বাংলা কাব্যনাট্য নিয়ে ব্যতিক্রমী এক কাজ
অরবিন্দ পুরকাইত
বাংলা সাহিত্যজগতে তুলনায় অর্বাচীন শাখা কাব্যনাট্য বা কাব্যনাটক নিয়ে অভিজিৎ দাশগুপ্তের 'বাংলা কাব্যনাট্য চর্চার রূপরেখা' বইটি অবশ্যই বিশিষ্টতার দাবিদার। কাব্যনাট্য নিয়ে এত বড় মাপের কাজ হয়নি এর পূর্বে। বাংলা ভাষার প্রধান-অপ্রধান বহু কবিই তাঁদের লেখাজোখার পরিসরে কাব্যনাট্যকেও স্থান দিয়েছেন। বর্তমান লেখকের কলমে ৯৬ জন কবির শোয়া দুশোর মতো কাব্যনাট্যের নির্যাস তুলে ধরা হয়েছে, যা আলোচ্য বিষয়ে লেখকের বিস্তৃত পাঠপরিধি এবং পরিশ্রমের পরিচায়ক। কাব্যনাটকের স্বরূপ তথা তার গঠন, তার ভাষা ও সংলাপ, ইতিবৃত্ত থেকে তার সময়লগ্নতা, দেশ কাল ভেদে কাব্যনাট্য, কাব্যনাট্যের পর্ব-পর্বান্তর, তার মঞ্চ প্রযোজনা ও পরিকল্পনা ইত্যাদি বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে তাঁর বিশ্লেষণে। সাহিত্য হিসাবে, মঞ্চসাফল্যের নিরিখে এবং একইসঙ্গে কাব্যনাট্যের সাহিত্য হিসাবে সার্থকতা ও মঞ্চসাফল্যের বিরল মণিকাঞ্চনযোগের প্রসঙ্গ নিরপেক্ষভাবে আলোচিত হয়েছে দৃষ্টান্ত-সহ। তিনি লিখেছেন যে প্রায় শতবর্ষের 'এই সাহিত্যধারাটি এমন একটা পথ দিয়ে চলেছে, যার সামান্যতম ভুলে বিষয়বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।'
যোগ্য অধিকারী কবি প্রবালকুমার বসু অনবদ্য তাঁর 'কথামুখ'-এ উৎস থেকে অধুনাতন অবধি কাব্যনাট্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে একটি সুপরিসর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে, তিনি বলেছেন, "চার ও পাঁচের দশক নাগাদ বাংলা ভাষার কবিরা এই নতুন ফর্মে আগ্রহী হতে শুরু করেন।" 'কাব্য ও নাটকের সমানুপাতিক সমন্বয়'-এ বিশ্বাসী শ্রী বসু লিখেছেন, "কাব্যের সমন্বয় তো একজন কবিই আনতে পারেন। ফলত কাব্যনাটক লেখার দায়িত্ব বর্তায় কবির উপরই।" তিনি লিখেছেন যে সেই সমন্বয়টা গড়ে না ওঠার কারণে, "কাব্যনাট্যচর্চা ধীরে ধীরে, নদী যেভাবে শুকোয়, সেইভাবে শুকিয়ে গিয়েছে। সাহিত্যের এক সম্ভাবনাময় আঙ্গিক নিজস্ব শৈলীতেই চেয়েছে হারিয়ে যেতে।"
আলোচ্য বিষয়ের প্রতি নিবেদিতপ্রাণতা থেকে লেখক অর্ধশতাধিক কবির প্রায় একশো কাব্যনাট্যের— কবি এবং কাব্যনাট্যের নাম উল্লেখ-সহ— হাতের কাছে না পাওয়ার কারণে আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বলে উল্লেখ করতেও কুন্ঠিত হননি (নামগুলি পেয়েছেন তিনি বিভিন্ন বইপত্র থেকে)। তার পরেও যে দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে বেশ কিছু কাব্যনাট্য, স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি তাও। খুবই আশ্বস্ত লাগল দেখে যে লেখক নিজেই জানিয়েছেন পরবর্তী সংস্করণে অন্যান্য কাব্যনাটকের পাঠ-অভিজ্ঞতা উপস্থিত করার।
গত শতকের কলকাতায় জন্ম শ্রী দাশগুপ্তের। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭০। পিতা প্রয়াত অসিতকুমার দাশগুপ্তের রেলের চাকরি-সূত্রে শৈশবে বসবাস ভাগলপুর, রামপুরহাটে। মাতা প্রয়াতা দীপ্তি দাশগুপ্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি-প্রাপ্ত অভিজিৎ যুক্ত শিক্ষকতায়। পাশাপাশি চলে তাঁর সাহিত্যচর্চা। একাধারে কবি ও কথাকার তিনি। দশটি কবিতা-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, রয়েছে একটি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্পের বই। গবেষণাধর্মী লেখাজোখায়ও বরাবরই আগ্রহী তিনি। পুরস্কৃত বর্তমান বইটি ছাড়াও তাঁর অন্য দু-একটি বই 'বিরোধাভাসের অন্য রবি', 'রবীন্দ্রনাথ ও দীনেশচন্দ্র সেন', 'বাংলা সাময়িক পত্র থেকে লিটিল ম্যাগাজিন (১৮১৮—২০১০) প্রভৃতি। '১৪টি কাব্যনাটক' নামে করেছেন কাব্যনাট্যের এক সংকলন। সম্পাদনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন 'খোয়াই' নামে এক পত্রিকার।
'ইলিশমঙ্গল কথা' বইটির জন্য শ্রী দাশগুপ্ত ২০১৬ সালে পেয়েছেন 'আত্মদ্রোহ সাহিত্যকৃতি সম্মান'।
বর্তমানে লেক ভিউ পার্ক, বনহুগলির বাসিন্দা স্বল্পভাষী শ্রী দাশগুপ্তের প্রিয় শখ ইতিহাসচর্চা ও ভ্রমণ।
একটি কথা মনে হয়েছে পড়তে পড়তে। এক-এক কবি ধরে তাঁদের কাব্যনাটকের সারসংক্ষেপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যায়নমূলক উক্তি একটু করে যুক্ত হলে 'সামগ্রিক পরিচয়' আরও সুচারু হয়ে উঠতে পারত।
বইটি শ্রী দাশগুপ্ত উৎসর্গও করেছেন গিরিশঙ্কর, রাম বসু, দিলীপ রায় ও দেবকুমার বসুকে, 'বাংলা কাব্যনাট্যের প্রচার ও প্রসারে যাঁদের অবদান স্মরণযোগ্য...'। ঋণস্বীকারে কার্পণ্য রাখেননি লেখক।
বাংলা কাব্যনাট্য নিয়ে ব্যতিক্রমী এই কাজটির জন্যে বাংলা সহিত্যজগৎ কৃতজ্ঞ থাকবে লেখকের কাছে। পুস্তকের নাম : বাংলা কাব্যনাট্য চর্চার রূপরেখা
লেখকের নাম : অভিজিৎ দাশগুপ্ত
প্রকাশকের নাম : যাপন চিত্র
প্রকাশকাল : বইমেলা ২০২৩
মূল্য : ২৫০ টাকা
আলোচক: অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন