দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মগরাহাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের
কিছু কথ্যশব্দ, উচ্চারণ, বাগ্.ধারা ইত্যাদি
(পর্ব— তিন)
~ অরবিন্দ পুরকাইত
স্থানীয় কিছু কথ্যশব্দ, উচ্চারণ, বাগ্.ধারা ইত্যাদির সংগ্রহ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল রামচন্দ্র নস্কর সম্পাদিত 'চর্যা' পত্রিকায়, ২০১৬ সালে। সে সংগ্রহ যায় নিজের 'গাঁ-ঘরের কথা' পুস্তকে, ১৪২৩ সনে। পরে এই ব্লগজিনেও কিছু সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ১৪২৮ সনের আশ্বিন মাসে। তার পরেও ধীরে ধীরে আরও কিছু সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলিই এখানে রাখা হল।
নিজের আগের সংগ্রহে এসে-যাওয়া শব্দ যা এসেছে এখানে, বাড়তি বা ভিন্ন কিছু বলার প্রয়োজনেই এসেছে।
আগের দু-বারই সংগ্রহ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা হয়েছে, বিশেষত প্রথম প্রকাশের সময় একটু বিশদভাবে। এখানে আর কিছু বলা নয় কেবল সংগ্রহটাই তুলে ধরা গেল।
অচারা — উপায়হীনতা, নিরুপায়। অচারায় নাজ্জামাই ভাতার। নাজ্জামাই—নাতজামাই।
অত্তারাযোগ (একটু ভদ্দরআনায় অত্রাযোগ) – প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি (সাধারণত দু-চারদিন ধরে), প্রাকৃতিক তাণ্ডব বা বিপর্যয়।
অনাকাচর — অনাচার (পূজা ইত্যাদি প্রসঙ্গে)। বাবা, ও কাঁচাখেকো ঠাকুর, ওর পুজোয় অনাকাচর হলি আর ওক্্খে আকবে নাকি!
আঙলানো — ঘাঁটা। বাঙালি/নিজের গু নিজে আঙলালি।
আল্্দা – আলাদা। স্বগ্রামস্থ মুসলমানগণের উচ্চারণ।
উৎকণ্ঠি - উৎকণ্ঠা থেকে এলেও গরম ইত্যাদিতে শারীরিক অস্বস্তি, কষ্ট প্রভৃতি বোঝায় ।
উয্যুগ – উয্যোগ/উদ্্যোগ। অজুহাত অর্থেও চলে – ওই এট্টা উয্যুগ প্যায়চে! উয্যুগে নক্খিও (লক্ষ্মী) খুব প্রচলিত ছিল। কোনও কাজে প্রণোদিত করে যে।
একডেলে — একটিই ডাল আছে এমন গাছ। গাচটা কেরাম একডেলে হয়ে উটেচে দেক!
এগোথেকা/এগোথেকা কলে – জরুরি, জরুরি ভিত্তিতে, তাড়াহুড়ো করে। ধানক'টা এগোথেকা কলে ত্যাকন সেরে না নিলি এই বিষ্টিই কী অবস্তা হত বলদেন! এগোথেকা অবস্তা – মুমূর্ষু দশা, মারা যায়-যায় অবস্থা।
এদ্্নে — এ দিনে।
এম্্নে — এমনিতে। এম্্নে কদ্দিন থাকে কিচ্ছু হয় না, আর এবার এত তাড়াতাড়ি পচে গেল!
এলিতেলি – হেঁজিপেঁজি, নগণ্য।
এলো-আমদা/এলো-আমদানি — প্রচুর, ইচ্ছামতো। আমার কি এত এলো-আমদানি আচে যে দু-বেলা তাদের সাঁইগুষ্টির ভাত জোগাব!
ওউন্তি — রউন্তি। বাড়তি, বাড়তি-থেকে-যাওয়া। কালকেরগার ওউন্তি গুড়টা এবার ঢেলে দি?
ওবরে (উচ্চারণ ওব্্রে) — ওপরে, উপরে।
কড়বেড় – জটিল।
কদ্বড়, এদ্বড় – কত বড়, এত বড়।
কল্লোম/করলোম – করলাম/করলুম।
কিড়মি — কৃমির উচ্চারণ। ঘুমির মদ্যি দাঁত কিড়মিড় করে, পেটডাবরি হয়ে যাচ্চে, হাতের তেলো চুলকোয় বলতিচিস — দেক, কিড়মি হয়চে মনে হয়।
কুমুক — কমুক। দাঁড়া, ভিড়টা কুমুক। বা, ভিড়টা কুম্্তি দে এট্টু।
কুলোট – আবাদের বিপরীত। আবাদে – কুলোটে। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার দক্ষিণাংশ আবাদ বা আবাদ-পরগনা আর অপেক্ষাকৃত উত্তরাংশ কুলোট বলে পরিচিত। কুলোট থেকে কুলোটে বা কুলুটে।
কুস্তোকুস্তি — কোনও কাজের জন্যে প্রচণ্ড খাটা, পরিশ্রম করা বা চেষ্টা করা। কুস্তি থেকে। বাবা, ঘণ্টাখানেক ধরে ঝেত চাপি-ছোড়ান ছেল — তা কুস্তোকুস্তি কল্ল, তেবু সে তালা ঝেদি খোলার নাম করে! (চাপি—চাবি। ছোড়ান—চাবি)
কেজরে থাকা — বিশৃঙ্খল বা অগোছালো হয়ে থাকা। দোকানের সামুনটা কেজরে আচে সিদিক কারোর নজর নি!
কেরমে কেরমে – ক্রমে ক্রমে।
কোদলা/কোৎলা – বড়, ধেড়ে। কোদলা ছাবাল, একোনো ভাত গালে তুলে খাওয়াতি হবে কেন রে!
কোর – করে-র উচ্চারণ। আট টাকা কোর আলুচ্চপ!
কোঁৎকা/কোঁতারে – বড়সড়, দশাসই, বেশ গায়ে-গতরে। কোঁৎকা/কোঁতারে দুটো তোড়ামাচ ধরেচে।
খানটাক/খানটা — খানিকটা।
খুলি — খোলবাজিয়ে। যেমন ঢুলি ঢোলবাজিয়ে।
খোড়েনটান ধরা — চরম অভাব, খুব টানাটানি। বাবা, হাতঘড়িটাও বেচে খেতি হয়, এত খোড়েনটান ধরেচে!
গ ওটা – বিশেষত ভাদ্র মাসের কুকুরের বিষয়ে। ক্ষেপে ওঠা। কেবল হুঁগরে হুঁগরে আসতিচিস, গ ওটা ছেইড়ে দোব রে!
গড়বেড় – সমস্যা, ব্যাগড়া, বাধা
গা-বিড়োনো – গা-বমি-বমি ভাব।
গা মিইটে ওটা – বিশেষত মিষ্টিজাতীয় জিনিস বেশি পরিমাণে খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছা না হওয়া (জলের ক্ষেত্রেও বলা হয়ে থাকে)
গাঁতাল – গাঁথা অবস্থায়, গাঁথাল, এক নাগাড়ে, ঝাঁকবেঁধে কিংবা লাইন ধরে।
গাচি দাওয়া — গাচি হল গাছি, গুছিয়ে ডাঁই করে বা টাল দিয়ে রাখা, বিশেষত বিচালি ইত্যাদি।
গুষ্টিগুলোন — গুলিয়ে বা ঘেঁটে একসা করা।
গৈলে-গানী – গোয়ালে গান করেন যিনি। গবাদি পশুর বৃদ্ধি এবং মঙ্গলের জন্য গোয়ালে যাঁরা মানিক পিরের গান করতেন।
ঘয্যোগের/ঘর্যোগের কতা – ঘরযোগের থেকে উচ্চারিত। ঘরের কথা, নিতান্তই পরিবারের বা কোনও নির্দিষ্ট সংসারের কথা। এ কি ঘয্যোগের কতা দেকলি তুই, অতগুনো নোকের আন্না!
ঘেত্তাবদ্দি/ঘেতো – অলস, কর্মবিমুখ, কুড়ে, সহজে কোনোকিছুতে গা করে না এমন। ওর মতন ঘেত্তাবদ্দির তুই বলিচিস ওই কাজ কত্তি!
ঘেড়োনো — দায়দায়িত্ব নেওয়া। ঘাড় দেওয়া থেকে।
চড়িচোট — (বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে) তৎপর, কর্মপটু।
চবালি — চোয়াল। নাক-চবালি মারা — হামবড়াই ভাব/গল্প।
চাজ্জমা – চারজমা থেকে। চারদিক যেন জমাটি। সব কাজ বর্তমান করতে পারে যে, গুছিয়ে সব কাজ করায় পটু, চারদিকের কাজ জমিয়ে করতে পারে যে। মেয়ে এগবারে চাজ্জমা, কোনো কাজডা ছুট যাবেনে। – সমস্ত কাজে তৎপর।
চিক্কুর/চিকুর মারা – বিদ্যুৎ চমকানো, মেঘের গায়ে বিদ্যুতের ঝিলিক; নিদারুণ যন্ত্রণার অনুভূতি, দপদপানি।
চেলে ফেলে দাওয়া – ঠিক ছুড়ে ফেলে দেওয়া নয়, চেলে দেওয়া থেকে চেলে ফেলে দেওয়া। এরপর কোনোদিন আমার বালতি সইরে তোর বালতি বসাস, তোর বালতি আমি চেলে ফেলে দোবো দেকিস।
ছ্যাঁক দাওয়া — বৃষ্টির ক্ষণবিরতি।
ছিকেত্তন/ছিখেত্তর – শ্রীক্ষেত্র থেকে? ছরকোট, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা (অযত্নে)। এ বচর নিচুর ছিকেত্তন/ছিখেত্তর। প্রচুর ফলায় ততটা কদর বা মূল্য না থাকা। (বচর — বছর, নিচু — লিচু)
জুটে থাকা – নারী-পুরুষে অবৈধ সম্পর্কে থাকা। আমার দেওরের ছাবালের সঙ্গে ঝে বউটা জুটে আচে...।
ঝাড়া মারা – দু-এক চালান/দফা ফসল বা ফল দেওয়ার পরের ফলশূন্যতা – পরে আবার ফল হতে পারে।
ঝামালি – ঝামেলা। ওদের ঝামালি (রোদের)।ঝ্যাৎখনগার ত্যাৎখন - যতক্ষণকার ততক্ষণ। ওষুধ খেলি ব্যতা কুমতেচে, হলি কী হবে, ওই ঝ্যাৎখনগার ত্যাৎখন।
ঠেকসোমারা – প্রায় শেষ হয়ে আসা/শেষ করে ফেলা। ঠেকে যাওয়া। ওরম ঠেকসোমারা সোমায়ে বেরুলি ঠিক সোমায় কী করে পোনছাবে! অর্থাৎ একেবারে শেষ মুহূর্তে বেরোনো। কাজডা ঠেকসোমারা হয়ে অ্যায়চে পেরায়।
ঠেঁডরুনো/ঠেঁটরুনো/ঠেঁডরানো/ঠেঁটরানো – ঠেঁটানো, (সাধারণত ভাবভঙ্গি নকল করে) ব্যঙ্গ করা।
ডাইবর/ডায়বর — ড্রাইভার।
ডেঙা মাচ – একটু বড় বড় বিলমাছ, চুনোমাছ নয়। বিল – জলাশয়, যেমন – খালবিল। চুনোচানা অনেক ধরা হয়ে গেচে, আর নিসনি – ডেঙা পেলি নে।
ডেড়ি — বাড়তি। আমার ডেড়ি ঝাঁজরি আচে, তুই দু-দিন পরে দিলিও অসুবিদে হবেনে।
ডোলা – গাছপালার ডাল ছাঁটা। ডুলে দেওয়া।
ঠাপ — ঠেলা, জরুরি, দায়। ঠাপ/ঠাপে পড়লি লোকে বাপ বাপ করে ছুডবে। ঠাপাঠাপি — অত্যন্ত জরুরি বা হুটোপাটি — এখনই করতে হবে এমন ভাব। এই ঠাপাঠাপির চাষের সোমায় কোত্থাও বেরোনোর সোমায় আচে রে ভাই! (ঠাপ কিঞ্চিৎ অপরিশীলিত প্রয়োগ)
ঢিবঢিবে – জনমনিষ্যিহীন জায়গা। বাবা, এই আতদুকুরি ওই ঢিবঢিবের মাজঘানে কে যাবে!
তলাঞ্চে – শেষগুড়ুনে, তলানি।
তামতুড়কি – হম্বিতম্বি।
তাম্বেক – পুরো, পুরোটা, সমস্ত, সম্পূর্ণ। তাম্বেক নুচিগুনো ককন খেয়ে নেচে গো!
তেবু – তবু।
থাদরিখেকো/থাদরিকানা – হঠাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা দিশাহীন অবস্থা (সচরাচর অল্প সময়ের জন্যে)
থাবগানি/থোবাড়ি – বকুনি, তিরস্কার; হেঁকে-বকে ওঠা
দবা ইতে দাওয়া — ভালরকম, অত্যধিক। সে আর বলুনি, খাওয়ার দবা এগবারে ইতে দেচে! দবা — দফা। ইতে ইতি থেকে, শেষ অর্থে।
দাগ — নির্দিষ্ট জমি বোঝাতে। আজ কোন দাগটা ওয়া হবে? ওয়া — রোয়া।
দিগিচি — দিয়ে গিয়েছি। দু-দিন আগে কাঁচি দিগিচি, একনও শান দাওয়া হয়নে!।
দিচ্ছেলম – দিচ্ছিলুম, দিচ্ছি।
দুউনি – দিয়ো না।
দুনেখাউকুড়ো – খানিকটা স্নেহের গালি। দুনিয়ার সব আত্মীয়স্বজনকে খেয়েছে যে (?)
দেছলম (উ. দেছোলোম) — দিয়েছিলাম।
দোইরে – দোর থেকে দোরে, তার থেকে দোইরে। দ্বারে, দরজায়। ঝার খাব তার দুবুনি আর তার দোইরে যাবুনি।
দোওয়া পাটি – দুয়ে নেওয়া পার্টি, টাকা-খেঁচা পার্টি
ধরঙ্গা করা – (মূলত বৃষ্টি সম্বন্ধীয়) আকাশ ধরা বা বৃষ্টি বন্ধ হওয়া। এই বিষ্টিই কে বেরোবে বাবা, আগাসটা এট্টু ধরঙ্গা কল্লি বেরোবো।
ধরুনি – দাই, ধাইমা। ধরে যে (স্ত্রীলিংগ)। কী ধরে? হওয়ার-সময় বাচ্চা ধরে। প্রসব করায় যে নারী। গরুর বেলায় ধরুনেও ছিল/আছে, অর্থাৎ যে পুরুষ গরুর প্রসব করায়।
ধুড়মুড় করে ওটা – ঘুম থেকে হঠাৎ ওঠা।
ন'কড়া-ছ'কড়া — তুচ্ছ দাম, যাচ্ছেতাই দাম।
ননী – নবনী, নবনীত। এর থেকে খুব মিহি অর্থ এসেছে – হলদি এগবারে ননী করে বাটতি হবে।
নাকচবালি মারা – বড় বড় কথা বলা, বড়লোকি ভাব দেখানো।
নিআসতি — নিয়ে আসতে।
নিউনি, দিউনি, খাউনি, যাউনি – নিয়ো না, দিয়ো না...
নিউলি — একটি বিচালি দুই বা তিন ভাগ করে তা দিয়েই যখন ধানের বোঝা বাঁধা হয়, উক্ত বিচালি বা বিচুলির ভাগ-করা যে অংশ দিয়ে অন্য বিচুলির বোঝা বাঁধা হয় তাকেই নিউলি বলে। নিউলি কাটা। নিউলির বাঁদন (বাঁধন)।
নিছাক্কারা/নিছেক্কারা — নিছক।
নিয়োনি, দিয়োনি – নিয়ো না, দিয়ো না।
নিসেএস – নিবি'খন, নিয়ে নিস। ছাতাটা আমার দোকানে পড়ে আচে, ওকেন থেকে নিসেএস।
নেপাত – নিপাত।
পব্বো – কাণ্ড। সীতেরানি ঝেন পব্বো কত্তেচে!
পলকে যাওয়া (উচ্চারণ পল্্কে) — হেজে যাওয়া।
পাইকেড়/পাইকিড়ি – পাইকার থেকে। পাইকারি ক্রেতা।
পাতা-মশলা — বিড়ি বাঁধার কেন্দুপাতা ও তামাকজাতীয় মশলা।
পুজ্জিমান — মজুত। এত পয়সা কোতায় নোকের ঝে তোমার জন্যি আজ্যির খাবার পুজ্জিমান করে একে দেবে!
পুঁটকি/পোঁদ শুইকে মোনো মেরে যাওয়া – শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার দরুন পশ্চাদ্দেশ রুগ্ন বা সরু হয়ে যাওয়া।
পেটে পোঁটা না থাকা – একেবারে খালি পেট, ক্ষুধার্ত, পেটে খাবার এতটুকুও কিছু না থাকা। সেই কোন সকালে দুটো পান্তা খ্যায়চে, চৌফুরে কল্লি পেটে আর পোঁটা থাকে! চৌফুরে চৌপ্রহর থেকে (যা থেকে চৌপ'র)। আদতে পুরো চার প্রহর নয়, সকাল থেকে দুটো-আড়াইটে-তিনটে অবধি কাজ করা।
পেটো — না, যা চার্জ করা হয় তার নয়, কৃমি।
পোস্কার — পরিষ্কার। পোস্কারি — পরিষ্কার-বাতিক মহিলা। অত পোস্কারি হওয়া আবার ভাল নয় বাবা।
ফুতি মারা – কানভাঙানো, কানভাঙানি দেওয়া। না-না, সে বে হয়চে তাই, কারা ফুতি মেরেচে ছাবালের নাকি বয়েস বেশি!
ফেইদে পড়ে থাকা – অসম্পূর্ণ এলোমেলো পড়ে থাকা (একটু অপরিশীলিত)।
ফেল দে — ফেলে দিয়ে। যাবার পতে এই ক'টা ওকেন ফেল দে চলে যাবি।
ফোকরানো — বলা, মুখ ফুটে উচ্চারণ করা।
বয়চে – বসেচে, বসেছে।
বলতেলো – বলতেছেল, বলছিল।
বলতেছেলম – উচ্চা. বোলতেছেলোম। বলিতেছিলাম, বলছিলাম। কাল তোদের বলতেছেলম ন্যায়...
বারকল্লা — একরকম আদরের তিরস্কার বা গালি। অল্পবয়সিদেরকে দেওয়া তিরস্কারের শব্দ। দূর বারকল্লা...
বুঁজো বাঁদা — এটা-সেটা দিয়ে ভরে রাখা/দেওয়া। বাঁদা হল বাঁধা।
বেড়খেলা – সহজে ধরা না দেওয়া।
বেড়গোড় – আঁকাবাঁকা ও জটিল।
বেড় দাওয়া – ঘিরে ধরা/বেষ্টন করা। বেড় দে ধর তো দেখি, মজা দেকাই!
বেলান্তে করা — চৌফুরে করা; আদতে এখন চার প্রহর নয়, সকাল থেকে দুটো-আড়াইটে-তিনটে অবধি কাজ করা। না, একন আসেনে, আজ বেলান্তে করে বীরের ভুঁইয়ের ধানটা পুরো তুলে নেবে।
ব্যেতা – ব্যথা। এলো পায় বোজা নে যাচ্চিস, পায় ব্যেতা হবে তো। আমাদের এদিকে প্রতিবেশী মুসলমান মহিলাদের উচ্চারণ।
ভটকানি – বিশ্রীভাবে মাখামাখি। ভটকানো/ভটকে দাওয়া। বাব্বা, নাকে সিগনি তা ভটকেচে!
ভিকিরি-মাউন্তুরে – ভিক্ষা করে বা মেঙে খায় যারা। ভিকিরি-কাঙাল বা কাঙাল-ভিকিরিও যুগ্ম প্রয়োগ।
ভেল — ঢং; অজুহাত। করবিনি-করবিনি, তা ওরম ভেল কত্তিচিস কেন!
মই-মাড়ান কলে খাওয়া – ইচ্ছামতো খাওয়া, নানান রকমভাবে খাওয়া। এ বচর ঝেমনি আম হয়ছেল তা তেমনি মই-মাড়ান কলে খাওয়াও হল!
মনসোবা/মনসোভা – মনোগত বাসনা, মনাভিলাষ। কী মনসোবায় ওই কাজ করেচে কী করে বলব বলদেন!
মাতালি/মাথালি — কোদালির কাটা মাটি মাথায় ঝোড়াতে করে নিয়ে যায় যারা। এক কোদালি আর দুই মাতালি/মাতা হলি হয়ে যাবে।
মিনি পয়সায় – বিনা পয়সায়।
মেজা – মাখানো, চটকানো। আমি বলব, আটা মিজে ছইড়ে দাও, খাক।
মেতা (উ. ম্যাতা) – জলজীবী গুঁড়িগুঁড়ি একরকম পোকা (মাছ বা চিংড়ির ডিমও হতে পারে) যা কাপড় দিয়ে ছেঁকে ধরে খাওয়া হয়। এর থেকে খুব মিহি অর্থে মেতা শব্দের প্রয়োগ আছে — মেতা করে হলদি বাটা।
যাউনি/যেউনি – যেয়ো না।
যাবেঅ্যানো,খাবেঅ্যানো – যাবে এখন, খাবে এখন। (বিশেষত এতদঞ্চলের প্রতিবেশী মুসলমানদের উচ্চারণ)
রংলা — রঙিন। কী সব রংলা গান দিচ্চিস, কেন তোদের কাছে কি পোরোনো গান কিচু নি নাকি রে!
রাংরেঙে/রাঙরেঙে/আঙএঙে/আঙরেঙে অবস্তা – রাঙা অবস্থা, সঙ্গতিসম্পন্ন, খুব ভাল আর্থিক অবস্থা, ফোলা-ফাঁপলা অবস্থা, ধনী। বাবা, ওর ছোট মেয়ের সোউরোদের আঙরেঙে অবস্তা, এগদিকি ধানের ধনী, তার ওপর জীবন মোল্লের হাটের ওপর বিরাট কাপড় দোকান!
লোবাত্ত/নোবাত্ত – লোভার্ত, লোভে আর্ত।
শুকো — বিড়ি বাঁধার তামাকজাতীয় মশলা।
শুল্লে — সরু। তার পর শুল্লে মতন এট্টা আস্তা পড়বে...
শেতন (উচ্চারণ সেতন) — শিথান থেকে। শিয়র, মাথার পাশে। টাকাটা ওর শেতনে একে দে।
শোল গজড়া — ছোট শোল মাছ, চারা শোল মাছ।
শ্যাঁদ্্লা/শ্যাঁতলা/শেওলা — শ্যাওলা।
সইলে-গইলে – কোনো রকমে, কোনোগতিকে, যে কোনোভাবেই। সইলে সলা থেকে সম্ভবত, গইলে গলিয়ে দেওয়া থেকে।
সাতভেজালে মানুষ — নানান কাজে ব্যস্ত মানুষ।
সেদ্্নে/সিদ্্নে — সে দিনে।
হলফলে হয়ে ওটা – নবীন ডাগর উজ্জ্বল বর্ধনশীল হয়ে ওঠা (মূলত শাকসবজি সম্বন্ধে)।
হালিমুগ – মুগ কড়াইয়ের এক প্রকার।
হিল্লাট/হিল্লেট – প্রাচুর্য অর্থে। বাবা, সে একন পয়সার হিল্লাট হয়ে গেচে/হিল্লাট করে নেচে। সে কেন অত দাম দে কিনবেনে বলো — পয়সার হিল্লাট/হিল্লেট হয়ে বসে আচে!
হিংসুকে – হিংসুটে।
হুইড়ে নাওয়া – ভদ্দরআনায় 'হুড়িয়ে নেওয়া' – ভুল বুঝিয়ে বা হুড়োহুড়ি করে সিদ্ধান্ত নিজের অনুকূলে আনা; নিয়ম-বহির্ভূতভাবে সিদ্ধান্ত অনুকূলে আনা। 'হুড়ো' থেকে (তাড়াহুড়ো)।
হেনে বোলানো — (বিশেষত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে) খোষামোদ করা। পতিবার খাবার সোমায় তোর হেনে বুইলে বুইলে খাওয়াতি হবে হ্যা রে! হেনে — স্নেহ থেকে?
হেবসে/হাবসে ওটা/যাওয়া – শাকসবজি, ধানগাছের ক্ষেত্রে খুব বেশি শরীর হয়ে গেলে (নুয়ে পড়তে পারে), গতরসর্বস্ব (ফল বেশি হয় না)
হোলডুবাডুব করা – নেচেকুঁদে বেড়ানো, কোনওকিছু নিয়ে খুব মাতা।
* * *
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন