Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

প্রবন্ধ ।। পিরিতের তথা সৌহার্দের পুঁজিবাদ (Crony Capitalism) ।। রণেশ রায়


 

পিরিতের তথা সৌহার্দের পুঁজিবাদ (Crony Capitalism)

রণেশ রায় 


অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে সামন্তবাদ ভেঙে বাণিজ্যবাদের কাল পেরিয়ে পুঁজিবাদের  বিকাশ ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পুঁজিবাদ ছিল প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ যা সামন্তবাদকে  বর্জন করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পুঁজিবাদের সবচেয়ে তীব্র সমালোচক কার্ল মার্কস ও  ফ্রেডরিক এঞ্জেলও কমিউনিস্ট মেনুফেষ্টতে এই প্রাথমিক  পর্যায়ের পুঁজিবাদকে প্রগতিশীল ব্যবস্থা  বলে উল্লেখ করেন। তাঁদের মতে ইতিহাসে বুর্জোয়া শ্রেণী খুব বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে।  উৎপাদনের উপকরণের অবিরাম বিপ্লবী বদল না এনে বুর্জোয়া শ্রেণী বাঁচতে পারে না। তাঁরা  বলেন:

 

'' বুর্জোয়া শ্রেণী বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই উৎপাদন  ও উপভোগকে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষুব্ধ করে তারা শিল্পের পায়ের তলা থেকে কেড়ে নিয়েছে সেই জাতীয় ভূমিকা যার ওপর শিল্প আগে দাঁড়িয়েছিল।  সমস্ত সাবেকি জাতীয় শিল্প হয় ধ্বংস পেয়েছে নয় প্রত্যহ ধ্বংস পাচ্ছে। তাদের স্থানচ্যুত করছে এমন নতুন নতুন শিল্প যার প্রচলন সকল সভ্য জাতির পক্ষেই মরাবাঁচা প্রশ্নের সামিল ; এমন শিল্প যা শুধু দেশজ  কাঁচামাল নিয়ে নয় দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে কাজ করছে; এমন শিল্প যার উৎপাদন  স্বদেশেই শুধু  নয় ভূলোকের সর্বাঞ্চলেই ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের উৎপন্নে যা মিটত তেমন সব পুরনো চাহিদার বদলে দেখছি নতুন চাহিদা , যা মেটাতে দরকার সুদূর বিদেশের নানা আবহাওয়ায় উৎপাদন।আগেকার স্থানীয় ও জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও স্বপর্যাপ্তির বদলে পাচ্ছি সর্বক্ষেত্রেই আদান প্রদান, জাতিসমূহের বিশ্বজোরা পরস্পর নির্ভরতা।বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন,তেমনি মনীষার ক্ষেত্রেও। এক একটা জাতির মানসিকতা সৃষ্টি হয়ে পড়ে সকলের সম্পত্তি। জাতিগত একপেশেমি ও সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে ; অসংখ্য জাতীয় ও স্থানীয় সাহিত্য থেকে জেগে ওঠে একটা বিশ্বসাহিত্য (কমিউনিস্ট পার্টির ইন্তাহার, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো  ) '' । 


কিন্তু একই সঙ্গে পুঁজিবাদের মধ্যেই তার ধ্বংসের বীজ নিহিত আছে বলে তাঁরা মনে করেন। এই স্তরের পরে প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে প্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ ঘটে। লেনিন  সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ বলে চিহ্নিত করেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতি পরিচালিত হতো বাজারের নিয়মে যেখানে ক্রেতা বিক্রেতারা এক ধরনের বাজারের সার্বভৌমত্বের সুবিধা ভোগ করত। তবে একচেটিয়া পুঁজিবাদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতার পরিসর  কমতে থাকে। তা সীমিত হয়ে পড়ে মুষ্টিমেয়র মধ্যে প্রতিযোগিতায়।


সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদের সংকট ঘনীভূত হয়। যুদ্ধ ভোগবাদ আর সমরবাদকে মদত করে পুঁজিবাদ টিকে থাকে বার বার বাজার সংকটে জর্জরিত হয়েও। পৃথিবীর বাজার দখলকে কেন্দ্র করে উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাজার দখলের জন্য একদেশের সঙ্গে আরেক দেশের মধ্যে যেমন যুদ্ধ শুরু হয় তেমনি ঔপনিবেশিক দেশের মুক্তিকামী  মানুষের সাথে পুঁজিবাদী দেশের যুদ্ধ হতে থাকে একের পর এক। দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যায়। আবার বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় পায়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পিছু হঠে। সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশ ছেড়ে  আসতে বাধ্য হয়। তবে ভারতের মত উপনিবেশগুলি থেকে অবিরাম সম্পদ লুঠ হয়ে যাওয়ায় সে সব দেশে স্বাধীন পুঁজিবাদের তেমন বিকাশ ঘটে না । দেশগুলো স্বল্প পুঁজির দেশ হয়ে ওঠে। ভারতের পুঁজি একধরনের আমলা পুঁজি হয়ে ওঠে যা বিদেশি বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে গাঁট ছড়া বাঁধতে বাধ্য হয় পুঁজির স্বল্পতার জন্য আর বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতার জন্য। ক্ষমতার হস্তান্তর হয় ১৯৪৭ সালে কিন্তু ভারত আত্মনির্ভর অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারেনি আজও।


আজকের দুনিয়ায় ঔপনিবেশিকতা নয়া ঔপনিবেশিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের পরবর্তী সময় থেকে, সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে উপনিবেশ গুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে। ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতি চালু হয়। পুরোপুরি বিদেশি পুঁজির শৃঙ্খল থেকে আমলাপুঞ্জি নিজেদের মুক্ত করতে না পারলেও নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতির মধ্যে বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবেশ থাকে না বলে দেশীয় আমলা পুঁজির বাঁধন কিছুটা আলগা হয়। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাদের প্রাধান্য পরোক্ষে রাখলেও ভারতের মাটিতে তাদের সংস্থাগুলিকে নিজেদের কব্জায় রেখেও কিছুটা ভারতীয় হয়ে ওঠে। যেমন ইউনিলিভার।ভারতে তার নাম বদলে হিন্দুস্থান লিভার হয়।নতুন বিদেশি পুঁজির তেমন অনুপ্রবেশ না থাকায় ফেরা আইনের মধ্যে এখানে শ্রম আইনের মধ্যে থেকে তাদের কর্পোরেট সংস্থা চালু রাখে। মারুতি বা এম্বাসেডর কোম্পানির মত কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু আজ বিশ্বায়নের কবলে পড়ে বিদেশী পুঁজির অবাধ আগ্রাসন শুরু হয়। সাবেকি আমলাপুজিও বিদেশি পুঁজির আগ্রাসনের সন্মুখীন হয়। কিন্তু  আমলা পুঁজির কোমর ভাঙ্গা বলে নিজেদের আবার বিদেশি পুঁজির সঙ্গে বন্ধনকে আরও শক্ত করতে হয়। বিদেশ থেকে আসা নতুন পুঁজির মুখে তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আমলা পুঁজিকে নতুনভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়।বিদেশি পুঁজির সঙ্গে গাট বন্ধন বজায় রেখে। দেশে রাষ্ট্রের সঙ্গে এক অশুভ আঁতাতে আসতে হয়। রাষ্ট্র বিশ্বস্তরে কর্পোরেটের অনুপ্রবেশ অবাধ করে দেয় বলে তারাও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাট বেঁধে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের স্বার্থ বজায় রেখে চলে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলকে অর্থ ও নানা সাহায্য দিয়ে। প্রযুক্তির ওপর দখল রেখে সেই কাজ সহজ হয়। শিল্প ব্যবসা বানিজ্যে তাদের ঝুঁকি বাড়ে। সাধারণ মানুষের জমা টাকায় এক ঋণ পুঁজি গড়ে ওঠে যা সরকারি ব্যাংকে সামাজিক পুঁজি হিসেবে বেড়ে ওঠে।এটা অর্থনীতির পক্ষে ব্যাংক জাতীয়করণের একটা সদর্থক দিক ছিল সন্দেহ নেই।  কর্পোরেট দুনিয়া ইতিমধ্যে ভারতে সাধারণ মানুষের সরকারি ব্যাংকে জমানো টাকার মধ্যে বিশাল ঋণপুজির গন্ধ পায়। নতুন আর্থিক নীতিতে ব্যাংক ইন্সুরেন্স কোম্পানির বেসরকারিকরণ ঘটে চলে। দেশী বিদেশী পুঁজি আর্থিক উদারীকরণের নীতির সুযোগ গ্রহণ করে। বিশ্বায়নের দৌলতে সরকারি ব্যাংকের অবাধ ঋণনীতি তাদের পুঁজি যোগানের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতির সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থার গাট বন্ধনে গড়ে ওঠে একধরনের নতুন পুঁজিবাদ যাকে আমরা পিরিতের পুঁজিবাদ বা সৌহার্দের পুঁজিবাদ বলছি। এর দৌলতে একধরনের লুম্পেন পুঁজি গড়ে ওঠে ব্যাংকের টাকা তথা সাধারণ মানুষের টাকা লুঠ করে কারণ এই অবাধ ঋণ নীতির ফলে কর্পোরেটের ঋণ ফেরতের তাগিদ থাকে না। পুঁজি খাটানোর ঝুঁকি বাড়ে বলে তারা নিজেদের পুঁজির ঝুঁকি যা নিত তাও কমাতে থাকে। ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ে আরও বেশি মাত্রায়। এ নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনায় আসব। এই লুম্পেন পুঁজির বিকাশ পুঁজিবাদের সংকটেরই একটা দিক যা প্রগতির পথ রুদ্ধ করে, পুঁজিবাদের মধ্যে থেকেই যে গণতন্ত্র মানবতার দাবি ওঠে তা অস্বীকার করে। বাজার অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা নীতিকেও অগ্রাহ্য করে। উৎপাদনকে নয় ব্যবসাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। বাজারে চাহিদা যোগানের মধ্যে চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়। উৎপাদন বাড়িয়ে যোগান বাড়িয়ে চাহিদা বাড়ানোর ক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয় না বরং এক ধরনের অনুগ্রহের অর্থনীতি গড়ে তোলে যা শ্রমের মর্যাদাকে উপেক্ষা করে অনুদানের ওপর বেঁচে থাকার মনন তৈরী করে। যা এই পিরিতের অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খায়। পিরিতের পুঁজিবাদকে কেতাবী ভাষায় সৌহার্দের পুঁজিবাদ বলা যেতে পারে। ইংরেজিতে একে বলে Crony Capitalism। এবার আমরা এর ওপর আলোচনা কেন্দ্রীভূত করব।


আজকের অনুদানের বা খয়রাতির অর্থনীতি একধরনের পুঁজিবাদকে সাহায্য করে যাকে পিরিতের পুঁজিবাদ বা Crony Capitalism বলে। ভোট সর্বস্ব এই পিরিতের অর্থনীতির জন্ম হয় পুঁজিবাদের গর্ভেই। তাই তাকে পুঁজিবাদের একটা ধরন বলে মনে করা হয়। আমরা এই ধরনের অর্থনীতির ওপর আলোকপাত করব। বলে রাখা দরকার যে এই পিরিতের পুঁজিবাদ একধরনের দুর্বৃত্তের অর্থনীতি যা পুঁজিবাদের সদর্থক দিকগুলি অস্বীকার করে বিভিন্ন ধরনের দুর্বৃত্ত মূলক কাজকে সমর্থন করে। বলা চলে দুর্বৃত্তমূলক কাজকে কেন্দ্র করেই এই অর্থনীতি গড়ে ওঠে। অর্থনীতির ক্ষমতাশালী করপোরেট গোষ্ঠীর সঙ্গে রাষ্ট্রের এক অশুভ আঁতাত দেখা যায়। অর্থনীতি আর রাজনীতির মধ্যে এক অশুভ সৌহার্দ তথা প্রীতি গড়ে ওঠে।এই সৌহার্দের ফলেই এই ধরনের অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে।


আজকের বিশ্বায়নের ছত্র ছায়ায় ভারত একধরনের পিরিতের তথা সৌহার্দের অর্থনীতিতে রূপায়িত হয়েছে। রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়ার মধ্যে গাটবন্ধন এই ধরনের ভয়ঙ্কর  অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে এই ধরনের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের তথা বাজার অর্থনীতির সদর্থক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় না। রাষ্ট্র আর তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি কোন স্বাধীন সত্তা হিসেবে থাকে না। অর্থনীতির স্বার্থের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থের এক মিশ্রণ ঘটে। উভয় জগতের ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর মধ্যে গলায় গলায় এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুই গোষ্ঠী একাকার হয়ে ওঠে। একের স্বার্থ অন্যের স্বার্থের পরিপূরক হয়ে যায়। এই ধরনের অর্থনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো কর্পোরেট জগতকে তার স্বার্থে কাজ করার অবাধ সুযোগ করে দেওয়া যার বিনিময়ে রাজনৈতিক দল ও দলীয় নেতা কর্মীরা নানা আর্থিক সুবিধা পায়। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ক্ষমতাশীল সরকার আর দলের সঙ্গে অর্থনীতির প্রভুদের গলায় গলায় সম্পর্ক দেখা যায় যার জোরে অর্থনীতির কাজকর্ম চলে তার স্বার্থে আইন বিচার প্রশাসন সংবাদ মাধ্যম সবই চলে। গণতন্ত্রের চার স্তম্ভ যাকে বলা হয় তা ধ্বংস হয়। আর এই আঁতাত ধরে রাখতে কর্পোরেট জগতের স্বার্থে একের পর এক তথাকথিত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় যা  ভারতে বিশ্বায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করার সময় কাল থেকে দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কোন অনাকাঙ্খিত কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদীর কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শ্রম সময়ের নিয়ম ভঙ্গ করে শ্রমিক কর্মচারীদের নীয়ম বহির্ভূত ভাবে খাটানো হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন সময়ে যে অধিকারগুলো মানুষ অর্জন করেছে সেগুলো একের পর এক খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে। অযাচিত ভাবে বিভিন্ন ধরনের অনুদান দিয়ে মানুষের শ্রমের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। মানুষের অধিকার বোধ দমন করার জন্য খয়রাতির মাধ্যমে  অনুগ্রহের একধরনের অনুৎপাদনশীল  ব্যবস্থার মধ্যে সমাজটাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য সরকারের মাধ্যমে কর্পোরেট জগৎ অর্থ ব্যয় করছে যা তারা ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে পায়। সংগৃহীত হয় কর থেকে। ব্যাংক ঋণ রয়ে যায় অনাদায়ী।এ হলো  এক ধরনের লুঠ। এই পিরিতের অর্থনীতির এটাই বৈশিষ্ট্য। এটা বলা চলে যে পিরিতের অর্থনীতির সাফল্য নির্ভর করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সরকারের  মধ্যে অশুভ আঁতাতের ওপর।এই আঁতাতের উদ্দেশ্য হল অর্থনীতি আর রাজনীতির জগতের প্রভাবশালীদের লুঠের পথ খুলে দেওয়া।


দেখা গেল যে পিরিতের পুঁজিবাদের উদ্ভব ঘটে অর্থনীতির প্রভাবশালীদের সঙ্গে রাজনীতির জগতে ক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালীদের মধ্যে এক ধরনের আঁতাতের ফলে। আর এই আঁতাতের অঙ্গুলিহিলনে চলে অর্থনীতি রাজনীতি। এতে অর্থনীতির প্রভুরা যেমন লাভবান হয় তেমনি রাজনীতির কর্তাব্যক্তিরা। অর্থনীতিতে লুঠের রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পদের নির্গমন ঘটে। পুঁজি উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত হতে পারে না। শিল্প সংকট যেমন নেমে আসে তেমনি কৃষিতে নেমে আসে ধ্বংস লীলা। জল জমি জঙ্গল লুঠ হয়ে যায়। আর্থিক দুরাবস্থার জন্য শ্রমজীবী মানুষের শহরমুখী গমনের হার বাড়ে। অথচ শিল্পের বিকাশ ঘটে না। সেখানে চাকুরীর সুযোগ সংকুচিত হয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা কাজ করে মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। রাষ্ট্রের আনুগত্যের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে শ্রমজীবী মানুষ। একধরনের অনুগ্রহের অর্থনীতি তৈরি হয় যা মানুষকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে বাঁচতে দেয় না। পুরো সমাজটাই হয়ে দাঁড়ায় ক্লীব পরনির্ভর অফলা। কৃষি উৎপাদন মানুষের জীবন ধারণ থেকে সরে যায় একধরনের খাদ্য শিল্পে যা অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয় যার ওপর অন লাইনে প্রভুত্ব করা আমাজনের মত বহুজাতিক ব্যবসা সংস্থার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। কৃষি পণ্য আমদানি বাড়ে। জমি বিকল্প ব্যবহারে বাড়ে। তার মধ্যে রিয়েল এস্টেট প্রধান। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধরনটাই বদলে যায় যা এই পিরিতের পুঁজিবাদকে মদত করে। এটা হলো ভারতের মত দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা। একদিকে কর্পোরেট দুনিয়া ব্যাংক লুঠ করে চলে আরেকদিকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় স্তরে লুঠের যাত্রারথের সারথী হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির মাতব্যরেরা। পশ্চিম বঙ্গে যেটা আজ প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আর্থিক বৈষম্যের ঘনঘটা। বিদেশী ঋণের ভারে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ভোগবাদের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয় যা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে কর্পোরেট দুনিয়াকে টিকিয়ে রাখতে চায়। যুদ্ধবাজকে মদত করা হয়।


আমরা যে অনুগ্রহের অর্থনীতির কথা বলেছি তা আলোচিত পিরিতের অর্থনীতিকে সমর্থন দেয়। আর পিরিতের অর্থনীতিতেই গড়ে ওঠে অনুগ্রহের অর্থনীতি যার স্বরূপ আমরা ভারতে দেখছি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন গালভরা নামের কর্মসূচিতে। পশ্চিমবঙ্গে এই কর্মযোগ্য চলছে রাজনীতি আর অর্থনীতির মধ্যে গাট বন্ধনের মাধ্যমে। আমরা বলেছি যে পিরিতের পুঁজিবাদ বাজারের নিয়মের ন্যুনতম নীতিগুলোও মানে না। আজ বিশ্বজুড়ে বিশ্বায়নের আবহে বহু দেশেই পিরিতের অর্থনীতির উদ্ভব ঘটেছে শুধু ভারতে নয়। এ হল অর্থনীতি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশের পর থেকেই এ নিয়ে চর্চা চলছে। তবে আজ এটা একটা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের মত এককালের ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিশেষ ভাবে দেখা যাচ্ছে।


আমরা দেখি যে পিরিতের পুঁজিবাদে অর্থনীতি আর রাজনীতি আলাদা সত্তা থাকে না, একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায়। আর এর সুবিধা গ্রহণ করে কর্পোরেট দুনিয়া আর রাজনীতির  ব্যবসাদারেরা। ব্যাংককে লুঠ যেমন করা হয় তেমনি শ্রমের মর্যাদা হরণ করে মানুষের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে সমাজটাকে করে তোলা হয় বন্ধ্যা পরনির্ভর। রাষ্ট্র এই ধরনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। আইন চালু করে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো দ্বংস করে এটা করা হয়। বিচার বিভাগ আইন বিভাগ প্রশাসন সংবাদ যোগাযোগ সব কিছুকে কাজে লাগিয়ে এই ব্যবস্থার কার্যকর মঞ্চ তৈরি হয়। প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করা হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে। অর্থনীতি রাজনীতির এই মিশ্রণ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ভেবেই বহুদিন আগে প্লেটো বলেছিলেন:


"Those who  exercise political power  should have no economic motives and those who are engaged in economic activities should have no         share in political power". 


আজ পিরিতের পুঁজিবাদ একটা ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতি আর অর্থনীতি একাকার হয়ে গেছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে কোন রাখ ঢাকনা রেখে। যে কোন অর্থনীতির পক্ষে এটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। সমাজের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বরাবরই ক্ষতিকর দিক আছে। তার মধ্যেও তার একটা মানবিক মুখের প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। মানুষের অধিকারবোধকে অস্বীকার করা হয় না। কিন্তু তার ধ্বংসাত্মক দিকটাকে স্বীকার করেও অর্থনীতিবিদ  জোসেফ সুম্পিতার পুঁজিবাদের ধ্বংসের কাজকে Creative Destruction বলে উল্লেখ করেন (Capitalism, Socialism, Democracy (1942)। কারণ পুঁজিবাদের আবির্ভাব ঘটে সামন্তবাদকে ধ্বংস করে যে সামন্তবাদ ছিল প্রগতির পরিপন্থী।কিন্তু পিরিতি পুঁজিবাদের জন্ম হওয়ায় পুঁজিবাদ তার সদর্থক দিক হারিয়েছে। পিরিতি অর্থনীতি মানুষের স্বার্থে উদ্ভাবনের পথে বাধা, মানব সভ্যতার পথে প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রকে অমানবিক কাজে মদত করে লুঠের পথ খুলে দেয়। রাজনীতি আর অর্থনীতির মধ্যে আঁতাত শুধু লোভ আর লাভের পথ প্রশস্ত করে। আর এই লাভ বাজার ব্যবস্থার ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়ার ফসল নয়। এ লাভ লুঠের ফসল।সাধারণ মানুষের টাকায় ব্যাংকে যে সামাজিক পুঁজি গড়ে ওঠে তা লুঠ করাই হলো এই লাভ। আজ যে ঋণ উন্নয়নের নামে দেওয়া হয় তা ফেরত দেওয়ার দায় থাকে না ব্যাবসায়ী শিল্পপতিদের। তাদের আত্মীয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা তাদের আড়াল করে উদারীকরণের নামে এমন নীতি বানায় যার ফাঁকে এরা বেঁচে যায়। আমরা জানি সাম্প্রতিককালে লক্ষ কোটি টাকার লুঠের ঘটনার সঙ্গে  যে ক্ষমতা-গোষ্ঠী যুক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।







মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩