Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

কাল্পনিক কথোপকথন : পারিজাত ব্যানার্জী


বৃত্তহীনা


— "দেখো লাবণ্য, কথা শুরু হওয়ার আগেভাগেই একটা হিসেব আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। কারণ আমি জানি, তোমার যা তেজ তাতে নাতো শেষমেশ অর্থহীন হয়ে যাবো এই আমিই! তবু তুমি কিছুতে পোষ মানবে না।"
— " ভালোবাসলেই বুঝি পোষ মানতে হয়?পোষ তো সামান্য ইঁদুরছানাকেও একটু যত্নআত্তি করলে ঠিক মেনে যায়! রাগ, অভিমান, হিংসে, কথা কাটাকাটি, অকারণ হইচই,ঝামেলা — এসব ছাড়া তো স্বয়ং রবিঠাকুরও ভালোবাসার গল্প লিখতেন না!"
—"আহ লাবণ্য! কথা ঘুরিও না! এখানে রবিঠাকুরের কথা আসছে কোথা থেকে? কথা হচ্ছে আমায় তোমায় নিয়ে, আর তুমি কি না অযথা ---"
—" অযথাই বটে! এই যে প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য ওঠে পুবের আকাশ লাল করে, কই আমরা কি দেখি, না ভাবি সেসব নিয়ে! রোজকার সব জিনিসকেই আমরা আসলে আলাদা করে আর গুরুত্ব দিই না তেমন, তা তাদের আমাদের জীবনে যতখানিই মূল্য থাকুক না কেন! কেন জানো? কারণ তা আমাদের কাছে অযথা রোম্যাণ্টিসিজম! আর এই যে আমি রবিঠাকুরকে নিজের ভূষণের পরম নিভৃতে আগলে অচিরেই হয়ে উঠেছি 'শেষের কবিতা'র লাবণ্য — তুমি সেই বিলেতফেরত 'অমিত রে' হলেও তা বোধহয় টের পেতে না! কারণ, তোমার কাছে এসব দ্বন্দ্ব ভিত্তিহীন!
—"লক্ষ্মীটি লাবণ্য, হেঁয়ালি বন্ধ করো। আমার ঢের কাজ এখনও বাকি পরে, তা কি জানো?বাবা মুখে রক্ত তুলে দিনরাত এক করে আমাদের থেকে দূরে থেকে হলেও কাজ করে আমায় সবচেয়ে নামী এবং দামী স্কুল কলেজে কেন পড়িয়েছিলেন জানো? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো। কাব্য করার জন্য নিশ্চয়ই না। নিজের পায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কাজ করে উপার্জন করার জন্য। তোমার রবিঠাকুরের অনেক সময় ছিল — পয়সাপত্র জমিজমা, ঘরবাড়িও নেহাৎ কম তো কিছু ছিলই না,বরং বলা ভালো প্রয়োজনের থেকে বহু ক্ষেত্রেই যথেষ্ট বেশিই ছিল। তাই পুর্ণিমার রাতে গঙ্গার বুকে ভাসতে ভাসতে পাতার পর পাতা ভরানো তাঁর পক্ষেই ছিল সম্ভবপর। এমনটাই যে হবে, তাতেই বা আর আশ্চর্য কি! আমার সে সাধও নেই, সাধ্যেও কুলোবে না আলঙ্কারিক কথা লিখে বেচে এই দূর্দিনের বাজারে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিন কাটানোর।"
—"তুমি ভুল জানো অমিত।"
—" লাবণ্য! আবার সেই ছেলেমানুষি? আমি অমিত নই, নিরঞ্জন।"
—" আচ্ছা বেশ। তোমার এই নতুন রূপকেই নাহয় নিলাম মেনে। যাগগে যা বলছিলাম, তুমি ভুল জানো নিরঞ্জন। তোমার বাবা তোমার জন্য রোজগার করেননি, বাড়ি থেকে অত দূরে গিয়ে বছরের পর বছর থাকেনওনি তোমাদের কথা ভেবে। তিনি তা করেছেন নিজের চাহিদা পুরণের জন্য, নিজের বেঁচে থাকার, মানে খোঁজার তাগিদে। তোমাকে যতটুকু ভালোবাসা দেওয়ার নিশ্চয়ই দিয়েছেন। তুমি তাঁর সন্তান, আত্মজ! তাঁর সারাজীবনের কামনা ভালোবাসার তুমি জীবন্ত ফসল! তা বলে তিনি কিন্তু তোমার জীবনী নিজে লিখতে পারেননা কখনওই।সে অধিকার আমাদের কারওরই নেই। তুমি তোমার পরিবারে সকলের মধ্যে বেড়ে উঠলেও কখনও পুরোপুরি পরিবারের অন্য সকলের মতো হও কি? আইডেণ্টিকাল টুইনস রাই হয়না, তুমি তো কোন ছাড়! প্রতিটি মানুষের এক অদ্ভুত নিজস্বতা থাকে যা এমনকি বাবা মায়েদের থেকেও হয় ভীষণভাবে স্বতন্ত্র। তাই তাঁরা অবশ্যই তোমায় ভালোবাসতে পারেন —কিন্তু তোমার জীবন, ভাবনা, ধারণা —এই সবকিছুর উপরে তাই বলে তাঁদের তোমার জন্য করা প্রতিটা কাজের দায়ের বোঝা কোনোভাবেই তাঁরা চাপিয়ে দিতে পারেননা।"
—" ছিঃ লাবণ্য! এসব কি বলছ তুমি?মাঝদুপুরে অফিস থেকে দৌড় করিয়ে আনলে শুধু তোমার এই বাজে বকবক শোনাতে? তুমি পারলে এতটা স্বার্থপরের মতো কথা বলতে? অবশ্য, তোমাকে দোষই বা দিই কিকরে?জন্ম থেকেই মা বাবাকে হারিয়েছো তুমি,আর কাকা কনভেণ্টে রেখে পড়িয়েই তাঁর দায় সেরেছেন। যতদিনে বড় হয়েছো, সেই সম্পর্কও চুকেবুকে গেছে। তোমার পক্ষে তাই এই কথাগুলো বলা সহজ হতে পারে, কিন্তু আমার পরিস্থিতিতে দাঁড়ালে বুঝতে — পারিবারিক দায়বদ্ধতাকে এভাবে ফুৎকারে কোনোমতেই উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাঁদের সম্মান জানাতে এমন অনেক কিছুই আমাদের করতে হয়, যা হয়তো মন থেকে মেনে নেওয়া না গেলেও করতে হয়, কারণ সেগুলোই কর্তব্য।"
—" চক আছে তোমার কাছে?"
—" চক? চক কোথায় পাবো? এ আবার কি হেঁয়ালি? আমি কি স্কুলে পড়াই নাকি?আর তাছাড়া আজকালকার নামীদামী স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ড কন্সেপ্টটাই উঠে গেছে। তার বদলে এসছে হোয়াইটবোর্ড, আইপ্যাড এইসব!"
—"হবে হয়তো! তবে ওসব আবার আমার ধাতে সয় না। তাই তো মোবাইল কিনে নিজেকে সকলের সঙ্গে তাল মেলাতে আপ-টু-ডেটও করিনি আমি। যাগ্গে, চক না থাকলেও হবে। পেন হলেও চলত। তবে পেন হলে আবার পাতা লাগত বৃত্ত আঁকতে। চক থাকলে এই টেবিলের উপরের গোলটা আঁকতাম।"
—" কিসের গোল? কি বৃত্ত?আচ্ছা লাবণ্য, তুমি কি কখনই কোনো কথা সোজা ভাবে বলতে পারোনা?"
—" আরে, সোজা করে বলব বলেই তো এঁকে বোঝাতাম। দেখাতাম কেমন করে একটা বৃত্তের মধ্যে তুমি ঘুরপাক খাচ্ছ পুকুরের জমা জলে। সেখানে নড়তে চড়তে হয়তো পারো তুমি ঠিকই, সাঁতার, ডুবসাঁতার সবই হয় নিশ্চয়ই — কিন্তু দুকূল ছাপানো সমুদ্রের স্বাধীনতা সেখানে মেলেনা কিছুতেই। জীবন হয়তো ঠিক কেটে যায়, তবে ওই পর্যন্তই! ওই কাটিয়ে দেওয়া জীবনে বাঁচার রসদ মেলে না! আর এই যে তুমি পুরোপুরিভাবে বাঁচতে পারলে না,তোমার অনেক ভাবনা, কথা, ইচ্ছে, বাসনা মনের মধ্যেই রেখে দিলে পাথরচাপা দিয়ে সারাজীবন, এর ফলেই জন্ম নেয় খেদ। আসে সবকিছু না পাওয়ার হতাশা। আর তাই নিজের ইচ্ছে চরিতার্থ করতেই এই তোমরাই আবার পরবর্তী প্রজন্মের উপর চাপিয়ে দাও দায়। একটা শিশুকে বড় করার সমস্ত খরচের মাশুল চাপিয়ে দাও এই আগামী প্রজন্মেরই ছোট্ট দুটি কাঁধে। বৃত্ত হল না, কি বলো?"
—" লাবণ্য ----"
—" আমার কথা শেষ হয়নি নিরঞ্জন। আমি কিন্তু অনাথ বলেই স্বাধীন নই। আমি স্বাধীন, কারণ কোনো শেকলের জোরেই আমায় বাঁধা যায় না। আর তাই আমি কোনো বৃত্তের দায়ে জর্জরিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে লাগামও পড়াই না। ওই যে তুমি প্রথমে পোষ মানার কথা বলছিলে না, সত্যিকারের ভালোবাসায় জানবে, কখনও কাউকে পোষ মানাতে হয় না! সেখানে একটা মানুষের নিজস্ব তেজই তার শক্তি। আলো নিভে গেলে সেই মরা জীবনের কিন্তু কোনো মানে থাকে না। আসলে কি জানো, আমি বোধহয় বৃত্তহীনা। আমি সরলরেখা বরাবর খালি চলতে থাকি দিকশুণ্যপুরে — আমাকে কোনো শক্ত গিটেও এভাবে বাঁধা যায় না।"
—" যদি কোনো বাঁধনে আটকাতেই না চাও লাবণ্য, তবে আজ কিসের আশায় আবার ডেকে পাঠালে আমায়? মনে আছে তোমার, এই তুমিই একদিন বলেছিলে এই দেখাকরাগুলো তোমার ভালো লাগে না। মনে হয় ভীষণ নিয়মমাফিক এইসব যোগাযোগের বাঁধন!"
—"মনে থাকবে না আবার?খুব মনে আছে। ধর্মতলা থেকে ট্রামে উঠেছিলাম দুজনে। সকাল থেকেই সেদিন খুব বৃষ্টি পরছিল। তার উপর ছাতা না থাকায় আমরা দুজনেই একেবারে ভিজে একসা। আমার শাড়ির আঁচলে কোনোরকমে নিজের মুখটা মুছে নিয়ে হঠাৎই বললে তুমি, 'চলো, এবার বাড়িতে কথাটা পাড়ি। অনেকদিন তো ঘোরাঘুরি হল। এবার বিয়েটা করে নেওয়া দরকার।' "
—" আর তাতে তুমি কি বলেছিলে মনে আছে? বলেছিলে সম্পর্ক যতদিন লাগামছাড়া থাকে, ততদিনই ভালো। তাকে যেই ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় আগল তুলে দিয়ে আটক করে ফেলবে, অমনি সে দমচাপা পরে নাভিশ্বাস তুলে শেষবার সোপান ধরার তাড়া লাগাবে! কেন লাবণ্য, বিয়ে করে বুঝি সুখী হয়না কেউ? বেশি দূরে যেতে হবে না, তোমার আশপাশেই তাকিয়ে দেখো তো, কত বিবাহিত মানুষজন! এরা বুঝি সবাই অসুখী! আর তুমি লাবণ্য? আমায় না বিয়ে করে তুমি কি সুখ পেলে, বলো তো সত্যি করে আজ? আসলে তোমার মনে ধরেনি না আমায়? তাই সুখের এসব অদ্ভুত ধুয়ো তুলে সোজা কথা, পালিয়েছিলে সেদিন তুমি!"
—" ওমা! সুখের কথা আসছে কোথা থেকে? সুখের সাথে ভালোবাসার, স্বাধীনতার এসবের তো কোনো বিরোধ নেই। অবশ্য প্রয়োজনও তেমন নেই। সেদিন মনে আছে, আরও বেশ কটা কথা বলেছিলাম তোমায়। বলেছিলাম জন্তুজানোয়ার, গাছগাছালি —এদের কথাও। এরাও তো সবাই ভালোবাসে একে অপরকে। একসাথে থাকে। সন্তান প্রতিপালনও করে যথাসময়ে। কিন্তু তাই বলে একে অপরের ঘাড়ে কোনো দায় চাপিয়ে তারা কিন্তু কাউকে আটকেও রাখে না। সন্তানরা একটু বড় হলেই তাদেরকেও স্বাবলম্বী হওয়ার পাঠ শেখায় তারা। খুঁজে নিতে বলে তাদের ভিন্ন এলাকা। আবার, সন্তান জন্মেছে বলেই কোনো বাবা মাও কিন্তু  একসাথে ঘর বাঁধে না। তারা একসাথে থাকে শুধুমাত্র তাদের যতদিন ইচ্ছে হয় ততদিনই। গাছেদের কথা ধরো তো, তাদের তো আরও ভালো — ফুল, ফল, পরাগ বা মুকুলের জন্ম দিয়েই তাদের কাজ শেষ। বাকি দায় সেই নতুন প্রাণের নিজেরই যে প্রকৃতির অন্য সব রসদের সাহায্যে খুঁজে নেয় তাদের বেঁচে থাকার আস্তানা। মৌমাছি, বোলতা, হাওয়া, আগুন, জল এসবের সাহায্যেই নির্ধারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের স্বাধীন অন্য আখ্যান।"
—" লাবণ্য, তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, আমরা মানুষ। সামাজিক জীব আমরা। তাই সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুনকে এভাবে এত সহজে উড়িয়ে দিতে পারিনা। অন্য পশুপাখির যা মানায়, গাছগাছালি যা করে , আমাদের সেটা করা বেমানান। অবশ্য তোমার সাথে তর্ক করা বৃথা। জানি, তুমি কিছুই বুঝতে পারবেনা। "
—" বুঝতে জানতেই যদি সবটা সময় কাটিয়ে দিই, তবে দেখব কখন, শিখব কখন বলো! এতদিন পরে ডেকে আনলাম, প্রাণভরে দুচোখ মেলে আগে দেখে  তো নিই তোমায়!"
—" আচ্ছা লাবণ্য, একটা কথা আজকে বলোতো। তুমি কি সত্যিই কোনোদিন ভালোবেসেছিলে আমায়? নাকি এসব বৃত্ত স্বাধীনতা কিছু নয়,তোমার সবটাই মিথ্যে, ভাঁওতা! জানো, খবর রাখো তোমায় ছাড়া সেসময় কেমন কেটেছে আমার দিনগুলো?বাড়ির সবাই তোমার আমার কথা জানত। মনে মনে প্রস্তুতিও নিচ্ছিল আমাদের বিয়ের। আর তুমি কিনা ---"
—" আমি তোমায় ঠকাইনি নিরঞ্জন। আমার এই একতরফা চলতে থাকা জীবনের সঙ্গে যেই বুঝেছি,তুমি তাল মেলাতে পারবে না, অমনি স্পষ্ট তোমায় বলে দিয়েছি সব। আমি আবেগে চলি, ভাবনায় নয় — ভালোবাসার জন্য বারবার মরতে রাজি, মরার জন্য ভালোবাসতে নয়। যে কোনোরকমের বাঁধন আমার চলার গতিকে থমকে দিত, আর আমার এই চেতনার মৃত্যু হলে পর কোনোভাবেই আমি নিজের গড়া পথ ধরে আর মাথা তুলে বাঁচতে পারতামনা সেদিন। আর আমার সন্তানকেও গণ্ডির বাইরে রেখে এভাবে বড় করতে পারতাম না।"
—" সন্তান? তুমি বিয়ে করেছো লাবণ্য?"
—"এতক্ষণ আমার কথা শুনে এই বুঝি মনে হল তোমার! নাঃ নিরঞ্জন, সত্যি বলছি, তোমার নাম অমিত রায় হলেও কিন্তু সত্যিই খুব একটা আশ্চর্য হতাম না আমি। তোমায় ভালোবেসেও বিয়ে করলাম না অন্যকে না ভালোবেসে তোমার মতো ঘর বাঁধব বলে? আমার দ্বারা এজন্মে তা আর হবেনা গো!"
—" আমার উপায় ছিলনা লাবণ্য। বাড়ির একমাত্র ছেলে আমি। মা বাবা আত্মীয়স্বজন— সবার সমস্ত আশা ভরসা চিন্তার ভার বর্তাচ্ছিল আমারই উপর। বিয়ে করে ঘর বাঁধব, সংসার করব, ছেলেমেয়ে হবে,তারা বাড়ি জুরে খেলে বেড়াবে, দাদু দিদাদের হাত ধরে স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, অনেক বড় চাকরি পাবে বড় হয়ে -----"
—"দেখেছো তো, শুধুমাত্র আরেকটা বৃত্ত আঁকবে বলে কত সহজেই আমাদের তথাকথিত ভালোবাসার 'নিরঞ্জন' করে দিতে পারলে! সত্যিই, নামটা কিন্তু ভারী সার্থক তোমার! আমি জানতাম অবশ্য তুমি পারবে। আর ঠিক এই কারণেই সেদিন ট্রামে তোমার হাত ছেড়ে নেমে পড়েছিলাম মাঝরাস্তায়। আমাদের ভালোবাসার বীজ তখন একটু একটু করে বড় হচ্ছে আমার শরীরে। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম, বিয়ে হলে আমার সন্তানকে শুধু আমার বা তোমার নয়, দায় নিতে হবে তার গোটা পরিবারের, এমনকি হয়তো সমাজেরও! ওই একরত্তি মেয়েটার উপর বড় বেশি চাপ হয়ে যেত গো সেটা, মা হয়ে তাকে এই বিপদে আমি কিছুতেই ফেলতে পারলাম না গো তাই।"
—" মেয়ে? আমার মেয়ে!"
—"নাঃ। আঠারো বছর হয়ে গেল তো ওর গত মাসে, সেই মেয়ে তাই আর তোমার আমার কারও নয়, নিজের। ওর বৃত্তটুকু ভাঙার জন্য মা হয়ে সামান্য এই স্বার্থত্যাগটুকু করতেই হয়েছিল আমায়। সেদিন সত্যি বলছি, ইচ্ছে থাকলেও তাই ঘর বাঁধতে পারিনি তোমার সাথে মেয়েটার স্বার্থে। তোমার ভালোবাসা আমার অনাথ জীবনে যে একরাশ উন্মুক্ত বাতাস ভরে দিয়েছিল — তাতে ভেসে থাকার লোভেই উড়ে যাওয়া ছাড়া সে সময় আমার আর কোনো গতি ছিল না।"
—" তুমি, তুমি আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিলে এভাবে? এতদিন পর তাহলে আজ আবার কেন ডেকে পাঠালে আমায়? কি ভাবলে আমায় সব বললেই আমি ক্ষমা করে দেবো তোমায়? জানো, যেই সন্তানের আশায় আমি বিয়ে করেছিলাম একদিন, সেই সন্তানের মুখ আমায় দেখাতে পারেনি স্রাবস্তী। কত অপমান সহ্য করেছি আমরা! বাবা মা যখনই শুনেছেন আমার কোনো দূরসম্পর্কের ভাইবোন বা বন্ধুবান্ধবের ছেলেমেয়ে হচ্ছে, কষ্টে চুপ করে গেছেন। আর এখন তো পাকাপাকিভাবে স্রাবস্তীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে বাড়ির এবং পাড়ার মহিলামহল। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ভুগছে ও আমার চোখের সামনেই অথচ আমার কিচ্ছুটি করার নেই। আমি মরছিলাম নিজের জ্বালায় এতদিন। ভাবোতো ঠিক কেমন লাগে যখন হঠাৎ তুমি জানতে পারো তোমার রক্তমাংসেই গড়ে ওঠা একটা মেয়ে অন্য জায়গায় বড় হওয়া সত্ত্বেও সবার কাছে সারাজীবন তুমি নপুংসকই থেকে যাবে!"
—" আর ঠিক এই কারণেই তোমার জীবন থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছিলাম আমি। তুমি জিজ্ঞেস করলে না, স্রাবস্তীর জন্য কি করার ছিল তোমার? যদি ওকে তুমি ভালোবাসতে পারতে সব রীতিনীতি, গণ্ডী, সমাজকে উপেক্ষা করে, তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই পেয়ে যেতে। দুটো মানুষ বিয়ে করে একসাথে ভালোবেসে ঘর করার জন্য। সমাজের চাপে পরে তার দায় রক্ষা করে সন্তান উৎপাদনের জন্য নয়! একবার যদি পারতে মুখ ফুটে একথা বলতে, তাহলে আজ আর স্রাবস্তী অসুস্থ হতো না। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে লড়ত সকলের সাথে যেমন করেই পারুক।
তুমি সন্তান কেন চেয়েছিলে নিরঞ্জন? নিজের বৃত্ত পূরণ করার দায়ে, তাই না? সমাজ যাতে তোমার দিকে আঙুল না তোলে, বলে তুমি বেমানান, সেইজন্যই তো? নিজে যা পাওনি, পারোনি, তার মধ্যে দিয়ে পাবে বলে তো? আর আমি বা স্রাবস্তীরা কেন সন্তান চাই জানো, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তার উপর কোনো দায় না চাপিয়ে তাকে ভালোবাসব বলে। তাই তোমার বৃত্তে না চাইতেও সামিল হয়ে তোমাদের চাহিদার সাথে তাল মেলাতে না পেরে আজ তোমার স্ত্রী মানসিকভাবে  জর্জরিত। বিশ্বাস করো এর দায় আমার বা আমার মেয়ে কারওরই নয়।
আরেকটা কারণেও সেদিন তোমায় বলিনি কিছু, কেন জানো? কারণ তাহলে আমাদের ভালোবাসায় জন্মানো সন্তান তোমাদের তথাকথিত সমাজ থেকে অন্য তকমা পেত। সবাই তাকে বলত 'বেজন্মা'। সেটা মানতে পারতে তো?পাশে দাঁড়াতে আমার? নাকি আমাকেই উল্টে বলতে গর্ভপাত করাতে?
যাগগে, আজ কোনো অনুযোগ করব বলে ডাকিনি কিন্তু তোমায়। সব জানালাম, কারণ আজ আমাদের দুজনেরই বেলা পরে এসেছে। সেই দুপুরও নেই এখন, সেই তেজও হারিয়েছে প্রকৃতিরই নিয়মে তোমার এই বৃত্তহীনা। এই সপ্তাহেই কলকাতা থেকে পাকাপাকিভাবে মুক্তি নিয়ে চলে যাচ্ছি আমি আরেকটা গণ্ডি ভাঙতেই। তার আগে ভাবলাম, তোমায় দিয়ে যাই মেয়ের খবরাখবর — দেখো কথা বলে, যদি পারো তার এখনকার বৃত্তে নিজেকে মানিয়ে নিতে। এই ফাইলটা রাখো, এতে ওর বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সববয়সের ছবি, স্কুলের রেজাল্টের কপি, সব পাবে। ও সমস্তটাই জানে। তাই যোগাযোগ করলে খুশিই হবে সে, তবে না করলেও দুঃখ পাবে না। আর আমার উপর করে থাকা রাগের আঁচ যদি এখনও না নিভে থাকে, তবে তা কাগজে লিখে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিও। কেমন? বয়স হচ্ছে তো, নিজের ভিতর তাই সব অভিমান চেপে রেখে তাই নিজেকে আর কষ্ট দিও না। উঠি, কেমন?"
—" লাবণ্য, কি নাম তার? কি করে সে?"
—"ও, বলা হয়নি না! ও নিজের নাম রেখেছে 'কৃষ্ণচূড়া'। ছোটবেলায় ওর অন্য নাম রেখেছিলাম আমি, ও তা পরে পাল্টে নিল। কোনো পদবি অবশ্য কখনও দিই নি। ওটাও তো আরেকরকম বোঝা, তাই না?
এবছরই ও কলেজে ভর্তি হল, বটানি নিয়ে। সাথে আপাতত পার্টটাইম একটা চাকরি করে রিটেলশপে। তবে গাছপালা ভীষণ ভালবাসে ও। ছোটবেলা থেকেই ওর ইচ্ছে, বড় হয়ে বাগানের মালী হবে। গাছেদের পরিচর্যা করবে। প্রকৃতির বান্ধবী হবে। দেখা যাক কতদূর এগোতে পারে। ওর রাস্তা, ও এগোবে, ওকেই তো বুঝে নিতে হবে সবকিছু, তাই না?"
___________________________________

পারিজাত ব্যানার্জী
  সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। 

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩