অঞ্জনা গোড়িয়া
বসন্ত উৎসব! এই নাম টা আমাদের খুব পরিচিত। বসন্ত উৎসব মানেই শান্তিনিকেতন আর শান্তিনিকেতন মানেই বসন্ত উৎসব। এত দিন খবরে কাগজে টিভি সংবাদে দেখে আসছি শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের কথা। শুনে আসছি মানুষের মুখে মুখে। তখনও কচিমনে ইচ্ছে করত একবার ঘুরে আসতে। রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে। বসন্ত উৎসবে। আবীরের উৎসবে। ভালোবাসার উৎসবে।
কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও কখনো যাওয়া হয় নি। ইচ্ছে থাকলেও সূচনা করতে পারিনি। এমন ই এক উৎসবের আয়োজন করা হলো এই বছর। পেরেছি। হ্যাঁ গো। ঠিক ই বলছি। এক বছর ধরে করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মনে সুখ সাধ আনন্দ বিষাদে পরিনত হয়েছে। যদিও এখনো আমরা করোনার আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। তবু কিছু টা সময় চেয়ে নিলাম একটু অন্যভাবে কাটাতে।
নবযুগের সূচনা করতে।
আমার এক ছোট্ট বোন এই গাঁয়ের ই বউ প্রীতি যখন বলল,এমন ই এক উৎসবের কথা। মনটা আনন্দে নেচে উঠল। বাড়িয়ে দিলাম হাত। নিঃসংকোচে। এগিয়ে এলাম দু-পা বাড়িয়ে।
এ হাত আর ছাড়বো না। চলবে এমনই সুন্দর উৎসব আমাদের ভালোবাসার গ্রামে। ভালোবাসার রঙ ছড়িয়ে দিতে।
এই গ্রামের মেয়েদের বউদের মধ্যে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো আমাদের এই বসন্ত উৎসবে।
লুকিয়ে থাকা শিল্পীস্বত্তা প্রকাশ পেল এই বসন্ত উৎসবে।
যে মেয়েটা কোনো দিন নাচ করেনি।যে মেয়েটা ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে। ভয়ে সংকোচে। যে বউটা সংসার জালে জড়িয়ে ভুলে গেছে সাজতে। ভুলে গেছে হাসতে। আজ তাদের মুখে হাসি। সবাই সব লজ্জা ছেড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে হাজির। খোঁপায় গুজে চন্দ্রমল্লিকা ফুল। পলাশ ফুল যদিও বসন্তের ফুল। সবাই খোঁপায় গুজে বসন্ত যাপন করলে গাছ গুলো ই প্রাণহীন হয়ে যাবে। তাই পলাশ শিমূল গাছে ই থাকুক। পরিবেশ টা সুন্দর করে রাখুক।
হলুদ শাড়িতে টুকটুকে হয়ে এসেছে আবীর হাতে।
সবার পায়ের তালে তালে কেঁপে উঠলো দিঘির জল। গাছের পাতা উঠলো থরথরিয়ে।পাখিরা গেহে উঠলো গান। আর রাস্তার দুপাশে পথচারীরা ফোন হাতে লাইফ ভিডিও কিংবা ফোটো তুলতে ভীড় করে দাঁড়িয়ে। দোকানদারভাই হাঁ করে চেয়ে তাদের ই বাড়ির মেয়ের দিকে। অবাক দৃষ্টিতে।
আকাশে বাতাসে বইছে রঙিন হাওয়া। এ এক নতুন বসন্তের সূচনা হলো।
নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে চলল আমাদের মেয়েরা। ছেলেরা ও এগিয়ে এসেছে সহযোগিতায়।কারোর যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে জলের বোতল। রাখা হয়েছে ছোলা বাতাসা আর বিশুদ্ধ পানীয়।
ছেলেরা ও লাল পাঞ্জাবিতে সজ্জিত।
গ্রামের বয়স্করা ফোঁকলা দাঁতে একঝলক হেসে বলল , এটা আমাদের সেই গ্রাম। এত মেয়ে এ গ্রামে? এত সুন্দর নাচতে পারে? অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
অন্ধকারের মাঝে একটু আলোর সন্ধান পেল।
গাঁয়ের বধূরা আজ আর কোনো বাধা মানবে না গাঁয়ের বউরা।এত দিন পর ফিরে পেল তাদের ছোট বেলাটা।একটু দোল খেলার সুযোগ।
তাই আজ আর কেউ রুখতে পারবে না। আজ তারা আবিরে রাঙাবে ই। খুশিতে মাতবেই। হাসিতে লুটোপুটি করবেই।
এই আমাদের গ্রাম। মনের দুঃখ কষ্ট বেদনা বিরহ সব এক নিমেষে মুছে ফেলে আনন্দ উৎসবে এগিয়ে এলো সবাই। এ যেন এক স্বর্গসুখ। আমি খুব সাধারণ এক গাঁয়ের বধূ। স্বপ্ন দেখি হাজার।স্বপ্ন দেখতে ও ভালোবাসি।
স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় না? কে বলেছে? সব স্বপ্ন ই সত্যি হয়। যদি অন্তর থেকে দেখি। তার ই একটা স্বপ্ন এই বসন্ত উৎসব।
একটা দিন আমরা মেয়েরা বউরা পুরুষরা একতালে হাঁটলাম। নাচলাম।গাইলাম।রঙ মাখলাম। আরও আরও ভালোবাসলাম। হাতে মুখে রং মেখে রঙিন হাওয়ায় মেতে উঠলাম। চেনা অচেনার বাধন গেল খুলে। মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার ঘোষণা। আমরা পেরেছি। আমরা হেসেছি।আমরা নেচেছি।আমরা গেহেছি। আমরা রং মেখেছি।
আমরা সবাই পেরেছি।
দোল খেলা হোলি খেলা মানে ই একদল মাতালের মাতলামো নয়। শুধু একটা নিছক ই ছুটি নয়।
ডিজে পিকনিক হুইস্কির ফোয়ারা নয়। পিচকারি আর বাদুড়ে রঙের জ্বালাময় বেদনা নয়।
বসন্ত উৎসব নিয়ে এল একরাশ শুভেচ্ছা আর রঙিন ভালোবাসা। আমি তো আছি ই। তোমরাও থেকো কিন্তু। আর নয় পিছিয়ে থাকার। এসো সবার হাত ধরি। এগিয়ে যাই সম্মুখে।খুশি আর শান্তির বার্তা দিতে।
রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল। লাগলো যে দোল। "
এভাবেই প্রতিটি গ্রামে শহরে সর্বত্র ই বসন্ত উৎসবে একটা দিন মেতে উঠুক প্রতিটি মানুষ। আনন্দ খুঁজে পাক মনপ্রাণ। প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠুক শান্তিনিকেতন।
সবাই এগিয়ে এসো এই উৎসবে। একটা সুন্দর শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তুলি। এসো স্বপ্ন দেখতে শিখি।স্বপ্ন দেখাতে শিখি।
একদিন স্বপ্ন সত্যি হবে ই।
=====================
অঞ্জনা গোড়িয়া
থানা -ফলতা
গ্রাম-- দিঘিরপাড়
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন