দেবগিরি
রতন যখন দেবগিরি মানে দৌলতাবাদ ফোর্টের সামনে বাস থেকে নামলো তখন বিকেল সাড়ে চারটে। নভেম্বরের মাঝামাঝি বেলা পড়ে এসেছে। দুটো উঁচু পাথরের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা লাল মাটির পথ ধরে গিয়ে আর্কিয়োলজিকাল সার্ভের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বড় বড় গজাল লাগানো কাঠের সিংহদুয়ার দিয়ে ঢোকার সময় গাইড বলল ঘুরিয়ে দেখাতে সাড়ে সাতশ নেবে। নেট সার্চ করে আসায় রতন কনফিডেন্ট ছিল। অত টকা খরচা করার ইচ্ছে হল না। সাধারণ চাকরি করে। ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ ওকে টেনে এনেছে ভারতের সবচেয়ে জটিল নক্সার এই দুর্গে। কোন আক্রমণকারীই ভেদ করতে পারেনি এর সুরক্ষা কবজ, শুধু অবরোধ করে দুর্গের অধিবাসীদের খাবার ফুরিয়ে দিয়েই জিৎ হাসিল হয়েছে।
টিকিট দেখিয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় গেট্ম্যান বলল বেশি দেরি না করতে, আলো মরে আসছে। একের পর এক বড় বড় দরজা পেরিয়ে ওপরে ওঠার সময় রতন দেখল সবাই নীচে নেমে আসছে, ওর সাথে ওপরে ওঠার কেউ নেই। কালকের ট্রেনের টিকিট কাটা। যতটা পারা যায় আজই দেখে নিতে হবে রতনকে, ইহজীবনে আসার আর সুযোগ হবে কিনা কে জানে!
ধাপকাটা গভীর কুয়ো, ভারতমাতা মন্দির, চাঁদ মিনার, চিনি মহল ছাড়িয়ে পাথরের সিঁড়ির চড়াই ধরে এগোতে লাগলো রতন। এখন আর কোনো দর্শককে নামতেও দেখছেনা রতন। সামনের কাঠের সরু পুলটা পেরোলেই ফোর্টের আসল অংশ শুরু, আন্ধেরি পেরিয়ে ঢুকতে হবে। অনেক দিনের ইচ্ছে রতনের আন্ধেরিতে ঢোকে কিন্তু গাইড ছাড়া ঢোকা কি উচিত হবে? সারাজীবন ঘুরে মরতে হবে অন্ধকারে। আলোও কমে আসছে। সরু পথটা দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকে বাঁদিক ঘুরে এক ধাপ নেমে একটা ছোটো চত্বর। তার সামনে আন্ধেরিতে ঢোকার খোলা দরজা। দরজার ভেতরটা অন্ধকার। চত্বরটা একটা লোক ঝাঁট দিচ্ছিল। রতন কাছে গিয়ে দেখলো, পাগড়ি পরা, মোটা গালপাট্টা, গায়ে খাটো পাঞ্জাবী আর ধুতি, কোমরে একটা কাপড় বাঁধা।
রতন জিজ্ঞেস করলো, "ইয়ে দরওয়াজা আন্ধেরি মে যাতি হ্যায়, ভাইয়া?"
"আন্ধেরি দেখনা হ্যায় জী?" লোকটা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো ঝাঁটা পাশে রেখে।
"কিতনা পয়সা লোগে?"
"ঘুমকে মজা আয়া তো দিজিয়েগা যো দিল করে।" বলে হাতের ইশারায় সঙ্গে আসতে বলে আন্ধেরির মধ্যে ঢুকে পড়লো লোকটা। একটু ইতস্তত করে রতনও ঢুকে পড়লো। খানিকটা আলো হয়েছে ভেতরে। আলোটা আসছে পাগড়ি ওয়ালার হাতে ধরা একটা মশাল থেকে। রতন বুঝলো, গাইডের পয়সা বাঁচাতে অনেকেই ওর সাথে ঢোকে আন্ধেরিতে।
"মেরে পিছে পিছে আইয়ে, সাবধানিসে। আশপাশ ভটকিয়েগা মত, খাই হ্যায়।" সতর্ক গলায় বলল লোকটা। একটু ভয় পেলো রতন। লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে দেখে এগোল ও।
"ও শিবো, ম্যায় হুঁ, চমন, কুছ চালা মত দেনা।" হেঁকে বলল লোকটা।
রতন অবাক হোলো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করারা আগেই ভেতর থেকে গলার শব্দ এলো, "মশাল আপনি মু পর রাখনা, পহেচান হোনা চাহিয়ে।"
"হো, ঠিক হ্যায়।" চমন উত্তর করলো।
খানিকটা সোজা গিয়ে সিঁড়িটা বাঁয়ে ঘুরলো। চমন হাতের মশালটা তুলে নিজের মুখটাকে আলোকিত করলো। ঐ আলোয় রতন দেখলো দুপাশের দেওয়ালের ওপর দিকে বাংক করা আর ঐ বাংকে বর্শা হাতে বসে রয়েছে সান্ত্রী। ব্যাপারটা কি বুঝতে পারলো না রতন। চমন আলো হাতে এগিয়ে যাচ্ছে আর তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে রতন। একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে একটা বাঁক ঘুরে ডানদিকের সিঁড়িতে পা দিতে যেতেই বাঁদিকের দেওয়ালের আড়াল থেকে লাফিয়ে এসে রতনের হাত ধরে আটকে দিল চমন।
"খাঁই হ্যায়, সিধা নীচে গিরোগে।" বলল চমন।
"আরে চমন ভাই, শুটিং চল রহি হ্যায় কেয়া, কোনসা ফিল্ম, ডিরেক্টার কওন হ্যায়?" সামনের বাংকের সান্ত্রীটির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো রতন।
চমন শুধু মশাল তুলে সান্ত্রীকে ঈশারা করলো, উত্তর দিলোনা। খবর যাতে না বেরোয় তাই কিছু বলা মানা আছে, বুঝলো রতন।
মশাল তুলে ছাদের কয়েকটা গর্তের দিকে ঈশারা করে চমন বলল, "শত্রু আগর ইতনা দূর আ ভি গ্যয়া তো উপর সে গরম তেল ডালকে অর আন্ধেরিমে বিষ কা ধুঁয়া ভরকে উসকো খতম কর দেতে হ্যায় হাম।" শুনে মনে প্রশ্ন জাগলেও করলো না রতন।
সিঁড়ির যে ধাপ আবার খোলা জায়গায় এনে ফেলল রতনকে সেটা কাঠের স্লাইডিং দরজা দিয়ে আটকানোর বন্দোবস্তো করা আছে। বাঁদিক দিয়ে সিঁড়ি ওপরে উঠে গ্যাছে। সিঁড়ির সামনের ল্যান্ডিং এর ধারে দাঁড়িয়ে দুজন অ্যাক্টর কথা বলছে। আলো কমে আসায় একটু কাছে গিয়ে দেখলো রতন। একজন বেশ জমকালো দামী নীল কাপড়ের পোষাক পরে দাঁড়িয়ে, কোমরে বড় ছুরি আর একজন সাদা সিল্কের ধুতি আর চাদর পরে, কাঁধের চাদরের ফাঁকে পৈতে দেখা যাচ্ছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে খাড়া পাহাড় ছাড়িয়ে বাইরের খোলা মাঠের দিকে তাকালো রতন। সারি সারি তাঁবু পড়েছে। কয়েকটা আলোও দেখা যাচ্ছে জ্বলে উঠেছে।
রতন ভাবলো, "বেশ বড় সেট পড়েছে তো!"
পাশের দুজনের কথা হালকা কানে এলো, ভাষাটা ঠিক বুঝলো না রতন, মারাঠী হবে। তবে কিছু চেনা শব্দ যেন কানে এলো। তুর্কি, ভুখ, নমক, বেইমান, আলি গুরসাস্প, গেঁহু, চাওল, কুমার সিমহন এরকম শব্দ। রতন বুঝলো ডায়ালগ মুখস্ত করছে।
স্ক্রিপ্টের এই অংশটা চিনতে পারলো রতন।
১২৯৬ সাল। দুর্ভেদ্য পাহাড়ী দুর্গে ঢুকতে না পেরে কারা প্রদেশের শাসক আলি গুরসাস্প, যে কিনা পরে আলাউদ্দিন খিলজি নামে ইতিহাস প্রসিদ্ধ হয়, দেবগিরি দুর্গ ঘেরাও করে রেখেছে। দেবগিরি শহর সম্পুর্ণ লুট করেছে তুর্কী শাসকের সৈন্যরা। শহরের সব ব্যাবসায়ীদের বন্দী করে রেখেছে আলি। বাইরে থেকে খাবার সরবরাহ বন্ধ। মজুত করা খাবার ফুরিয়ে এসেছে। দুর্গে ঢুকে পড়ার আগে বেশ কিছু বস্তা দানাশস্য শহর থেকে এনে রাজার গুদামে রাখা হয়েছিল কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেইসব বস্তায় খাদ্যশস্য নেই, নুন ভর্তি বস্তা সবগুলো। যুবরাজ সিমহন বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে সামন্ত জমিদারদের বিদ্রোহ দমন করতে দেবগিরির বাইরে গেছেন। অসহায় যাদব রাজ রামচন্দ্র আর মন্ত্রী সে বিষয়ে কথা বলছেন।
"উপর তক যায়েঙ্গে, চমন ভাই?" বলে ঘুরে রতন দেখলো চমন নেই। আলো আরও কমে এসেছে। দোনোমোনো করে অ্যাক্টর দুজনের পাশ দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি ধরল রতন।
"কাঁহা যাওগে?" ধমকের সুরে কথাটা শুনে পিছন ফিরে রতন দেখলো সাদা ধুতির অ্যাক্টর তার দিকে তাকিয়ে আছে।
"উপর যানা হ্যায়, টিকিট হ্যায় মেরে পাস।" রতন বিরক্তি চেপে বলল।
"ঘর যাও।" এবার আরও কড়া ভাবে বলল সাদা ধুতি।
পাশের একটা ভাঙ্গা দেওয়ালের পেছন থেকে চমন বেরিয়ে এল। হাত জোড় করে সাদা ধুতিকে নমস্কার করে আরো বেশি মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করলো নীল পোশাকের অ্যাক্টরকে। তারপর রতনের কনুই ধরে নেমে পড়লো আন্ধেরির মধ্যে। এবার আন্ধেরির বাংকগুলোতে মশালের আলো দেখলো রতন। আন্ধেরির দরজা দিয়ে সামনের চত্বরটায় পা দিয়ে রতন দেখলো দুটো টর্চের আলো পুলটা পেরিয়ে এদিকে আসছে।
"কিতনা দেঁ তুমহে চমন ভাই?" বলে ঘাড় ঘুরিয়ে রতন দেখলো চমন নেই। যা, প্রাইভেট প্র্যাকটিস ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে। এবার টর্চের আলো পড়লো রতনের গায়ে।
"কন হ্যায়?" বলে সামনে এগিয়ে এলো আর্কিয়োলজিকাল সার্ভের দুজন গার্ড। "আপ অন্ধেরে মে ইধার হ্যায় আভি তক। চলিয়ে নীচে।"
ওদের সাথে যেতে যেতে রতন জিজ্ঞেস করলো, " উপর কোনসি ফিল্মকা শুটিং চল রহি হ্যায়, ভাইয়া?"
"ক্যায়সি শুটিং? আভি কুছ নেহি চল রহা। পিছলে মাহিনে হুয়া থা শাহিদ কাপুর অর প্রিয়াংকা চোপড়াকা শুটিং।"
মেন্ধক কামানের গম্বুজের সামনে এসে দুর্গের বাইরের মাঠের দিকে তাকালো রতন। একফোঁটা আলো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার আর হালকা কুয়াশা ঘিরে রয়েছে জায়গাটা।
--
Abhra Ghosh
বারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
9433112702