Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

ছোটগল্প : অভ্র ঘোষ



পরশুরাম 





(১)
শীতের সকাল। থানায় বড়বাবু আসেননি বলে হলহলে ভাব। লেডি কনস্টেবলের সাথে মেজোবাবুর রোজকার মস্করা চলছে। ভগা চা দিয়ে গেলো। লকআপ থেকে পকেটমার গজা চা চেয়ে খিস্তি খেলো ডিউটি অফিসারের কাছে। একটা পাগল টাইপের লোক থানার বারান্দায় বসে আছে উবু হয়ে।
এমন সময় ফোন বাজলো থানায়।
কনস্টেবল অমিত ফোন ধরে কথা বলে এসে মেজোবাবুকে বলল, "স্যার, সুইসাইড।"
"কোথায়?"
"নপাড়ায়।"
"চলো, আর এই রায়, বড়বাবুকে খবর দাও।"
---------
পুলিশের গাড়ি যখন অকুস্থলে গিয়ে পৌঁছালো ততক্ষণে পুরো বস্তি জড়ো হয়ে গ্যাছে বিশুর ঘরের সামনে। ভীড় হটিয়ে ঘরে ঢুকে মেজোবাবু দেখলেন টালির চালের ভিতরের বাঁশে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে বিশু, গায়ে জামা আর প্যান্ট। তক্তোপোষের ওপর বসে দুজন মহিলা আর দুটো বাচ্চা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে৷
পুলিশ দেখে কান্নার জোর বেড়ে গেলো বিশুর বউয়ের।
"স্যার, চারমাস বাদে বাড়ি ফিরেছিলো লোকটা। রাতে কিছু খেলো না। এতদিন বাদে এলো, আমায় ছুঁলোও না, নিলোও না। সকালে উঠে দেখি এই কান্ড।"
এক দেখাতেই বিশুকে চিনতে পেরেছিলেন মেজোবাবু, দাগী আসামী। চুরি, ছিনতাই, মারামারি অনেক কেস আছে ওর নামে।
"চারমাস কোথায় ছিলো বলেনি?"
"না সার, চুপচাপ ঘরে ঢুকে শুয়ে ছিলো।"
---------
বডি নামিয়ে গাড়ি ডেকে পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে বিশুর বউকে নিয়ে থানায় এলেন মেজবাবু। বড়বাবু এসে গেছিলেন। বিশুর বউয়ের বয়ান নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। থানায় কারও কোনও হেলদোল হোলনা একটা ছিঁচকে পকেটমারের সুইসাইড নিয়ে।
দুদিন বাদে সকাল এগারোটায় সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বসুর ফোন এলো বড়বাবুর কাছে। বললেন তাড়তাড়ি হাসপাতালে আসতে।
ডোম ঐদিন বলছিলো বডি নিয়ে, কি যেন দেখেছে ঠান্ডাঘরে ঢোকানোর সময়, প্রাইভেট চেম্বারে যাওয়ার তাড়া থাকায় তখন সময় হয়নি শোনার।
আজ বিশুর পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে ডাক্তারবাবুর চক্ষুচড়কগাছ। এমন ব্যাপার হয় শুনেছেন ডাক্তার বসু কিন্তু দেখলেন এই প্রথম!
বড়বাবু মর্গে পৌঁছে বডি দেখে হাঁ।
এ কি করে সম্ভব।
অদ্ভুত ব্যাপার!!!

(দুই)
বিশুর ওপেন করে কাটা বডি টেবিলে  শোয়ানো। সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থানার বড়বাবু আর সরকারি ডাক্তার।
“মালটা হিজড়ে !“  প্রথম মুখ খুললেন বড়বাবু, “কিন্তু আমি তো এটাকে খালপাড়ের ছুকরিদের খাট থেকে তুলেছি দু’একবার। বাচ্চাও আছে দুটো।“
“না, হিজড়ে না।“ ডাক্তারবাবু বললেন।
“ঐতো।“ বিশুর কোমরের নীচের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন বড়বাবু। উদ্দিষ্ট বিষয়টা বিজলি নামে সাথেই খাপ খায়।
“ এটা ন্যাচারাল না। ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি করা হয়েছে।“
“মানে?”
“জেন্ডার রিওরিয়েন্টেশান সার্জারি।“
“সেক্স চেঞ্জ অপারেশান?”
“গোদা বাংলায় তাই বলে!”
“কিন্তু এই দামড়া মরদ তা করাবে কেনো আর অত টাকা পাবেই বা কোথায়?’’
“সেটা বের করা আপনার কাজ, মন্ডল বাবু। আমি রিপোর্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি কাল।“
--------
“স্যার, বিশুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন?’’ দেখন হাসি মুখে ঝুলিয়ে কাগজটা হাতে করে বড়বাবু নজরুল মন্ডলের ঘরে ঢুকলেন মেজবাবু রববীন্দ্রনাথ দত্ত।
“হ্যাঁ।“ কাজ থেকে মাথা না তুলেই জবাব দিলেন মন্ডলবাবু। 
“কি করবো?”
“বেশি ভাটিয়ো না এটা নিয়ে। সুইসাইড কেস বলে ক্লোস করে তোমার লকারে রেখে দাও।“
“আচ্ছা স্যার।“
----------
কিন্তু কেস ক্লোস হয়েও হলনা।
এবার সুইসাইড করলো বিশুর স্যাঙ্গাৎ ভ্যাদা। রেললাইনে দুটুকরো বডি পাওয়া গেল। ওর মায়ের বয়ান হোলো চারমাস বাড়ি ছিল না ভ্যাদা। ফোনও সুইচ অফ করা ছিল বিশুর মতই।
দুজনের কারও ফোনই পাওয়া যায়নি বডির আশপাশে। 
পোস্টমর্টেম করার সময় ডাক্তার সোম ডেকে একই ব্যাপার দেখালেন বড়বাবুকে। ভ্যাদাকে সুচারু ভাবে ভেদি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশুর মতই ক্ষত সম্পুর্ণ সেরে গ্যাছে। 
----------
ঐদিনই এস পি ডেকে পাঠালেন বড়বাবুকে। খবর ঠিক পৌঁছে গ্যাছে। সোর্সরাই লাগিয়েছে, বড়বাবু বুঝলেন। 
“স্যার।“ স্যালুট ঠুকে দাঁড়ালেন বড়বাবু।
“বসো।“ হাত দিয়ে চেয়ার দেখালেন এস পি শর্মা সাহেব। “বিশু আর ভ্যাদার বেপারটা কি, মোন্ডোল?”
বিস্তারিত বললেন বড়বাবু। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখালেন।
“ইন্টারেস্টিং! ভিতরের খবর কুছু জানা গেলো?” জিজ্ঞেস করলেন শর্মা সাহেব।
“এখনও তেমন প্রোগ্রেস হয়নি স্যার। সোর্সদের লাগিয়ে দিয়েছি। আশা করছি খবর পেয়ে যাবো। দাগী আসামী তো দুটোই।“
“তাড়াতাড়ি পাতা লাগাও আর আমায় আপডেট দাও। কুইক।“
“ইয়েস, স্যার।“ 
----------
দুদিন পরে সকালে অফিসে ঢুকেই মেজোবাবুকে ডাকলেন বড়বাবু মন্ডল সাহেব। 
“মালদুটোর ফোন নাম্বার পেয়েছ, দত্ত?” বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন। 
“হ্যাঁ, স্যার।“ মেজোবাবু দত্ত জবাব দিলেন। 
“কোম্পানির থেকে খবর নিয়েছ  কোথায় লাস্ট লোকেশান ছিলো আর কখন বন্ধ হয়েছে?’
“হ্যাঁ স্যার। ঐ যে হাই রোডের ধারের ড্যান্স বারটা আছেনা, ড্রীমগার্লস, ওখানে লাস্ট বন্ধ হয়েছে।
“গেছিলে?’
“আজ রাতে যাবো স্যার।“
“হ্যাঁ, রাতেই তো যাবে, বুড়ো ভাম, নাচ দেখবে কি করে না হলে? আমি যাবো, তুমি বিশুর বউ আর ভেদার মাকে আনাও মেয়ে কনেস্টোবল পাঠিয়ে। দেখি কিছু জানা যায় কিনা আরও।
এস পি সাহেবও ইয়েতে লেগে আছে, আপডেট দাও, আপডেট দাও।“  


(৩)
বিশুর বউ পিংকি নতুন তেমন কিছু বলতে পারলো না। চারমাস আগে একদিন ভ্যাদার ফোন  আসার পর বিকালে বেরিয়ে গেছিল বিশু। রাত হচ্ছে দেখে পিংকি ফোন করে সুইচ অফ পায়। পুলিশে ওরা কোনোদিনই যেচে যায়না না, তখনো যায়নি। ভ্যাদার মাকে জিজ্ঞেস করে জানে ভ্যাদাও নেই। বিশু আগে কয়েকবার বলেছিল বাইরে কোথাও কাজে যাবে বড় রোজগারের জন্য। আশা করে বসেছিল পিংকি। ঐদিন বিশু বাড়ি ফিরে কোনো কথাই বলেনি। চোখ মুখ বসা। না কামানো দাড়ি। পরদিন সকালে ঐ ঘটনা।
ভ্যাদার মাও পিংকির বয়ানকে সাপোর্ট করলো। ভ্যাদার মা বলল ভ্যাদা ঘরে ফিরে তেমন কথা বার্তা বলেনি। খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। পরদিন বিশুর খবর শুনে বডি দেখে এসে গুম হয়ে বসে ছিল। বিয়ে করার কথা বলাতে খেঁকিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছিল। বেরোয়নি বাইরে তারপর আর। কদিন পর রেলে গলা দিল ভ্যাদা। কিছুই বুঝতে পারছেনা ভ্যাদার মা। আর একটা কথা বলল ভ্যাদার না। ভ্যাদা শুয়ে থাকার সময় ভ্যাদার দুহাতে অনেক দাগ দেখেছে। 
মন্ডলবাবু জিজ্ঞেস করলেন ভ্যাদার মা ভ্যাদাকে ইঞ্জেকশান নিতে দেখেছে কিনা কখনও। দেখেনি বলল ভ্যাদার মা। বিশুর বউও বলল বিশুর হাতে কখনও ইঞ্জেশানের  সিরিঞ্জ দেখেনি।
ড্রাগের কানেকশান আছে কিনা ক্লিয়ার হোলনা বড়বাবুর কাছে।
দুজনের দুটো ছবি অবশ্য দিতে পারলো বিশুর বউ আর ভ্যাদার মা।
ওরা চলে যাওয়ার পর পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা আবার দেখলেন বড়বাবু ভালো করে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দুজনের হাতেই ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশানের চ্যানেলের দাগ আর কবজি আর পায়ের গোছে  লাল গোল দাগের উল্লেখ আছে!
“শালা, কেসটা কি!” মন্ডলবাবু স্বগতোক্তি করলেন।
বিশু আর ভ্যাদার কল রেকর্ডস যোগাড় করতে বললেন দত্তকে।

ড্রীমগার্লস বারে সন্ধ্যের দিকে এলেন বড়বাবু, প্লেন ড্রেসে, একজন সাদা পোশাকের কনস্টোবলকে নিয়ে।
ম্যানেজার চিনতে পেরে দৌড়ে এলো। কেবিনে বসালো।
“কি দেবো, স্যার?’’
“হুইস্কি দাও আর এসে বোসো এখানে।“
সার্ভ করা হয়ে গেলে ম্যানেজারকে বসালেন টেবিলের উলটো দিকে।
“বাইরে কনেস্টোবলকে খেতে দিয়েছ?’’
“হ্যাঁ, স্যার।“
“এ’দুটোকে চেনো?’ বিশু আর ভ্যাদার ছবি দেখালেন বড়বাবু। 
“চেনা চেনা মনে হচ্ছে, স্যার। দাঁড়ান ববিকে ডাকি, ও বলতে পারবে।“
“ববি কে?’
“ওয়েটার স্যার, পুরোনো ছেলে।“
ববি এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো বড়বাবুর সামনে। 
“চেনো এদের?”
ছবি দুটো হাতে নিয়ে দেখলো ববি, “চিনি স্যার, আসত মাঝে মাঝে এখানে।“
“আর আসেনা?” বাজিয়ে দেখলেন মন্ডলবাবু।
“শুনলাম স্যার, সুইসাইড করেছে।“
“সবই জানো দেখছি!”
ববি চুপ করে মাথা নীচু করলো।
“এখানে সিসিটিভি আছে?’ ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন বড়বাবু।
“আছে স্যার।“
“ক’দিনের ফুটেজ থাকে?’
“একমাসের, স্যার।“
“তাই দাও।“
ম্যানেজারের সাথে ববিও বেরিয়ে যাচ্ছিল। বড়বাবু আটকালেন। 
“তুমি যাও,” ম্যানেজারকে পাঠালেন ফুটেজ আনতে। 
“কবে লাস্ট এসেছিল এ’দুজন মনে আছে?’
“না,স্যার।“ তুরন্ত জবাব দিলো ববি।
কিছুক্ষণ চুপ করে ববির দিকে তাকিয়ে থাকলেন বড়বাবু। অনেক দিনের অভিজ্ঞতায় পড়লেন ববির দুচোখ।
“আচ্ছা যাও।“ ছেড়ে দিলেন এখনকার মত।
ফুটেজ নিয়ে বার থেকে বেরোতেই ফোন এলো। খোঁচর পন্টা। খানিক্ষণ কথা বোলে কনেস্টোবলকে আবার ভেতরে পাঠালেন বড়বাবু।
“স্টাফদের সবার ফোন নাম্বার নিয়ে এসো তো।“

পরদিন সকালে বড়বাবু থানায় এলেন একটু দেরি করে। দত্ত এসে খবর দিলো যে একটা ছেলে জয়েন করতে এসেছে।
আগে নর্থ বেঙ্গলের একটা থানায় ছিল।
“ডাকো, ডাকো।“ বললেন বড়বাবু।
একটা হালকা পাতলা ছেলে ঢুকলো, হাইটও খুব বেশি নয়। পোশাক ছাড়া বোঝাই যেতনা যে এ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টার।
স্যালুট মেরে সোজা দাঁড়িয়ে বল, “সাব ইন্সপেক্টার পরশুরাম চক্রবর্তী রিপোর্টিং স্যার।“
“আরে বাবু, এটা আর্মি নয়। বসো, বসো। বাড়ি কোথায়?”
“গোঘাট স্যার।“ বসতে বসতে বলল পরশুরাম।
“বিয়ে?”
“না স্যার, বোন আছে …”
বাড়ি থেকে এলে?”
“না স্যার।“
“স্টেশান থেকে চলে এসেছ?”
“হ্যাঁ, স্যার।“
“মালপত্র?”
“বাইরে আছে স্যার।“ 
“কোয়ার্টার্সে ঢুকিয়ে দেবে হোমগার্ড কেউ একজন। ঠিক আছে, দেখ কেমন লাগে এখানে।“
“ঠিক আছে, স্যার।“
“আগের থানায় খুন জখম হোতো?’’
“পলিটিকাল কিছু আর ঐ গরু আর মানুষ পাচারের বখরার গন্ডগোলে যা হোতো,  স্যার।“
“এখানেও আছে পলিটিকাল ঝামেলা।“
পরশুরামের সাথে আর কিছুক্ষণ কথা বোলে বেশ চৌকশ লাগলো বড়বাবুর। দত্তকে ডেকে বললেন বিশুদের সুইসাইডের ফাইলটা ওকে দিতে। সংক্ষেপে বললেন এতদিন কি হয়েছে। 
“ফাইল পড়ে বোলো কি বুঝলে। হেব্বি পেঁচিদা কেস। দেখো  কিছু বের  করতে পারো কিনা? আর ড্রীমগার্লের ববিকে একটু সেঁকো, মালটা জানে কিছু মনে হয়।“ 

দুপুরবেলা বেলা বড়বাবুর পারমিশান নিয়ে কোয়ার্টারে এসে ফাইলটা খুলল পরশুরাম। তার আগেই হোমগার্ড এসে ঘর গুছিয়ে দিয়ে গ্যাছে।
ফাইলে আছে দুজনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, বিশুর বউয়ের বয়ান, ভ্যাদার মায়ের বয়ান, ড্রীমগার্লস বারের গত একমাসের সিসিটিভি ফুটেজ ভরা পেন ড্রাইভ, ড্রীমগার্লস বারের স্টাফেদের ফোন নাম্বার, বিশুর কল রেকর্ডস আর ভ্যাদার কল রেকর্ডস। আরও আছে বিশু আর ভ্যাদার জ্যান্ত আর মরা অবস্থার ছবি। কি চেঞ্জ হয়ে যায় মানুষ বডি হলেই।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা ভালো করে পড়লো ফার্স্টে। শালা এত নিঁখুত সার্জারি করেছে যখন তখন ডাক্তার জড়িয়ে আছে কেউ সিওর। কিন্তু কেনই বা করবে কোনো ডাক্তার এমন কাজ, এতে পয়সা কামানর চান্স নেই। থাকার মধ্যে আছে লাইফ নস্ট হওয়ার রিস্ক। গল্পটা কি! বিশুর বউ আর ভ্যাদার মায়ের বয়ান থেকে কিছুই তেমন বোঝা যাচ্ছেনা। 
সারাদিনের ধকলের জন্য এই সব ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো পরশুরামের।

(৪) 
রাতে স্বপ্ন দেখল পরশুরাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমর অব্দি লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। ওর সুপুষ্টু গোঁফজোড়া নেই। ঠোঁটে
লিপস্টিক লাগানো, টকটকে লাল। গলার নীচের দিকে তাকিয়ে শরীর ভিজে উঠলো। ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে।

টয়লেট থেকে বেরনো মাত্র বেল বাজলো। একজন পোক্ত চেহারার ছাপা শাড়ি পরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। পরশুরামকে দেখে বলল, “আমি স্যার, এই কোয়ার্টারে কাজ করি। বড়বাবু ঠিক করে দিয়েছেন। বাজার করে আনি?”
পরশুরাম টাকা দিল। খানিক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে চা বানিয়ে দিল ঐ মহিলা। টাকা ফেরৎ দিলনা। বুঝে গেলো পরশুরাম মোডাস  অপারেন্ডি। মুচকি হাসলো নিজের মনেই। নাম জিজ্ঞেস করে জানল রিনা। 
চা নিয়ে ফাইলটা খুলল আবার। কেসটা হেব্বি ইন্টারেস্টিং লাগছে। একটা লিস্ট বানালো আর কি কি খুঁজে বের করতে হবে।
ড্রীমগার্লস বারে একবার যাওয়া দরকার। যেদিন ভ্যাদা আর বিশুর ফোন সুইচ অফ হয়েছে সেদিন ড্রীমগার্লস বারে আর কারা কারা ছিল তাদের ঐদিনের টাওয়ার  লোকেশান ধরে খুঁজে বার করতে হবে। আশেপাশের আর কোথাও চারমাস আগের সিসি টিভি ফুটেজ আছে কিনা দেখতে হবে। বিশু আর ভ্যাদার  ফোন বন্ধ হওয়ার আগের কয়েকদিনের কল রেকর্ডস চেক করতে হবে। 
একটা ব্যাপারে পরশুরাম সিওর যে  বিশু আর ভ্যাদাকে যে বা যারা সার্জারি করেছে ডাক্তারই হবে। ড্রীমগার্লস বারে সেদিন কোনো ডাক্তার ছিল কিনা সেটাও দেখতে হবে। এসব সস্তা জায়গায় কি ডাক্তাররা আসে, সেটাও প্রশ্ন। গিয়ে দেখতে হবে ড্রীমগার্লসে ডাক্তারের আনাগোনা হয় কিনা।

রিনা চলে গেলো। বলল পরে এসে দুপুরের রান্না করবে। সকালে খেয়েদেয়ে বড়বাবুর কোয়ার্টার্সে গেলো পরশুরাম। চা খাচ্ছিলেন বড়বাবু। 
“চা খাও।“ বোললেন বড়বাবু।
“আচ্ছা, স্যার।“ পরশুরাম রাজি হল।
“রিনা, চা দে আর একবার।“
পরশুরাম অবাক হয়ে তাকাতে বড়বাবু বললেন, “তোমাকেও ধরে ফেলেছে নাকি? আমার নাম বলেছে বোধহয়। ঠিক আছে, একটু চোখে চোখে রেখো।“
“আপনিও স্যার একা থাকেন?” পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো।
“এমন বালের জায়গায় কেউ সংসার আনে! তুমি বল কেসটা কি বুঝলে?” 
রিনা চা দিয়ে গেলো হাসিমুখে। চা খেতে খেতে বড়বাবুকে ফীডব্যাক দিলো পরশুরাম। আর কি কি লাগবে তাও বলল। বড়বাবু বললেন মেজবাবুকে বোলে দেবেন। পরশুরাম যেন দত্তর সাথে কথা বোলে বুঝে নেয় কোথায় কি পাওয়া যাবে। আর বড়বাবু এও বললেন এখন আর রেগুলার কোনো ডিউটি দেবেন না। আগে এই কেসটার একটা হেস্তনেস্ত করুক পরশুরাম। এস পি মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।

দুপুরবেলা অব্দি মেজোবাবুর পাত্তা পাওয়া গেলোন। খুব ব্যাস্ততার কথা বোলে পরশুরামকে এড়িয়ে গেলেন। কন্সটবল সুমিতা বলল, “স্যার, মেজোবাবু আপনার ওপর রেগে আছেন।“
“কেন?’’ পরশুরাম আন্দাজ করেছিল কিন্তু সরল মুখ করে জিজ্ঞেস করল। দুদিনেই ও দেখে নিয়েছিল মেজোবাবুর সাথে সুমিতার খুব দহরম মহরম।
“আপনি কাল সবে এসেছেন আর বড়বাবু আপনাকে এর মধ্যেই নেকনজরে দেখতে শুরু করেছেন এটা দত্তবাবু নিতে পারছেন না।“
“এবাবা, উনি কত সিনিয়ার! আমি তো ওনার থেকে কাজ শিখবো বোলে ওনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।“
“মেজোবাবুকে ডাকবো স্যার?” 
“ডাকবে কি! উনি কোথায়? আমি যাচ্ছি।“ সুমিতার উৎসাহ দেখে মজা লাগছিলো পরশুরামের।
মেজোবাবু সোজা মানুষ। ওনাকে গলাতে বেশি সময় লাগলো না পরশুরামের। বড়বাবুর পারমিশান নিয়ে  সন্ধ্যেবেলা মেজোবাবুকে নিয়ে ড্রীমগার্লস বারে তদন্ত করতে যাওয়া সাব্যাস্ত হল। সুমিতাও যাবে। একজন লেডি দরকার বারের ড্যান্সারদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। মেজোবাবু পুত্র জ্ঞান করা শুরু করলেন পরশুরামকে।

সন্ধ্যেবেলা প্লেনড্রেসে ড্রীমগার্লস বারে ঢুকলেন তিনজন। কিন্তু পরশুরাম আগেই বোলে দিয়েছিল দত্ত আর সুমিতাকে যে ও পরে ঢুকবে। অচেনা হলে খবর আদায় সুবিধা। পুলিশকে সবাই এড়িয়ে চলতে চায়। প্রথমে মেজোবাবু আর সুমিতা ঢুকে ম্যানেজারকে এনগেজ করে নেবে, ববি আর বার ড্যান্সারদের সাথে কথা বলবে। পরশুরাম পরে ঢুকে ওনাদের সাথে যোগ দেবে কিন্তু আজ ওর পরিচয় গোপন রাখা হবে। 
খুব সাধারণ জামা প্যান্ট পরে বারে ঢুকলো পরশুরাম। দত্ত বা সুমিতাকে দেখতে পেলোনা। ভেতরের কোনো ঘরে আছে নিশ্চয়ই। একটা বীয়ার নিয়ে কোণের দিকের টেবিলে বসল পরশুরাম। পাতি জায়গা। পেঁচো মাতালই বেশি। খানিক্ষণ বসার পর ওয়েটারগুলোকে  আর ম্যানেজারকে চিনে ফেলল পরশুরাম। বেশি স্টাফ নেই। চারজন ওয়েটার। ববি, কানাই, সুন্দর আর রতন। ম্যানেজারকে ওরা ডাবুদা বোলে ডাকছিল। আর একটা বাচ্চা ছেলে আছে দেখল পরশুরাম, বাচ্চা বলেই ডাকছিল খদ্দেররাও। ওর কাজ হল টেবিল সাফ করা, মোছা। খদ্দেরদের সবাই রেগুলার মনে হোলো। বাচ্চার সাথে সবার খুব দোস্তি। পরশুরাম ডাকল বাচ্চাকে। বলল, এই তোর নাম কি রে?”
“বাচ্চা।“ নতুন লোক দেখে ডিফেন্সিভ হয়েছে ছেলেটা বুঝলো পরশুরাম।
“এখানে সবাই তোকে চেনে, নারে?”
“হ্যাঁ।“ অ্যাপ্রিশিয়েশান কাজে দিয়েছে বাচ্চার হাসি দেখে বোঝা গেলো। 
“আমায় একটু শশা দিতে বলবি।“
“বলছি।“
ববি এলো শশা নিয়ে। বলল, “স্যার, এদিকে নতুন নাকি?’
“এই যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। তেষ্টা পেলো খুব।“ পাঁড় মাতালের টোনে বলল পরশুরাম।
“আচ্ছা স্যার, আমাদের সার্ভিস খুব ভালো। আসবেন। সব পাবেন।“
ববির গলার স্বর পরশুরামের ইন্দ্রিয়গুলোকে সতর্ক করলো। হেসে ববিকে বলল, “সব?’
“হ্যাঁ, স্যার। একটু পরেই ড্যান্স শুরু হবে দেখবেন।“
“তাই, কখন শুরু হবে?’
“আটটায়”
“আচ্ছা, আচ্ছা, দেখি।“ পরশুরাম বুঝে গেলো এখানে কি হয়।
ড্যান্স শুরু হল আটটায়। সুমিতা আর দত্ত এসে একটা টেবিলে বসল। ড্যান্সারদের বেশিরভাগই অপুষ্টিতে ভোগা অভাবী মেয়ে দেখে বোঝা যায়। চড়া মেক আপও রূপসী বানাতে পারেনি কাউকেই। জঘন্য বাজনা আর তার সাথে বিচ্ছিরি নাচ। খারাপ লাগে খুব এই মেয়েগুলোর জন্য। বাইরে বেরিয়ে এল পরশুরাম।

চারদিকে তাকিয়ে দেখল বাইরে অন্য কোথাও সিসিটিভি লাগানো আছে কিনা। দেখতে দেখতে একটু এগিয়ে মোড় ঘুরতেই একটা ছেলে, পাকানো চেহারা, সারা মুখে দাড়ি সামনে উদয় হোলো হঠাৎ। পুলিশি সতর্কতায় আজকেই ইস্যু হওয়া বন্দুকের দিকে হাত চলে গেছিল পরশুরামের। ছেলেটা হাত তুলে বলল, “স্যার, আমি পন্টা, বড়বাবু আমায় চেনে। খবর আছে স্যার।“
“আমায় তুমি চেন?’ পরশুরাম অবাক হোল।
“আপনাদের না চিনলে আমার চলবে কি করে স্যার।“ পন্টার হাসিটা বেশ ভালো মানুষের মত।
“কি খবর আছে বল?’
“এখানে মাগীবাজি হয়, স্যার।“
“জানি।“
“গাঁজাও সাপ্লাই দেয় ববি আর সুন্দর।“
ভাট না বকে বিশুর খবর দে।“
“বিশুর খবর এখনও পাইনি স্যার।“
“পেলে জানাস।“ বোলে এগিয়ে যেতে গিয়েও পন্টার দিকে ফিরলো পরশুরাম। “শোন এখানে এই লাইনে বারের দিকে মুখ করে কোথাও সিসিটিভি আছে কিনা দেখবি তো কাল সকালে, আর বেশি ছড়াস না। আমায় ফোন করবি সকাল দশটায়। নাম্বার লেখ।“

থানায় ঢুকে পরশুরাম দেখল বড়বাবু নেই। শুনলো কোন মিনিস্টার আসবে কাল,  তার সিকিউরিটির মীটিং আছে এসডিপিওর সাথে।
কনস্টবল অমিত বলল যে বিশু আর ভ্যাদার কল রেকর্ডস এসে গ্যাছে। অমিত ছেলেটা বেশ চটপটে। পরশুরাম ওকে বলল বিশু আর ভ্যাদার কল রেকর্ডসে ওদের বাড়ির লোক ছাড়া যাদের ফোন নাম্বার আছে তা বের করতে। তবে বিশু আর ভ্যাদার ফোন বন্ধ হওয়ার দিন ড্রীমগার্লসে কে কে ছিল তার ইনফর্মেশান এখনো পাওয়া যায়নি। প্রসেসিং চলছে। 
কোয়াটার্সে ফিরে পরশুরাম দেখলো খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। ভালই রাঁধে রিনা। চিকেনটা বেশ ঝাল ঝাল হয়েছে পছন্দ মতো। খাওয়ার পর মায়ের ফোন এল। কথাবার্তা বোলে ফাইলটা আবার খুলল পরশুরাম। কাল ববিকে ডেকে কড়কাতে হবে। দেখা যাক যদি কোনো খবর পাওয়া যায়। ডাক্তার একটা হাতে এলেও কেসটা খানিকটা বোঝা যেত।
সেদিন রাতে পরশুরাম স্বপ্নে রিনাকে দেখলো।


ব্রেকফাস্ট করে অমিতকে ফোন করল পরশুরাম। অমিত বলল বিশু আর ভ্যাদার ফোনের কল রেকর্ডসে তেমন কাজের কল হিস্ট্রি নেই। বাড়ি্র লোক বা অন্য কিছু চেনা ছিঁচকের ফোন আছে। আর যা আছে তা সব টেলিকলার। আর ড্রীমগার্লসের ঐদিনের লোকেশান ডিটেলস এখনও আসেনি।

দশটা বাজার আগেই পন্টা ফোন করলো। গলায় উত্তেজনা। “আছে স্যার।“ 
”দাঁড়া আমি আসছি।“
থানা থেকে একজন লেডি কনেস্টবলকে নিয়ে ড্রীমগার্লসের সামনের মোড়ের মাথায় পৌঁছালো পরশুরাম। পন্টা দাঁড়িয়ে ছিল। দূর থেকে রাস্তার ওপর তিনতলা বাড়িটা দেখিয়ে দিল। সামনে এসে পরশুরাম দেখল বেশ বড় বাড়ি। রইস ফ্যামিলি। বাড়িটার সিসিটিভির মুখ ড্রীমগার্লসের এন্ট্রান্সের দিকে করা। বেল বাজালো পরশুরাম। দরজা খুলল একটা ছেলে। পরিচয় দিয়ে পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো সিসিটিভির ফুটে্জের ব্যাপারে। এরা মাস ছয়েক হোলো লাগিয়েছে সিস্টিভি আর এবাড়ির কলেজে পড়া ছেলেটি আজ অব্দি সব ফুটেজ এক্সটার্নাল হার্ড ডিস্কে জমিয়ে রেখেছে। সিজার লিস্ট বানিয়ে হার্ড ডিস্কটা সিজ করলো পরশুরাম।
বাইরে বেরিয়ে দেখলো পন্টা দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একশ টাকা দিল পরশুরাম। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফাঁক দিয়ে ভালোমানুষী হাসিটা হাসলো পন্টা। পরশুরাম পন্টাকে জিজ্ঞেস করলো ড্রীমগার্লস বারে কোনো ডাক্তার মাল খেতে আসে কিনা। পন্টা বলল খোঁজ নিয়ে জানাবে।

থানায় ফিরে ববিকে ফোন করলো পরশুরাম। আধঘন্টার মধ্যে আসতে বলল। সুন্দরকে ফোন করলো তারপর। বিকেলে আসতে বলল। 
ববি যখন এল তখন বড়বাবুর ঘরে বসে চা খাচ্ছিল পরশুরাম। নিজের টেবিলে এল। ববিকে বসতে বলল। ববির চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বিয়ে করেছিস?’’
পরশুরামের ঠান্ডা গলা শুনে একটু থমকে গেলো ববি। “হ্যাঁ স্যার।“ সতর্ক হয়ে উত্তর দিল।
“বাচ্চা আছে?’’
“হ্যাঁ।“
“ছেলে?’
না স্যার, মেয়ে।“
“কত বড়?’’
“তিন বছর।“
“গাঁজা কেসে একবছর আর মেয়েছেলে শোয়ানো কেসে বছর পাঁচেক জেলে থাকলে নিজের মেয়ে তোকে ভুলে যাবে আর তোর বউ যাকে বলবে তাকেই বাবা ডাকবে তোর মেয়ে।“
“কি হল স্যার?” নিজের টেনশান লুকানোর অনেক চেষ্টা করেও পারলো না ববি।
“বিশুর ব্যাপারে কিছু মনে আছে? লাস্ট কবে এসেছিল, সেদিন মনে রাখার মত কিছু হয়েছিলো ?’’
“স্যার, মা কালি বলছি। বিশুকে আমি চিনতাম, ভ্যাদাকেও। কিন্তু ওদের মরে যাওয়ার ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা।“
“তোরা ফুটেজ রাখিস না কেনো বেশি দিনের?”
“কি স্যার?”
“সিসিটিভির ফুটেজ।“
“ও স্যার মালিক জানে আর ডাবুদা জানে।“
“জেলে যেতে না চাইলে গাঁজা আর মেয়ের ধান্দা ছাড়।“
“আর করবো না স্যার।“
“তোদের ওখানে কোনো ডাক্তার আসে মাল খেতে?”
“মনে পড়ছেনা স্যার।“
“আচ্ছা, যা। খেয়াল রাখিস, ডাক্তার এলে আমায় জানাস“

ববি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সুমিতা পরশুরামের টেবিলে এল। “বাবা, স্যার, আপনি তো লোকটাকে কাঁদিয়ে দিয়েছেন।“
মুচকি হাসলো পরশুরাম। মেজোবাবু রবীন্দ্রনাথ দত্তর মুখটা মনে পড়লো। এখনো আসেননি বোধহয়।

দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি কোয়ার্টার্সে এল পরশুরাম। রিনা তখনো রাঁধছে। সামনের ঘরে মিনিট পাঁচেক বসে রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে পরশুরাম দেখল দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রান্না করছে রিনা। আঁচল কোমরে গোঁজা। পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চানে গেলো পরশুরাম।
শুয়ে পড়েছিল পরশুরাম দুপুরে খেয়েদেয়ে। ফোনের আওয়াজে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বড়বাবুর ফোন।
“হ্যাঁ, স্যার?’
“তুমি কোথায়?”
“কোয়ার্টারে, স্যার।“
“তাড়াতাড়ি এসো, এস পি সাহেব এসেছেন। বিশুর কেসের ব্রিফ চাইছেন।“
“গাঁড় মেরেছে!” অজান্তেই বলে ফেলল পরশুরাম।
“জলদি এসো।“ ফোন কেটে দিলেন মন্ডলবাবু।
ড্রেস পরে থানায় পৌঁছালো পরশুরাম। বড়বাবুর চেয়ারে বসেছিলেন শর্মা সাহেব। এদিকের চেয়ারে বড়বাবু। স্যালুট করলো পরশুরাম।
“কেতদুর এগিয়েছেন?” সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন এস পি সাহেব।“
পরশুরাম বলল ডিটেলে। ডাক্তার ইনভল্ভড এটা জোর দিয়ে বলল। এস পি শুনলেন। বললেন তাড়াতাড়ি করতে। এটাকেই প্রায়োরিটি দিতে।

শর্মা সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচমিনিট বাদে ঢুকলো সুন্দর। ওকেও একই কায়দায় ববির মত চমকালো পরশুরাম। তেমন খবর পাওয়া গেলো না। তবে একটা বিষয় নতুন করে নজরে আনলো সুন্দর। বাচ্চার সাথে নাকি বিশুর হেবি দোস্তি ছিলো। চিপস চকলেট কিনে দিত আর বেড়াতেও নিয়ে যেত। পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো বাচ্চা এখন বারে আছে কিনা। সুন্দর বলল বাচ্চা আজ আসেনি। বাচ্চার বাড়ি কোথায় জেনে নিলো পরশুরাম। 
পাশের ওয়ার্ডের বস্তিতে বাচ্চার বাড়ি গিয়ে যখন পৌঁছালো পরশুরাম তখন অন্ধকার হয়ে গ্যাছে। বস্তির ঘরে হলুদ বাল্ব জ্বলছে। বাচ্চার বাড়ি দেখিয়ে দিল একজন। দরজা খোলাই ছিল। একজন মহিলা বেরিয়ে এল। পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো বাচ্চা আছে কিনা। মহিলা ভেতর থেকে একটা লোককে ডেকে নিয়ে এলো। 
“কি হয়েছে, স্যার?” লোকটার ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর।
“বাচ্চা নেই?’’
“জ্বর হয়েছে।“
“ডাকুন একটু।“
“কি করেছে, স্যার?” এবার বাচ্চার মা হেদিয়ে উঠলো।
“আরে, কিছু করেনি, কটা কথা জিজ্ঞেস করবো ঐ বিশুর ব্যাপারে।
পরশুরামের পুলিশি চোখে ধরা পড়ল বাচ্চার মা আর বাবার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বদলে গেলো।
“কই ডাকুন।“ ধমক দিলো পরশুরাম।
বাচ্চার মা গিয়ে হাত ধরে নিয়ে এলো বাচ্চাকে। চোখ মুখ বসা। জ্বর সত্যিই হয়েছে। একটা চিপসের প্যাকেট এনেছিল পরশুরাম। বাড়িয়ে দিল বাচ্চার দিকে। নিতে নিতে মনে হয় পরশুরামকে চিনতে পারল বাচ্চা।
“এই তুই বিশুকে চিনতিস?”
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল বাচ্চা।
“ভ্যাদাকে?’
“হ্যাঁ।“
“ওদের কি হয়েছিল জানিস?”
“সুইসাইড করেছে।“
“না, না, ড্রীমগার্লসে কি হয়েছিল?”
“কই, কিছু নাতো।“
পরশুরাম লক্ষ্য করলো বাচ্চার মা ওর হাত ছাড়েনি।
“ওরা কবে লাস্ট এসেছিল মনে আছে? সেদিন কোনো ঝামেলা হয়েছিল?’’
“মনে নেই স্যার।“
“ঠিক আছে যা, শুয়ে পড় গিয়ে।“
বাচ্চার মা আর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল পরশুরাম, “ডাক্তার দেখিয়ো।“
তারপর মনে পড়াতে বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করল, “ড্রীমগার্লসে কোনো ডাক্তার আসে মাল খেতে?”
“জানি না তো!”বাচ্চার গলায় বিস্ময়।
“ওর নাম কি?’’ বাচ্চা ভেতরে ঢুকে গেলে ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো পরশুরাম। 
“চৈতন্য সাহা।“ 

বিশু আর ভ্যাদার ফোন অফ হওয়ার দিন সন্ধ্যে থেকে রাত ড্রীমগার্লসে কারা কারা ছিল তার টাওয়ার লোকেশান ডিটেল পাওয়া গেল পরদিন। অমিত আর সুমিতাকে পরশুরাম লাগিয়ে দিল ফোন করে করে তাদের সবার ডিটেলস জানতে। রাতে হাতে পেলো সবার হিসেব।
একজনও ডাক্তার নেই। সবই প্রায় সাধারণ মাতাল। আর আছে কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট, কাছাকাছির কলেজ থেকে সস্তার জায়গা খুঁজে আসে। “দোর শালা!” স্বগতোক্তি করলো পরশুরাম।
বডি ঘুরিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে গিয়ে সিজ করে আনা হার্ড ডিস্কটা চোখে পড়ল কম্পিউটার টেবিলে। 

হার্ড ডিস্কটা কম্প্যুটারে চালালো পরশুরাম। ফাইল খুলে ডেটটা দেখে নিলো চার মাস আগে যেদিন বিশুদের ফোন অফ হয়েছিল। ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে ঐদিনের রেকর্ডিঙ্গে গেলো। রাত দশটার পর থেকে দেখতে দেখতে দেখলো এগারোটা বারোর সময় পাঁচটা ছেলে আর দুটো মেয়ে একসাথে বেরোচ্ছে। কয়েকবার রিওয়াইন্ড করে মনে হল তাদের মধ্যে দুজন বিশু আর ভ্যাদা। বাকিদের চেনা মুশকিল। কে এরা কে জানে! মেয়েদুটোই বা কে! এখানে মেয়েরাও মাল খেতে আসে! সেদিন কোনো মেয়েকে তো দেখেনি পরশুরাম। এদের আইডেন্টিফিকেশান করাতে হবে। সিসিটিভির ক্যামেরাটা আর একটু কাছে হলে ভালো হোতো। আর মালগুলো বেরিয়ে এই বাড়িটার উল্টো দিকে চলে গেলো।
থানা থেকে বেরিয়ে নিজের কোয়ার্টারে এলো পরশুরাম। দরজা খোলা দেখে মনে পড়লো রিনা চাবি দিয়ে আসেনি থানায়। ভেতরে আলো জ্বলছে। পরশুরাম ঢুকে দেখলো একটা মেয়ে মাটিতে বসে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এ আবার কে?
“এই, ওঠো।“ পরশুরাম ডাকলো মেয়েটাকে।
চমকে দাঁড়িয়ে পড়লো মেয়েটা। সতের আঠারো বছর বয়েস হবে।
“কে রে তুই?’’ পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো।
“আমি মান্টি।“ রিনরিনে গলায় বলল মেয়েটা।
“এখানে কি করছিস?”
“মা বলল বড়বাবুর বাড়ি রেঁধে আসছে, আমায় এখানে থাকতে বলে গেলো।“
“তুই রিনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ, স্যার। মা আসলেই চলে যাবো।“
“কখন গ্যাছে তোর মা?”
“একঘণ্টা হয়ে গ্যাছে।“ দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল মান্টি।
“ঠিক আছে, বোস।“ বলে বেডরুমে চলে এলো পরশুরাম।
রিনাকে যা ভেবেছিল তার থেকেও বেশি হারামি রিনা সেটা বুঝলো পরশুরাম।
রিনা এলো আরো একঘন্টা পর। সামনের দরজা খোলা রেখে বেডরুমে বসে থাকলো পরশুরাম। রিনাকে কাটা কাটা ভাবে ঠান্ডা গলায় বলল যেন আর কোনোদিন রিনা ছাড়া আর কেউ ওর কোয়ার্টারে না ঢোকে।
কাঁচুমাচু মুখে ক্ষমা চাইলো রিনা।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো পরশুরামের।
“শালা কেসটা কাল কিভাবে শুরু করব!” ভাবলো মনে মনে। এস পি যদি ফোন করে জানতে চায় তাহলেও প্রোগ্রেস কি তা বলতে হবে।
একটা সাদা পাতা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলো কাল পরপর কি কি কাজ করতে হবে।
প্রথম কাজ সিসিটিভিতে লোকেদের আইডেন্টিফিকেশান। তার আগে বাকি কাজের প্ল্যান করা যাচ্ছেনা। এতো মহা জ্বালা। সমাধান পাওয়া যাচ্ছেনা আবার ঘুমও আসছেনা।
মোবাইলে ফেসবুক খুলল পরশুরাম। বেশিক্ষণ ভালো লাগলোনা।
মোবাইল বন্ধ করে মহুয়ার কথা ভাবতে শুরু করলো পরশুরাম। ওর পাড়ার মেয়ে। কিন্তু কথা হয়নি কোনোদিন। মিষ্টি মুখ। মিষ্টি গলা। সাহসই হয়নি পরশুরামের কথা বলার।
আনশান ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো পরশুরাম।
সকালে থানায় গিয়ে সুমিতা আর অমিতকে নিয়ে বসলো পরশুরাম। ফুটেজে বিশু আর ভ্যাদাকে আইডেন্টিফাই করলো অমিত। মেয়ে দুটোকে আইডেন্টিফাই করলো সুমিতা। সেদিন বারে গিয়ে দেখেছে। মিনা আর বীণা। যমজ বোন। কাছেই থাকে।
“ম্যানেজারকে ডাকো তো।“ অমিতকে বলল পরশুরাম।
ডাবূ এলো সাড়ে দশটার সময়।
“মিনা আর বীণার বাড়ি কোথায়?” সরাসরি কাজের কথায় এল পরশুরাম।
“কেনো, স্যার?’
“দোর বাল, বাড়ি কোথায় বল।“
“পুব পাড়ায় স্যার।“
“নিয়ে চল।“
ডাবু নিয়ে এল পরশুরাম, অমিত আর সুমিতাকে। এতটা আশা করেনি পরশুরাম। ডাবু তাহলে এদের সাথে ভালোই খেলতো।
সাদামাটা বাড়ি। নতুন হয়েছে দেওয়াল। প্লাস্টার হয়নি। কাঁচা কাঠের দরজা।
ধাক্কা দিল অমিত।
একজন লোক বেরিয়ে এলো। লুঙ্গি পরা। গায়ে চাদর জড়ানো।
“মিনা আর বীণাকে ডাকুন?” বলল পরশুরাম।
পুলিশ দেখে ভড়কে গেছিলো লোকটা। “ওরা তো এখন নেই, স্যার।“ ভয়ে ভয়ে বলল।
“কোথায় গ্যাছে?”
“জানিনা, স্যার। কাল বার থেকে এসে সবে বসেছে তখন ফোন এলো। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল দুজনেই। একটা নাগাদ ফোন করলাম, সুইচ অফ।“
“পুলিশে জানিয়েছেন?”
“এমন স্যার ওদের অনেক হয়, রাতে কাজ থাকে।“
“শুয়োরের বাচ্চাদের কি লাইফ, নিজের মেয়েদের ভাঙ্গিয়ে খেতে হচ্ছে।“ মনে মনে ভাবলো পরশুরাম।
সুমিতাকে বলল বাড়ির ভেতরে সার্চ করে আসতে। কাউকে পেলোনা সুমিতা। বিনা আর মীণার মায়ের থেকে ওদের ফোন নাম্বার নিয়ে চলে এলো পরশুরাম।
মিনা আর বীণার ফোন সুইচ অফ পেলো পরশুরামও। অমিতকে বলল লাস্ট লোকেশান আর কল রেকর্ডস চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পন্টাকে ডেকে নিল পরশুরাম। বিশু, ভ্যাদা, মিনা আর বীণাকে চিনতে পারলেও বাকি তিনজনকে পন্টা চিনতে পারলো না। পন্টাকে বলল পরশুরাম তাড়াতাড়ি খোঁজ করতে।
পন্টা বেরিয়ে যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ফোন এল থানায়। দুটো মেয়ের লাশ পাওয়া গ্যাছে খালপাড়ে। বড়বাবুকে ইনফর্ম করে ফোর্স নিয়ে গেল পরশুরাম। দুটো বছর কুড়ির মেয়ে, অপুষ্ট, মুখে চড়া মেক আপ আর ঝলমলে ড্রেস পরা। ডাবুকে ডাকালো পরশুরাম। ডাবু চিনতে পারল, মিনা আর বীণা ।
“কোনটা বীণা আর কোনটা মিনা?”
“বলতে পারবো না , স্যার।“
পরশুরাম একটা খিস্তি দিয়ে ডাবুকে বলল, “লক আপের মশার কামড় খেয়েছিস কখনও?”
বাধো বাধো স্বরে ডাবু বল, “যার বাঁ কুঁচকিতে তিল আছে ও মিনা।“



বডিদুটো পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিল পরশুরাম। তারপর থানায় ফিরে এল। বড়বাবুর সাথে কথা বলল পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। এবার কেসটা ঘোঁট পাকিয়ে  গেল।  দু দুটো মার্ডার। এস পি সাহেব আরও লাফাবে।

সকালেই ফোন এল এস পি সাহেবের। বড়বাবু বেশি ভাঙ্গলেন না যে বিশুর কেসের সাথে এর কানেকশান আছে। চুপচাপ ধাতানি শুনলেন। ফোন রেখে পরশুরামকে বললেন, “ভালই এগোচ্ছ কিন্তু এবার তো দুদিনের আগে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাবেনা। আর কল রেকর্ডস পেতেও সময় লাগবে। সাইবার সেলকে বলছি।“
“হ্যাঁ স্যার, ভাবছি একবার বাড়ি গিয়ে আসি। পরশু সকালে এসে ডিউটি জয়েন করবো।“
“যাও।“

সাড়ে সাতটায় বাস থেকে নামলো পরশুরাম। বাস রাস্তা থেকে খানিকটা ভেতরে পরশুরামের বাড়ি। রহিমকাকা ভ্যান নিয়ে এগিয়ে এল। “যাবে তো?”
চাকরি পাওয়ার আগে বাবার বয়েসী রহিমকাকা তুই বলত। এখন আর বলেনা। বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে দিল ভ্যান।
ভাড়া দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই পরশুয়াম দেখল মা রান্নাঘরের দাওয়া থেকে নামছে। দেখে একগাল হেসে বলল, “আয় কিছু খেয়ে নে।“
“দাঁড়াও হাত পা ধুয়ে আসি।“
“কিরে এত দেরী হল?” বাবা বেরিয়ে এল হাতে খবরের কাগজ নিয়ে।
“ট্রেন লেট। বোন কই?”
“টিউশানে গ্যাছে। আসলো বলে।“
মুড়ি আর চপ খেলো পরশুরাম। সঙ্গে চা। বোন এসে গেল সাড়ে নটায়।
“এই দাদা, তোর নতুন থানা কেমন রে?”
“থানার ভালো মন্দ হয়না। পেটের দায়, তাই চাকরী করতে হয়। তোর পড়াশুনা কেমন হচ্ছে? ফাইনালের পর কি করবি?”
“মাস্টার্স করবো। এই এবার আমাকে একটা ভালো মোবাইল কিনে দে তো।“
“কেনো, একটা তো আছে।“
“দূর ওটায় আর চলছে না।“
“দেখছি দাঁড়া।“

রাতে খাওয়ার পর মা বাবার সাথে ঘরে এসে বসলো পরশুরাম।
“একটা পান দাও তো মা।“ অনেকদিন মায়ের হাতে পান খাওয়া হয়নি।
“পুবপাড়ের তিনবিঘা জমিটা কিনবি নাকি?” বাবা জিজ্ঞেস করলো?” 
“দর কমাবে বলল?” 
“কাল চল তাহলে সকালে।“
“হ্যাঁ, চল।“
এবার মা বলল, “কিরে বিয়ে করবি না?”
“দূর, দাঁড়াও, বোনের আগে হোক।“
“ও এখন বিয়ে করবে না। পড়া শেষ করে চাকরি করবে, তুই করে নে।“
“সে অনেক ঝামেলা।“ মহুয়ার মুখটা মনে পড়লো পরশুরামের।
“ঝামেলা তোকে সইতে হবেনা, সে তোর মামা আর কাকারা সামলাবে।“ বাবা বলল।
“আচ্ছা, দ্যাখো।“ হাই তুলে নিজের আগ্রহ লুকালো পরশুরাম।

পরের দিনটা ব্যাস্ততায় কেটে গেলো। বিকেলের দিকে বন্ধুদের সাথে তেঁতুলতলায় বসে ছিল পরশুরাম। চা খাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে মাথা তুলে দেখলো মহুয়া আসছে। প্রথমে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল পরশুরাম। কি মনে হতে আবার তাকালো। এবার মহুয়ার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখ সরাতে পারলো না পরশুরাম। খানিক্ষণ পর চোখ নামিয়ে নিল মহুয়া। সামনে দিয়ে চলে গেলও। পরশুরামের মনে হোলো ঠোঁটে যেন হাসি মহুয়ার। 
রাতে খাওয়ার সময় মা বলল পরশুরাম মেয়ে দেখতে যাওয়ার সময় পাবে কিনা। পরাশুরাম মহুয়ার কথা ভাবছিল। হুঁ হাঁ করে গেল মা আর বাবার কথায়। বোন আবার মোবাইল দেওয়ার কথা বলল। কিন্তু কথা কানে গেলোনা পরশুরামের। খেয়ে দেয়ে বিছানায় চলে এল। মহুয়া কি হেসেছিল তখন? পরশুরামের মনে হোলো এ ব্যাপারটা বিশুর কেসের চেয়েও জটিল। বোন  এসে জিজ্ঞেস করে গেল, “দাদা কাল কটার বাস ধরবি রে?”
পরশুরাম সেই রাতে স্বপ্ন দেখল মহুয়া জমির আলের ওপারে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে কিন্তু পরশুরামের পা জমির কাদায় আটকে আছে। অনেক চেষ্টা করেও মহুয়ার কাছে পৌঁছাতে না পেরে পরশুরাম চেঁচিয়ে উঠল। এত জোরে মহুয়ার নাম ধরে ডেকেছিল যে নিজের ঘুমই ভেঙ্গে গেল পরশুরামের। 
পরদিন ঘুম থেকে  উঠে মনটা তিতে হয়ে গেলো পরশুরামের। আবার যেতে হবে থানায়। তারপরই রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। মহুয়ার হাসির কথা মনে এলো। 
চা খেয়ে রেডি হোলো পরশুরাম। ব্যাগ গুছিয়ে মা বাবাকে প্রণাম করে দেখলো বোন নেই। “বোন কই?”
“সকালে কোথায় বেরোলো।“ মা বলল।
মোবাইল পায়নি বলে রাগ করলো নাকি? মনে মনে ভাবলো পরশুরাম। পরের বার আনতে হবে। 

রহিমকাকাকে বলে রেখেছিলো বাবা। ভ্যানে উঠে রওনা হোলো পরশুরাম। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলো বাস দাঁড়িয়ে আছে। সোজা থানায় যাবে বলে পোশাক পরেই বেরিয়েছিল পরশুরাম। খালাসি তাড়াতাড়ি হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ড্রাইভারের কেবিনে রেখে ড্রাইভারের কানে বলে দিল কিছু। ড্রাইভার একবার পিছন ফিরে দেখলো। কন্ডাকটর একটা ভালো সিট দিল।
বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলো পরশুরাম। রহিমকাকা ভ্যানের পাশে দাঁড়্রিয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। মুখটা প্রায় ঘুরিয়ে নিয়েছিল পরশুরাম। কি মনে হতে ভালো ভাবে দেখল। আরে বোন এখানে কি করছে। বাসটা ছেড়ে দিল এই সময়। পরশুরাম মুখ বাড়িয়ে দেখলো বোন আর একটা মেয়ে ভ্যানে উঠে বসেছে। অন্য মেয়েটা একবার মুখ ফেরালো বাসের দিকে। এরা এখানে কি করছে? ব্যাপারটা কি! বোনকে ফোন করবে ভাবলো পরশুরাম। কিন্তু সঙ্কোচে করতে পারল না।



সারাটা পথ বাসস্ট্যান্ডের ঘটনাটা মাথায় ঘুরলো পরশুরামের। স্টেশানে নামার পর গাড়িতে ব্যাগ তুলে দিলো হোমগার্ড। থানায় নেমে ব্যাগ কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলো পরশুরাম। বড়বাবুর ঘরে গেলো প্রথমে। বড়বাবু বললেন আজ দুপুর নাগাদ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া যাবে। জেলার সাইবার সেলকে বলেছেন বীণা আর মিনার কল রেকর্ডস তাড়াতাড়ি পাওয়ার ব্যাবস্থা করতে। খানিক কথা বলে চা খেয়ে নিজের টেবিলে গিয়ে বসলো পরশুরাম। সুমিতা এল। হাসি মুখে বল, “স্যার, বাড়িতে সব ভালো।“
“হ্যাঁ।“ পরশুরামও হেসে উত্তর দিল। “অমিতকে ডাকো তো।‘’
অমিত এসে দাঁড়াল। “কিছু হাতে এলো?” পরশুরাম জিজ্ঞেস করল।
“না স্যার, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি এখনও আর কল রেকর্ডসও পাইনি হাতে, তাড়া দিয়েছি আজও সক্কাল সক্কাল।“
“হ্যাঁ, লেগে থাকো। আর টানতে ইচ্ছে করছেনা কেসটা।“

দুপুরে খেয়ে আবার থানায় এল পরশুরাম। কনস্টোবল রতন পরামানিক বিকেলের দিকে সরকারি হাসপাতাল থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে এলো।
দুজনকেই গলা টিপে মারা হয়েছে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে দুজনেই তা স্পষ্ট। রেপের কোনো চিহ্ন নেই তবে দুজনের কেউই ভার্জিন ছিলোনা।
ব্লাড টেস্টে দেখা গ্যাছে দুজনেই এইচ আই ভি পসিটিভ। 
বড়বাবুকে দেখালো রিপোর্ট। কিন্তু বিশু বা ভ্যাদার ব্লাড রিপোর্ট কি হয়নি পোস্টমর্টের সময়। হাসপাতালে অনেক সময় কিছুদিন ব্লাড স্যাম্পেল রাখা থাকে। বড়বাবুকে বলল পরশুরাম। বড়বাবু ফোন করলেন হাসপাতালে। ব্লাড স্যাম্পেল  আছে বলল হাসপাতাল থেকে। ব্লাড টেস্ট করিয়ে পাঠাতে বললেন বড়বাবু।
পরশুরাম বড়বাবুকে বলল বাচ্চার ব্লাডও টেস্ট করাতে হবে। বিশুর সাথে বাচ্চার মেলামেশার ঘটনাটা খুলে বলল আবার। বড়বাবু ব্যাবস্থা করবেন বললেন। 
টেবিলে এসে বসলো পরশুরাম। ফোন বেজে উঠলো। বোন ফোন করেছে। 
“এই তুই আজ সকালে বাসস্ট্যান্ডে কি করছিলি রে?” প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো পরশুরাম। 
“কাজ ছিলো। তুই আবার কবে আসবি রে, দাদা?” 
“দেখি কবে ফাঁকা পাই, কেনো? ফোনের জন্যে তর সইছেনা?”
“না, না, তুই আয় তাড়াতাড়ি, তখন বলব। ছাড়ছি।“
বলি বলি করেও বাসস্ট্যান্ডে দেখা ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে পারলোনা পরশুরাম।

রাতে আবার মহুয়াকে স্বপ্ন দেখল পরশুরাম। মহুয়া নৌকা করে যাচ্ছে আর পরশুরাম গুন টানছে সেই নৌকার।

পরদিন দুপুরের পর বীণা আর মিনার কল রেকর্ডস পাওয়া গেলো। দেখা গেলো ঐদিন রাতে মিনার মোবাইলে কল এসেছিল। অমিতের আবার চোখে পড়লো ঐ নাম্বারটা বিশু আর ভ্যাদার ফোন বন্ধ হওয়ার দিন ড্রীমগার্লসে ছিল। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টের নাম্বার। সাইবার সেলকে বলা হল খুব আরজেন্টলি ঐ নাম্বারের ডিটেলস বের করে দিতে। ফোন করে সতর্ক করতে চাইছিলো না আর পরশুরাম। আগের বারের ফোনের কারণেই জোড়া মার্ডার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এখন। 
রাতে ডিটেলস এলো। বড়বাবুকে বলল পরশুরাম। বড়বাবু এস পি সাহেবকে ফোন করলেন। শর্মা সাহেব বললেন ডিটেলস নিয়ে যেতে ওনার অফিসে। গেল বড়বাবু আর পরশুরাম। এবার অ্যারেস্ট করার সময় এসেছে সেটা ডিটেলসে এস পি শর্মাকে বোঝানো গেলো। উনি রাজি হলেন সব শুনে।
পরদিন সকালে কাগজপত্র তৈরি করে সুমিতা আর অমিতকে নিয়ে সাদা পোশাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে গেলো পরশুরাম। গাড়িটা দূরে রেখে ঢুকলো। সিকিউরিটিকে কার্ড দেখালো অমিত আর চুপ করে থাকতে বলল। অমিতকে গেটে রেখে সুমিতাকে নিয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে গেলো পরশুরাম। পিওনকে দিয়ে নাম লিখে পাঠালো। ডাক আসতে সুমিতাকে বাইরে রেখে ঢুকলো।
“বলুন?” প্রিন্সিপাল গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন। 
“আপনার একজন স্টুডেন্ট মনসিজ রায়ের নামে মার্ডার চার্জ আছে। ও কোথায়?” 
“ক্লাসে আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনারা সিওর?“
“হ্যাঁ, একদম সিওর। আপনি চাইলে এস পিসাহেবের সাথে কথা বলতে পারেন।“
“আপনার নাম?”
“সাব ইন্সপেক্টার পরশুরাম চক্রবর্তী।“
এস পি সাহেবের সাথে কথা বলে রেজিস্টারকে ডাকলেন প্রিন্সিপাল। ডাটা বেস থেকে জানা গেল মনসিজ থার্ড ইয়ার কম্প্যুটার সায়েন্স। 
প্রিন্সিপাল ক্লাসে ঢুকতে যিনি পড়াচ্ছিলেন অবাক হয়ে গেলেন। প্রিন্সিপাল জানতে চাইলেন মনসিজ রায় কে আছে। একটি দাড়িওয়ালা মোটা সোটা ছেলে উঠে দাঁড়ালো। প্রিন্সিপাল বাইরে ডাকলেন মনসিজকে।
“এনার সাথে যাও।“ প্রিন্সিপাল বললেন।
“কেনো, স্যার?” মনসিজ জিজ্ঞেস করলো।
“বীণা আর মিনার ব্যাপারে কিছু কথা আছে ভাই।“ পরশুরাম বলল নরম স্বরে।
মনসিজের চমকে ওঠা চোখে পড়লো পরশুরাম আর প্রিন্সিপাল দুজনেরই।
কোনো কথা না বলে পরশুরামের সাথে এসে গাড়িতে উঠলো মনসিজ। এতটা সহজে হবে ভাবেনি পরশুরাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। 



থানায় আনা হল মনসিজকে। বড়বাবু কোয়ার্টার থেকে এলেন। এস পি সাহেবকে ফোন করা হল। বড়বাবুর ঘরে একটা চেয়ারে বসান হল মনসিজকে।
“বাড়ি কোথায়?” বড়বাবু মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন।
পাশের থানা এলাকার নাম বলল মনসিজ। 
“তোমার বাড়ির কারও ফোন নাম্বার দাও।“ বড়বাবু বললেন।
“কেন?” মনসিজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো। 
“তোমার বাবা মাকে খবর দিতে হবে। আইন।“
“না, খবর দিতে হবেনা।“
“শোনো ভাইটি, আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিওনা।“ বড়বাবুর গলা হীমশীতল।
“আমার মনে নেই।“
“বাবা মা কারও নম্বর মনে নেই? তোমার মোবাইল কোথায়?”
“ক্লাসে, ব্যাগের মধ্যে, সুইচ অফ করা আছে।“
বড়বাবু তাকালেন পরশুরামের দিকে। পরশুরাম বেরিয়ে ফোন করল প্রিন্সিপালকে। অমিতকে পাঠালো ব্যাগ নিয়ে আসতে। নিজের আলমারি থেকে  ড্রীমগার্লসের সামনের বাড়ির সিসিটিভির ফুটেজের হার্ড ডিস্কটা নিয়ে এলো বড়োবাবুর ঘরে। চালালো কম্প্যুটারে। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পস করলো। বিশু আর ভ্যাদা বেরোচ্ছে তিনজন ছেলের সঙ্গে। সাথে বীণা আর মিনা।
বড়বাবু আর পরশুরাম মিলিয়ে দেখলেন। মনসিজকে চেনা যাচ্ছে। 
“বাকি দুজন কে?” কম্প্যুটার স্ক্রীনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বড়বাবু।
ফুটেজ চালানোর পর মনসিজ আরও ঘাবড়ে গেছে বোঝা গেলো।
“অন্য দুজন কে?” পরশুরাম জিজ্ঞেস করলো।
মনসিজ চুপ। মাথা নীচু। চোখ মেঝেয়। টেবিলের কাঠ খুঁটছে নখ দিয়ে। 
ঘরের বাইরে থেকে বেতের একটা মোটা লাঠি এনে শব্দ করে টেবিলে রাখলেন বড়বাবু। মনসিজ চমকে উঠলো। সোজা হয়ে বসলো।
“কি নাম অন্য দুজনের?” এবার বড়বাবুর দাঁতে দাঁত চেপা হিসহিসে গলা। মনসিজ তাও চুপ।
“নাহ, তুমি দেখছি ভালো কথার বান্দা না।“ লাঠিটা হাতে নিলেন বড়বাবু। 
“সুমিত আর রাতুল” এবার মুখ খুলল মনসিজ।
“তোমার বন্ধু? এক কলেজের?”
“হ্যাঁ।“
“আজ এসেছে ক্লাসে? তোমায় আনার সময় ছিল?”
“হ্যাঁ।“
“জলদি কর পরশুরাম। তাড়াতাড়ি যাও।“ পরশুরামের দিকে ঘুরে বললেন বড়বাবু। 
এর মধ্যেই সবার ছবির একটা স্ক্রীনশটের কয়েকটা প্রিন্ট করে নিয়েছিল পরশুরাম। মেজোবাবুকে ডেকে নিলো আর কয়েকজন কস্টবলকেও নিয়ে নিল। অমিতকে ফোন করে বলল কলেজেই থাকতে। 
এবার আর অত সহজ হলনা বিষয়টা। সুমিত আর রাতুল ক্লাসে ছিলনা। হোস্টেলের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছিল। এছাড়া খবর ছড়িয়ে গেছিল বলে ভীড়ও বেড়েছিল। প্রিন্সিপাল হেল্প করলেন কারণ এস পি সাহেব আগে থাকতে ফোন করে দিয়েছিলেন। মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে আসতে পারলো পরশুরামরা। এবার আর ব্যাগ আর মোবাইল নিতে ভুল করেনি।
থানায় তিনজনকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা শুরু করার পর ওদের ভেঙ্গে পড়তে বেশি সময় লাগলো না। আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করেও বয়ান তেমন বদল হোলো না।
এতদিনে দুজন ডাক্তারের নাম পাওয়া গেলো। এম ডি মেডিসিন ডাক্তার মলয় সেন আর এম এস ডাক্তার সুমন মিত্র। দুই বন্ধু। দুজনেই এই থানা এলাকার বাইরের বাসিন্দা।
মলয় বিয়ে করেনি এখনও। বাবা মা মারা গেছেন। বাড়িতে একাই থাকে, চেম্বারের সময় কেবল লোকজন আসে, বাকি সময় খালি। হোটেলে খাবার খান আর ঘরের কাজের জন্য ঠিকে লোক আসে সপ্তাহে তিনদিন। সুমন হল সুমিতের দাদা। বড় বড় হাসপাতালের সাথে অ্যাটাচড। একজন গরীব লোকের দরকার এই অজুহাত দিয়ে একটা হাসপাতাল থেকে আই সি ইউ এর ইকুইপমেন্ট আর বেড নিয়ে এসেছিলেন। আরও কিছু জিনিষ কিনে এনে অপারেশান থিয়েটার বানান হয়েছিল মলয়ের বাড়িতে। ওখানেই বিশু আর ভ্যাদার অপারেশান হয়। ওখানেই ওদের রাখা হয় আর চিকিৎসা চলে চারমাস। সিডেটিভ দিয়ে আর খাটের সাথে বেঁধে রেখে কন্ট্রোলে রাখা হয়। তারপর ওরা সুস্থ হলে ওদের বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে আসা হয় চোখ বেঁধে।
এস পি সাহেবও চলে এসেছিলেন। উনি বললেন ডাক্তারদের ফোন করে বলতে যেন চুপচাপ এখানে চলে আসে। ফোন করার দায়িত্ব পরশুরামই নিল। স্পষ্ট করে বলল যে  সব কথা পুলিশ জানে। সম্মান বাঁচাতে চাইলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতে বলল। সুমন তো নিজের ভাইয়ের ডিটেনশানের কথা শুনে কাকুতিমিনতি করল যেন ওকে কিছু না করা হয়। আর মলয় প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও ভয় দেখানর পর আসতে রাজি হল। আর সুমন আসছে শুনে বোধহয় সাহসও পেলো।
সাস্পেক্ট তিনজনকে অন্য ঘরে বসিয়ে বড়বাবু আর শর্মা সাহেব কথা বলছিলেন। মোডাস অপারেন্ডিটা মোটামুটি সহনশীলতার মধ্যে থাকলেও মোটিভ শুনে ওঁরা অবাক। বিশু আর ভ্যাদার ব্যাপারটা প্রিপ্ল্যান্ড হলেও বীণা আর মিনার খুন যে ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে তা পরিষ্কার। পরশুরাম ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে শুনছিল দুজনের কথা। এর মধ্যে প্রিন্সিপালও ঢুকলেন, নিশ্চই এস পি সাহেব ডেকেছেন। 
শর্মা সাহেব পরশুরামের দিকে তাকালেন, “চার্জ কি দিবে, পরশুরাম?”
“চার্জশিট কি দেব, স্যার?” পরশুরাম বল।
“আঁ, কি বললেন?” পরশুরাম অবাক। বড়বাবু আর প্রিন্সিপালও।
“বিশু আর ভ্যাদার মত পাকা ক্রিমিনাল সুইসাইড করলে তো দেশের ভালো স্যার। বীণা আর মিনা যা জীবন কাটাচ্ছিল মরে গিয়ে তার থেকে উদ্ধার পেয়েছে। ওদের বাবা ওদের নিঙরে টাকা কামাচ্ছিল। চারজন মরে গিয়ে বেঁচেছে আর আমরাও।“ পরশুরাম চুপ করল।
ঘরে কোনো শব্দ নেই। সবাই চুপ। মাথা নীচু। 
“প্রিন্সিপাল সাব, আপনার স্টুডেন্টদের কাছে আর যেন কখনও গাঁজা না পাওয়া যায়। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং।“ এস পি শর্মা বললেন। “মন্ডল, দেখো ব্যাপারটা। তুমার এরিয়া ক্লীন রাখাটা তুমার রেস্পসিবিলিটি এটা মনে রাখবে। কাল আমার সাথে দেখা করবে সব মিটে গেলে। আমি আসি এখন।“ বেরিয়ে গেলেন এস পি। 
হতবাক প্রিন্সিপালকে বড়বাবু হেসে বললেন, “আপনাকে একটু মিথ্যে বলতে হবে। আপনার স্টুডেন্টরা আর গাঁজা সহ ধরা পড়বেনা এটা ওদের মুচলেকা দিতে হবে।“
“মানে?” প্রিন্সিপাল অবাক।
“স্যার, ওরা যা করেছে তাতে পেনাল কোডে লেখা শাস্তি ওদের প্রাপ্য কিন্তু ওরা আমাদের উপকার করেছে দুটো ক্রিমিনালকে শাস্তি দিয়ে আর দুটো মেয়েকে শান্তি দিয়ে। আসুন আমি বোঝাচ্ছি আপনাকে।“ পরশুরাম বলল। 
এবার খানিকটা বুঝলেন প্রিন্সিপাল, “আচ্ছা, আচ্ছা, দেখবেন যেন বেশি জানা জানি না হয়!”
সন্ধ্যের মধ্যে মলয় আর সুমন এসে গেলো। তাদের সাথে আলাদা কথা বললেন বড়বাবু। মুচলেকা লেখানো হোলো মনসিজ, সুমিত আর রাতুলের। 
খুব ঠান্ডা গলায় বড়বাবু ওদের পাঁচজনকেই বললেন যে ওদের কেসের সমস্ত রেকর্ড রাখা থাকবে। আর যেন কখনও এমন কিছু করার কথা না ভাবে ওরা। 

রাত হোল বেশ কোয়ার্টারে ফিরতে। খাবার খেয়ে ফোন করলো বোনকে। মাথাটা খালি লাগছে। কেস শেষ হলেই এমন লাগে। 
“হোয়াটস অ্যাপ খোল আর তারপর আমায় ফোন কর,” কেটে দিল বোন এই কটা কথা বলেই।
খুলল পরশুরাম। বোনের পাঠানো একটা ছবি। আরে এতো জবা। বোনের বন্ধু। সেদিন বাসস্ট্যান্ডে এসেছিল বোনের সাথে। বেশ মিষ্টি দেখতে হয়েছে তো!
“জবার ছবি পাঠালি কেনো?” কল করে জিজ্ঞেস করলো বোনকে।
“কেমন লাগল?” বোনের গলায় চাটনির সুর। 
অ্যালার্ট হল পরশুরামের পুলিশি মন, “কি ব্যাপার রে?”
“তুই আসছিস কবে?”
“জানিনা, আসবো। এই তো ঘুরে এলাম।“
“জবা তোর ফোন নাম্বার চাইছিল, দেবো?”
“আমার নাম্বার, কেনো?”
“তোর হবু বউ তোর নাম্বার চাইবে তাতে দোষ কি?”
সেদিন রাতে পরশুরাম স্বপ্নে জবাকে পেলো।


১০ 

খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে হল পরশুরাম আর জবার। মা বাবার তো আগ্রহ ছিলই, বোনের ইচ্ছা ছিল চতুর্গুন। জবা যদিও পরশুররামের বোন সন্ধ্যার চেয়ে খানিকটা বড় কিন্তু ওদের দোস্তি অনেকদিনের। জবা গ্রাজুয়েট হয়েছে দুবছর আগে। বন্ধু এবার বৌদি হবে ভেবেই আহ্লাদে আটখানা হচ্ছিল সন্ধ্যা।
বিয়ে মিটলো। অষ্টমঙ্গলা সেরে এসে তেঁতুলতলায় বন্ধুদের সাথে বসেছিল পরশুরাম রবিবার। আরও দুদিন ছুটি আছে হাতে। তারপর জবাকে নিয়ে কোয়ার্টারে ফিরবে। চায়ের ভাঁড় হাতে গল্প করতে করতে চোখ তুলে দেখলো মহুয়া আসছে। চোখ সরালো না পরশুরাম। খানিকটা এসে মহুয়াও চোখ তুলে তাকালো। তাকিয়ে থাকলো পরশুরামের চোখের ভেতর। এবার পরশুরাম স্পষ্ট দেখতে পেলো মহুয়ার হাসি, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। পরশুরামও হাসল।

পরশুরাম থানায় চলে গেল খেয়েদেয়ে। জবা ঘর গোছাতে বসল আজ। এখানে আসা ইস্তক গোছগাছ করা হয়নি। টেবিলে কয়েকটা ফাইল পড়ে আছে। পরশুরাম কোয়ার্টারে ফাইল এনে কাজ করে দেখেছে জবা। গোছাতে গিয়ে দেখলো একটা ফাইলে লেখা বিশু-বিশালাক্ষী/ভ্যাদা-ভেদি। মজা লাগলো লেখাটা পড়ে, ফাইলটা খুলল জবা। কাগজগুলো ওলটাতে শুরু করলো। 
কয়েকজনের ছবি। মরা লোকের ছবিও আছে। দেখে গা কেমন করে উঠলো জবার। তাড়াতাড়ি ওল্টালো পাতাগুলো। কয়েকটা পাতা আলাদা করে স্টেপল করা। প্রথম পাতায় লেখা
 মনসিজ রায়। ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। বয়েস একুশ।
তারপর লেখা শুরু-
“আমরা তিনজন মাঝে মাঝে যেতাম ড্রীমগার্লসে। বিশু আর ভ্যাদাও আসতো দেখতাম। আমরা জানতাম বীণা আর মিনা পয়সা নিয়ে শোয়। আমরা কোনোদিন শুইনি। তবে বিশু আর ভ্যাদা ওদের নিয়ে যেত কোনো কোনো দিন তা দেখতাম। একদিন আমাদের টেবিলের পাশের টেবিলে বসে খাচ্ছে বিশু আর ভ্যাদা। ওদের আলোচনা কানে এল। রেলস্টেশানে একটা পাগলী থাকে। ওকে ওরা মাঝে মাঝেই রেপ করে। যেভাবে বর্ণণা করছিল নিজেদের মধ্যে, শুনে গা ঘিনঘিন করছিল। আর পয়সা দেয় বলে বীণা আর মিনার সাথেও যা ইচ্ছে তাই করে। ওদের যন্ত্রণা দিয়ে বিশুরা আনন্দ পায়। দুটোই পার্ভার্ট। 
ওইদিন তেমন কিছু মনে হয়নি। এরপর একদিন মলয়দার বাড়ি গেছিলাম আমরা। সুমিতের দাদার বন্ধু বলে আমাদের যাওয়া আসা ছিল। আলোচনায় উঠে এলো বিশুদের ব্যাপারটা। সুমনদাও ছিলো ওখানে। সব শুনে মলয়দা হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সুমনদা বলল মলয়দার মায়ের ওপর নাকি রেপ অ্যাটেম্পট হয়েছিলো। মলয়দার বাবা বাঁচাতে গিয়ে খুন হন। আঘাত সইতে পারেননি মলয়দার মা। আত্মহত্যা করেন। মলয়দা তখন ফার্স্ট ইয়ারে। তারপর মামার সাহায্যে বাকি পড়া শেষ করে। 
বিশু আর ভ্যাদা রেপিস্ট শুনে মলয়দার মাথায় খুন চেপে যায়। ও চেয়েছিলো ওদের মেরে ফেলতে কিন্তু আমার মাথায় আসে আরও বেটার প্ল্যান। মেরে ফেললে তো শাস্তি হলনা। শান্তি দেওয়া হল। সুমনদাকে জিজ্ঞেস করলাম ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি করতে পারবে কিনা। সুমনদা রাজি হয়ে গেলো। 
সব ব্যাবস্থা করা হয়ে গেলে মলয়দা আর সুমনদা আমাদের গ্রীণ সিগনাল দিলো। এর মধ্যে আমরা বিশু আর ভ্যাদার সাথে ভাব জমিয়ে নিয়েছি। ঐদিন, যেদিন আপনারা আমাদের একসাথে বেরোতে দেখেছেন আমরা বীণা আর মিনাকে ভাড়া করি। বিশু আর ভ্যাদাকে লোভ দেখাই মদ আর মেয়ের। এটাও বলি আমারা একটা দারুন জায়গায় নিয়ে যাবো কিন্তু শর্ত হল মোবাইল এখানেই সুইচ অফ করতে হবে কারণ আমাদের কলেজ থেকে আমাদের ওয়াচে রাখা হয়। কলেজ থেকে আমরা বাড়ি যাবো বলে বেরিয়েছিলাম। আমরাও ওদের সামনে মোবাইল সুইচ অফ করে দি। ওরা তখন বাংলার নেশায় চূর , তার ওপর মেয়ের লোভ, এককথায় রাজি হল। জানতাম ঐ ফাঁদেই ওরা পা দেবে। একটা গাড়ি বলাই ছিল। উঠে সোজা মলয়দার বাড়ি।
ওখানে ওদের ওভারপাওয়ার করতে বেশি চাপ হয়নি। বীণা আর মিনাকে অনেক টাকা দিয়েছিল মলয়দা চুপ থাকার জন্য কিন্তু ওরা লোভ সামলাতে পারেনি। আপনারা ফোন করার পরই আমরা বীণা আর মিনাকে কল করে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু ওরা আরও টাকা চাইছিলো আর না দিলে আপনাদের সব বলে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। ঐদিন ওদের ডেকেছিলাম বোঝানর জন্যে কিন্তু ওরা কিছুতেই শুনছিল না। মলয়দার মাথায় রাগ চড়ে যায়। ও মিনার গলা চেপে ধরে। ওরা অপুষ্ট। ঐ চাপেই মরে যায় মিনা। বীণাকে মারে রাতুল। ও ভয় পেয়ে গেছিল, সব জানাজানি হলে লাইফ শেষ হয়ে যাবে বলে। বাকিটা তো স্যার আপনারা জানেন।
বাকিদের বয়ানের কাগজেও একই লেখা প্রায়। পড়ে আশ্চর্য্য হয়ে গেল জবা। অদ্ভুত মানুষের কাজকর্ম।
ফাইল আরও ওল্টাতে ওল্টাতে একটুকরো কাগজ মেঝেতে পড়ল। তাতে লাল কালিতে লেখা-
"মহুয়ায় নেশা জমে
জবায় ভজন পূজন
যদি হও সুজন
এক বুকে দুজন"

----------------------------------------------------------

Abhra Ghosh
6/6 Panapara 3rd Lane,
PO Talpukur, Barrackpore,
North 24 Parganas,
Kolkata-700123

9433112702


নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩