বই হাতিয়ার
শ্যামল হুদাতী
আম আদমিরা বই ধরো - ওটাই হাতিয়ার। বই বিশ্বাসের অঙ্গ, বই মানব সমাজকে সভ্যতা টিকিয়ে রাখার জ্ঞান দান করে। অতএব বই হচ্ছে সভ্যতার ধারক ও বাহক।
আবার কলম তরোয়ালের চেয়েও ধারালো। কলম হৃদয়ের জিভ। শক্তিশালী লেখার প্রভাবে ভুল, কুসংস্কার, অন্ধতা, জড়তা, হীনতার, সংকীর্ণতাকে ত্যাগ করে এবং এক বিরাট শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। লেখকের প্রধান কাজ হল লেখা মারফত পাঠকের সঙ্গে সমন্বয় সাধন ঘটানো।
কিন্তু আম আদমি বই যে ধরবে অর্থ পাবে কোথায়। আজও আমাদের ২৩% মানুষ দুবেলা খাবার জোটাতে পারেন না আর ৯৭ কোটি মানুষ ঠিক করে খেতে পারেন না বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট। দেশব্যাপী সমীক্ষা স্পষ্ট গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে পড়া,লেখা ও অংক শেখার মান ক্রমশ নিম্নগামী। দেশে বেসরকারি স্কুলের রমারম ফলে অর্থকৌলিন্যের প্রাধান্য। এমন অবস্থায় ভুখা মানুষ কি ব্রাত্য?
ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় ক্রমশ অবনতি ঘটছে আমাদের দেশ। দেশের মানুষ ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না। আমাদের দেশের স্থান ১০৭ নম্বরে। আমাদের আগে আছে বাংলাদেশ ৮৪ নম্বর, শ্রীলংকা ৬৪ নম্বর। অর্থাৎ শ্রীলংকান ও বাংলাদেশিরা গড় ভারতীয়দের চেয়ে বেশি খেতে পায়। অথচ ভারত নিয়মিতভাবে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশকে কম দামে খাদ্য রপ্তানি করে থাকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ কোটি কেজি খাবার নষ্ট হচ্ছে বিশ্বে। এই নষ্ট খাবারের পরিমাণ বিশ্বে মোট উৎপাদিত খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ। যা দিয়ে প্রতিবছর পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব প্রায় 200 কোটি মানুষকে।
সারা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে একই বিপর্যয় মধ্যে পড়তে পারে, এই অভিজ্ঞতা আমাদের কোভিড দিয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে মানুষ অনেকটা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। গোটা পৃথিবীজুড়ে সামাজিক কাঠামোতে আঘাত করেছে এই বিপর্যয়। গরিব দেশে অভিঘাত অনেক বেশি। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, বহু পরিবার অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। যারা কাজ হারায়নি তারাও নানারকম মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতার মুখে পড়েছে যার পরিণাম সুদূরপ্রসারী।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। অনলাইনে ক্লাস গোটা শিক্ষাকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক শুধু নয় শিক্ষা অর্থনীতিতেও বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট- " অ্যানুয়াল অফ এডুকেশন রিপোর্ট"(ASER) ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে। ৩০,০০০ কর্মী, ৬১৬ জেলায়, ১৯০৬০ বিদ্যালয়ের ৭ লক্ষ শিক্ষার্থীর ওপর এই সমীক্ষা করা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রত্যেক রাজ্যের গ্রামীন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান এবং এই সঙ্গে ছাত্ররা কি শিখেছে,কতটা প্রয়োগ করতে পারছে, তাদের এবং শিক্ষকদের উপস্থিতির হার কি রকম পরিবর্তিত হয়েছে, বাবা-মা কতটা লেখা পড়া জানেন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সব তথ্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে রিপোর্ট তৈরি করে।
এই রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায় গ্রাম ভারতের শিক্ষা চিত্রের কতটা পরিবর্তন হয়েছে। দুটি প্রধান তথ্য উঠে এসেছে:
(১) পড়ুয়ার সংখ্যা কোভিড পূর্ব থেকে পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং
(২) ছাত্রদের পড়ার, লেখা এবং অংক করার দক্ষতা সবটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় নিম্নগামী।
এই রিপোর্টে চিহ্নিত করা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকদের কোভিড পরবর্তী আর্থিক সামাজিক পরিস্থিতিকে। বেশিরভাগ অভিভাবকরা কাজ হারানো কিংবা তাদের আর্থিকাবস্থা অবনতির কারণে ভালো সংখ্যক ছাত্রছাত্রীরা বেসরকারি বিদ্যালয় থেকে সরকারি বিদ্যালয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে অনেক ছোট ছোট বেসরকারি স্কুল উঠে যায়।
স্বাধীনতার আগে থেকেই আমরা দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বহু মানুষের নিরলস পরিশ্রম এবং বদান্যতায় অনেক স্কুল গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই সরকার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা মেনে ক্রমে ক্রমে স্কুলগুলো অধিগ্রহণ করে এবং অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেয়। ১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল প্রধান বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা। একই পাঠ্যসূচি আর একই পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। অবশ্যই দু'চারটে ইংরেজির মাধ্যম বিদ্যালয় থাকলেও পরীক্ষা ব্যবস্থা মূলধারার শিক্ষায় কোন উল্লেখযোগ্য ছাপ ছিল না।
এই ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করেছে এবং লালন পালন করেছে। শিক্ষা যে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার সেই ব্যবস্থা সরকার মান্যতা দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের পরবর্তী অধ্যায় বিনামূল্যে শিক্ষার ধারণা বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। আবার ওই আমলেই ১৯৮১ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি বন্ধ করা হলো কোঠারি কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী । তখন ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানো হতো না। যদিও পশ্চিমবঙ্গে অনেক গুণীজনেরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করে পথেও নেমেছিলেন । সরকারি ব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি এবং পড়ানো ধরনের কিছু পরিমার্জন ও পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু যথাযথ প্রয়োগে আন্তরিকতা আর দক্ষতার অভাব ছিল বলে জানা যায়।
আবার অন্যদিকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের ঢালাও ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ইংরেজি আমাদের আভ্যন্তরীণ কাজের ভাষা শুধু নয় উচ্চ শিক্ষারও ভাষা। শিক্ষিত শহরে মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিহার করতে শুরু করেন এবং অচিরেই সেই ছাপ জেলায় জেলায় পড়তে শুরু করল। কিন্তু শিক্ষা যে সাংবিধানিক অধিকার সেই দাবি হারানোর প্রথম ধাপ। এই প্রসঙ্গে জানাই
সংবিধানের আর্টিকেল ২১এ,শিক্ষার অধিকার, ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী সকল শিশুকে রাষ্ট্র বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রদান করবে।
ইদানিং একটা জিনিস আমাদের চোখে পড়ছে যে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য এখন দাঁড়াচ্ছে শিক্ষার বেসরকারিকরণ এবং শিক্ষাকে ক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত করা। কিন্তু আম আদমিরা কোথায় যাবে? শিক্ষা যে সাংবিধানিক অধিকার সেটা তারা ক্রমশই হারাতে শুরু করেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা যে আসল শিক্ষা সেটা রাষ্ট্রের প্রশাসন ভুলতে শুরু করেছে। উচ্চ শিক্ষার মান ও উৎকর্ষতা বিশ্বের দরবারে দেশের নির্ণায়ক হয় ঠিকই কিন্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে অবহেলা করে নয়। উচ্চ শিক্ষা বেসরকারিকরণ নীতি অনেক আগেই নেওয়া হয়েছে এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সে পথে হাঁটানোর জন্য কোভিড পরিস্থিতি আশীর্বাদ হয়ে গেল। দেশের আপামর মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে উচ্চমূল্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা কেনার ক্ষমতা সম্ভব নয়। সেই জন্য বেসরকারি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ব্যাংকে এসেছে "এডুকেশন লোন"। প্রায় বিনা বাধায় আমরা মেনে নিয়েছি যে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা আর নাগরিকের অধিকার এটাই হয়ে গেল নাগরিকদের ঋণের বোঝা। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা এডুকেশন লোনের নির্ণায়ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা এবং সাথে সাথে রাষ্ট্র সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা ও পালন করলো না। তারা চিরকাল ভুখাই থেকে যাচ্ছে।
এরচেয়েও মারাত্মক, নির্বিকার রাষ্ট্র পরোক্ষে মোবাইল অ্যাপ নির্ভর শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে। যা কিনা বহু জাতিক ভান্ডারকেই মজবুত করবে। ধীরে ধীরে শিক্ষার অঙ্গনে ভুখা মানুষরা ভুখাই থেকে যাবে। আরো যন্ত্রণাদায়ক, নিজের মেধা নয় পরিবারের আর্থিক অবস্থার আনুকুল্যে শিক্ষা কিনতে হচ্ছে।
"আম আদমি ধর বই" ওটা একটা স্লোগান, পৃথিবীর গরিব মানুষদের উজ্জীবিত করার শুধু একটা হাতিয়ার। রাষ্ট্র নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতলে পাঠাচ্ছে, অযোগ্যরা শিক্ষার আঙিনায় দুর্নীতির আশ্রয়ে ঘুষ দিয়ে প্রবেশ করছে, মেধারা রাস্তায় গড়াগড়ি করছে, রাষ্ট্র যুব সমাজকে অধঃপতনের রাস্তা দেখাচ্ছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কি এখনও চুপ করে বসে থাকবে?
সাহিত্যিক,কবি কুলদের আহ্বান গর্জে উঠুক কলমাস্ত্র সমাজের আর্ত নিপীড়িত আম আদমিদের অস্তিত্বে এবং প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তোমাদের শক্ত কলম চলুক কবি কর্মের অপক্ষপাতিত্বে। যেখানে বুদ্ধিজীবীরা সাইড লাইনে বসে খেলার মজা দেখছে সাহিত্য সমাজকে এগিয়ে এসে আম আদমিদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করতে হবে।
------------------------
শ্যামল হুদাতী
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড
কলকাতা - ৭০০০৬৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন