Featured Post
স্মৃতিকথা: আলোকোৎসবের দিনে ।। সুবীর ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আলোকোৎসবের দিনে
সুবীর ঘোষ
শ্যামাপুজো নিয়ে আমার প্রত্যক্ষ স্মৃতি একবারের । যে নিঝঝুম শান্ত গ্রামটিতে আমি শৈশব কাটিয়েছি সেখানেও যথোচিত সমারোহে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । মধ্যরাতের পুজো । অল্পবয়সিদের কাছে এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকা খুব কষ্টকর তবু একবার জোর করে জেগে রইলাম । মন্দিরেই কাটালাম পুজোর মুহূর্তগুলি । পূজাপাঠ চলছে , কাঁসর ঘণ্টা বাজছে । হয়তো বলিও হয়েছিল , ঠিক খেয়াল নেই। মন্দিরে মহিলাদের ভিড়, আমরা নিজের বন্ধুদের নিয়ে ছুটোছুটি হুল্লোড়েই মেতে ।
এর পর থেকে প্রতি বছরই পুজো এসেছে, চলেও গেছে। পূজাপর্বটি টের পাই দূর থেকে শব্দের সূত্র ধরে , আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।
এ তো গেল ধর্মীয় দিকটি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেওয়ালি বা দীপাবলি। আলোকোৎসব বলতে পারলে খুশি হতাম । কিন্তু আলোর সঙ্গে জড়িয়ে যে শব্দ-বিভীষিকা তার উল্লেখ না করে থাকা যায় না। ছোটোবেলায় আমাদের সীমিত করে রাখা হয়েছিল তারাবাতি, চরকি আর রঙমশালের মধ্যেই। একটু বড়ো যারা দোদমা, রকেট, চকলেট বোম ইত্যাদি ফাটাতে পারত তারা আমাদের চোখে হিরো ছিল। তখনও শব্দ-নিয়ন্ত্রণের ডেসিবেল বাঁধা ব্যবস্থা চালু হয়নি। পরদিন সকালে যে জায়গায় এগুলো ফাটানো হত সেখানটা রংচটা হয়ে আছে দেখতে পেতাম। এখনও পাই। এখনো এত সতর্কবার্তা দেওয়ার পরেও বাজির ধোঁয়ায় চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসে। বয়স্ক ও অসুখগ্রস্ত মানুষের পক্ষে তা বিভীষিকা হয়ে ওঠে। বর্তমান সময় করোনা নামের ভয়ানক ভাইরাসে আক্রান্ত। করোনা ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। তার সঙ্গে যদি জোটে বাজির ধোঁয়া তা হলে তা প্রাণঘাতী হতে বাধ্য । মানুষের শুভ বুদ্ধির কাছে একান্ত আবেদন , এ বছর পুরোপুরি বন্ধ রাখুন বাজির ব্যবহার। মানুষের প্রাণের থেকে তো বড়ো কিছু নয়।
আমাদের এদিকে একটা কথা চালু আছে—দুর্গাপুজোয় প্রতিমা আর কালীপুজোয় প্যান্ড্যাল । সেটা কিছুটা কথার কথা । কেননা দুর্গাপুজোতেও অনেক জায়গাতে দেখবার মতো প্যান্ড্যাল হয়ে থাকে । তবে আমাদের শহরে আমরা কালীপুজোতে মূলত প্যান্ড্যাল দেখার জন্যই বেরুতাম । একবার এ রকম বেরিয়ে কিছুতেই রাস্তা পার হতে পারছি না । রাস্তার ওপর মুহুর্মুহু বাজি ফাটছে । একটু পাশ কাটিয়ে যাব তার যো নেই । তারপর যখন পেশাগত জীবনে প্রবেশ করলাম তখন থেকে আমাদের ক্লাবেই সীমাবদ্ধ থাকতাম । ঘণ্টা খানেকের ওপর বাজি পোড়ানোর উৎসব হত । শব্দবাজি নিশ্চয়ই কিছু থাকত । তার ফাঁকে ফাঁকে নানা রকমের আলোবাজি—আলোর কারুকাজ, কোনোটা নীচে , কোনোটা আকাশে । রকেটগুলো আকাশে উঠে গিয়ে নানা রঙের মালার রূপ ধরে ফিরে আসত । আমার পুত্র যখন খুব ছোটো আর ওকে যেবার প্রথম এই অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলাম ঐসব দুমদাম শব্দ শুনে ভয় পেয়ে সে এমন কান্না জুড়ে দিল যে ওকে নিয়ে বাইরে এসে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দেখতে লাগলাম । একটু দূরত্ব হওয়ার জন্য তার কান্নাও গেল থেমে । ক্রমে সে যখন একটু বড়ো হল এই আলো-বাজির উৎসবে তার উৎসাহই সব থেকে বেশি দেখতাম ।
এই সুন্দর আনন্দ উপভোগের দিনে বাজি ফাটাতে গিয়ে দুর্ঘটনা কম ঘটে না । একবার একটি কিশোরী বাজিতে আগুন ধরেনি মনে করে হাত থেকে বাজিটা ছেড়ে দিতে দেরি করেছিল আর তাতেই তার একটা হাত জ্বলে যায় । চিকিৎসা করে সুস্থ হতে তার অনেকদিন সময় লেগেছিল ।
আর একটা ঘটনা তো মর্মান্তিক । দরজার বাইরে সার দিয়ে প্রদীপ জ্বলছে । পুত্র , পুত্রবধূ , নাতি- নাতনিরা বাজি পটকা ফাটাচ্ছে । ঠাকুমা ঘরের ভেতরেই ছিলেন । হঠাৎ তাঁর শখ হল একটু বাইরে গিয়ে দেখেন । এদিকে এক এক করে সবাই তখন ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে । ছেলে ঢুকে গেল তার প্রিয় টিভি সিরিয়ালের সময় হয়ে গেছে বলে । বৌমা ফিরে গেছে রান্নার কাজে । বাইরে তখন একমাত্র ছোটো নাতনিটি এবং ঠাকুমা। নাতনিটি তারাবাতি জ্বালায় প্রদীপের শিখা থেকে আর ঠাকুমাকে দেখায় তার ওস্তাদি । এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে নাতনি । নাতিও বাইরে নেই । একা ঠাকুমা । নাতনি জল খেতে ভেতরে ঢোকার আগে ঠাকুমাকে তার জ্বালানো তারাবাতিটি ধরিয়ে দিয়ে যায় । ঠাকুমা তাঁর বয়স্ক ভারী শরীর নিয়ে আগুপিছু করতে গিয়ে কীভাবে যেন শাড়িতে আগুন ধরিয়ে ফেলেন । হতভম্ব হয়ে তিনি চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতেই ভুলে যান । নিজেই শাড়ি খোলার ও আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন । ফলে অনেকটা সময় চলে যায় । নাতনি ফিরে এসে এই ঘটনা দেখে যখন সবাইকে ডাকে তখন তিনি অনেকটাই পুড়ে গেছেন । হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । কয়েকদিন লড়াই করার পর সেই বৃদ্ধার জীবনাবসান হয় । এরকম মৃত্যু তো তাঁর হওয়ার কথা নয় । তাই আপশোশ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই ।
দীপাবলির আগের দিন ভূত চতুর্দশী । এই ১৪ ভূতের নামগুলো একবার লিখে ফেলা যাক্ । আলেয়া/ স্কন্ধকাটা/ পেত্নী/ নিশি/ মেছো ভূত / একানড়ে/ মামদো/ বেতাল/ চোরাচুন্নি/ শাঁকচুন্নি / কানাভুলো/ পেঁচাপেঁচি/ গেছো ভূত/ ব্রহ্মদৈত্য । কালীমাতার অনুষঙ্গে যেহেতু শ্মশান , মুন্ডমালা , ডাকিনী-যোগিনী জড়িয়ে আছে তাই ভূতপ্রেতের আখ্যান এসে মিশে যাওয়ার মধ্যে অবাক হবার কিছু নেই । ভূতের গল্প খুব ছোটোবেলা থেকে মা-মাসিদের মুখ থেকে শুনে এসেছি । ভয় পেলে বড়োদের গা ঘেঁষে বসতাম । একটু বড়ো হতেই নিজে নিজে পড়তে শুরু করলাম ভূতের গল্প । আমার খুব প্রিয় ছিল এই জাতীয় গল্প । অনেক ছোটো ছেলেমেয়েই ভূতের গল্প খুব পছন্দ করে জানি । আমাদের বাংলাসাহিত্যে ভূতের গল্পের সমাহার খুব সমৃদ্ধ , সন্দেহ নেই । খুব বড়ো বড়ো লেখক খুব সফল ভূতের গল্প লিখেছেন । আমি যখন যে অবস্থায় বেড়ে উঠছি তখন এ দেশে বিদ্যুদয়ন খুব ব্যাপক ছিল না । বেশির ভাগ গ্রামই ছিল অন্ধকারে ঢাকা । গাছপালা ঘেরা নিঝঝুম গ্রামগুলি সন্ধ্যার পর একটা ঝুপঝুপে ভূতুড়ে চেহারা নিত । মা মাসিদের গল্প অনুযায়ী শ্যাওড়া গাছে ভূত থাকে । ব্রহ্মদত্যি নামক কুলীন ভূত আবার থাকে সাত্ত্বিক বেলগাছে । একানড়ে থাকে তালগাছে । শাকচুন্নি হল সাদা কাপড় পরা মহিলা-ভূত । সঙ্গে মাছ থাকলেই মেছো ভূতে পিছু নেয় । এসব যাঁরা আমাদের বলতেন তাঁরা কেউই ভূত দেখেননি । এমন কী আলোছায়ার নিশ্চুপ অন্ধকারে অনেকবার ভেবেছি এই বোধহয় ভূত এসে ঘাড় মটকাল কিন্তু কোনোদিনই ভূতের সঙ্গে দেখা হল না এ জীবনে । সুকুমার রায়-ই ঠিক বলেছেন ভূত যদি না থাকে তা হলে ভূতের ভয় লাগে কেন ? বড়োদের মুখে শুনেছি অন্ধকারে বনের পথ দিয়ে যেতে যেতে শিশুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় । ভয় পান মানুষটি । সঙ্গের পাহারাদার আশ্বস্ত করে—ও কিছু না , গাছের ডালে শকুনের বাচ্চা চেঁচায় । কিংবা মেঠোপথে যেতে গিয়ে দূরে দেখা যায় আলো । মনের ভেতর জেগে ওঠে ভয়—শাকচুন্নি না কী ! না , ওই হল গিয়ে আলেয়া । বর্তমান বিজ্ঞানমতে গ্যাস থেকে নির্গত ওই আলো ।
আমাদের আবহমান গুরুজনেরা ভূতপ্রেতের ধারণাগুলি লালন করেছেন । সবাই যে ভূতে বিশ্বাস করতেন এমন ভাবার কারণ নেই । কিন্তু আমাদের এইসব কল্পকাহিনীগুলো সযত্নে চর্চিত হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে । বাংলা ভাষায় অজস্র ভূতের গল্পের পাশাপাশি সেই স্কুলজীবনেই পড়েছিলাম একটি চমৎকার ইংরেজি বই—ফোক টেলস অব বেঙ্গল । লেখক—রেভারেন্ড লালবিহারী দে । ক্যাপ্টেন আর সি টেম্পল-এর অনুরোধে লালবিহারী দে এই বইটি লিখেছিলেন ১৮৮৩ সালে । এই বই এখনও পাওয়া যায় । টেম্পল সাহেব বুঝেছিলেন মা মাসিদের মুখে মুখে ফেরা অতি সমৃদ্ধ আমাদের দেশের লোককাহিনীগুলি গ্রন্থভুক্ত হওয়া দরকার । গল্পগুলো অত্যন্ত উপাদেয় ফ্যান্টাসিতে ভরা । ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী , ভূতপ্রেত , রাক্ষস, কেশবতী কন্যা এ সবের গল্প আমাদের ঐতিহ্য । আমি মনে করি ছোটোদের বেড়ে ওঠার সময় এই সব কল্পকথার একটা প্রয়োজনীয় ভূমিকা থাকে । এগুলি তাদের কল্পনাপ্রবণ হতে শেখায় । আর যে কোনো নতুন চিন্তা ও ধারণার জন্ম হয় কল্পনা থেকে । আমার পুত্র যখন ছোটো ছিল তখন এই কল্পনাপ্রবণতা বাড়ানোর জন্য তাকে অনেক বই খেলনা পাজল ইত্যাদি কিনে দিতাম যাতে তাকে মাথা খাটাতে হয় । আরো অনেক আগে যখন সে খুবই ছোটো তখন বড়দিনে সে ঘুমিয়ে পড়লে একটা মোজার আকারের ঝোলায় নানা রকম উপহার কিনে ঝুলিয়ে দিতাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে ঐসব উপহার পেয়ে তার স্থির বিশ্বাস জন্মাত এগুলি তাকে সান্তা ক্লস এসে দিয়ে গেছে । এ রকম অনেক মা বাবাই করে থাকেন, নতুন কিছু নয় । এ হল নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে মা বাবার একটু আমোদ আহ্লাদ । শিশুদের এই বিশ্বাসটা খুবই উপভোগ্য এবং এটা ভেঙে দিতে নেই । কিন্তু হল কী আমার ছেলে যখন একটু বড়ো বয়সে সাতকাহন করে এ কথা বন্ধুদের বলতে গেছে তখন এক বন্ধু তাকে বলে দেয়--না রে সান্তা ক্লস মোটেও আসে না । ওটা তোর মা বাবাই রেখে দিয়েছে । ব্যস আমাদের ফুর্তির দিন শেষ হয়ে গেল । আসলে হয়েছিল কী। ঐ ছেলেটা তার মা বাবাকে বলেছিল -- সবার বাড়িতে কেমন সান্তা ক্লস এসে খেলনাপাতি লজেন্স চকোলেট দিয়ে যায় । কই আমাকে তো দেয় না । ওর মা বাবা ওসব ঝামেলা এড়ানোর জন্য গোপন কথা ফাঁস করে দেন ।
ছিলাম দীপাবলিতে , এসে গেছি বড়দিনের কথায় । ভূত চতুর্দশীর সঙ্গে ১৪-শাক খাওয়ার চল আছে । এই ১৪- শাক কী কী ? এগুলি হল-
ওল/কেঁউ/বেতো/সর্ষে/কালকাসুন্দা
শেষ করি দীপাবলির প্রদীপ নিয়ে । অন্ধকার গ্রামদেশে সারি সারি মাটির প্রদীপ জ্বালানো ঘন অন্ধকারকে আলোয় পরিবর্তিত করার একটা প্রতীকী প্রয়াস মাত্র । এখন গ্রাম শহরে নানা বৈদ্যুতিক আলোর ঝিলিক । প্রদীপের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সেখানে ঢাকা পড়ে যায় সহজেই । আমার তো এখনো প্রদীপই দীপাবলির প্রথম পছন্দ । এক সময় রবীন মজুমদারের কণ্ঠে “ আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি না-ই বা জ্বালো” গানটা খুব প্রিয় ছিল । প্রদীপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথও অনেক লিখেছেন ।
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে ।।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো---‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে’।
________________
সুবীর ঘোষ
দুর্গাপুর
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন