Featured Post
ভ্রমণকাহিনি ।। বিশাখাপত্তনম ও আরাকুভ্যালি ।। স্তুতি সরকার
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বিশাখাপত্তনম ও আরাকুভ্যালি
স্তুতি সরকার
প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মাঝেই মন যেন ডানা মেলে উড়তে চায়। কিন্তু কোথায় যাবেন? পাহাড়ে, সমুদ্রে না জঙ্গলে? কারোর পছন্দ পাহাড় তো কারোর পছন্দ সমুদ্র । কারোর আবার জঙ্গল। তাই দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলাম বিশাখাপট্টনম আর আরাকু ঘুরে আসা যাক যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল তিনটিই একসঙ্গে আছে। সেই মতো অনলাইনেই পুরো ট্যুরের টিকিট বুকিং সেরে, শুক্রবার সারাদিন অফিস করে রাত্রে হাওড়াস্টেশন থেকে 'হাওড়া ত্রিচি স্পেশাল' ট্রেনে করে ভাইজাগে পৌঁছলাম সকাল সাতটা কুড়ি নাগাদ। তিনদিন দুই রাত্রির ছুটি কাটাতে যাচ্ছি বিশাখাপট্টনম আর আরাকু ভ্যালি বেড়াতে। ইংরাজরা ওয়ালটেয়ার বলতেন যায়গাটাকে। ভাইজাগও বলে ডাকে অনেকে।
আমাদের এপিটিডিসির হোটেলে বুক করা ছিলো। ট্যুরিজম এর গাড়িও বলা ছিলো সেই দিনেই সাইট সিইং করাবার জন্য। স্টেশনে প্লাকার্ড হাতে ড্রাইভার অপেক্ষা করছিলো। সেই গাড়িতেই হোটেলে এসে উঠলাম প্রথমে। হোটেলে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে ঘর বন্ধ করে এ পি টি ডি সির হোটেলেই রাজকীয় কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেয়ে লোক্যাল সাইট সিইং করতে বেরুলাম। ট্যুরিজম এর এসি ডিলাক্স গাড়ি অপেক্ষা করছিলো। আমাদের যাত্রা হলো শুরু।
বিশাখাপাটনাম অন্ধ্রপ্রদেশের সবচেয়ে বড় বন্দর শহর। বে অফ বেঙ্গলের পাশে অবস্থিত। এটা ফেমাস সুন্দর সুন্দর শহর বীচ, পাহাড়, আর মিউজিয়াম এর জন্য বিখ্যাত।
প্রথমেই গেলাম ভীমলি বিচ। একদম উত্তরে খুব সাজানো-গোছানো এই বিচে আছে অনেক স্ট্যাচু, অনেক সেলফি জোন। পুরো বীচ জুড়ে ছড়িয়ে আছে ল্যাটলাইট পাথর তাই স্নানের জন্য উপযুক্ত নয় এই বীচ।বেশ দূরে হওয়ায় দর্শক সমাগমও খুব কম।
এরপর গেলাম ঋষিকণ্ডা বিচ। দিনের বেলায় ভাইজাক এর সেরা বিচ এটা স্নানের জন্য পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখানে লাঞ্চের জন্য আছে অনেক রেস্টুরেন্ট।আছে নানান রকম অ্যাডভেঞ্চার ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা স্কুবা ডাইভিং সমেত।
এবার গন্তব্য থোতলা কোণ্ডা। ২০০০ বছরের পুরনো এক বুদ্ধিস্ট মনষ্ট্রী। ভাইজাগ শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমুনিপট্টনম হিলটপে অবস্থিত । একদম বিচের পাশে। খুব সুন্দর ভাইজাগ সিটি পাখির চোখে বিচ ভিউ উপভোগ করা যায় বিচভিউ পার্ক থেকে । পাহাড়ের ওপরে সাজানো-গোছানো সুন্দর ২০০০ বছরের পুরনো এই বৌদ্ধস্তূপটি পাওয়া গেছে ১৯৯৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে সরকারের খননকার্যের ফলে। সেই সময়ের প্রত্নতত্তের ধ্বংসাবশেষ। বৌদ্ধদের ধার্মিক স্থান। খাবার ও জল সঙ্গে রাখতে হবে। এখানে কিছুই পাওয়া যায় না।
ভিমলি বীচ ভিউ পয়েন্ট: কৈলাশগিরি: পাহাড়ের উপরে অবস্থিত খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো পার্ক। উপরে ওঠার জন্য আছে রোপওয়ে । টিকিট দেওয়া হয় সকাল ১১ টা থেকে দুপুর ১২ টা ৪০ এবং বিকেলে দুটো থেকে সন্ধ্যা সাড়েসাতটা পর্যন্ত । আটটায় পার্ক বন্ধ। প্রতি মাসের ১৯ তারিখে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে রোপ্যয়ে। পাহাড়ের উপরে পুরো পার্ক ঘুরে দেখার জন্য ট্রেনে করে ঘোরার ব্যবস্থা আছে।মাঝখানে আছে হর পার্বতীর বিরাট মূর্তি। এখানে আছে টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট। আছে অনেক রেস্টুরেন্ট। কৈলাশগিরি ঘুরে দেখতে সময় লাগে এক ঘন্টা।
ইয়ারাডা বীচ: বিশাখাপত্তনমের ১৫ কিলোমিটার দূরে বে অফ বেঙ্গলের পূর্বদিকে অবস্থিত একটা ভিলেজ এটা। এর পাশেই আছে গঙ্গাভরম বীচ, ডলফিনস্ নোজ আর গঙ্গাভরম পোর্ট। খুব সুন্দর এখানকার সিনিক বিউটি।
এবার দেখলাম লাইটহাউস।
আমাদের আজকের মতো শেষ গন্তব্য রামকৃষ্ণ বিচ বা আর কে বীচ: আরকে বিচ এর কাছেই রয়েছে কয়েকটি দ্রষ্টব্য। যেমন সাবমেরিন মিউজিয়াম, ফ্লাইট মিউজিয়াম, বিশাখা মিউজিয়াম, মৎস্যালয় একুরিয়াম, কালী মাতার মন্দির প্রভৃতি দিনের বেলায় ঋষিকোণ্ডা বিচ যেমন সবথেকে জমজমাট সন্ধ্যেবেলায় আরকে বিচ তেমন জমজমাট। এর সঙ্গে এখানে পাবেন রকমারি স্ট্রিটফুড। এর সবগুলোর ভিতরে দেখে, সন্ধ্যেবেলায় জমজমাট আরকেবীচে কিছু সময় কাটিয় সেখানের আশেপাশের দোকানে অল্প কিছু জিনিসপত্র কিনে এবং খাওয়া দাওয়া করে রাত্রে হোটেলে ব্যাক করি।
পরের দিন টুরিস্ট কারে করে গেলাম বোরা গুহলি বা বোরাকেভ। আরাকুভ্যালির অনন্ত গিরি পাহাড়ের উপর অবস্থিত বোরাকেভ।
বোরাকেভ: দশলক্ষ বছরের পুরনো এই বোরাকেভ। বোরাকেভ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে ক্যামেরা ব্যাগ ছাড়া অন্য কোন ব্যাগ নিয়ে যাওয়া যায় না। ব্যাগ রাখার জন্য ক্লোক রুম আছে।এন্ট্রি গেট থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে পৌঁছাতে হয় বোরা গুহা। ওখানে অনেক বাঁদর আছে। সাবধান। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পেলাম ভিউপয়েন্ট। এখানে একটা ছোট কাফেটেরিয়া আছে। তার পাশ দিয়ে আরও নিচে নেমে যাওয়ার রাস্তা, এসে শেষ হয়েছে গোস্থানী নদীর ধারে। এই নদীর জলে মিশে থাকা এসিডে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চুনাপাথর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অনন্ত গিরি পাহাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্টি হয়েছে এই গুহা বোরাকেভ। গুহার ভেতরে বাঁধানো রাস্তা এবং সিঁড়ি আছে।অনেক বড়ো গুহা। ব্রিটিশ জিওলজিস্ট উইলিয়াম কিং ১৮০৭ সালে এটা আবিষ্কার করেন। তবে স্থানীয় মানুষরা বলেন রাখাল গরু চরাবার সময়ে একটা গরু এই গুহার ছাদের গর্ত দিয়ে নিচে পড়ে যায়। তখন এই গুহাটা আবিষ্কৃত হয়। ওড়িয়া ভাষায় বোরা কথার অর্থ গুহা। তাই এই গুহার নাম রাখা হয় বোরাগুহা বা বোরাকেভ। স্থানীয় মানুষেরা গুহার ভিতরে একটা শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করেন। সেটার পূজা-অর্চনা শুরু হয়। এখনো প্রতিবছর শিবরাত্রির সময় স্থানীয় মানুষেরা এখানে পুজা দিতে আসেন।
গুহার ভিতরে গিয়ে রাস্তা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা নিচে চলে গেছে আর একটা উপরে চলে গিয়ে - ছোটো একটা মন্দিরে মিশেছে। রাস্তাটা খুবই খারাপ। সাবধানে উঠতে হবে। তবে নিচের দিকের রাস্তায় সচ্ছন্দে হাঁটতে পারা যায় শুধু একটা জায়গায় একটু মাথা নিচু করে নিতে হয়। গুহার ভেতরের অন্ধকার জায়গায় অনেক বাদুর আর চামচিকে আছে । খুব বিশ্রী গন্ধ। গুহার ছাদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়া চুনা জলে মিশে থাকা খনিজ পদার্থ জমে জমে গুহার মেঝেতে আর ছাত থেকে ফলার মতো বিভিন্ন আকৃতি তৈরি হয়েছে। মানুষ এই আকৃতিগুলোকে বিভিন্ন ভাবে কল্পনা করে বিভিন্ন নাম দিয়েছে, কোথাও মানুষের ব্রেন, শিব পার্বতী প্রভৃতি। গুহার ভিতরে গাইড পাওয়া যায়। এখানে কাকাবাবু ও সন্তু সিনেমা ইয়েতির কিছু শুটিং হয়েছিল । বোরাকেভ ঘুরে দেখতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘন্টা। বোরাকেভ দেখার পরে এখানের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিলাম। লাঞ্চের জন্য অনেক হোটেল আছে।
এরপর যাব কাটিকা ওয়াটার ফলস । তবে এর জন্য আলাদা জিপ ভাড়া করতে হয় । ৬ কিমি জিপে যেতে হয়। তারপর ৭০০ কিলোমিটার হেঁটে উপরে উঠতে হবে।
কোটিকি ফলস্ ঘুরে এপিটিডিসির হোটেল অনন্ত গিরি তো রাত্রে থাকলাম।
পরদিন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে আরাকুভ্যালিতে প্রবেশের পথে পড়বে অনন্থগিরি কফি গার্ডেন।পথের দুদিকে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত কফি ও গোলমরিচের বাগান । এখানে কফি খাওয়া যায়।কফি ও গোলমরিচ কিনে আনতে পারেন ৫০ টাকা ও ৩০ টাকা প্যাকেট।
গালিকোণ্ডা ভিউ পয়েন্ট- অনন্ত গিরি পর্বতের সুন্দর ভিউ পাবেন এখানে। আরাকু ভ্যালির অন্যতম ভিউ পয়েন্ট এটা। অনন্ত গিরি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘেরা পথের সৌন্দর্য দেখবার মতো।
পথে পড়বে ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। এখানে কিছুটা সময় কাটালে ভালো লাগবে।
পরের দ্রষ্টব্য শুটিং পয়েন্ট। অনন্ত গিরি পাহাড় শেষ হয়ে যেখানে আরাকু ভ্যালি শুরু হচ্ছে সেখানে অনেক দক্ষিণের সিনেমার শুটিং হয় । এখানে প্রাকৃতিক রূপ সত্যিই মনমুগ্ধকর ।
এবার ট্রাইবাল মিউজিয়াম ।
কিন্তু আমারা পদ্মপুরাম বোটানিক্যাল গার্ডেন আগে দেখব । অনেকটা শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মত। তবে আকার এবং বৈচিত্রের অনেক ছোট। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। এটা ঘুরে দেখার জন্য টয় ট্রেন আছে। সময় লাগে কুড়ি মিনিট।
এখানে আদিবাসী সমাজের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ভিতরে কায়াকিং এর ব্যবস্থা আছে।তীর-ধনুকের নিশানা লাগাতে পারেন । তারের উপর দিয়ে সাইকেল চালাতে পারেন। দুপুরে আদিবাসী ধুমসা নাচ হয়। এদের সঙ্গে সেলফি তুলতে পারেন নিজের। মিউজিয়ামের ভেতরে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার নানা টুকরো ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন তাদের শিকার উৎসব, তাদের পূজা-পার্বণ, দৈনন্দিন গৃহস্থালির, এমনকি তাদের আনন্দ উৎসবেরও।
শেষ গন্তব্য কফি মিউজিয়াম। কফি মিউজিয়ামের ইতিহাস থেকে শুরু করে কিভাবে প্রসেসিং এর মাধ্যমে কফি তৈরি হয় সেই সব জানলাম । এখানে বসে কফি খেলাম। তারপরে কফি অর গোলমরিচ কিনে নিলাম।
এবার পথের অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাইজাগে ফিরে আসা। এখন লোক্যাল মার্কেট ঘুরে কিছু লোক্যাল জিনিস কিনলাম । তারপর বিশাখাপট্টনম স্টেশনে আসলাম। অনেক রাত্রে আমাদের ঘরে ফেরার ট্রেন।
স্তুতি সরকার।
হাইল্যান্ড উইলোস, ব্লক- ১, ফ্ল্যাট নং- ৫০৪।
নিউটাউন, একসান এরিয়া- ২ বি,
কলকাতা- ৭০০ ০৬৭
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন