রমেশ এবার ক্লাস ফাইভে উঠেছে। করোনার সময় যেহেতু সারা বছরেই স্কুল ছুটি তাই পূজার ছুটির কোন আনন্দ নেই। এবার রমেশরা স্বপরিবারে তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। গ্রামটার নাম হল মন্থরনগর , গ্রামে রমেশের জ্যাঠা এবং দুই কাকা রয়েছেন। ঠাকুরদা এবং তাদের ভাইয়েরা কেউই আর বেঁচে নেই। শুধু মেজ ঠাকুমা বেঁচে আছেন। মন্থরনগরে তাদের বাড়ির দুর্গাপূজা বেশ বড় করেই হয়।
রমেশ মন্থরনগরে এসে প্রথম দিন তার দিদির সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোয় , ঠাকুর দেখার সময় রমেশ এবং তার দিদি হাঁটার প্রতিযোগিতা করে, কে বেশি জোরে হাঁটতে পারে তা দেখার জন্য। রমেশ জোরে হাঁটতে হাঁটতে তার দিদির থেকে অনেক দূরে চলে যায়, এবং দিদিকে আর খুঁজে পায় না। রমেশ আর রাস্তা চিনতে পারে না। যেখান দিয়ে সে এসেছিল সেই রাস্তাটাও অন্ধকারে সে আর চিনতে পারছে না। এটা গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্ত। এখানে পুজো তো দূরে থাক, কোন জনবসতি ও নেই। সারা রাস্তা অন্ধকার কোন শব্দ নেই শুধুমাত্র কিছু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া।
রমেশ কান্নাকাটি শুরু করে। রমেশ হাতড়াতে হাতড়াতে সামনের দিকে এগিয়ে চলে এই আশায় যদি কোন ব্যক্তির সাথে তার দেখা হয় সে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সামনে এগিয়ে রমেশ দেখতে পায় একটা আলো। রমেশের মন আনন্দে নেচে ওঠে, সে দৌড়ে এগিয়ে যেতে থাকে সেই আলোর দিকে, কিন্তু হঠাৎ করে সে একটা গর্তে পড়ে যায়। রমেশ চিৎকার করতে থাকে সাহায্যের জন্য। কেউ আসে না। রমেশ অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করার পর দেখতে পায় কি জানো একটা মোটা দড়ি রমেশের দিকে ছুঁড়ে দেয় উপর থেকে। রমেশ সেই দড়িটাকে শক্ত করে নিজের কোমরে বেঁধে নেয়, এবং সেই লোকটি তাকে গর্ত থেকে টেনে উপরে তুলে নেয়। উপরে উঠতে রমেশ দেখল সাহায্যকারী লোকটি মন্থরনগর অঞ্চলের বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার। বৃদ্ধ রমেশ কে তাকে প্লাটফর্ম চত্বরে নিয়ে গেল ও তাকে একগ্লাস জল দিল। এরপর সেই বৃদ্ধ তাকে অনেকদূর এগিয়ে দেয়, এবং রমেশ নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে সেই বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার তাকে বলে তার সাহায্যের কথা বাড়ির কাউকে না জানাতে।
দেখতে দেখতে দশমী চলে এলো। বিকেল বেলায় সবাই মাকে নিয়ে চলল বিসর্জনের পথে। তাদের বাড়ির লোক ছাড়াও বিসর্জনের জন্য গিয়েছিল গ্রামের বহু মানুষ। রমেশ তার দিদির হাত ধরে চলেছে মায়ের বিসর্জন দেখতে। বিসর্জন শেষ হলে সকলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়, কিন্তু রমেশের দিদি চিৎকার করে ওঠে...." রমেশকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না....! "
রমেশের বাবা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বাড়ির সকলে চিন্তায় পড়ে যান। এদিকে রমেশ গেছে সেই স্টেশন মাস্টারের কাছে তাকে বিজয়ার প্রণাম করতে। আজকে আর রমেশের অন্ধকারে ভয় নেই কারণ তার হাতে একটি টর্চ লাইট ছিলো। রমেশ যাচ্ছিল, কিন্তু পথে হঠাৎ করে তাকে দুজন ছেলেধরা অপহরণ করে। রমেশকে তারা টানতে টানতে তাদের আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার রমেশকে বাঁচায় তাদের হাত থেকে। ছেলেধরা দুজন পালিয়ে যায়।
স্টেশন মাস্টারকে দেখে রমেশ তাকে প্রণাম করে । রমেশ লক্ষ্য করে যে স্টেশনটি অন্ধকার, সেখানে সবকিছুই ভাঙাচোরা প্লাটফর্ম থেকে শুরু করে স্টেশন মাস্টারের ঘর ,টিকিট কাউন্টার , সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই স্টেশনে স্টেশন মাস্টার বাদে আর কেউ নেই। কোন ট্রেন এসে দাঁড়ায় বলে তো মনে হয় না ..?! রমেশ এবার একটু আশ্চর্য হয়। স্টেশনমাস্টার রমেশকে দ্রুত সেই নিঝুম এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। রমেশ পুনরায় তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। গিয়ে দেখে সবাই মহাউৎকন্ঠায় তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। রমেশ ফিরে আসতেই তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। রমেশ আগের দিন ও আজকের পুরো ঘটনাটা কথা সবাইকে বলে। রমেশের কথাগুলো শুনে মেজ ঠাকুমা চিৎকার করে ওঠেন, তিনি বলেন যে
সেই বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টারকে তিনি চিনতেন। তিনি খুবই পরোপকারী ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। বছর তিরিশেক আগে ওই স্টেশনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল । ট্রেন আসার সময় একটি শিশু ভুল করে তার মায়ের কোল থেকে রেল লাইনে পড়ে যায়, স্টেশন মাস্টার ওই শিশুটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে রেললাইনের ওপর চলে যায় ।কিন্তু, তার আর শেষ রক্ষা হয়নি। ট্রেনের পাশে গিয়ে স্টেশনমাস্টার নিহত হয়েছিলেন সেদিন। তারপর থেকে ওই স্টেশনে কোনদিন ট্রেন দাঁড়ায় নি। সবাই মনে করে ওই স্টেশনে আজও ওই স্টেশন মাস্টারকে দেখা যায় । তাই ওই অঞ্চল এবং ওর থেকে বেশ অনেকটা অঞ্চলজুড়ে কোন লোক বাস করে না।
সহকার ওই স্টেশনকে পরে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। রমেশের কথাগুলো যদি সত্য হয় তাহলে ওই স্টেশনমাস্টার আজও ওই চত্বরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ান বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করতে। রমেশ এতদিন গল্পের বইতে পড়ে এসেছে ভূত নাকি মানুষের ক্ষতি করে.?! ঠাকুমার কথাগুলো শোনার পর রমেশ চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায় সব ভূত কি শুধু মানুষের ক্ষতিই করে? একটু খুঁজলে হয়তো বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টারের মত কিছু ভূতকেও পাওয়া যায়।
________________________________
আর্য্য ভট্টাচার্য্য
মহারাজা নদীয়া উচ্চ বিদ্যালয়,শান্তিপুর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন