উৎসবের আনন্দ-- তখন এখন
সাইফুল ইসলাম
উৎসব মানেই আনন্দ। আর এই আনন্দের প্রকাশ নতুন নতুন জামাকাপড়, রকমারী খাবার,হৈ-হুল্লোড়,একে অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার এর মধ্যে। কোন উৎসব হয় নিভৃতে আবার কোন উৎসব হয় প্রকাশ্যে। কোনো উৎসবে ভরে উঠে আলোর রোশনাই আবার কোনো উৎসব হয় আলোকোজ্জ্বলহীন।
আমি যেখানে থাকি, এখানকার অধিকাংশ মানুষই উৎসব বলতে বোঝেন ঈদ, দুর্গাপূজা আর কালীপূজা। এই সকল উৎসবে মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন; তবে সে আনন্দ কোনটা ক্ষণস্থায়ী আবার কোনটা দীর্ঘস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী আনন্দের ভিড়ে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ চাপা পড়ে যায়। আর সেই আনন্দোৎসব পেতে অনেক আগে থেকেই সকলের প্রস্তুতি শুরু হয়। সেই রকমই একটা উৎসব দীপাবলী, যাহা এখানকার প্রতিটা মানুষ অপেক্ষায় থাকেন। কারণ দীপাবলী পূজো উপলক্ষে এখানে যে মেলা বসে তাহা অতি সুপ্রাচীন এবং তার স্থায়িত্ব হয় প্রায় পনের দিন।
এখন গ্রাম বদলে গেছে। মাটির রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। এমন একটা সময় ছিল যখন মেলা প্রাঙ্গনে যেতে একমাত্র ভরসা ছিল গোরুর গাড়ি। কালীপূজোর পরের দিন মেলা তাই ছোটদের আনন্দের শরীক হতে হত বড়দেরকেও। কারণ ছোটদের আনন্দেই বড়দের আনন্দ। পূর্ব প্রস্ততি অনুযায়ী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শুরু হত অর্থের জোগানের তোড়জোড়। এমনকি সব বাড়ীতে দূর-দূরান্তের গ্রামগুলি থেকে আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় হত। বছরে একটা মেলা,মেলার দোকান বসার আগেই ছোটদের চোখে-মুখে খুশীর ঝিলিক লক্ষ্য করা যেত।
নির্দিষ্ট দিনে দুপুর থেকেই শুরু হত মেলা যাওয়ার তোড়জোড়। মেলায় কত রকমের খাবার দোকান; নদীয়ার বিখ্যাত পুতুল নাচ; কত ধরনের ছোট বড় মিলিয়ে নাগরদোলায় চড়ে আনন্দে ফেটে পড়া। সবশেষে মেলার শেষ প্রান্তে সারি সারি আখের দোকান। আখ চাষীরা মেলায় যাতে তাদের আখ বিক্রি করতে পারেন তার হিসেব রেখেই আখ চাষ করতেন। দোকানে বসে আখ খাওয়া আর বাড়ী ফেরার পথে আখ হাতে নিয়ে আসা।
আমরা ছোটরা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বাবার কোমর ধরে পুরো মেলা ঘুরতাম। এখনকার মত মেলায় মোগলাই,চাউমিন পাওয়া যেত না।বাড়ি থেকে গামছায় বেঁধে বাবা নিয়ে যেতেন মুড়ি আর আমাদের রসগোল্লা দিয়ে বসিয়ে দিতেন দোকানের সামনে। রসগোল্লার রস হাত বেয়ে গড়িয়ে আসত কনুই পর্যন্ত।রসের মাখা মুড়ি সারা মুখে লেগে থাকত। জিভ দিয়ে হাত চেটে খেতে গিয়ে ভাবতাম মেলায় বুঝি এমনি করেই খেতে হয়।
আজ যুগের সাথে সাথে সব পাল্টে গেছে। সেই পূজো,সেই মেলা সবই আছে।শুধু আনন্দ কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে। আজ বাবা নেই। এখন আমিই বাবা।ছেলে মেয়েদের কবে মেলায় নিয়ে গেছি মনে পড়ে না। একটু বড় হতেই ওরা নিজেরাই মেলায় যায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ওদের সাহসও বেড়ে গেছে অনেকাংশে।
বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করেছে টিভি।যার দাপটে সেই ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ তার ছন্দ হারিয়েছে। তখন শুধু বাজত ঢাক আর এখন ঢাকের বাদ্যির সাথে চলছে ডিজে। শ্রুতি মধুর শব্দ চাপা পড়ছে ডিজের হৃদয় কাঁপানো শব্দে।
যুগের চাকা গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকি। পূজো আপন মহিমায় বিরাজমান আজও।আশা করি অচিরেও একই থাকবে।
উৎসব আসে, উৎসব যায়। শুধু মনের মাঝে কিছুটা দাগ কেটে যায়,কোনটা হাল্কা,কোনটা গভীর। তখন যে নিখাদ আনন্দ কচি মনে দাগ কাটত এখন তেমনটি আর নেই। এখনকার বাচ্চারা আর দশদিন আগে থেকে লাফালাফি করে না। কেমন যেন নিষ্প্রভ আনন্দ ওদের কে ঘিরে ফেলেছে।
-------------
------------------------------------------------------------
সাইফুল ইসলাম
বর্দ্ধন পাড়া,বীরভূম
ফোন-৯৬৪১৭৭০০১৯
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন