কালীপুজোর স্মৃতি
চম্পা পণ্ডিত গোরাই
দুর্গাপুজো শেষ হলেই আমরা ছোটরা দিন গুনতাম। কালী পুজো আসতে আর কতো দেরী । কালীপুজো মানেই মামাবাড়ি। কতো আনন্দ,কতো উচ্ছ্বাস । মাামাতো ভাইবোন, মাসি, মাসির ছেলেমেয়ে । সবাই মিলে নানারকমের দুষ্টুমি, খেলার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কি ভাবে যে কেটে যেতো খেয়াল ই থাকতো না ।
মনে হতো এই দিনগুলো যেন কোনোদিন, ফুরিয়ে না যায় । মামাবাড়ির আবদার, সে তো বলার নয়। কেউ ধমক দিতো না, বাধা দিতো না । মামা আসতো আমাদের নিতে । একদিন সকালবেলা সকলে মিলে বেরিয়ে পড়তাম মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে । পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যেতো । বাসরাস্তা থেকে অনেকটা দূরে মামাদের গ্রাম । আমাদের নিতে গরুর গাড়ি আসতো । ছই দেওয়া গরুর গাড়ি টি দেখলেই, আমার মন আনন্দে নেচে উঠতো । মনে হতো এই তো পৌঁছে গেলাম। গাড়িতে যাওয়ার সময় লাল রাস্তার দুপাশে, দিগন্ত বিস্তৃত ধানের জমি । হেমন্তের সূর্যাস্তের সোনালী রঙ পাকা ধানের উপর পড়ে চকচক করছে । নয়নমুগ্ধকর সেই দৃশ্য ভরিয়ে দিতো প্রাণ, মন। আমাদের বাড়ির পরিবেশ ও মামাবাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা । কোথাও কোনো মিল নেই । মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়, বাঁশবন, মাঠের মধ্যে দু-একজন লোক । কুয়াশা ঢাকা সন্ধ্যা, খেজুর রসের মিঠে গন্ধ, মন যেন মেতে উঠতো খুশির ছোঁয়ায় । গ্রামে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যেতো । কতো লোকজন আসতো আমাদের দেখতে । কতো রকমের কৌতুহল তাদের চোখে । হাজার প্রশ্ন তাদের মুখে । কখন বেরিয়েছিলাম ? আস্তে অসুবিধে হয়নি তো । সকলকে মিষ্টি মুখ করিয়ে সেদিনের মতো বিদায় দেওয়া হতো । সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তিতে আমরা নেতিয়ে পড়তাম । রাত্রিতে বিছানায় শুয়েও ট্রেনের দুলুনি অনুভব করতাম। অন্ধকার রাত্রি, ঝিঁঝির ডাক, বাঁশবনের আওয়াজ, জোনাক জ্বলা সব মিলিয়ে কেমন যেন গা ছমছম করতো। বাইরে তাকাতে সাহস হতো না। ভোরবেলা খ্যাপা বোষ্টমের ভোরাই শুনে ঘুম ভাঙতো। মনে হতো কোনো স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছি । আবেশে, খুশিতে মনের মধ্যে আনন্দের বান ডাকতো। মামা খেজুর রসের হাঁড়ি নিয়ে এসে ডাক দিতো সকলকে । হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাসে পা দিলে, শরীর উঠতো শিরশিরিয়ে । কুয়াশা মাখা আবছা গ্রামখানি, খুব ভালো লাগতো। মুখ হাত ধুয়ে চুমুক দিতাম ঠান্ডা খেজুর রসে। এতো ঠান্ডা যে কাঁপুনি ধরে যেতো। রান্নাঘরে চা পানের সঙ্গে চলতো আড্ডা। গাই দোহা শেষ হলেই বাথানে গরু দিতে যাওয়া হতো। আমরাও হাতে লাঠি নিয়ে সঙ্গে যেতাম। গ্রামের মেয়ে, বৌরা রঙ বেরঙের শাড়ি, গয়না পরে কুয়ো থেকে জল নিতে আসতো। সকলেই নানান রকমের প্রশ্নে অস্থি করে তুলতো। আটচালায় ঠাকুর দেখতে গিয়ে আমাদের মনই ভরতো না। বাড়ি থেকে বারবার ডাক আসতো। এতো রকমের খেলা ফেলে যেতে, মন চাইতো না। এলাডিং - বেলাডিং, চু-কিত্ কিত্, কবাডি, বৌ-চুরি, কুমির ডাঙা । আমাদের ওখানে এসব খেলা ছিলো না।
কালীপুজোর দিন সকাল থেকে নানারকম কাজের মেলা। আলপনা দেওয়া, ঠাকুরের খিচুড়ি ভোগ রান্না, লুচি, পিঠে নানা রকমের খাবার তৈরি হতো। বিকেলে পাটকাঠি বাঁধা হতো। চার-পাঁচটা কাঠি একসাথে নিয়ে, খড় দিয়ে মাঝে মাঝে বাঁধন দেওয়া হতো । সন্ধ্যের পর বড়োদের সঙ্গে বাঁধের ধারে গিয়ে, ওগুলো জ্বালানো হতো। সবার হাতে থাকতো পাটকাঠির গোছা। আলোকময় হয়ে উঠতো চারিদিকে । আমরা খুব আনন্দ পেতাম। ছোট হয়ে নিভে যাওয়া পাটকাঠি, হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেগুলো গোবর গাদার উপর পুঁতে দেওয়া হতো। কালীপুজোর রাত্রিতে আঙাডোঙা ফল দিয়ে লাঙল, জোয়ালের উপর আঁকা হতো আলপনা । মাটির প্রদীপ জ্বালানো হতো চারিদিকে । আলো আঁধারি ছায়ার খেলা চলতো। তখন কারেন্ট ছিল না। কতো রকমের বাজি ফাটানো হতো। চকোলেট বোমা জ্বালিয়ে, তার উপর নারিকেল মালা চাপা দেওয়া হতো। বাজি ফাটলে নারিকেল মালা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়তো। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তারাবাতি জ্বালানো হতো।
রাত্রে বড়োদের সঙ্গে আমরাও কালীপুজো দেখতে যেতাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতো তাও বাড়ি ফিরতে চাইতাম না। ঠান্ডায় কুঁকড়ে যেতাম। কালীপুজো শেষ হতে হতে ভোর। পাখি ডাকতো। আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে গিয়ে সকালের আলো ফুটতো। সেদিন দেখতে পেতাম খ্যাপা বোষ্টমকে। কোমরে গোঁজা থাকতো লাঠি, খঞ্জনি বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে চলে যেতো। আমরা বাড়ি ফিরতাম। সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব । সন্ধ্যের সময় গরুর বিয়ে। হলুদ, মেথি বাটা হতো। গরুকে স্নান করানো, তেল মাখানো, আলতা দিয়ে ছাপ দেওয়া হতো গরুর গায়ে। ধানের শিষ দিয়ে তৈরি হতো গরুর মুকুট।
পরদিন ভাইফোঁটা। সকাল থেকে নানারকম ব্যস্ততা । বাজার, রান্না, জলখাবার, দুপুরের রান্না । সে এক এলাহী ব্যাপার। দুপুরে নতুন জামা কাপড় পরে সব ভাইয়েরা লাইন দিয়ে বসতো। একটা থালায় থাকতো ধান, দুর্বা, প্রদীপ, শাঁখ, ঘষা চন্দন। অন্য থালায় থাকতো মিষ্টি । শাঁখ বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে ফোঁটা দেওয়া হতো। এরপর ঘরে ফেরার পালা। অকারণেই জল বেরিয়ে আসতো চোখের কোণে । পুজোর কটা দিন কি আনন্দই না করতাম সকলে মিলে। খুশির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কখন যে হারিয়ে যেতো দিনগুলো, বুঝতেই পারতাম না। আবার অপেক্ষা গোটা একটা বছরের।
:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন