Featured Post
গদ্য ।। রঙের খেলা ।। সুবীর ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
রঙের খেলা
সুবীর ঘোষ
ছোটোবেলায় একটা গান শুনেছিলাম ---আকাশে আজ রঙের খেলা / মনে মেঘের মেলা । আশা ভোঁশলের গাওয়া । এই গানটা শুনলেই সন্ধের আকাশে ঘটে যাওয়া কত বিচিত্র রঙের সমাহার যা দেখেছি তার কথাই মনে পড়ে যায় ।
কিন্তু যে বিষয়ের ওপর লিখতে দেওয়া হয়েছে তা সন্ধ্যাকাশের রঙের খেলা নয় । বরং আমাদের যে বার্ষিক রঙের খেলা অর্থাৎ দোল উৎসব তার কথাই বলা হয়েছে । অতএব সেই কথাতেই আসি ।
ছোটোবেলা যে গ্রামে কাটিয়েছিলাম সেখানে প্রধান আরাধ্য দেবতা ছিলেন বলরাম । কৃষ্ণসখা । কৃষ্ণের সঙ্গে দোল উৎসবের ব্যাপক অনুষঙ্গ ছড়িয়ে আছে আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে এবং পুরাণকথায় । সেই বলরাম মন্দির প্রাঙ্গণে দোল খেলা হত দোলের দিন বিকেলবেলা । আবির কম , গোলা রং বেশি । এ ব্যাপারে আমাদের উৎসাহ ছিল খুব । আমাদের এক একজনের নানা সাইজের পিচকারি থাকত । কাউকে কাছ থেকে রং দেবার একরকম পিচকারি তো দূর থেকে কাউকে দিতে আর এক রকম লম্বা পিচকারি । রঙ যখন ফুরিয়ে যেত তখন চলত স্রেফ জল ছোঁড়াছুড়ি । কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে গায়ে মাথায় ঢালা । আমরা বড়দের বিশেষ ঘাঁটাতাম না । তাঁরা নিজেদের মধ্যে রং খেলতেন । এক রকম রং ছিল বাঁদুরে রং । সে রং এমনি বেয়াড়া যে মুখে ঘষে দিলে আর উঠতেই চাইত না। স্কুলে অনেক বন্ধুকে দেখেছি দোল চলে যাবার পর বহুদিন পর্যন্ত লাল রঙা হাত নিয়ে স্কুলে আসতে ।
তারপর যখন কলেজে গেলাম , বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দোলের দিন বসন্তোৎসব হত । আর তার জগৎজোড়া খ্যাতি সকলের জানা । অসংখ্য মানুষ সেই অনুষ্ঠানে আসতেন । আমি যখন সেখানে পড়ছি তখন এখনকার মতো এত লক্ষ লক্ষ লোক আসতেন না ঠিক তবে খুবই ভিড় হত কিন্তু তা ছিল সংযত পরিশীলিত ভিড় । বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ।
সকালবেলা আমরা হস্টেলের ঘর থেকে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি বা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসে জড়ো হতাম আম্রকুঞ্জে । সেখানে বসন্তোৎসবের সূচনা হত । প্রথম গানটি সেই ভুবন বিখ্যাত ---খোল্ দ্বার খোল্ । এর পর একের পর এক নৃত্যগীত ও পাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হত । মূল অনুষ্ঠান শেষ হলে তবেই আমরা গৌরপ্রাঙ্গণে গিয়ে শুধুমাত্র আবির দিয়ে দোল খেলতাম । গোলা রঙ নিষিদ্ধ । আমাদের নিজেদের মধ্যে যারা গান গাইতে পারত তারা আর এক দফা গানের আসর বসাত । প্রচন্ড আমোদ ও উৎসাহে কেটে যেত সকালটা । এই উপলক্ষে আমার অনেক লেখক-কবি বন্ধু নানা জায়গা থেকে আসতেন । পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাও বেরোত । আমাদের নিজস্ব পত্রিকা ছিল—সাহিত্যিকা--- রবীন্দ্রনাথ- প্রতিষ্ঠিত । তখন ছাপাছাপির ব্যাপারটা এত সহজলভ্য ছিল না । আমরা তাই সাইক্লোস্টাইল করেই পত্রিকা বের করতাম । তাতেই খুশির বন্যা বয়ে যেত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ।
ঐ দিন সন্ধেতে হত গানের আসর ও নৃত্যনাট্য । গানের আসরে আমরা অনেক নামী শিল্পীর গান কাছ থেকে শুনতে পেতাম , যেমন ---সুবিনয় রায়, স্বপন গুপ্ত, সাগর সেন , অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়,মায়া সেন , ঋতু গুহ, বনানী ঘোষ , বাণী ঠাকুর , গীতা ঘটক, সুচিত্রা মিত্র । এছাড়া আমাদের কাছের মানুষ শান্তিদেব ঘোষ,কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন এঁরা তো থাকতেনই । শান্তিদেবের উদাত্ত কণ্ঠে সেই ---ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গানটি এখনো কানে বাজে । একবার অনেক রাত পর্যন্ত ডাগর ভাইদের ধ্রপদ ও ধামার শুনেছিলাম । সে কী অসাধারণ যে গান লিখে বোঝানো যাবে না ! এক দিকে মাটির পৃথিবীতে সুরের মূর্ছনা অন্যদিকে আকাশ ভাসানো চাঁদের আলো । কী যে মোহময় রাত্রি তা একেবারে মনের ভেতর অব্দি নাড়িয়ে দিয়ে যেত ।
পরবর্তী জীবনে শিল্পশহরে কর্মজীবনে এসে আবার সেই গোলা রঙের দিনে ফিরে যেতে হল । কিন্তু মন থেকে তার আর সায় পেতাম না । তাই সুযোগ পেলেই চলে যেতাম শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠান দেখতে । আমাদের শহরে কবি ও সমাজসেবী রণজিৎ গুহ এক পার্কের ভেতর একটি সমরুচির মানুষদের নিয়ে বসন্তোৎসব চালু করলেন আজ থেকে প্রায় দু'দশক আগে । সেখানে শুধুই আবিরের ব্যবহার । গানবাজনা হই হই আড্ডা –নানা কিছু খাওয়া দাওয়া । মধ্যাহ্নভোজের পর শেষ হত সেই জমায়েত । বহু কবিলেখক বন্ধুর সঙ্গে গল্পগুজবে বেশ কেটে যেত দিনটা । করোনা পরিস্থিতিতে এই নিয়ে দু'বার সেই জমায়েত হতে পারেনি । ঐ অনুষ্ঠানে প্রত্যেকবার একজন কবি ও একজন সমাজসেবীকে সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয় । ২০১১ সালের সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল আমাকে । তাই আমার এই অনুষ্ঠানের প্রতি ব্যক্তিগত আকর্ষণ আছে ।
আর একটি ব্যক্তিগত ভালো লাগার কথা বলে এ লেখা শেষ করি । কৈশোরে যখন আমরা প্রায় রাধাকৃষ্ণের মতোই হোরিখেলা খেলছি আমাদের বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে , সেই সময় কলকাতার বিখ্যাত রোশনাই পত্রিকাতে আমার একটি কবিতা ছাপা হল--- দোল নামে । সে সব দিন চলে গেছে কবেই ! তার বহু বছর বাদে ১৯৯৭ সালে রোশনাই পত্রিকার প্রকাশক এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি একটি সংকলন বের করলেন---নির্বাচিত রোশনাই নাম দিয়ে । সেখানে তাঁরা আমার সেই দোলের কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করেছিলেন । এ আমার নীরব নিঃশব্দ এক গভীর আনন্দ। সেই কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম---
দোল
এল দোল ! এল দোল ! ফাগুনের আঙিনায়
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খুশিমনে গান গায় ।
এল আজ ঝকঝকে পূর্ণিমা দিন
আকাশ বাতাস আজ রঙেতে রঙিন ।
নানা রঙে রাঙা আজ বন উপবন
তারই ছোঁয়া নিয়ে হাসে যত কচি মন ।
এল দোল ! এল দোল ! ফাল্গুন আসরে
আবির ছড়িয়ে দাও এ ধরণী 'পরে ।
গান গাও , গান গাও সুমধুর স্বরে
এল দোল ! এল দোল ! সকলের ঘরে ।
সুবীর ঘোষ
৩০১ আশ্রয় এ্যাপার্টমেন্ট
গ্রুপ হাউসিং , বিধাননগর
দুর্গাপুর—৭১৩২১২
চলভাষ—৯৯৩২৬৪০৯৪৯
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন