লড়াই লড়াই লড়াই চাই
সুদীপ দাশ
আমাদের তো সাতচল্লিশ সালে পাওয়া স্বাধীনতা।সেই স্বাধীনতা এল দ্বিখন্ডিত দেশ নিয়ে। দেশের দুই প্রান্তে দুই প্রদেশে তখন দেশভাগের হাহাকার।সে সময়ের আগে পরে, কত যে হানাহানি,কত লড়াই, যা তখন কুখ্যাত ছিল 'রায়ট' নামে।বাঙালি জীবন তদবধি আজও জাতি,ধর্ম দলে বিভাজিত।সেই ব্রিটিশ শাসনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই শুরু হল কম্যুনিস্ট পার্টি।কালে কালে তারও কত বিভাজন।নেতাজীও কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে করলেন ফরওয়ার্ড ব্লক,বললেন, 'এই দল ব্রিটিশের, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রকৃত বিরোধিতা করবে।'
তাছাড়া সেই শতাব্দীপ্রাচীন ঘটি বাঙালের দ্বন্দ্ব তো রয়েছেই ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানে।সেই সংঘাত ফুটবলের মাঠ থেকে পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়েছে।এমনকি মাঝে মাঝে রক্তক্ষয়ী রূপও নিয়েছে অতীতে।
পোকায় কাটা এক গণতান্ত্রিক দেশ উপহার পেলাম।সেখানে ডান,বাঁ উভয়েরই নিত্য নূতন দল উপদলের পত্তন।আবার একই দলে থেকে স্বার্থসংঘাতে তৈরী হতে থাকল বিভিন্ন গোষ্ঠী। বাঙালির অভিধানে এল নতুন শব্দ,-- 'গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা কোন্দল।'
ছোটবেলায় যখন মধ্যপ্রদেশের জবলপুরে মামাবাড়িতে যেতাম,তখন ওদেশে একটি চালু কথা শুনতাম,-- ' যেখানে বাঙালি,
সেখানে কালীবাড়ি,
সেখানে দলাদলি।'
তখন অতটা বোধগম্য না হলেও দিনে দিনে কথাটা বাঙালির ক্ষেত্রে এক নির্মম সত্য হল।
একদম ছোট্ট বেলায় থাকতাম আজাদগড় নামক উপদ্রুত অঞ্চলে যা টালীগঞ্জের এক পাড়া।তখন সত্তর একাত্তর সাল ।যখন তখন বোমাবাজি হত সেই সব পাড়ায়।মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত বিকট গুম্,গুম্ শব্দে। জেগে উঠে বলতাম ,'কিসের আওয়াজ মা?
মা বলতেন-----'আরে ও কিছু না,বোম পড়ছে ঘুমিয়ে পড়।'
টালীগঞ্জে,সত্তর ,একাত্তরের সেই এক রক্তাক্ত সময়ে কলকাতার এলাকা ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কোন পাড়া কংগ্রেস,তো কোন পাড়া সি পি এম বা কোন পাড়া নকশাল, আবার কেউ বা কংশাল।নেহেরু কলোনী,গান্ধি কলোনী, রিজেন্ট কলোনী ,নেতাজীনগর, বিজয়গড় অঞ্চল তখন এক এক পাড়া,এক এক দল বা উপদলের আখাড়া। সেই সময় বাঙালি দেখেছিল তরতাজা ছেলেগুলো কেমন করে 'বডি' হয়ে যায়।একবার মায়ের সাথে আমি সন্ধ্যায় এক বাজারে গেছি। হঠাৎ শুনি কয়েকজন একটা ছেলেকে ট্যাক্সিতে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে,আর ছেলেটি 'বাঁচাও বাঁচাও' করে চিৎকার করছে।কিন্তু কেউই সাহস করে বাঁচাতে এল না।পরদিন তার লাশ পাওয়া গেল গল্ফ ক্লাবের মাঠে।এই ছিল দস্তুর।
আমার বাবার এক প্রিয় রাজনৈতিক দাদা ছিলেন যিনি উত্তর চব্বিশ পরগণার হাড়োয়া অঞ্চলে কম্যুনিস্ট পার্টিতে খুবই সক্রিয় ছিলেন।একবার খবর এল,তিনি নিখোঁজ। তারপর তার খন্ড খন্ড দেহ পাওয়া মিলেছিল ওই হাড়োয়া অঞ্চলে।কিন্তু মুন্ডটি আর পাওয়া যায় নি।তারপর লাল পতাকায় মুড়ে সেই দেহ যেদিন আজাদগড়ের বাড়িতে এল প্রচন্ড ভীড় হয়েছিল ,কিন্তু মা সেদিন আমাকে সেই দৃশ্য দেখতে দেয় নি। আজও আমার এটি একটি আফশোষ,যে মা কেন আমাকে সে দিন ওই দৃশ্য দেখতে দিল না? আবার সেই পরিবারের এক দিদিকে জানি,যে প্রায় কুড়ি বছর পরে, যখন বামফ্রন্ট জমানা তখন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছুটেছিল ওই হাড়োয়ার গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির কাজ করতে, পরে দলীয় কোন্দলে নির্মম মোহভঙ্গ হয়ে ফিরে আসে। কি স্বাভাবিকই না ছিল সে সময়ের এইসব ঘটনাগুলো?
মনে পড়ে সেই বাহাত্তরের বিধানসভা নির্বাচন,-- আমার তো তখন আট বছর বয়স।দেখলাম বাড়িতে মা বাবার চাপা স্বরে অনুযোগ,--
'ভোট দেওয়া হল না,'--
আগেই নাকি সবার ভোট পড়ে গিয়েছিল সেইবার।তারপর একদিন দোতলার ছাদ থেকে দেখেছিলাম এক গৌরবর্ণ ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরিহিত সিদ্ধার্থ রায় হাত নাড়াচ্ছেন বিপুল হর্ষধ্বনিতে, মুখে বিজয়ীর চওড়া হাসি।চলল তাঁর সরকার আরও কয়েক বছর।
সাতাত্তরে কেন্দ্রে জনতা সরকার।আর বঙ্গে আবার বিধানসভা নির্বাচন।একদিন রাত দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের বাড়ির কড়া নাড়ল কেউ।বাবা দরজা খুলে দেখেন, বামপন্থী নেতা প্রশান্ত শুর এবং কয়েকজন।ওরকম লুকিয়ে ভোটের প্রচারে এসেছেন।সি পি এম পার্টির টালিগঞ্জ কেন্দ্রের প্রার্থী তিনি।পরে বামফ্রন্ট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন।
আবার বিরাশি সালের নির্বাচনের আগে একদিন হঠাৎ প্রকাশ্য দিবালোকে একটি ছেলেকে কয়েকজন খুন করে গেল গান্ধী কলোনী অঞ্চলে।আমরা দুর থেকে ঝামেলা দেখে পালালাম।পরদিনের কাগজ জানাল,_
''কংগ্রেস সিপিএমের সংঘর্ষে মৃত্যু,'
সেই 'ঘরে বাইরে'র ব্রিটিশ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ,-- বাঙালিকে সহজেই 'ভাগ কর আর শাসন কর' পদ্ধতিতে বাগে আনা যায়।
রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি কিনা ,অথবা নেতাজী তোজোর কুকুরের কিনা অথবা হাল আমলের রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত না নেতাজীর ভার্সান----বাঙালির আইকনদের নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিতে কিছু লোক সবসময় তৎপর।আর বাঙালিও আবার সেই দলে, উপদলে দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছে অবিরত।
এ লড়াই থামার নয়,কিছু লোকের লড়িয়ে দিয়েই তো ফায়দা!!
তাই তো বিভিন্ন দলের উপদলের বিভিন্ন রঙে আজ রাঙিয়ে নেওয়ার মন্ত্র পেয়ে বসেছে বাঙালিকে।
আবার আজ নির্বাচন সমাসন্ন, তাই আজ বাঙালি দল,উপদল,দলবদল,ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত।প্রায় প্রতিদিনই হানাহানির খবর আসছে।
----'আসছে ভোটের মাস,
মন তাই ভাবছে কি হয়, কি হয়,
কি জানি কি হয়?'
----------
সুদীপ দাশ
১৪, মেটাল বক্স হাউসিং এস্টেট
বাঁশদ্রোনী, কলকাতা-৭০০০৭০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন