Featured Post
গল্প ।। সামান্য মেয়ে ।। রণেশ রায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সুন্দরবনের এক প্রান্তিক গ্রাম। ছোট্ট একটা দ্বীপ। সুন্দরী গাছ আর গরান গাছে ঘেরা যেন এক সবুজ বনানী। সেখানে গড়ে উঠেছে কিছু মানুষের বাস। জমিতে চাষ, জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ আর মাছ ধরাই প্রধান জীবিকা। শাক সবজি ধান যা উৎপাদন হয় তা দিয়ে পরিবারের পেট চলে। যারা মধু সংগ্রহ করে বা মাছ ধরে তারা তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। উৎপাদন কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য মহাজনের ঋণের কারবার চালু থাকে। এখানে হরবছর ঝড় বন্যা লেগেই থাকে। সাগরের নোনা জল ঢুকে জমির চাষের বারোটা বাজিয়ে দেয়। মানুষের খাওয়া পড়ার অভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। আর তখন গরিব মানুষকে খাওয়া পড়ার জন্য মহাজনের দ্বারস্ত হতে হয়। গ্রামের চল্লিশ পঞ্চাশটি পরিবারের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু। তাদের জমিজমা বেশি থাকায় উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় যা তাদের বাড়তি লাভ। এছাড়া এরা ব্যবসা মহাজনী কারবারের সঙ্গে যুক্ত। মহাজনী কারবার ব্যবসাই এদের সমৃদ্ধির কারণ। এ গ্রাম ছাড়াও এদের শহরে ব্যবসা ঘর বাড়ি সম্পত্তি আছে। ধরুন এই অজ পাড়াগাঁয়ের নাম অমাবস্যার চাঁদ। ভ্রমণ রসিক মানুষের কাছে এই গ্রাম থেকে দেখা জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ এই ছোট্ট দ্বীপের সবুজ বনানী নদীর কলোকল যতই মনোরম যতই সুন্দরী রহস্যময়ী মনে হোক না কেন এখানে বসবাসকারী রোজ জীবিকার জন্য যুদ্ধরত মানুষগুলোর কাছে ব্যাপারটা এক নয়। বোধ হয় এটা উপলব্ধি করেই কোন কালে কোন পরিব্রাজক বা সাহিত্যিক এই গ্রামের আপাত সৌন্দর্যের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের ভয়াভয় দারিদ্রের জীবন দেখে এই গ্রাম সমাজকে তিনি এ ভাবেই দেখেছিলেন যেখানে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচে মানুষের জীবনটা অন্ধকারে ঢাকা থাকে। ঠিক যেমন কবি সুকান্ত দেখেছিলেন: পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
এই অজপাড়াগাঁয়ের এক সামান্য মেয়েকে নিয়েই আমাদের এই উপাখ্যান। মেয়েটির বয়স হয়তো বছর কুড়ি হবে । হয়তো বলতে হল কারণ এ ধরণের গ্রামে গরিব মানুষের ঘরে জন্মানো সন্তানের জন্ম দিন লিপিবদ্ধ থাকে না। অনেক সন্তানের সবার নাম বাবা মায়ের মনে থাকে না। যদি জন্মের পর থেকে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ থাকত তবে জন্মদিনটা মনে থাকত। সেটা এই গ্রামীণ জীবনে গরীব ঘরে তেমন চালু নেই।তাও গ্রামে একটা স্কুল থাকায় একটা দিনকে জন্মদিন বলে নথিভুক্ত করার রীতি চালু হয়েছে এখন। গরিব বাবা আমাদের গল্পের এই মেয়েকে আদর করে বুড়ি বলে ডাকে। ওই ডাকেই সবাই ওকে চেনে। আর ওদের অপর্ণা বা সুপর্ণার মত মন ধরানো ভালো নাম দিয়ে কি হবে! যারা স্কুলের গন্ডি টপকাবার সুযোগ পায় না গ্রামের বাইরের জগৎটা যারা চেনে না তাদের ভালো নামে কাদের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবে! তার চেয়ে গাঁয়ের মেয়ের গেঁয়ো নামে পরিচিতিটাই ভালো। সেটা অনেক আন্তরিক। বুড়ির বছর কুড়ি বয়স। পড়াশুনার ইচ্ছে থাকলেও বেশিদূর এগোতে পারে নি। স্কুলের বেড়া ডিঙানো সম্ভব হয় নি। সামান্যের মধ্যে যদি অসামান্য কিছু থাকে তার তা হল মিষ্টি মুখ, মুখে লেগে থাকা হাসি আর শরীরের ছিপছিপে গঠন। সে যখন হাসে কাশ ফুল ফোটে। সে যখন হাটে কবিতার ছন্দ তাতে। কবির ভাষায় কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ। তবু সে সুন্দরী নয়। ঘরে অভাব, সে অভাবের ছায়া চেহারায়। তেমন চাকচিক্য নেই। ঘরে বাইরে তার কাজ। মায়ের সাথে ঘরে সংসার আগলানো। ছোট ভাই বোনেদের দেখাশুনা। দোকান পাট সবই। তারপর বাড়তি কাজ বাবাকে সামলানো। একজন দিন মজুর বাবা সারাদিন খেটে খুটে বেসামাল হয়ে ঘরে ফেরে। তখন মাকে পাহারা দেওয়ার কাজ মেয়ের। বাবা বাড়িতে মেয়েকেই ভয় করে। ভয় বললে হয়তো ভুল বলা হয়। স্নেহবশত সমীহ করে। মেয়ে বাবার আদরের দুলালী। অন্ধ স্নেহ তার প্রতি। মায়ের ওপর বাবার যত হম্বি তম্বি। কিন্তু মেয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তার নেই। বেসামাল অবস্থাতেও নিজেকে মেয়ের সামনে সামলে রাখে। মেয়ে ঘরে বাইরে এত সামাল দেওয়ার মুখে নিজে বেসামাল হয়ে পড়ে যার ছোঁয়া লাগে শরীরে মুখে। তাও যা অবশিষ্ট তাতে চেহারার ওই মাধুর্য। হলপ করে বলা যায় জীবনযাপনের এই বেয়ারাপনা না থাকলে সে সুন্দরী বলে খ্যাতি পেত। তবে তাতে তার কিছু আসে যায় না। বরং গরিব মানুষের সে খ্যাতি বিড়ম্বনার কারণ হতে পারত গ্রামের উচ্চবিত্ত ভদ্রলোকদের কল্যানে। মানুষের চোখে পড়ার ভয় থাকত। তাও যে মধ্যে মধ্যে সে গ্রহে পড়তে হয় না তা নয়। তবে তাকে এড়িয়ে চলার কায়দা সে বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে শিখে গেছে।
সুন্দরবনে বিদ্যাধরি নদী থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া একটা খারির মুখে বুড়িদের গ্রাম। সেই গ্রামে কয়েকটি বিত্তশালী পরিবারের বাস। শহরে ব্যবসা আর গাঁয়ে জমির মালিকনার দৌলতে তাদের বিত্ত।এরকমই একটা বিত্তশালী পরিবারের কর্তার নাম কুশল মানি। ভদ্রলোক নিজে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। গ্রামে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি। কুশল বাবুর ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ ভিন প্রদেশে চাকুরীরত আর কেউ কেউ শহরে থাকে চাকুরী বা ব্যবসা সূত্রে। মেয়েরা যার যার শশুর বাড়িতে। ছয় ছেলের মধ্যে দুজন কুশলবাবুর সঙ্গে থাকে। এখানকার ব্যবসা জমি জমা দেখাশোনা করে। তাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। কুশলবাবু রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ছেলেদের বা নাতীদের মিশনে ভর্তিতে অসুবিধে হয় না। পড়াশুনার দৌলতে প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত। কুশলবাবুর বড় মেয়ে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত গড়িয়ায় থাকে। স্বামী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মেয়ের ঘরের নাতিটি কুশলবাবুর নেওটা। দাদুর কাছে ছোট বেলা থেকে আসাযাওয়া। একটু ভাবুক প্রকৃতির ভালো ছেলে। ছেলেটির নাম নীলাশীষ, সবাই নীলু বলে ডাকে। লেখাপড়ায় ভালো। এখন ইংরেজি নিয়ে এম এ পড়ে। এই গ্রামের জীবনের প্রতি একটা টান আছে। মধ্যে মধ্যে চলে আসে। একুশ বাইশ বছর বয়স। প্রকৃতি ওকে টানে। ওর প্রকৃতি প্রেম ওকে লেখার উপাদান যোগায়। আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখা এখানকার মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে ওর উৎসাহ। তবে প্রকৃতির প্রাচুর্য আর তার মধ্যে মানুষের কঠিন জীবন যাপন, এই বৈপরীত্য তাকে পীড়িত করে।প্রকৃতি একদিকে যেমন উদার অন্যদিকে তেমনি নিষ্ঠুর। আর তার নিষ্ঠুরতার শিকার প্রধানত গরিব মানুষ। প্রকৃতির দানের সবটাই লুট করে নেয় বিত্তশালী মানুষ। গরিব মানুষ প্রকৃতিকে ছেঁচে যে সম্পদ সৃষ্টি করে তার কণামাত্র গরিব মানুষ পায় না। দিনে দিনে একদিকে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে আর তার ফলে একটা ক্ষুদ্র অংশ লাভবান হচ্ছে। অপরদিকে মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হচ্ছে। প্রকৃতির রোষের শিকার হয় গরিব মানুষ। তাদের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই নাগালের বাইরে। নীলুর ভাবুক মন এই স্ববিরোধতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। এর প্রতিকারই বা কি ভেবে পায় না।
বুড়িদের বাড়ির কাছেই একটা পুকুর। জ্ঞান হওয়ার পড় থেকে এ গ্রামের সবচেয়ে কাছের কিছুর মধ্যে বুড়ির কাছে পুকুরটাই সবচেয়ে আপন জন। পুকুরের কাছেই সে তার যা কিছু নির্দ্বিধায় সমর্পণ করে। সেই শিশুকাল থেকে তার শরীর মন উৎসর্গ করেছে এই পুকুরকে। তার কাছে বুড়ির কোন লজ্জা নেই। বুড়ির সুখ দুঃখের সাথী এই পুকুর। নিজের নগ্ন শরীর সে এই পুকুরের বুকে ভাসিয়ে দিতে কখনও কার্পণ্য করে নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে তার নারীত্বকে আবিষ্কার করেছে পুকুরের সঙ্গে জলকেলিতে। পুকুর তার সব চাহিদা মেটায়। পুকুরের জলই তার জীবন। পুকুরের জলে তার জ্বলন্ত শরীর শীতল হয় মন শান্ত হয় পিপাসা মেটে। বাসন বসন ধোয়া মোছা সবেতেই পুকুর তার বন্ধু। তাই দিনের একটা বড় সময় বুড়ির কাটে পুকুরে, কখনও জলে কখনও পুকুর পাড়ে। সে পুকুরের সঙ্গে নিভৃতে সুখ দুঃখের কথা বলে। পুকুর তাকে তার বারোমাস্যার কথা তুলে ধরে। গ্রীষ্মের দহনে তার ভরাট বুক ক্ষীণকায় হয়ে যায়। সে চেহারায় তাকে চেনাই যায় না। বর্ষায় তার ভরা যৌবন। শীতে সে আবার মজে যায়। ঝড় তুফান পুরুষাকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে কখনো কখনো। ক্ষত বিক্ষত করে তাকে। সমুদ্রের নোনা জল যেন তাকে ধর্ষণ করে। আবার বসন্তের সবুজ বনানী তাকে হাতছানি দেয়। পুকুরের এই সুখ দুঃখের বারোমাস্যার সঙ্গে বুড়ির নাড়ীর যোগ।
বুড়ি আর কারও চোখে না পড়লেও নীলুর চোখে পড়ে। পুকুরের পর বুড়িও বাবা মা ছাড়া আর যাকে আপন করে চিনেছে এই গ্রামে সে হল নীলু। এই পুকুরকে সাক্ষী রেখেই দুজনের আলাপ। এক অসম বন্ধুত্ব। কি আর্থিক অবস্থা কি সামাজিক মর্যাদা কি বিদ্যা বুদ্ধি সব কিছুর বিচারেই এ এক অসম সম্পর্ক। তাও সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। প্রথমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার আগেই নীলু বুড়িকে আবিষ্কার করেছে তার রূপে তার সৌন্দর্যে। শরীরের রূপে চলন বলনের সৌন্দর্যে। এই অসম দুই কিভাবে একে রূপান্তরিত হলো সেটা জেনে নেওয়া যাক। বিকেলে বুড়ি যখন সব কাজকর্ম ছেড়ে পুকুর পাড়ে বসে পুকুরের সাথে গল্প করে তখন নীলুকে প্রায়ই দেখা যায় উদাস মনে পুকুর পাড়ে। পুকুর ঘাট থেকে অদূরে সুন্দরী গাছ আর গরান গাছে আচ্ছাদিত রূপসী দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে আড়চোখে বুড়ির দিকে তাকায়। উদাস মনে কি যেন ভাবে। বোধহয় ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী গাছ তার কাছে বুড়ির ছিমছাম দেহ বৈশিষ্ট্য। আর সবুজে সবুজে গরানের গুল্ম যেন তার মুখাবয়ব যা হাসির চ্ছটায় প্রস্ফুটিত। নীলুর রোমান্টিক মনে মান্না দের একটা গানের কলি ভেসে আসে: সে কেন এত সুন্দরী হল---
নীলু আবিষ্কার করে বুড়িকে কেবল দেহ সৈষ্ঠবে নয় তার মানসিক সৌন্দর্যেও সে তাকে চিনেছে। বুড়িও উদাসিন এই যুবকের মধ্যে এক প্রেমিককে যেন খুঁজে পায়। যে শুধু দেহের নয় মনেরও পিয়াস।
কিছুদিনের জন্য নীলু এসেছে এ গ্রামে। গ্রীষ্ম কাল। বৈশাখ শেষ হয়ে জৈষ্ঠ। গ্রীষ্মের দহনে শরীরে জ্বলন। এ জ্বালা শুকোতে সময় লাগে। যতক্ষণ না বর্ষা নামে। দিনের শেষ বেলাতে তাপ কিছুটা কম। পুকুর পাড়ে বাতাসের শীতল হাওয়ায় শরীরের জ্বালা মেটে। সঙ্গে মনের জ্বালাও কমে। বিকেলে যথারীতি বুড়ি এসেছে তার সইয়ের কাছে। এরই মধ্যে বুড়ি লক্ষ্য করেছে নীলুও এসেছে। এখন নীলু শুধু যে প্রকৃতির টানে আসে তা নয়। তার মানসে এক মানস সুন্দরী। সেই হয়তো এখন তার প্রকৃতি। সে টান সে উপেক্ষা করতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ এক বিপত্তি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। আকাশে ধূমায়িত মেঘ যেন আছড়ে পড়বে। সুন্দরবনের গ্রীষ্মের এই বিকেলটাকে নীলু চেনে না। মাতাল হয়ে ওঠে বাতাস। আছড়ে পড়ে ঝড়। সব যেন লন্ড ভন্ড। এখান থেকে কুশলবাবুর বাড়ি বেশ দূরে। এদিকে নীলু পুকুরের পাড়ে ঢালের কাছে। বুড়ি প্রকৃতির এই চরিত্র জানে। এরপর কি হতে পারে সে আন্দাজ করে। এই অবস্থায় নীলু টাল মাটাল হয়ে যেতে পারে। ঝড়ের ধাক্কায় হয়তো পড়ে যাবে পুকুরের জলে। ভালো সাঁতার না জানলে বিপদ। এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বিপদ বুঝে বুড়ি এগিয়ে আসে। সে আসতে আসতে যে ভয় পাচ্ছিল তাই হয়। নীলু নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। বুড়ি এগিয়ে এসে ওকে ধরে। নীলু বুড়িকে ধরে ওঠে। খুব জোড়ে বৃষ্টি নামে। দুজনে কাছেই একটা ছাউনিতে আশ্রয় নেয়। এই প্রথম দুজনে দুজনের চোখাচুখি । কথা বলার সুযোগ।বর্ষণ সিক্ত বসনে বুড়ি আনত মুখে নীলুর কথার উত্তর দেয়।পরস্পরকে আনুষ্ঠানিকভাবে চেনা। কার কি নাম কে কি করে কোথায় থাকে ইত্যাদি। তবে এতে পরস্পরকে চেনার আগ্রহের তেষ্টা কারও মেটে না। এরই মধ্যে বৃষ্টি ভেজা নারী দেহ নীলুকে চিনিয়ে দেয় বুড়ির দেহ সৈষ্ঠব। নামের সঙ্গে চেহারার কি অমিল। নামটা যেখানে তাকে নিয়ে যায় আকাশ পারে চরকা কাটা বুড়ির দুয়ারে তেমনি এই বৃষ্টি ভেজা নারী শরীর তাকে সুযোগ করে দেয় সেই বর্ষা রাতে বিরোহিনীর ঘরে উঁকি মারতে। এ যেন পুকুরের ছায়ায় দেখা এক যুবতী।সিক্ত স্নিগ্ধ। দিনের রোদের দহন আর পরিশ্রমের ক্লান্তিতে রিক্ত শরীরটা বৃষ্টিতে ভিজে আর স্নিগ্ধ বাতাসে সিক্ত হয়ে ওঠে।আর ওর কথাবার্তা সম্ভ্রব বোধ নীলুকে আকৃষ্ট করে।বুড়ি বোঝে নিলু শিক্ষিত মার্জিত এক পুরুষ। সে কৃতজ্ঞ তার সাহায্য পেয়ে। সে বার বার বলে আজ বুড়ি তার প্রাণ রক্ষক। তবে দুজনেই এই প্রথম আলাপে মনের টানটা যতটুকু অনুভব করে শরীরের টানটা ততটা নয়। সংযত দুই পুরুষ নারীর প্রথম পরিচয়টা জনমানব শূন্য এই রহস্যময়ী আলো আঁধারেও মানসিক যোগাযোগের মধ্যেই সীমিত থাকে। বেশ কিছু পর বৃষ্টি থামলে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেই একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। দুজনেই সঙ্গে নিয়ে যায় শরীর ও মনের এক অচেনা অথচ কাঙ্খিত স্পর্শের রেশ।
এরপর থেকে দুজনকে দেখা যায় গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরালা খুঁজতে। নীলুর এখানে আসার আকর্ষণ বেড়ে যায়। ও এলে ওরা দুজন দেখা করে। নির্জনে বসে গল্প করে। কখনও বনে বাদারে কখনও পুকুর পাড়ে। দুজনের শিক্ষা দীক্ষা চাল চলনে ব্যাপক ফারাক থাকলেও যখন ওরা আলাপে প্রলাপে তখন এই আনুষ্ঠানিক বৈপরীত্য দূর হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে কাছে টেনে নেয়। পরিবেশের বন্যতা তাদের সভ্য সমাজের কৃত্রিমতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সুন্দর বনের আদিমতা তাদের আঁধারে ঢেকে দেয়। সুযোগ করে দেয় একজনকে আরেকজনের কাছে পেতে। দুজনের একান্ত আলাপে সব সময় যে প্রেমের জোয়ার বয় তা নয়। মত পার্থক্য দেখা যায়, সংশয়ের কালো মেঘ উঁকি মারে। বিশেষ করে আলোচনা প্রসঙ্গে উভয়ের পরিবারের সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন যখন ওঠে। বাড়িতে কে কি করে সে সব আলোচনা হয়। বুড়ি সবসময় যেন দ্বিধাগ্রস্ত শঙ্কিত থাকে। একেই সে গাঁয়ের মেয়ে। গাঁয়ের আঁচার আচরণ চাল চরণ শহরের শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে আলাদা। দুটো পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি শিক্ষা দীক্ষা দুজনকে সামাজিক মর্যাদায় দুই প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এই অবস্থায় সমস্যাটা মেয়েদের বেশি বিশেষ করে অর্থে শিক্ষায় সামাজিক মর্যাদায় মেয়েরা যদি বুড়ির মত শতছিন্ন পরিবার ভুক্ত হয়। ছেলের পরিবার যদি বিত্তশালী হয় তবে সাধারণত সেই বিত্তশালী পরিবার থেকে চাহিদাটা আকাশ প্রমান। বিয়ের যৌতুক যদি থাকে তবে তো প্রশ্নই ওঠে না। সাধ্যাতীত। তাছাড়া লেখাপড়া চাল চলন কিছুতেই খাপ খায় না। এসব ভেবে বুড়ি শঙ্কিত হয়। প্রাথমিক আবেগটা কেটে গেলে নীলু কি ওকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারবে? নীলু পারলেও ওর পরিবার। বুড়ি জানতে চায়। এতে নীলু বিড়ম্বনায়। সত্যি কথাটা পুরো বলতে পারে না। জানে বাড়ি মানিয়ে নিতে পারবে না। ও নিজেও কি পারবে? উত্তরটা সবটা জানা নেই। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী সমাজে মর্যাদাসম্পন্ন একজনের পক্ষে বাস্তবে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। নীলু সেটা জানে। জানে বলেই আলাপ চারিতায় তার ব্যবহারে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। আর বুড়ির মত মেয়েদের বাস্তব বোধ অতি তুখোড় কারণ বাস্তবকে তাদের মত মেয়েদের মুখোমুখি প্রাত্যহিক জীবনে মোকাবিলা করতে হয়। তাই সে সেটা বোঝে। তাও প্রেমের আমেজে বিষয়গুলো চাপা থাকে। এক ধরণের স্পর্ধা মাথা চাড়া দেয়। স্পর্ধা নিয়েই বুড়িরা বেঁচে থাকে। কিন্তু নিলুরা কি পারবে শেষ রক্ষা করতে, প্রেমের নিগড় আঁকড়ে ধরে রাখতে। নাকি আর দশটার মধ্যে নয়টায় যা ঘটে তারই এখানে পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সেই বিচ্ছেদ বিরহের সেই খেলা!
ওদের এই মেলামেশায় অসম সম্পর্কে গ্রামের মানুষের মধ্যে আলোড়ন ওঠে নি যে তা নয়। ব্যাপারটা আর এখন গোপন নয়। ওরা দুজন চলা ফেরা মেলা মেশায় আগের থেকে অনেক বেশি স্পর্ধিত। অনেকটাই খোলা মেলা। বলতে গেলে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলে। এটা যে সবাই মেনে নেয় তা নয়। তবে এ ধরণের অজপাড়াগাঁয়েও আজ শহরের ছোঁয়া। ছেলে মেয়েরা আগের তুলনায় অনেকটাই লাগাম ছাড়া। ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে স্কুলের পড়ে। মেয়েদের উপস্থিতি স্কুলে রাস্তা ঘাটে খেলার মাঠে বেড়েছে। পরস্পর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । তাই এসব নিয়ে এখন আর তেমন হৈ চৈ হয় না। ঘরে ঘরে এর প্রভাব। অন্যের ঘরের আলোচনা আনতে গেলে সবারই নিজের ঘরে চোখ পড়ে। তাই এ ধরণের সম্পর্ক নিয়ে আসর বসিয়ে তা নিয়ে গুলতানি হয় না আগের মত। তবে এ নিয়ে আড়ালে আগডালে কথা হয়। বিব্রত হয় বাড়ির অভিভাবকরা। যেমন মানি মাস্টারমশায়ের কাছে নাতি নিয়ে নালিশ এসেছে। তিনি রীতিমত অস্বস্তিতে। আজকের দিনে প্রেম ভালোবাসা আর কারও অভিভাবকের অভিভাবকত্ব মেনে চলে না। সেটা মাস্টারমশাই জানেন। এ নিয়ে তিনি নাতিকে শাসন করতে ভরসা পান না। আবার চিন্তা আছে ব্যাপারটা মেয়ে জামাই কিভাবে নেবে। আর এই অসম সম্পর্কটা তিনি জানেন জামাই মেনে নেবে না। তাদের যে আর্থিক অবস্থা আর জীবন ধারণ তাতে দুস্থ প্রায় অশিক্ষিত পরিবার আর সে বাড়ির মেয়েকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। উনার স্ত্রী বেঁচে নেই যে সে ব্যাপারটা সামাল দেবে। এর জন্য তাকেই দায় নিতে হবে। তিনি যে কি করবেন ভেবে পান না। ওদিকে বুড়ির বাবার অবস্থা আরও খারাপ। তিনি জানেন ব্যাপারটা একদম মানান সই নয়। সমাজ একে গ্রহণ করে না। অনেকে ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছে যে মানু বাবু মানে বুড়ির বাবা সুযোগ নিয়ে মেয়েকে এক বোকা ভালো ছেলের ঘারে চাপিয়ে দিতে চাইছে। অথচ মানু বাবু কিন্তু মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন। দুচারজনের সঙ্গে কথাও বলেছেন। তবে একটা গরিব পরিবারে মেয়ের বিয়ে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তিনি মেয়ের এই বিষয়টা একেবারেই পছন্দ করেন না। বরং তাঁর মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। ধনি পরিবারের সুখী ছেলে। সেখানে মেয়ের সুখ কি সইবে? ওদের কখন কি মর্জি হয়। ঘোর ভাঙলে ছেলে সরে যেতে পারে। এর মধ্যে কোন অঘটন না ঘটে! উনার নানা দুশ্চিন্তা। তিনি মেয়েকেও বকাবকি করেছেন। কিন্তু তার আর কি করার আছে ? আরও একটা ব্যাপার তলায় তলায় পাকাচ্ছে। সে আর এক সমস্যা। এ গ্রামের এক মহাজন নিধিবাবু তাঁর ছেলের জন্য বুড়িকে পাত্রী হিসেবে পেতে চান। মহাজন মানুষটাকে মানুবাবুর একেবারেই পচ্ছন্দ নয়। শুধু টাকা বোঝে। আর গরিব মানুষকে পায়ের তলায় রাখতে চেষ্টা করে। ছেলেটাও তথৈ বচ। গুণের শেষ নেই। জুয়া মদ তো আছেই। তাছাড়াও অনেক। মানুবাবু নিজেও একজন মাতাল। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে মাতালের বিয়ে দিতে আপত্তি। আবার গ্রামের এরকম এক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রস্তাব মুখের ওপর অস্বীকার করা মুশকিল। অথচ জানেন এমন জামাইয়ের সঙ্গে মেয়ে বেশিদিন ঘর করতে পারবে না।
গ্রামীন সমাজে মানুষগুলোর মধ্যেকার বাদ বিবাদ হিংসা প্রতিহিংসা পরস্পর সহযোগিতা আনন্দ নিরানন্দ কোন আভিজাত্যের আড়ালে আড়াল থাকে না। তা খোলাখুলি অনেকসময় দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ পায়। সভ্য সমাজে যা একধরনের অসভ্যতা। এই গ্রামের পারস্পরিক সম্পর্কেও এটা ব্যতিক্রম নয়। সেই জন্যই দেখি মানি মাস্টারমশাইকে তার নাতিকে নিয়ে নানা রকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। মাস্টারমশাই এর সঙ্গে নিধিবাবুর বিরোধটা প্রকাশ্যে আসে। গ্রামের মানুষের যে শ্রদ্ধা মাস্টারমশাই পান সেটা নিধিবাবু পান না। যদিও নিধিবাবুর আর্থিক প্রতিপত্তি মানি বাবু থেকে কম নয়। আর মাস্টারমশাই দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে নিধিবাবুর মহাজনী কারবার ফেঁপে ওঠাটাকে পছন্দ করেন না। সে নিয়ে পরষ্পর দ্বন্দ্ব বিদ্বেষ। নিধিবাবুর মধ্যে একটা প্রতিহিংসা স্পৃহা কাজ করে। মাষ্টার মশাইয়ের নাতির বুড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে নিধিরাম ঘোট পাকানো শুরু করেন। তার দুটো উদ্দেশ্য। মাষ্টার মশাইকে অপদস্ত করা আর একই সঙ্গে নাতিকে বুড়ির থেকে দূরে সরিয়ে বুড়ির বাবাকে বাধ্য করা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। উনু জানেন উনার পরিচয়ে আর ছেলের গুণের জন্য এখানে সক্ষম পরিবারগুলোর ঘরের মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়া মুশকিল। আবার উনার ছেলে তার নিজ গুনেই আসে পাশে গ্রামে পরিচিত হয়ে গেছে। আর উনি তো তার বড় পরিবারের জন্য একজন বউ একই সঙ্গে বাদী চান যে তাঁর ঘরে দিনরাত মুখ বন্ধ রেখে গতরে খেটে যাবে আর একই সঙ্গে ছেলের সব অপকীর্তি মেনে নিয়ে তার রাতের সঙ্গিনী হবে।সেটা সম্ভব মানুর মত গরিব মানুষের মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েই। নিধিবাবু তার এই দ্বিমুখী লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বলে বেড়াচ্ছেন মানিবাবুর প্ৰশ্রয়ে গরিব অশিক্ষিত মানুষগুলো বেড়ে উঠছে। তাদের ঘরের মেয়েরা বেপরোয়া। এটাকে আটকাতে না পারলে গ্রামের জীবনে উশৃঙ্খলা দানা বাঁধবে। গ্রামের বেশ কিছু মানুষ নিধিরামের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে তাকে সমর্থন করে। মানি মাস্টারের সামাজিক সম্মানের হানি ঘটতে থাকে বলে উনি আশংকিত হয়ে ওঠেন। উনি গরীব মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও উনার আর্থিক প্রতিপত্তি সামাজিক মর্যাদা উনাকে নাতির সঙ্গে বুড়ির প্রেম ঘটিত ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাই নাতি এ পথ থেকে সরে আসুক সেটা তিনি চান। আর তার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে যার সঙ্গে মানুবাবুর পরিবারের আত্মীয়তা সম্পর্কটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই তিনি বুঝেও নিধিরামের আক্রমণের মুখে নিজেকে কম জোরি বলে মনে করেন। তার কাছে এ লড়াই নিজের সন্মান রক্ষার লড়াই বলে মনে হয় যেটাতে জয় সম্ভব ওদের বিচ্ছেদে। যদি নাতি সরে আসে তবে তা নির্বিগ্নে ঘটে যায়। নিধিরামের মত একটা লোকের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যেতে হয় না। নিজের সন্মান বাঁচিয়ে এ যুদ্ধে জয় সম্ভব।
ইদানিং এ গ্রামে বুড়ি আর নীলুকে আগের মত দেখা যায় না। আগে প্রতি শনি রবিবার ছুটিতে নিলু যেমন নিয়মিত আসত এখন তেমন আর আসতে পারে না। হয়ত ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার চাপ বেড়েছে অথবা কুশলবাবু নাতির বেশি আসাটা পছন্দ করেন না তাই। বুড়িকে নিলু জানিয়েছে এ নিয়ে দাদু বিরূপ। আর নীলুর বাবা মা ব্যাপারটা জানায় জটিলতা বেড়েছে। তবে কি নিলু আসতে আসতে সরে যাচ্ছে। বাড়ির চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে চলেছে! প্রশ্ন ওঠে বুড়ির মনে। এ ব্যাপারটা আগে বুড়ি নীলুর কাছে তুলেছিল। এরকম একটা অমিলের মেলবন্ধন কি সম্ভব। এতটা অসম সম্পর্ক বাস্তবে কার্যকরী হওয়া ততটা সম্ভব নয় বলে সে সংশয় প্রকাশ করেছিল। কিন্তু নিলু সেটা গ্রাহ্য করে নি। তাকে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ী মনে হয়েছিল। আর নীলুর একার কেন বুড়িরও তো একটা সমস্যা ছিল। ও বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। জানত নিধিবাবুর চাপ দিন দিন বাড়ছে। বাবাকে রাজি হতে বাধ্য করানোর চেষ্টা চলছে। আর গ্রামের কেউ কেউ তাতে সায় দিচ্ছে। নিধিরাম এর প্রস্তাবটা বুড়ির বাবা যখন বুড়িকে জানায় তখন বুড়ি সেটাতে আপত্তি জানায়। কিন্তু ও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। জানত নিধিবাবুরা পয়সার প্রতিপত্তি খাটিয়ে বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এ কাজটা সম্পন্ন করতে চাইবে। আর বাবার পয়সা নেই, সেই গরিমা নেই যে ইচ্ছেমত মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করবে। ওদিকে এটাও সত্যি যে সে নীলুর ও তার পরিবারের কাছে তেমন মানানসই নয়। আর বিয়েটা তো মানানসই দুজনের মধ্যে গাঁট বন্ধনের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের সামাজিক স্বীকৃতি। প্রেম সেখানে পরের প্রশ্ন। প্রেম থাক বা না থাক মানিয়ে চলার বিষয়টি প্রধান। আর মেয়েদের কাছে মানিয়ে চলাটা বাধ্যবাধকতা। তার নিজের সত্তা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হলেও। প্রেমে পড়ে নিলু নিজেকে প্রত্যয়ী বলে যতই মনে করুক না কেন বিয়ে আর প্রেম সব সময় একই প্রবাহে বয় না। বিয়ের পর জটিলতা তৈরী হয়। সেও হয় তো ও বাড়িতে শেষ পর্যন্ত বান্দায় পরিণত হবে। যেভাবে নিধিরাম ওকে উনার বাড়িতে বউ হিসেবে পেতে চায় সেটাই নীলুর বাড়িতে ওর পরিণতি। বিশেষ করে ও যেখানে পড়াশুনা জানে না। আচার আচরণে একটা বৈপরীত্য। এই সব সাথ পাঁচ ভেবে বুড়ি একেক সময় ভাবে এই সম্পর্কটা না তৈরী হলেই ভালো হত। ওদের মত গরীব ঘরের মেয়ের কাছে এটা দিবাস্বপ্ন। নিধি বাবুদের খোয়ারেই ওদের স্থান। আর বাবা এই নিয়ে যদি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তবে বাবাকে দোষ সে দিতে পারে না। দারিদ্রই এর জন্য দায়ী। গরীব বলেই ওর পড়াশুনা হয়নি সামাজিক মর্যাদা সে পেতে পারে না । তাই এটাই যেন বিধাতার বিধান। তাকেও হয়তো মেনে নিতে হবে।
নীলু বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পড়াশুনা আর অন্য কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাড়িতে বুড়িকে নিয়ে বিশেষ করে বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। সম্পর্কটা জানা জানি হবার পর বাবা রীতিমত খড়গ হস্ত। এর জন্য দাদুকে যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে। সেটা নীলু মেনে নিতে পারে নি। মাও ব্যাপারটা যে মেনে নিয়েছেন তা নয়। তবে তিনি নিলুকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে এ ধরণের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা শক্ত। এই সমাজে মায়ের এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক বলে মনে হলেও বাবার সঙ্গে তার বিরোধ কারণ বুড়ির পরিবার গরিব বলে তারা বাবার কাছে মানুষই নন। তাছাড়া আনুষ্ঠানিক বিচারে অশিক্ষিত। পরিবারের সাথে বিরোধ নিলুকে পরিবার থেকে যেন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সময় কাটায়। অনেক সময় বাড়ি ফেরে না, বাড়িতে থাকলে পড়াশুনা নিয়ে থাকে। আর সে একটা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যারা দেহ ব্যবসায়ী মেয়েদের অধিকার সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে লড়াই করে, তাদের মুক্তির কথা ভাবে। সেই সূত্র ধরে নিষিদ্ধ পল্লীতে তাদের যাতায়াত। তার এম এতে অধ্যয়নের বিশেষ বিষয় এইসব মেয়েদের শিল্প সাহিত্য প্রতিভা। এই নিয়ে সে লেখালেখি করে। এদের বাস্তব জীবন যেন ওকে জীবনটাকে দেখার ব্যাপারে নতুন একটা চোখ দিয়েছে। সে আমাদের স্বীকৃত সমাজের সঙ্গে এই সমাজটার পার্থক্য বোঝে।একটু গভীরে ঢুকে বুঝতে চেষ্টা করলে চমকে ওঠে। আমাদের সমাজটা স্বীকৃত কিন্তু এই সমাজটা ব্রাত্য যদিও আমাদের সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত গরিব বড়লোক সব স্তরের মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটাবার জন্যই অর্থের মাধ্যমে লেনদেনে গড়ে উঠেছে এই বাজার। এটাও পণ্যের বাজার। মেয়েরা এই বাজারে মাছ মাংস শাক সবজির মত পণ্য। ফল ফুল সবজি এমন কি বিশেষ ক্ষেত্রে মাছ মাংস দেবতার প্রাঙ্গনে উৎসর্গের দ্রব্য হলেও তা বাজার থেকে এনে ঘরে তুললেও একটা জ্যান্ত মানুষ একই সেবা করেও অর্থাৎ মানুষের চাহিদা মেটালেও এই সমাজে অস্পৃশ্য ব্রাত্য হয়ে যায়। মূল সমাজে তার জায়গা হয় না। সভ্য জগতে এ এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতা। এই দেহব্যবসায়ী মেয়েদের সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরাও ব্রাত্য।
অনেকদিন পরে নীলু সুন্দরবনের সে গ্রামে। দিদিমা বেশ কিছুদিন মারা গেছেন। তখন পরীক্ষা থাকায় আসতে পারে নি। তাছাড়া বুড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা নেই। ওর বিয়ে হয়ে গেছে সেই নিধিরামের ছেলের সঙ্গে। বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবাকে বাঁচাতে। দু বছর আগে যে ভয়ঙ্কর ঝড় তুফান তাতে ওদের ঘর ভেঙে যায়। বাবাকে নিধিরাম টাকা দেয় ঘর করে নিতে। সে টাকা শোধ দিতে পারে না বাবা। তারপর চাপে পড়ে বাধ্য হয় মেয়েকে ও বাড়িতে সমর্পণ করতে। নীলুর খুব ইচ্ছে জানতে ও কেমন আছে। কিন্তু কি করে জানবে। এদিকে দাদুর শরীর ভালো না। তার দুই ছেলে এখন আলাদা থাকে। দাদু বড় ছেলের সঙ্গে ওর স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে। এখানে নীলুর আর আগের মত টান নেই। তাও দাদুর স্নেহ ধন্য সে। দাদুর কাছে বুড়ি আর বুড়ির পরিবারের খবর পায়। বুড়ি শ্বশুর বাড়িতে ভালো নেই। পরিবারের সব কাজ। তার ওপর জামাইয়ের উশৃঙ্খল জীবন। বুড়িকে মদ্য অবস্থায় কুৎসিত গালাগালি আর মারধর করে। এই নিয়ে গ্রামের মানুষজন বিরক্ত। ওকে সাবধান করলেও কিছু আসে যায় না ওদের। শুনে নীলুর মন খারাপ। নিজেকে দায়ী করে। ও যদি ওর ব্যাপারে যত্নশীল হত ওর নিজের সিদ্ধান্তে কঠিন থাকত তবে মেয়েটার এই পরিণতি হত না। ওর ইচ্ছে করে ওকে একবার দেখার।
বিকেল না হতেই নীলু সেই পুকুর পাড়ে। অতীত স্মৃতি তাকে তাড়া করে। এখানেই বুড়ির সাথে আলাপ। সেই ঝড় তুফান। বৃষ্টিস্নাতা বুড়ি যেন সামনে দাঁড়িয়ে। সেই দুর্যোগে ওই ওর অভয়। বুড়ির জন্য জলে তলিয়ে যায় নি। মনে পড়ে এই সবুজ বনানী। নিটোল পুকুর যে পুকুরের জলের ছায়ায় সে আবিষ্কার করেছিল বুড়ির শরীরের সৌন্দর্য রাশি। তা আজ কেমন ধূসর। এই শীতের বিকেলে সূর্যের রেশমিতে পাতা ঝরে গেছে। গাছের মাথা ন্যাড়া মাথা । প্রকৃতি কেমন বিষণ্ণ। তার প্রকৃতি প্রেম যেন আজ বিরহ বেদনায়। অন্যমনস্ক নীলুর হঠাৎ চোখে পড়ে কে এক মহিলা কাপড় কাঁচছে। মনে পড়ে এই সময় বুড়ি কাপড় কাঁচত বাসন মাঝতো তারপর শরীরটাকে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিত কোন যেন পরিচিত এক ভঙ্গিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলুর মন বলে এই তো সেই বুড়ি। কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে। সেই টান টান শরীর ভেঙে পড়েছে। মাত্র দু বছরে এ কি চেহারা হয়েছে! দাদু বলেছেন বুড়ি ভালো নেই। এই ভালো না থাকার প্রত্যক্ষ নিদর্শন। ওদিকে বুড়িও নিলুকে লক্ষ্য করেছে। না চেনার কিছু নেই কারণ নীলু একই রকম আছে। দুবছরটা কোন সময় নয়। এরপর কোন ভনিতা না করে বুড়িই এগিয়ে আসে। জানতে চায় ওর খবর কি। তারপর দুজন পাশাপাশি আগের মত। বুড়ি জানায় ওর অবস্থা। ও বাধ্য হয়েছিল বিয়ে করতে। তারপর সেই অত্যাচার। কিছুদিন হল তার বাবা মারা গেছে। সে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে এসেছে আর ফেরার ইচ্ছে নেই। ছোট তিন ভাইবোন আর মা। মা বাবুদের বাড়িতে কাজ করে। সেও সকালে একবেলা কাজ করে। তার আর ফেরার ইচ্ছে নেই। শ্বশুরবাড়ি জোর করছে ফেরার জন্য। তারা বিনে পয়সায় পাওয়া এরকম এক বাদিকে হারাতে রাজি না যে সংসারের কাজ করে আবার অপদার্থ একটা মানুষের কামনা চরিতার্থ করে। তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। রোজগার বাড়াতে কি করবে ভেবে পায় না। এক এক সময় ভাবে মায়ের কাছে ভাই বোনকে রেখে নিজে শহরে গিয়ে একটা কাজ বেছে নেবে। বুড়ি জানতে চায় নীলু কি করছে। নীলু জানায় ওর পড়াশুনা শেষ হয়ে গেছে। একটা চাকরি খুঁজছে। ভেঙে সবটা বলে না। নিজের সংগঠনের কাজ বা বাড়ির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। কথা বার্তা শেষে দুজনে ঘরে ফিরে আসে। বুড়ি তাকে অনুরোধ করে এখান থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু বুড়ি পরস্ত্রী বলে সেটা নীলুর পক্ষে সম্ভব নয় বলে সে জানায়।
বছর পনের কেটে গেছে। এখন নীলুর বয়স চল্লিশ বা তার কাছে। সুন্দরবনে দাদু মারা গেছে। তার সেখানে আর যাওয়া হয় না। খবর পেয়েছে বুড়ি কলকাতায় কোথাও কাজ করে। তার রোজগারে সংসার চলে। কলকাতায় নীলুর অলিতে গলিতে যাতায়াত হলেও এই লোক অরণ্যে কোথায় বুড়িকে খুঁজে পাবে? তাও ভাবে কখনও যদি দেখা হয়। আর দেখা হলেই বা কি! ও কি করতে পারবে। নীলু মগ্ন থাকে দেহব্যবসায়ীদের সগঠনের কাজ নিয়ে। সমাজ সেবা হিসেবে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই তার ইচ্ছে। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও বাবার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। আর দেহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ সেটা তো সভ্য সমাজে পাতে পড়ে না। আর ওতে একটা অস্পৃশ্যতার ছোঁয়া আছে যেটা বাবার সংস্কৃতিতে ব্রাত্য। তাই সে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে উত্তর শহরতলিতে থাকে। টিউশনি করে নিজের ভালোই চলে যায়। আর ওর পড়ানোতে যথেষ্ট সুনাম। তাই অসুবিধে হয় না। বিয়ে করে নি। এরই মধ্যে জীবনের একটা পর্যায় সে পার হয়ে এসেছে যেটা আমাদের অজানা। এম এ পড়তে পড়তে নীলু যখন মেয়েদের এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ শুরু করে তখন ওর ক্লাশের রিনা বলে একটি মেয়ে ওই সংগঠনে কাজ করত। তখন নীলুর বুড়ির সঙ্গে সেই সম্পর্ক। মেয়েটি কাজকর্মে দক্ষ। ও নিলুকে পছন্দ করত। বিষয়টা যেন আর না গড়ায় তাই নীলু রিনাকে বুড়ির কথা বলে। রিনা বোধ হয় এই অসম সম্পর্ক টিকবে না বলে অনুমান করে। নীলুর সংগ ধরে থাকে। নীলু ওকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। তারপর বুড়ির সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়লে ওর বিয়ে হয়ে গেলে রিনারর সঙ্গে নীলুর সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। দুজনে একসঙ্গে কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। নীলু ভাবে ওর সঙ্গে বিবাহিত জীবনটা গড়ে তুলবে যেটা দুজনকে সংগঠনের কাজে সাহায্য করবে। কিন্তু এম এ পরীক্ষায় রিনা খুব ভালো ফল করে। বিদেশে গিয়ে পড়াশুনা করার জন্য স্কলারশিপ পায়। সে সেটা গ্রহণ করে। বিদেশে যাওয়ার পর কিছুদিন দুজনের মধ্যে চিঠিতে যোগাযোগ থাকে। রিনা ওখানে ডক্টরেট করে চাকরি পায়। আর দেশে ফেরে না। শোনা যায় ও পিএইচ ডির গাইডকে বিয়ে করে অক্সফোর্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। আর নীলু এখানে বুড়ির স্মৃতি নিয়ে আর সংগঠন নিয়ে দিন যাপন করছে। রিনার পাট চুকে যায়।
নীলুর চিন্তাজগতে একটা বিষয় বার বার ঘুরে ফিরে আসে। এই নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা বন্ধুদের সঙ্গে বিবাদ হয়। প্রশ্ন জাগে এই সংগঠনের কাজ দেহব্যবসায়ীদের কতদূর সাহায্য করতে পারে? নীলুর মনে হয় এই পিছিয়ে পড়া সমাজে বঞ্চিত বিচ্ছিন্ন মেয়েদের মধ্যে একটা অধিকার বোধ জাগিয়েতো লা যায় এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন সরকারি সুবিধা আদায় করা যায়। এদের সন্তানদের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। নীলু মনে করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটা করা যায়। শান্তিপূর্ণ পথে আন্দোলনকে অস্বীকার করা যায় না। সীমাবদ্ধতা থাকলেও গণতন্ত্রের পরিসরে এটা করা প্রয়োজন। আবার অনেকে মনে করে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়া যায় না। নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের পথে এই সংগ্রাম একটা সমঝোতার পথ মাত্র। সমাজ পরিবর্তনের লড়াই ছাড়া এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নেই। শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে একে যুক্ত হতে হয়। কিন্তু দেহ ব্যবসায়ীরা শ্রমিক শ্রেণী নয় তাই তাদের লড়াইকে ঠিক শ্রেণীসংগ্রাম সেটা সঠিক অর্থে বলা চলে না যদিও এটা শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য এক শ্রেণীকে উৎখাতের লড়াই এটা নয়। এই নিয়ে বিতর্ক চলে।
নীলু মধ্য কলকাতায় একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে সংগঠনের কাজ করে। ওদের আন্দোলন গতি পেয়েছে। দেহব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এখন নতুন করে তাদের ছেলেমেয়েদের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া তাদের মূল স্রোতের শিক্ষাব্যবস্থায় যে কোন প্রতিষ্ঠানে বিনা খরচায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেবার দাবি ওঠে। এতদিন ওদের জন্য পৃথক কয়েকটা স্কুলে দায়সারা ভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাকে সার্বজনীন করার দাবি ওঠে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ না দিলে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি কার্যত অস্বীকার করা হয়। এ ব্যাপারে হাওড়ার একটা নিষিদ্ধ পল্লীতে ফুলকি নামে এক মহিলার নেতৃত্বে আন্দোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওদের সঙ্গে একত্রে নিলুরাও নিজেদের কর্মস্থলে আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়। যে ব্যাপারে ফুলকির সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব পরে নীলুর ওপর। ফুলকিকে নীলু চেনে না। শুনেছে ও নাকি খুব ভালো সংগঠক। নিজে একজন দেহ ব্যবসায়ী ছিলেন এখন সর্বক্ষনের সংগঠক। নীলু হাওড়ায় নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। ঠিকানা ধরে ফুলকিকে খুঁজে পায়। যে নিয়ে যায় সে ফুলকির দরজায় নিলুকে পৌঁছে দেয়। নীলু দরজায় কড়া নাড়ে। এক মহিলা দরজা খুলে দাঁড়ায়। সুন্দর ছিমছাম চেহারা। দেখেই নীলু চেনে। সেই বুড়ি দাঁড়িয়ে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। অবাক হয় নীলু। ও এখানে! ওর মনে পড়ে বুড়ি বলেছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে রেহাই পাবার জন্য আর সংসার খরচ টানার জন্য ও কলকাতায় কোন কাজ ধরবে। তবে এটাই কি এই সেই কাজ। কে এর সন্ধান দিল! বুড়িও নিলুকে চেনে। একটু শ্লেষের ভঙ্গিতে বলে: কি তুমি? পরস্ত্রীর দুয়ারে!
নীলুর মনে পড়ে সেই পুকুর ঘাটে যখন শেষ দেখা বুড়ি তাকে তার দুরবস্থা থেকে বাঁচাতে অনুনয় করেছিল তাদের পরস্পর সম্পর্কের দাবিতে। নিলু সেই সম্পর্ককে মূল্য দেয়নি l তখন সে বুড়িকে বলেছিল বুড়ি পরস্ত্রী। তাকে সে কিভাবে সাহায্য করবে? আইনে আটকাবে। নীলু বোঝে আজ সঠিক মুহূর্তে সঠিক জবাবটা দিয়েছে বুড়ি। আজ এটা তার প্রাপ্য। সে রাগ করে না। বরং বুড়ির প্রতি অনুরাগে যেন সিক্ত হয়। হাসতে হাসতে বলে,
" আমাকে বসতে দেবে তো? অনেক কিছু আলোচনার আছে। তুমিই তো ফুলকি? তোমার সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কথা বলতে এসেছি।" এরই মধ্যে ও লক্ষ্য করে বুড়িকে শেষ দেখায় যে বুড়িয়ে যেতে দেখেছিল সেটা আজ আর নেই। শরীরে মাংস লেগেছে। মুখে চাকচিক্য। সে সেই যৌবনের বুড়ি।
ফুলকি নীলুকে নিয়ে ঘরে বসে। কে কেমন আছে জানতে চেয়ে কথা শুরু হয়। বুড়ি জানায় বছর বারো তের হল সে এখানে আসে। এক দালাল চাকরি দেবে বলে আনে। তবে চাকরি নয় এই ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। আর এই ব্যবসার আয়ে এতদিন তার সংসার চলত। নিজের হেসে খেলে চলে যায়। এখন ভাইরা বড় হয়ে কিছু না কিছু করে। সংসারের খরচ ওরাই চালায়। বুড়িকে আর টাকা পাঠাতে হয় না। বুড়ি ফুলকি নামে এখানে এখন এই মেয়েদের সংগঠক। নিজে দেহ ব্যবসার কাজ ছেড়ে দিয়ে এই সংগঠন নিয়েই আছে। মেয়েদের দেখাশোনা করে। এখান থেকে ও আর বাড়ি ফেরে না। আর সমাজে সে এখন ব্রাত্য । সন্মান নিয়ে থাকতে পারবে না। সব শুনে নীলু বলে:
তুমি আমার সঙ্গে চল। এখন আর তুমি পরস্ত্রী নও। এই সংগঠনে কাজ করে আমি অনেক শিখেছি। জেনেছি কে পরস্ত্রী আর কে নিজের স্ত্রী। তুমি চল আমার সঙ্গে থাকবে। দুজনেই সংগঠনের কাজ করব।"
বুড়ি বলে:
"সেটা আজ সম্ভব নয়। আমি জানি এই মেয়েদের আমি মুক্তি দিতে পারব না। কিন্তু ওদের ছেড়ে চলে গেলে আমার বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। এখানে আমি স্বাধীনভাবে সম্মানের সঙ্গে আছি। আর এই মেয়েরা এদের ছেলেমেয়েরা আমাকে যে সন্মান দেয় সে সন্মান স্বীকৃতি আমি কোনদিন তোমাদের সমাজে পাই নি পাব না। বলত শ্বশুর বাড়িতে বউয়ের পরিচয়ের আড়ালে আমি কে ছিলাম।একজন বিনা পয়সার বান্দি যাকে দাসী ছাড়া কিছুই বলা যায় না। ক্রীতদাসকেও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়, দেহ ব্যবসায়ীকে দেহের সেবা দেওয়ার বিনিময়ে পয়সা দেওয়া হয়। কাজের লোককে মাইনে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে কিছু না দিয়ে সব করিয়ে নেওয়া হত। নামে মাত্র বাড়ির বউ। অনিচ্ছা সত্বেও এক দুশ্চরিত্র লম্পটকে দেহ দিতে হত। সেটাও কার্যত এক ধরণের ধর্ষণ। এমন কি তোমার সঙ্গে বিয়ে হলেও তোমার বাড়ি আমাকে কি দিত? আজ সমাজ আমাকে যাই বলুক আমি জানি আমি আমিই। আমার নিজস্ব সত্তা আছে। এমনকি খদ্দেররাও আমাকে সমীহ করে। আর মেয়েদের মুক্তির জন্য আন্দোলনে নেমেছি। জানি এই ব্যবস্থার বদল না হলে এদের মুক্তি সম্ভব নয়। তবে সেতু বানাতে কাঠবেড়ালির কাজটা তো করতে পারি।"
সব শুনে নীলু থ বনে যায়। জীবন সম্বন্ধে কি গভীর বোধ। মেয়েদের অধিকার তাদের সম্মানের সম্পর্কে এ কি প্রত্যয়! আর সবটাই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। কথা না বাড়িয়ে কিছুটা সংগঠনের কথা কিছুটা আন্দোলনের কথা বলে ফেরার জন্য নীলু উঠে দাঁড়ায়। মনে হয় দুজনের মধ্যেকার এতদিনের অসম সম্পর্ক যেন সমতা অর্জন করেছে।আজ সত্যিকারের সামাজিক মর্যাদার নিরিখে দুজনে একই আসনে। কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াইয়ের ময়দানে। সেখানেই তাদের প্রেমের সার্থকতা। একজন আরেকজনকে চিনে নেওয়া।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন