নীলচে কুয়াশার পিছনে
মাঘের হিমকুচি কুয়াশার দানা আর ঠোঁট ফাটা বেহিসাবি হিমেল হাওয়া সব রূপ গ্রাস করে। উত্তুরে বাতাসে ধেয়ে আসে হিম, বুভুক্ষুর মত। বিবর্ণ রুক্ষ, তন্বীর খসখসে পিঠে এলানো চুল, শ্রীহারা ত্বক। সে আসে সর্বগ্রাসী ক্ষয়ের গন্ধ নিয়ে, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু নিত্য সব হারায় এ বেলায়। দিন শেষে রুগ্ন ফুলের পাপড়ি খসে, ধূসর বিকেলে বার্ধক্য ভিড় করে আসে। নুইয়ে পড়া গাছের স্তন থেকে চুপিসারে টুপ্ টাপ শিশির ঝরে।
লাল বট ফলের অস্তরাগের রং সাপটে থাকে নীল আসমানে, দূরদিগন্ত ভারী হয়ে আসে। সরপুঁটি আর কলমীলতার গন্ধ মাখা ভাপ ওঠে কেঁপে কেঁপে, সারি সারি তাল গাছের পিছনে দূরের পুকুর থেকে।ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। বরফ সাদা ঠান্ডা, পেঁচার ধূসর কালো ডানার মত অন্ধকারে জমাট বাঁধতে থাকে। একফালি বাঁকা চাঁদ ঢেকে থাকে কুয়াশায়, মৃত জোৎছনার ক্ষয়িষ্ণু নীলচে আলোর মায়া চিরে ভেসে আসে শকুন শাবকের কান্না, ভিজতে থাকে চরাচর।
কতক ঝরে পড়া পাতার আগুনে গোল হয়ে বসি।আগুনের মিঠে আতপে বসে থাকতে থাকতে হাত, পা, খোলা বুক চিড়বিড়িয়ে ওঠে। পিঠে বরফ কুচি ঠান্ডা লেপটে থাকে তখনো। মনে হয়, কেউ এসে একটু উষ্ণতা ছড়িয়ে দিলে ভালো হয় আরো।
খুব নীলচে কুয়াশা সমুদ্রের ওপার থেকে ভেসে আসে কার অর্থহীন সুর! ভোরের শিশিরের মতো খুব মিহি আর ঘন, খেজুরের রসের মতো কণ্ঠস্বর!বেশিক্ষণ কানে এলে নেশা ধরে যায়। সে মায়াবী হাতছানি এড়ানো বড্ডো কঠিন। বটের ডালে গলায় দড়ি দেওয়া আদিবাসী বৌটা নাকি এ সময়ে ঘুরে বেড়ায় ঘোমটায় মুখ ঢেকে, আনাচে কানাচে, কচুরিপানায় মজা পুকুরের ওধারের আমবাগানে। ধোঁয়াটে কুহেলির আঁধার চিরে সুর করে ডাকে। সে ডাক এড়ানো বড্ডো কঠিন।
এই তো সেদিন, আকাশে তখন কৃষ্ণা দ্বাদশী।জ্যোতির্বলয় ঘিরে ম্লান মৃদু আলো, ছন্নছাড়া মেঘের বুকে সর্বনাশের হাতছানি। বছর ত্রিশের তরতাজা সরেন টুডু নেশায় মজে, উঠে গিয়াছিল আগুনের আতপ ছেড়ে।
---" উঠ!চল,যাই কিনে!দিখা আসি মুকে কিসে ডাকে বটে।"
পরের দিন ওই বটের গাছের নিচে মাথা শুদ্ধু কোমর পর্যন্ত মাটির নিচে গোজা অবস্থায় পাওয়া গেছিলো তাকে। বিস্ফারিত দুচোখে মেখেছিলো তীব্র ভয়।শরীরে যন্ত্রণার ছবি তখনো স্পষ্ট।
শুকিয়ে যাওয়া মাঘে, মনে হয় অনন্ত জিঘাংসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘোমটা দেওয়া সেই সাঁওতাল বউ।শীতের রাতে, ঘন কুয়াশার আড়ালে মরা চাঁদের আলোয় হাতের তরবারি ঝলসে উঠছে বারে বারে।আর মুখে হাত দিয়ে সুর করে ডেকে চলেছে কাকে!ডেকেই চলেছে, ডেকেই চলেছে।
শীতে আমার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
---------------------------------------------------
Tarun kumar Pramanik
9332881855
9875349800