লাভপুরের গ্রামীণ দুর্গোৎসব
রমলা মুখার্জী
আমার বাড়ি হুগলী জেলার বৈঁচিতে, কিন্তু আমার বিয়ে হয়েছে বীরভূম জেলার লাভপুরে। লাভপুরের দুর্গাপুজোর রীতিনীতি আমাদের হুগলী জেলার থেকে পুরোপুরি আলাদা। এখানকার দুর্গাপুজোতে একটি প্রাচীন ভক্তিমণ্ডিত ভাবের সপাঠাঙ্গে সমস্ত পুজোগুলির একত্রিত হবার সুন্দর একটি পরিকল্পনাও রয়েছে যা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ষষ্ঠীর দিন বোধন যেমন হয় মন্দিরে মন্দিরে সেরূপই লাভপুরেও হয়। কিন্তু সপ্তমীর দিন থেকে সমস্ত পুজোগুলির মধ্যে একটি সমবেত প্রথা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের সমস্ত পুরুষ ও ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন বস্ত্র পরিধান করে এসে প্রথমে জড়ো হয় আমার শ্বশুরবাড়ি বাবুপাড়ার পুজো "ওপর সদরে"। "ওপর সদরের" দুর্গাঠাকুরের পুজোর ঘট প্রথম ভরতে বের হবে এবং মন্দির থেকে ঘট নিয়ে পুন্যার্থীরা বের হয়ে প্রধান রাস্তায় অপেক্ষা করবে। ঘট ভরতে প্রত্যেক পূজা মণ্ডপ থেকেই দোলায় চেপে ঘট যায়, সর্বাগ্রে যায় "ওপর সদরের" দোলা, তারপর ক্রমান্বয়ে কুলীন পাড়া ও দত্ত পাড়ার দুটি দোলাও এসে হাজির হয়। সমস্ত বাজনদাররাও একসঙ্গে পিছনে বাজনা বাজাতে বাজাতে অগ্রসর হয় ও সব গ্রামের ছেলেমেয়েরাও শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। কিছুটা অগ্রসর হবার পর 'নবডাল সংঘের' ঘট ভরতে যাওয়ার দোলাটিও ঐ শোভাযাত্রায় এসে যোগদান করে। এবার দলটি কয়েক গজ যাবার পর সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সন্নিকটস্থ দক্ষিণপাড়ার "নমো সদরের" দুর্গা মন্দিরের কাছে গেলে "নমো সদরের" দোলাটিও ঐ শোভাযাত্রায় যোগ দেয়। বাজনদাররা সবাই সমবেতভাবে বাজনা বাজাতে বাজাতে ও গ্রামের সবাই (মেয়েরা বাদে) শোভাযাত্রা করে স্টেশন সংলগ্ন লাইঘাটা পুকুরে ঘটে জল ভরতে যায়। বাদ্য হিসেবে থাকে ঢাক, ঢোল ও কাঁসর। এইসব বাজনদারদের পূর্বপুরুষরা জমিদারের আমল থেকেই জমি দিয়ে বহাল করা আছে। লাইঘাটা পুকুরে ঘট জলপূর্ণ করে আবার সবাই সমবেত ভাবে ফেরে। প্রত্যেকটি পুজোর মধ্যে আমি একটি সমবেত সংগীতের সুর লক্ষ্য করি, একটা একতা, একটা যেন মিলনমেলা। কোন প্রতিযোগিতা নয়, সবাই একসঙ্গে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে।
হুগলী জেলায় দুর্গাপূজায় সাধারণত বলিদান প্রথাটি নেই, কিন্তু লাভপুরের দুর্গাপূজায় বলিদান প্রথাটি মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। তারও আবার নানান নিয়মকানুন আছে। অষ্টমীর দিন "ওপর সদর" ও "নমো সদরের" পুজোতে ধপধপে নিখুঁত সাদা রঙের "পাঁঠা" একটি করে বলিদান করা হয়। কোন কালো বা অন্য কোন রঙ যেন সেই সাদা ছাগশিশুটির গায়ে না থাকে। তবে পুজোকমিটিকে ছাগশিশু খুঁজতে হয় না, যার বাড়িতে এইরূপ ছাগশিশু জন্মলাভ করে সে স্বয়ং এসেই পুজোকমিটিকে অগ্রিম জানিয়ে দেয়। নবমীর দিন প্রচুর কালো পাঁঠা বলিদান করা হয়। মানতের পাঁঠাই বেশি থাকে, কিছু থাকে পুজো কমিটির। ওখানে পুজো কমিটিকে বলে "সরকারী"। এখানে লাভপুরে "ষোলকলা মানত" বলে একটি মানত বা পুজো দেবার প্রতিশ্রুতির প্রচলন আছে। একটি ছড়ায় ষোলোটি কলাই থাকবে এমন একটি কলার ছড়া, অন্যান্য ফল, এখানকার বিখ্যাত মন্ডা (একপ্রকার মিষ্টি) দিয়ে প্রধানত অষ্টমীর দিনই পুজো দেয় বৌ-মেয়েরা। তবে সব দিনই পুজো দিতে আসে সকালবেলায় সবাই। পুষ্পাঞ্জলি নারী ও পুরুষ উভয়ই দেয়। শাশুড়িমায়ের কাছে শুনেছি "ওপর সদর" ও "নমো সদরে"র পুজোতে দুটি দরজার প্রচলন ছিল। একটি ব্রাহ্মণ ও অপরটি অব্রাহ্মণদের পুজো দিতে আসার প্রবেশ পথ। কিন্তু ক্রমশ সে বর্ণবৈষম্য ঘুচে গিয়ে এখন সব বর্ণই মিলেমিশে পুজো দেয় মা দুর্গাকে।
অষ্টমীর দিন সকালে পুজো ও পুষ্পাঞ্জলির পর পাঁঠাবলির সময় মাটির সাজের প্রতিমা মুকুটে যে মাটির কলকা থাকে সেখানে পুরোহিত রাখেন পুষ্পসম্ভার। পাঁঠাবলির আগে শ্বেত-শুভ্র ছাগশিশুটিকে পুকুরে স্নান করিয়ে আনে তারাশঙ্করের গল্পে উল্লেখিত শশী ডোমের বংশধরেরা। অতঃপর ঐ ছাগশিশুটিকে সিঁদুর ও মালা পরানো হয়। পঞ্জিকায় উল্লেখিত বলিদানের সময় জেনে সেইসময় অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রাম থেকে বলিদান দেখার জন্য জনসমাগম হয় এবং তারা সমবেত হয় বলিদানের হাঁড়িকাঠ যে আটচালায় স্থাপন করা হয় সেই স্থানে। দর্শনপ্রার্থীরা সমবেত হয় "জয় মা জয় মা" ধ্বনি তোলে। এইভাবে কিছুক্ষণ ধ্বনি তোলার পর কোন অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে দুর্গামায়ের মুকুট থেকে একটি ফুল গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, পুরোহিত মশাই "ফুল পড়েছে" বললেই সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে "ফুল পড়েছে" বলে। প্রধান পুরোহিত সেই ফুল দিয়ে ঐ শ্বেত ছাগশিশুটিকে উৎসর্গ করেন। এবার ছাগশিশুটিকে হাঁড়িকাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হাঁড়িকাঠে বেচারিকে আটকানো হয়। ঘাতক খর্গটি মন্দির থেকে নিয়ে এসে এককোপে ঐ ছাগশিশুটিকে বলি দেয়। বলিদান হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন বাদ্য বাজানো নিষেধ। যখনই বলিদানের খর্গ ছাগটির শরীর স্পর্শ করবে তখনই ঢাকে কাঠি পড়বে ও সমস্ত বাজনদাররা বাজনা বাজাতে আরম্ভ করবে এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ওদিকের কুলীন পাড়াতেও বলিদান আরম্ভ হবে এবং সেই কাজের জন্য রিলে ব্যবস্থার মত কিছু লোক মোতায়েন করা থাকত যারা খবরটি একে অপরকে "বাবুপাড়ায় লেগেছে রে" এই ধ্বনি তুলে হেঁকে হেঁকে মুহূর্তের মধ্যে খবরটি কুলীন পাড়াতে পৌঁছে দিত যাতে একই মুহূর্তে উক্ত দুই স্থানে বলিদান সম্পন্ন হতে পারে। বর্তমানে মোবাইলেই অবশ্য এই কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঐ ঘাতক যাকে ওখানে 'কামার' বলে সে এবং বাজনদাররা এসে 'কুলীন পাড়া'র বাজনদারদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সবাই মিলিতভাবে "নমো সদরে" এসে উপস্থিত হয় ও ঠিক ঐ প্রক্রিয়াতেই বলিদান সম্পন্ন করে। অতঃপর ঐ শোভাযাত্রা "নবডাল সংঘে" এসে উপস্থিত হয় ও পুজা-অর্চনা করেন পুরোহিত। এখানে দুর্গার পটে বা ছবিতে পুজো হয়, বাকি সমস্ত জায়গার প্রতিমা হয় একচালে অর্থাৎ একসঙ্গে মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গনেশ থাকেন।
নবমীর দিন নবমীর পুজো-অর্চনার পর সব স্থানেই পুজোকমিটির গুটি কয়েক পাঁঠাবলির পর জনসাধারণের মানতে'র ছাগশিশু বলি আরম্ভ হয়। ছাগমুণ্ডগুলি ঠাকুরের কাছে নিবেদন করে ধড়টি বাড়ি নিয়ে গিয়ে পিঁয়াজ, রসুন ছাড়া ঘি ও মশলা দিয়ে রান্না করে ভক্তরা প্রসাদ খায়।
ওপর সদরের পুজোতে নবমীর দিন রাতে হয় ভোজ। তারজন্য ওপর সদরের শরিকদের পাড়ার পুকুর যার নাম "বাড়ি পুকুর" সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরা হয়। মাছের ঝোল, মুড়ির মাংস মানে ছাগশিশুর মস্তক অংশের মাংস (ঘাড় অঞ্চলে যেটুকু থাকে), সব্জি, আমড়ার চাটনি দিয়ে ওপর সদরের ভোজ হয়। কিন্তু ভোজের আগে সন্ধ্যেবেলা থেকে আরম্ভ হয় "কেষ্টযাত্রা"। গ্রামের লোকেরা ভাদ্রমাসের ভাদুপুজোর পর থেকেই মহড়া দিয়ে কেষ্টযাত্রার প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ঐ নবমীর দিন সন্ধ্যেবেলায় সেটি ওপর সদরের আটচালাটিতে মঞ্চস্থ করে।
দশমীর দিন সকালে সবাই নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফণীমনসার ডাল নিয়ে ঘট বিসর্জন করতে যায়। ঘট বিসর্জনের ঠিক আগে একটি পিতলের থালায় একটি একটাকার মুদ্রা, ধান, দুর্বা দিয়ে ঠাকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে পুজো করাতে হয়, একে বলে 'যাত্রা দেখানো'। যাত্রা দেখানোর পর ঘট বিসর্জন হয় আবার আগের মতই দোলায় চাপিয়ে, বাজনা বাজিয়ে। দোলা বহন করবে নতুন উপনয়ন হয়েছে এমন চারজন নবীন ব্রাহ্মণ সন্তান; তারা ধুতি, উত্তরীয় পরিধান করে থাকে। বিজয়া দশমীর দিন বড় মাছ খেতে হয়; পারিবারিক জেলে বা কেওটাকে দশমীর দিন কাপড়, নাড়ু ইত্যাদি দেওয়া হয় তার পরিবর্তে সে একটি ছোট পুঁটিমাছ ও বেশ বড় একটি কাতলা বা রুই মাছ দেয়। ছোট পুঁটিমাছটিকে সিঁদুর মাখিয়ে বাড়ির রান্নাঘরে রাখা হয় এবং সেই পুঁটিমাছটির পাশে এক বাটি দইও রাখা হয়। ঘট বিসর্জন করে ফিরে, মা দুর্গাকে প্রণাম করে বাড়ির রান্নাঘরে রাখা দই ও ঐ ছোট পুঁটিমাছটিকে দেখে প্রণাম করে তবেই সবাই গুরুজনদের প্রণাম করে। গুরুজনদের প্রণামের প্রচলন এখনও লাভপুরে বেশ আছে। লাভপুরের বিশেষত্ব হল নানারকমের নাড়ু বা 'লাড়ু' তৈরী করা হয় নানা উৎসবে। পুজোর সময় চিঁড়ে, খই, ছোলা, নারকেল, চোনা(বেসনের বোঁদের মত ছোট্ট ছোট্ট বড়া), সিঁড়ি(বেসনের লম্বা লম্বা ঝুড়ি ভাজার মত) ইত্যাদি দিয়ে গুড়ের পাক করে রকমারি নাড়ু বানানো হয়। দশমীর দিন সন্ধ্যায় ঠাকুর বিসর্জন বা ঘট বিসর্জনের পর থেকেই ছোটরা বড়দের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে এবং প্রত্যেককে বড়রা নাড়ু, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে।
লাভপুরে সাঁওতাল গোষ্ঠীরও কিছু বাস আছে। লাভপুরে সাঁওতাল পুরুষকে বলে মাঝি ও সাঁওতাল স্ত্রীলোকদের বলে মেঝেন। একাদশীর দিন সকালে মাঝিরা মাথায় ময়ুরের পালক গুঁজে, মালকোচা মেরে ধুতি ও গেঞ্জি গায়ে মাদল বাজায় এবং মেঝেনরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে, মাথায় রঙিন ফুল গুঁজে ও গলায় রূপোর হাঁসুলি, খোঁপায় রূপোর ফুল, পায়ে রূপোর মল ও হাতে রূপোর মোটা বালা পরে মাদলের তালে তালে নেচে বাবুদের বাড়ি থেকে বকশিশ আদায় করে। ভদ্রলোকেরা চাল, আলু, টাকা দিয়ে এই নৃত্য বেশ উপভোগ করে।
লাভপুরে ষষ্ঠী থেকে একাদশী পর্যন্ত চলে দুর্গাপুজোর উৎসব ও এটি খুবই উপভোগ্য এবং আনন্দদায়ক এই মহামিলনের উৎসব। পুজো এলে মনে খুশির প্লাবন বয় সবার।
লাভপুরের 'ফুল্লরা' পীঠস্থানে রোজই সতীপুজো বা দুর্গাপুজো হয়, নিত্য ভোগ হয়। এখানে সতীমায়ের ফুল মানে গর্ভ প্লাসেন্টা পড়েছিল। তবে দুর্গাপুজোর সময় এখানেও ধুমধাম সহকারে ছাগবলি দিয়ে পুজো হয়। সেই বলির মাংস ছোট ছোট টুকরো করে কেটে মুসুর ডালের সাথে সেদ্ধ করে মাস-মুসুরি তৈরী করা হয় ও সেই প্রসাদ দর্শনার্থীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয় দশমীর দিন।
লাভপুরের দুর্গাপুজোর সব ভাল হলেও বলিদান প্রথাটি আমার ভাল লাগে না। এই বলিদান প্রথাটি যেন অবলুপ্ত হয় এটাই আমি মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
রমলা মুখার্জী
বৈঁচী, বিবেকানন্দপল্লী, জেলা হুগলী, পিন 712134
ফোন 7003550595ডঃ
হোয়াটসঅ্যাপ 9474462590
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন