ধ্যার সময় যখন সেখানে প্রদীপ জ্বলতো, আমাদের বাড়ি থেকে বিন্দুর মতো দেখা যেতো সেই আলো। কারোর কারোর উঠোনে আবার মাটিতে গর্ত করে একটা উনোন পাতা। সেখানে শুকনো পাতা আর কাঠকুটো জ্বেলে ভাত ফোটানো হতো, জল গরম করা হতো। এই রকম উনোন গুলোকে বলা হতো পাতা উনোন। আর লোহার বালতির মতো যে উনোন গুলো হাতল দিয়ে ধরে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতো, তাকে বলা হতো তোলা উনোন। একটা ফাঁপা নলের মত জিনিসে ফুঁ দিয়ে দিয়ে পাতা উনোনে হাওয়া দেওয়া হতো, যাতে আগুন ভালো করে জ্বলে ওঠে। যেহেতু শুকনো পাতা আর কাঠকুটোই এই উনোনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো, তাই প্রত্যেকটা উঠোনের একটা কোনায় সংগ্রহ করে রাখা থাকতো জ্বালানি কাঠকুটো। আমাদের বাড়িতেও অনেকে আসতো শুকনো কাঠ-পাতা নিতে। বড়ো বড়ো গাছের নীচ থেকে ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করে বস্তায় ভ'রে নিয়ে যেতো শুকনো পাতা।
আমাদের পাড়ার এক জেঠিমা তাঁদের বাড়ির উঠোনে বসে বসে সেই রকমই একটা পাতা উনোনে মুড়ি ভাজতেন। সেই বাড়িটা ছিল আমার ছোটবেলার প্রাণের বন্ধু বুড়িদের বাড়ি। ওদের বাড়িতে অনেক লোক। ওদের একটা গোয়াল ছিল। সেখানে থাকতো সাদা রঙের দুটো গরু আর তার বাছুর। বাছুরের গলায় ঘন্টা। গরুর দুধ দোয়ানো, বিশাল বঁটি দিয়ে খড় কাটা, জাবনা দেবার জন্য বড়ো বড়ো মাটির পাত্র- এই সবকিছু আমি ওদের বাড়িতেই দেখেছি। খড় কাটা বঁটির ধারালো দিকটায় আবার করাতের মতো খাঁজ কাটা থাকতো। যাতে মোটা মোটা খড়ের আঁটি ধরে একবারেই টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা যায়। সেই টুকরো করে কাটা খড় ভাতের মাড়ের সঙ্গে মেখে জেঠিমা গরুগুলোকে খেতে দিতেন। যদিও গরুদের দেখাশোনা করার জন্য ওদের বাড়িতে একজন লোক ছিল, তা সত্ত্বেও বেশীরভাগ সময় ওবাড়ির জেঠু বা জেঠিমা নিজেরাই ওদের খেতে দিতেন। আর ওরাও, খিদে পেলেই অদ্ভুত ভাবে ডেকে উঠতো, "ম্মা"! জেঠিমা সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, "কি হয়েছে মা? খিদে পেয়েছে? এই তো যাচ্ছি!" জেঠিমা গরু গুলোকে খুব ভালোবাসতেন। সবসময় ওদের 'মা' বলে ডাকতেন আর খুব মিষ্টি করে কথা বলতেন। গোয়াল ঘরটার কাছাকাছি গেলেই তীব্র ঝাঁঝালো একটা বিশেষ গন্ধ পাওয়া যেতো। সেটা ছিল গোবরের গন্ধ, গরুর গায়ের গন্ধ, খড়-বিচালি আর ঘাসের মেশানো একটা অদ্ভুত গন্ধ। জেঠিমা নিজের হাতে গরু দুটোকে স্নান করিয়ে দিতেন। ওদের সঙ্গে কথা বলতেন। গায়ে, মাথায়, গলায় হাত বুলিয়ে দিতেন। গোয়াল ঘরটা মাঝে মাঝেই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করানো হতো লোক দিয়ে। সন্ধ্যার সময় মশা তাড়ানোর জন্য বড়ো একটা মাটির ধুনুচিতে করে নারকেলের ছোবড়া আর ধুনোর ধোঁয়া দেওয়া হতো।
যাই হোক, যা বলছিলাম! কালো রঙের লোহার কড়াইতে গনগনে গরম খানিকটা বালি। ভাজতে ভাজতে বালির রঙ হলুদ থেকে কালো হয়ে গেছে। বুড়ির মা, মানে আমাদের সেই জেঠিমা মুড়ি ভাজছেন, ওনার ডান হাতে কয়েকটা মাত্র নারকেল পাতার নতুন কাঠি, (যাকে আমরা ঝাঁটার কাঠি বলি আর কি) হাত পাখার মতো করে ছড়িয়ে ধরা রয়েছে। কাঠির খুন্তিও বলা যায়। বাঁ হাত দিয়ে তিনি অল্প কিছু চাল কড়াইতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আর ডান হাতের কাঠি গুলো দিয়ে ক্রমাগত সেগুলো নাড়ছেন। আমি মুখ নীচু করে, সব ভুলে সেই কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কালো বালির মধ্যে ঠিক ফুল ফোটার মতোই সাদা মুড়ি হয়ে ফুটে উঠছে চালগুলো। আমার কাছে সেটা ছিল এক অপার বিস্ময়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি তাকিয়ে থাকতাম ঠিক কখন একটা একটা করে সাদা মুড়ি ফুটে উঠবে গনগনে গরম কালো বালির মধ্যে। জেঠিমা দক্ষ হাতে বালির ওপর থেকে সেই কাঠির খুন্তি দিয়ে মুড়িগুলো তুলে ফেলে পাশের একটা পাত্রে রাখছেন। তারপর আবার অল্প কিছু চাল ছড়িয়ে দিচ্ছেন কড়াইয়ের মধ্যে। ছোটবেলায় বুড়িদের বাড়িতে সদ্য ভাজা সেই মুড়ি দুয়েকবার খেয়েছি। দোকান থেকে কেনা মুড়ির স্বাদ সেই মুড়ির স্বাদের ধারে কাছেও আসে না।
আমাদের বাড়িতে তখন অনেক রকমের গাছ ছিল। নারকেল, সুপারী, আম, জামরুল, খেজুর, এইরকম পরিচিত প্রায় সব গাছই ছিল। অনেকগুলো কুলগাছও ছিল। ছিল বাতাপী লেবু আর গন্ধরাজ লেবুর গাছ। আর ছিল প্রচুর ফুলের গাছ। জবা, গাঁদা, বেল, টগর, শিউলি, গন্ধরাজ, কাঠ গোলাপ, কাঞ্চন, করবী, কামিনী, মাধবীলতা - কতো আর বলবো? খেজুর গাছটা ছিল একদম ছোট্ট। কিন্তু একবার সেই ছোট্ট গাছটাতেই প্রচুর রস হয়েছিলো। আমার মা সখ করে আমাদের উঠোনে একটা মাটির উনোন পেতেছিলো। সেই উনোনে আমাদের নিজেদের গাছের খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে মা গুড় বানিয়েছিলো। জলের মতো দেখতে রস লোহার কড়াইতে জ্বাল দিতে দিতে আস্তে আস্তে ঘন গাঢ় বাদামী রঙের হয়ে উঠতো। কড়াইয়ের নীচ থেকে যাতে পোড়া না লেগে যায়, তাই খুন্তি দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে হতো রসটা। ঘন হতে হতে একটু একটু করে আঠালো হয়ে উঠতো তরল রস। এই ভাবেই বানানো হতো খেজুরের রসের গুড়।। রস জ্বালের সময় যে সুগন্ধ ছড়াতো বাতাসে, তার কথা কি আর বলব!
আমরা সেই বাড়িতে যাওয়ার পর পর, মাত্র দু'এক বার ওই বিশাল মাঠটায় ধান চাষ হতে দেখেছি আমি। তখন তো আমি খুবই ছোট ছিলাম, স্কুলেও ভর্তি হইনি। যখন স্কুলে যেতে শুরু করলাম, তখন অবশ্য মাঠটায় আর চাষবাস হতো না। কেন যে হতো না, তখন সেটা বুঝতে পারিনি। তখন দিনের বেলায় সেখানে গরু-ছাগল চরাতে আসতো আশেপাশের লোকজন। সারাদিন ধরে গরুগুলো মাঠে বাঁধা থাকতো আর ছাগলগুলো ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। বাছুর আর ছাগল ছানাগুলো মাঠ জুড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলে বেড়াতো। আর বিকেলে, আমরা মানে পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে সেখানে খেলা করতাম। এর বেশ কিছু বছর পর, একদিন দেখলাম, মাঠটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে, প্লট বানিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হলো। এখন সেখানে ঘন বসতি। সেই বাঁশ বাগানও আর নেই আর মালির বাগানটাও মিলিয়ে গেছে। সেখানে এখন অনেক অনেক বহুতল ভবনের ভিড়। বড়ো হয়ে যখন দেবেশ রায়ের "তিস্তাপারের বৃত্তান্ত" পড়লাম, তখন আমার ছোটবেলায় প্রথম দেখা 'জমিতে লাঙল দেওয়া'র কথা মনে পড়ে যেতো। একটা আসল ছবি, আর একটা বইয়ের পাতায় আঁকা ছবি- এই দুটো ছবি আমার মনে মিলেমিশে কখন যেন একাকার হয়ে গেছে। লাঙল দেবার সময় লোকটা মুখে যে অদ্ভুত একধরনের শব্দ করতো, আজও যেন সেই শব্দটা আমার কানে বাজে। সারাদিন ধরে দুটো বলদ নিয়ে একটা লোক বিশাল মাঠটার শক্ত মাটি ফালা ফালা করে ফেলছে, আর আমি উঠোনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি!
সদ্য বানানো বাড়িটায় তখন একটাই ঘর আর একটা ঘেরা বারান্দা। সামনে সাদা রঙের সিমেন্টের একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে একটা টিউবওয়েল। তার ঠিক পেছনেই কলা গাছের ঝাড়। আমাদের বেড়া ঘেরা উঠোন আর খোলা মাঠের মাঝখানে ছিল পর পর দু'টো বিশাল আম গাছ। দুই গাছের ছায়া মিলে গিয়ে ঘন হয়ে গাছের তলাটা সবসময় ঠান্ডা করে রাখতো। আমি দেখতাম, প্রায় প্রত্যেক দুপুরে একজন লোক প্রায়ই এসে ওই গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করতো। তারপর তার লাল রঙের গামছার মোড়ক খুলে, তার ভেতর থেকে বাটি বের করে তরকারী দিয়ে ভাত খেতো। তারপর শুয়ে শুয়ে একটা ছোট বাঁশি বাজাতো। দুপুরবেলার বিষন্ন নির্জনতায় লোকটার বাঁশির সুর আমার খুব অলৌকিক মনে হতো। সুরটা আমাকে কেমন যেন আনমনা করে দিতো। এক মূহুর্তের মধ্যে আমার চেনা ঘর-বাড়ি, ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকা মা- সব কিছু কেমন 'উধাও' হয়ে যেতো। আমি একা ঘরে শুয়ে শুয়ে সেই বাঁশি শুনতাম আর দেখতাম আম গাছের ডালে ব্যস্তবাগীশ কাঠবেড়ালিদের ঘর-সংসার।
প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখ পড়ে এপ্রিলের ১৪ কিম্বা ১৫ তারিখে। আর তার আগে আগেই, চৈত্রের শেষ থেকে শুরু হয়ে যেতো কালবৈশাখীর মরসুম। পয়লা বৈশাখ মানেই বাংলা নতুন বছরের শুরু। পয়লা বৈশাখ মানেই প্রচন্ড গরম। পয়লা বৈশাখ মানেই নতুন জামা। পয়লা বৈশাখ মানেই পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর আমাদের ছোট বেলায় পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল 'হালখাতা'। হালখাতা আর কিছুই নয়। মাসকাবারি বাকির খাতার হিসেব মিটিয়ে, নতুন বছরের জন্য আবার নতুন করে খাতা খোলা। যদিও আমার বাবার বাকি বকেয়া কখনো কোথাও থাকতো না, তবু আমাদের চেনা জানা সব দোকান, যেখান থেকে সারা বছর কেনাকাটা করা হতো, সেই সব দোকান থেকে আমাদের কাছে হালখাতার নিমন্ত্রণ আসতো। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার বাবা মায়ের সঙ্গে আমিও সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলাম। উপহার স্বরূপ পাওয়া যেতো একটা প্যাকেটে নানারকমের কিছু মিষ্টি, ঠাকুর দেবতার অথবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিওয়ালা একটা বাংলা ক্যালেন্ডার, পরিচিত হাসি মুখ আর শুভেচ্ছা বিনিময়। আমাদের কাছে দোকানদারদের কেউ কাকু, কেউ জেঠু। কেউ আমার বাবা-মাকে দাদা-বৌদি বলে ডাকছেন। কেউ হয়তো বাবাকে নাম ধরে সম্বোধন করছেন, আর মাকে বলছেন বৌমা। কেউ বলতেন, তিনি নাকি বাবার দেশের লোক। কেউ বলতেন, তিনি আমার দাদুকে মানে মায়ের বাবাকে চেনেন। আমার বাবা-মা দুজনেরই জন্ম পূর্ব বাংলা মানে বর্তমানের বাংলাদেশে। দেশের লোক বলতে ওঁরা বোঝাতেন যে ওখানে সবাই এক জেলা অথবা এক গ্রামে থাকতেন। মা'কে দেখতাম হাসি মুখে তাঁদের সকলকে সম্বোধন করতে। কখনো মনে হতো না, ওঁরা আমাদের আত্মীয় নন। পরিবারের সদস্য তো ছিলেন না কেউই, তবু কেমন করে যেন শুধু কেনাবেচার সম্পর্ক অতিক্রম করে ওঁরা আমার বাবা-মায়ের পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন। আমরাও তো সারা বছর কতো জায়গা থেকে কতো কিছুই কেনাকাটা করি। কিন্তু ওইরকম সম্পর্ক তো কই একটাও গড়ে ওঠেনি! আসলে সেইসব দিনকালই ছিল আলাদা। সেইসব মানুষগুলোও ছিল একেবারেই অন্যরকম!
ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখের দিন বিকেলে পাড়ার ক্লাবে কবিতা বলতে যেতাম মায়ের হাত ধরে। পরনে থাকতো পয়লা বৈশাখের নতুন জামা। মাঝে মাঝেই সেই খড়খড়ে মাড় দেওয়া সুতির নতুন জামা থেকে নতুন কাপড়ের গন্ধ এসে লাগতো নাকে। তাতেই একটা বিজয়ীর আনন্দ পেতাম আমি। কবিতা বলবার দিকে যতোটা মনোযোগ থাকতো, ঠিক ততোটাই মনোযোগ থাকতো নতুন জামাটার দিকে। কারণ, নতুন জামা পরা তখনকার দিনের বাচ্চাদের কাছে একটা বিশেষ ব্যাপার ছিল। তখন আমরা সারা বছরে মাত্র দুই-তিনবারই নতুন জামা পেতাম। একবার, পয়লা বৈশাখে আর একবার দূর্গাপূজার সময়। এছাড়া আর একবার জন্মদিনে। তবে জন্মদিনে প্রত্যেকবার যে নতুন জামা জুটতো, এমনটা কিন্তু নয়। অনেক সময়ই শুধু মায়ের বানানো পায়েস দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হতো। অবশ্য তাতে আমাদের কোনো দুঃখ ছিল না। আমরা সেই আন্তরিকতাকেই উপহার বলে গ্রহণ করতে শিখেছিলাম।
পয়লা বৈশাখের জামা আমি একই রকম ভাবে এখনো পেয়ে যাই। ছোটবেলার মতো সেই একই রকম ভাবে মা একখানা জামা কিনে রাখে। পয়লা বৈশাখের দিন হাসিমুখে হাতে তুলে দেয়। বলে, "এই দিনে নতুন জামা পরতে হয়!" ছোটবেলায় দেখেছি, বাড়ির সকলের জন্যই মা জামা কিনে আনতো। বাবার জন্য কেনা পাঞ্জাবীটা যেই না বাবাকে দেওয়া হতো, অমনি বাবা আলমারি খুলে দেখাতে শুরু করতো, তার কতো নতুন জামা পড়ে রয়েছে। পরে ওঠা হয়নি। তাই নতুন করে নতুন জামা কেনার কোনো দরকার নেই। বাবার এই ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম আমরা সবাই। আড়ালে ভাইবোনেরা এই নিয়ে হাসাহাসিও করতাম। তবু প্রত্যেক বছরই মা নতুন জামা কিনে আনতো বাবার জন্য। সেই জামা যে বাবা কতো বছর পর পরতো, তা শুধু বাবা নিজেই জানে! এখনো আমার বাবা নতুন জামার বিষয়ে সেই একই ধারা অব্যাহত রেখেছে!
আমার বাবার কোনো বিলাসিতা করার অভ্যাস ছিল না। বাবাকে কখনো দামী জামা, দামী জুতো, দামী ব্যাগ ব্যবহার করতে দেখিনি। এমনকি সারা জীবন একটা হাত ঘড়িও ব্যবহার করেনি বাবা। চাকরী থেকে অবসর নেবার সময় অফিস থেকে বাবাকে একটা দামী হাতঘড়ি দিয়েছিলো। বাবা সেটা আমার ভাইকে দিয়ে দিয়েছিলো। এতো দিনেও বাবার নিজের কোনো মোবাইল ফোন নেই। এখনো পর্যন্ত বাবার কাছে যা ফোন আসে সব সেই আমাদের পুরনো ল্যান্ড লাইনে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, বাবা খুব কিপটে মানুষ। বরঞ্চ ঠিক তার উল্টো। বাজার থেকে সবচেয়ে ভালো ভালো জিনিস প্রচুর পরিমাণে কিনে নিয়ে আসতে ভালোবাসে বাবা। ভীষণ ভালোবাসে বাজার করতে। কে কি খেতে ভালোবাসে, মনে করে করে তার জন্মদিনের দিন সেই সব কিছু কিনে নিয়ে আসে। সারা জীবন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব প্রত্যেকের পাশে দাঁড়িয়েছে একদম নিঃশব্দে। দু'হাত ভরে সকলকে সাহায্য করেছে। অথচ, সেই সাহায্যের মধ্যে কোনো অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য ছিল না। কোনো কৃতজ্ঞতার ঋণে কাউকে আবদ্ধ করতে চায়নি বাবা। অনেক সময় আমরাও, এমনকি মা ও প্রথম দিকে জানতে পারিনি কার জন্য কি করেছে বাবা। হয়তো জেনেছি অনেকদিন পরে। যখন জেনেছি, তখন অন্যদের থেকে, অন্যভাবে জেনেছি। আর তখন বাবার জন্য গর্বে, শ্রদ্ধায় ভরে গেছে নিজের অন্তর। অথচ, বাবা নিজের থেকে কাউকে কিছু বলতো না, পাছে সেই মানুষটি সংকোচ বোধ করে! আমার মাকেও দেখেছি, দূর্গাপূজার সময় প্রত্যেকজন আত্মীয় স্বজনের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনে আনতে। প্রত্যেকের জন্য নতুন কিছু না কেনা পর্যন্ত নিজের জন্যও নতুন শাড়ি কিনতো না মা। অথচ বরাবর আমার মাকেই আমি পরিবারের সকলের কাছে সবচেয়ে নম্র হয়ে থাকতে দেখেছি। আমার বাবা সরকারী চাকরী করতো আর মা ছিল স্কুলের শিক্ষিকা। ইচ্ছে করলেই ওরা শুধু নিজেদের নিয়ে অনেকটা স্বচ্ছল ভাবে জীবন যাপন করতেই পারতো। কিন্তু দুজনের কেউই তা করেনি। সকলকে নিয়ে, সকলের সঙ্গে একসাথে ভাগ করে নিয়েছে সুখ-দুঃখ। এখন আর এমন মানুষ খুব বেশী দেখতে পাই না, যারা শুধু নিজেদের নিয়ে নয়, সকলকে নিয়ে, সকলকে ভালো রেখে একসঙ্গে বাঁচতে ভালোবাসেন। তাই নিজেদের মধ্যে ওদের নিয়ে আমরা যতো মজাই করি না কেন, মনে মনে ওদের জন্য রয়ে যায় আজন্মের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আর অহঙ্কার। আর সেটা ওরা এইরকম বলেই।
উত্তর দিক হইতে আইল টিয়া
সোনার মুকুট মাথায় দিয়া
যদি টিয়া মন করে
হাওল মাটি চাওল করে।
- " বলো তো এটা কি?" মা ধাঁধাটা বলার সাথে সাথে উত্তর দিকের আকাশটা মেঘে মেঘে কালো হয়ে উঠেছিলো। নীচে সবুজ ধান ক্ষেতের উপর মেঘের ছায়া পড়ে কেমন নীলচে হয়ে গেছে। আর তখনই দেখি, আকাশের একটা দিক ছেয়ে ফেলে, ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে উড়ে আসছে উত্তর দিক থেকে। ধানগাছের উপর বসে অপক্ক, সবুজ ধানের শীষ গুলো ধারালো ঠোঁট দিয়ে ভেঙে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। ধানগাছ গুলো এক এক বার মাটির দিকে নুয়ে পড়ছে, আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আমি আর মা উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখছি সেই অভিনব দৃশ্য।
চাষবাস যখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল, তখন মাঠটায় রোজ বিকেলে পাড়ার সব বাচ্চাদের খেলার আসর বসতো। তখন আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতাম সোজা মাঠে। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা মিলে কতো রকম যে খেলা হতো তার হিসেব নেই। বুড়ি-ছোঁওয়া, জোড়া-ছাড়া, লুকোচুরি, নাম পাতানো, রং-রং, এলাটিং-বেলাটিং, ওপেন-টি-বায়োস্কোপ আরও কতো কি! প্রতিটা খেলার আবার একটা করে নিজস্ব ছড়া ছিল। যারা আমাদের সময়কার, কেবল তারাই এসব নামের জাদু বুঝবে! মনে পড়ে যাবে খেলার সেই ছড়ার সুর। ছোটবেলার সেই খেলাগুলো বোধহয় সব হারিয়ে যাচ্ছে! সঙ্গে ছড়াগুলোও! যাচ্ছে, নাকি ইতিমধ্যেই গেছে- কে জানে! কালবৈশাখীর সময়টা ছিল বিকেলের ঠিক আগে। ঝড়টা হঠাৎ উঠতো, তারপরই নামতো তুমুল বৃষ্টি, কখনো কখনো শিলও পড়তো। সূর্যাস্তের আগেই কোনো কোনো দিন হঠাৎ করেই আবার আকাশ একদম পরিষ্কার হয়ে যেতো। পশ্চিম আকাশের অস্তগামী সূর্যের আলো পূবের ক্যানভাসে এঁকে দিতো একটা মসৃণ রামধনু। আর সেই রামধনু দেখতে পেলে কি খুশিই না হতাম আমরা! মনে হতো, আমাদের আশপাশটা বুঝি রূপকথার এক নগরী হয়ে উঠেছে।
মধ্যদিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে!
ধরণীর 'পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধরিল কে!
কানন-আনন পাণ্ডুর করি
জলস্থলের নিশ্বাস হরি
আলয়ে-কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায়ে গগন ভরিল কে!
ক্লাস নাইনে উঠে মোহিতলাল মজুমদারের 'কালবৈশাখী' কবিতাটা পড়ার সময় কল্পনা করতে আমদের একটুও অসুবিধে হতো না কাননের পান্ডুর মুখ আর ধরণীর পরে বিরাট ছায়ায় ছত্র কেমন হয়! সময়ের কাটাকুটি খেলায় এখন আর কালবৈশাখী খুঁজে পাই না। খুঁজে পাই না পরম মূল্যবান আরও কতো কি!
আকাশ কালো মেঘে এমন ছেয়ে গেছে যে, দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গাছগুলোও যেন আসন্ন ঝড়ের মন্ত্রণায় থমকে আছে। আকাশের প্রান্তে বিদ্যুতের রেখা ফুটে উঠেই দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকে কানে আসছে মেঘের চাপা গুরুগুরু ধ্বনি। বড় কোনো শিল্পীর গানের অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে যেমন তবলার মৃদু বোল আর বাজনার টুং-টাং ভেসে আসে স্টেজের দিক থেকে, ঠিক তেমনই, প্রকৃতিও যেন আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে তার অনবদ্য উপস্থাপনার। বিশাল মাঠটায় এখানে ওখানে ছোট ছোট হাওয়ার ঘূর্ণি উঠছে থেকে থেকে। উড়ছে ধুলোবালি, উড়ছে ঝরাপাতা। মাটির সোঁদা গন্ধ এসে নাকে লাগছে। খেলা থামিয়ে ছোটরা নিজেরাই ঘরে ফেরার উদ্যোগ করছে। ওপাশের পাড়া থেকে একটু বড়ো একদল ছেলেমেয়ে আম গাছগুলোর তলায় এসে জুটেছে আমের গুটি কুড়াবে বলে! মনে মনে ভাবছি, মায়ের গলা শোনা গেল বলে! আর ঠিক তক্ষুনি ঝড়টা উঠলো। দুরন্ত, ঠান্ডা, জোলো হাওয়া এসে ঝাপটা মারলো চোখে-মুখে-চুলে। আর অমনি, আমি, হাওয়ার দিকে মুখ করে দু'টো হাত দু'দিকে ছড়িয়ে যতো শক্তি আছে সব দিয়ে ছুটতে লাগলাম- ঝড়ের দিকে, ঝড়কে পেতে!
************************
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন