Featured Post
গল্প ।। পাপের ভার ।। চন্দন মিত্র
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মাসছয়েক হল এই উপসর্গটা দেখা দিয়েছে। শরীরটা পাথরের মতো ভারি। নড়াচড়া করাটাই কষ্টকর। বসতে গেলে কষ্ট, উঠতে গেলে কষ্ট, হাঁটতে গেলেও কষ্ট। প্রেসার নর্মাল, সুগার নর্মাল, লিপিড প্রোফাইল নর্মাল ; এম-আর-আই রিপোর্টও নর্মাল। কিছু না-দিলে মুখ থাকে না, তাই ডাক্তার মণ্ডল অ্যাসিড ব্লকার ও স্ট্রেস রিলিফ মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছেন। ওষুধ চলছে কিন্তু উপসর্গ প্রশমিত হচ্ছে না। ভক্তিবাবু ভাবলেন ডাক্তার পরিবর্তন করা ছাড়া উপায় নেই। যখন তিনি চেন্নাই যাওয়ার জন্য একপ্রকার মনস্থির করে ফেলেছেন, তখন রোগটা ধরে দিলেন পারিবারিক গুরু ত্রিলোকেশ শাস্ত্রী। তিনি রাখঢাক না-করেই বাড়ির লোকজনের সামনেই বলতে শুরু করলেন, শোন ভক্তিপ্রসাদ, তোর রোগ সারানোর সাধ্য কোনও ডাক্তার-বদ্যির নেই। এতদিন যত পাপ করেছিস সব তিলে তিলে জড়ো হয়ে তোর শরীরকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। তুই তো দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক, এত এত শাস্ত্র পড়েছিস তা পাপের ভার বিষয়টা বুঝিস তো?
কী বলছেন গুরুদেব। আমি প্রিন্সিপাল, এত বড় একটা কলেজের দায়িত্ব সামলাই। কত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়ে !
হ্যাঁ, সে তো পড়বেই ! কিন্তু খোঁজ নিয়েছিস যারা তোকে ডাকে, তারা আড়ালে তোর নামে কী বলে ! এই যে তুই গ্রাম-শহর মিলিয়ে খান পাঁচেক প্রাসাদ বানিয়েছিস ; তুই যা বেতন পাস তাতে সম্ভব ! আমি তোর কোষ্ঠী বানিয়েছিলাম। আমি তোর পরিণতি জানতাম। তাই তোর অমন নাম দিয়েছিলাম, যদি ভালো কিছু হয়। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাবে বল ! অনেক অনেক টাকা জমা করলি কিন্তু তার বাইরে আর কী পেলি তুই। ছেলেদুটোকেও মানুষ করতে পারলি না।
এবার ভক্তিবাবু সত্যিই লজ্জায় পড়ে যান। কারণ গুরুদেব যা বলছেন তা একেবারে ধ্রুব সত্য। তিনি কাতর কণ্ঠে অনুনয় করলেন, গুরুদেব কোনও উপায়ই কি নেই ?
গুরুদেব বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর ঝোলা থেকে পাঁজি, মোটা একটা বই ও একটা বাঁধানো খাতা বের করে টেবিলের উপর রাখেন। পাঁজি ও বই দেখে খাতায় কীসব নোট নিতে থাকেন। নানা আঁকিবুঁকি কেটে হিসাবনিকাশ করে শেষে তিনি একটা নিদান দেন। শোন ভক্তিপ্রসাদ, আসন্ন মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে গিয়ে ঠিক ব্রাহ্মমুহূর্তে পূর্বদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সাতটা ডুব দিবি। আর এক মাস মাছ খাওয়া তো দূরের কথা ছুঁয়েও দেখবি না।
সস্ত্রীক ভক্তিবাবু বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ভ্যাসেল ঘাটে পৌঁছে গেলেন। নিজের গাড়ি নিয়ে আর এগোনো সম্ভব নয়। এবার তাঁকে পরনির্ভরশীল হতেই হবে। ঘণ্টা তিনেক লাইন ঠেলে ভক্তিবাবু আর তাঁর সহধর্মিণী ভ্যাসেলে চাপার সুযোগ পেলেন। ভ্যাসেল থেকে উঠে লাইন দিয়ে বাসে উঠতে উঠতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেল। কপিলমুনির আশ্রম চত্বরে পৌঁছে ভক্তিবাবু উঠলেন তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্রের হোটেলে। আগে থেকে বলা ছিল। রাতের খাবার খেয়ে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে ভক্তিবাবু ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু ঘুম এল না। এদিকে তাঁর পাশের জন ততক্ষণে নাক ডাকাতে শুরু করে দিয়েছেন। ভক্তিপ্রসাদ ভাবতে শুরু করলেন, গুরুদেব কেন তাঁকে সাগরে ডুব দিতে বললেন ! সত্যিই কী ডুব দেওয়ার পর তিনি রোগমুক্ত হবেন ! তাঁর দর্শনশাস্ত্র পড়া মন বড় বেশি সংশয়ী। তিনি বিভিন্ন জায়গায় উপনিষদ বা অন্যান্য শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিলেও সেগুলি তিনি ঠিক বিশ্বাস করেন না, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করেন না। আসলে তিনি সংশয়বাদীদের দলেই পড়েন বোধহয়। আজ নেহাতই ঠেকায় পড়ে গুরুদেবের উপদেশ মানতে চলেছেন। ঘুম তো হলই না, অ্যালার্ম বেজে গেল। সহধর্মিণীর ঘুম ভাঙিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দুজনে চললেন সাগরের দিকে।
জনারণ্য হলেও সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য কোনও তীর্থযাত্রীকেই কোনোরকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। ভিড়ের তালে তালে পা-মেলালেই হল। সস্ত্রীক ভক্তিবাবুও ভিড়ের ছন্দ শিরোধার্য করে শেষমেশ সাগরজলের পতিতপাবনী ছোঁয়া পেলেন। পূর্বদিক রক্তাভ হয়ে উঠেছে। সেদিকে অপলকে তাকিয়ে ভক্তিবাবু পরপর সাতটা ডুব দিলেন। শেষ ডুবটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ থেকে ঘামের মতো বিন্দুবিন্দু পাপ বেরিয়ে একত্রিত হয়ে একটি মনোলোভা চিতল মাছের রূপ ধারণ করে সাগরজলে হারিয়ে গেল। ডুব দেওয়া শেষ হতেই ভক্তিবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন। তিনি বহু আগের সেই পাখির পালকের মতো হালকা ফুরফুরে শরীরটি ফিরে পেয়েছেন। আনন্দের আতিশয্যে তিনি উচ্চৈঃস্বরে জয় মা গঙ্গা বলে স্ত্রীকে পাঁজাকোলা করে জলের মধ্যে তুলে ধরলেন। তাঁর স্ত্রী তো লজ্জায় ঘোমটা দিয়ে ফেলেছেন। ভক্তিবাবু বুঝতে পারলেন কাজটা তিনি ঠিক করেননি। তাড়াতাড়ি করে তিনি গিন্নির হাত ধরে ভিড়ের দঙ্গলে পা-মেলালেন। অতঃপর পাখির মতো উড়তে উড়তে পরের দিনই তিনি বাড়ি ফিরলেন। এদিকে সেই চিতলমাছ সাঁতার দিতে দিতে সাগর থেকে নদীতে ঢুকে পড়ল। তারপর নদী থেকে ঢুকে পড়ল খাঁড়িতে, যে খাঁড়ির লাগোয়া একটি গ্রামে বাস করেন আমাদের এই গল্পের ভক্তিবাবু। পৈতৃক মাটির বাড়িটি ভেঙে সেখানেই তিনি বানিয়েছেন তিনতলা ইমারত।
বিমল দাস সকালবেলা জাল কাঁধে বেরিয়েছিল। জাল ফেলতে ফেলতে দুপুর হয়ে গেল। দুচারটি পুঁটি-ট্যাংরা-চিংড়ি ছাড়া কিছুই মিলল না। সে ভাবল, আজ কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলাম। বউ বাপের বাড়িতে তার মুখ দেখার প্রশ্নই নেই! বিমলের খেয়াল হয় অনেকদিন পর আজকে সে নিজের হাতে যত্ন করে দাড়ি কেটেছে। আয়নায় সে নিজের মুখই তো দেখেছে অনেকক্ষণ ধরে। এটা মনে হতেই সে ভাবল মুখ দেখে বেরোনো কথার কথামাত্র! এসব ভাবতে ভাবতে সে শেষবারের মতো জালটা ছুড়ে দেয়। জালের দড়ি টানতে টানতে সে অনুভব করে জালে যেন কী একটা গোঁত্তা মারছে ! বিমল সাবধান হয়ে যায়। অত্যন্ত ধীর গতিতে সে জাল গোটাতে থাকে। জাল তুলতে তুলতে সে দ্যাখে পেল্লাই সাইজের একটা চিতল আটকা পড়েছে। এবার সে ভাবে ভাগ্যিস সে আজ নিজের মুখ দেখে বেরিয়েছিল !
বিমল দাস জানে মাছটি নিয়ে কোথায় যেতে হবে। চকচকে চিতল দেখে ভক্তিবাবুর জিভে জল চলে আসে। তিনি বিস্মৃত হন, মৎস্যভক্ষণ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার কথা। চিতলের পেটি চিবোতে চিবোতে তিনি একপ্রকার স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেন। ভক্তিবাবু খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময় দেখেন শরীর আবার আগের মতো পাথর হয়ে গেছে।
=====০০০=====
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন