রক্তে ভেজা বর্ণমালা
তারিখটা ছিল ৮ ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ সন।
রোজকার মতো রক্তিম ছিল না ভোরের আকাশটা-- সকালটাও ছিল না তেমন ঝলমলে।
জমাট বাঁধা রোষানলের ধোঁয়াটে চাদরে আচ্ছাদিত ছিল ঢাকার স্বাধীন আকাশ,
স্বাভাবিক ভাবেই বিপদের আশঙ্কা দানা বাঁধছিল বাংলা জননীর সন্দিগ্ধ অন্তরাত্মায়--
হয়তো বা কোনো পশ্চিমি ঝঞ্ঝা কেড়ে নিতে পারে সন্তানদের মুখের ভাষা-- মাতৃভাষা--বাংলা ভাষা,
কালো মেঘের আড়াল থেকে দু'নলা বন্দুকের ট্রিগার টেনে ধরল পুলিশ,
বন্দুকের হিংস্র পেট থেকে যখন বেরিয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি,
গুলিবৃষ্টির দাপটে মুহূর্তেই শুরু হয়ে গেল যখন বাঁধ ভাঙা রক্তের বন্যা...
নিরসন ঘটল দেশমাতৃকার সকল সন্দেহ...!
বিশ্ববাসী দেখল তাজা তাজা প্রাণেরা কেমন চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেল হাসতে হাসতে..
মৃত্যুর পথে...
বরকত, সালাম, সফিউর,জাব্বার, রফিদদের মত আরো কত তরতাজা প্রাণের জীবনদীপ নিভে গেল জন্মের মতো বাংলার আকাশ হতে,
রক্তবন্যায় প্লাবিত হোল বাংলার মাটি...
বাংলার বুক থেকে প্রাণেদের কেড়ে নিলেও প্রাণেদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে পারল কি তারা আদৌ বাংলা বর্ণমালাকে,
যে বর্ণমালা তাদের প্রাণ প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়ে বিচ্ছুরিত হয়েছিল যুগ যুগ ধরে বাংলার আকাশে বাতাসে ?
অবশেষে শহীদদের কবরে রক্তাক্ষরে লেখা হল তাদের জয়গাথা,
সেই বর্ণমালা--অ আ...ক খ...দিয়েই,
বুলেটহীন ফাঁকা নলের ধুঁয়ো উড়ে গেল ফুৎকারে...
অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে শাসককে আত্মসমর্পণ করতে হোল আত্মবলিদানের কাছে,
রক্তে ভেজা মাটির রসে জারিত হোল বাংলা বর্ণমালা--
প্রাণ ফিরে পেল বাংলার সাধের ভাষাবৃক্ষ,
শহীদদের রক্তে লিখিত হোল ভাষা আন্দোলনের নূতন অধ্যায়--
নজিরবিহীন জ্বলন্ত ইতিহাস !
স্বীকৃতি পেল মাতৃভাষা--রাষ্ট্রীয় ভাষা রূপে,
গর্বে ভরে গেল বাঙালির প্রাণ,
দিকে দিকে ধ্বনিত হোল বাংলার জয়গান--
"আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" ও "শহীদ দিবস" রূপে স্বীকৃতি পেল একুশে ফেব্রুয়ারি--
নেচে উঠলো বাঙালির হৃদয়--
মিথ্যে হোল না শহীদদের রক্ত-
ব্যর্থ হোল না তাদের সংগ্রাম-
বিশ্বের দরবারে রক্ষিত হোল
বাংলা মায়ের সম্মান...।
বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হোল আবদুল গাফফারের সেই গান,
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি..."
আমার বাংলা
বাংলা আমার রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-
জীবনানন্দের সুরলালিত্য ছন্দ,
বাংলা আমার নদীমাতৃক অরণ্যানীর
হৃদয় ভরা আনন্দ।
বাংলা আমার শ্রীচৈতন্য-রামকৃষ্ণ-
বিবেকানন্দের পুণ্য পীঠস্থান,
বাংলা আমার বাঁধনা পরব-পুজো-পার্বণ-
রমজানের পবিত্র আজান।
আমার বাংলার মন্দির-মসজিদ-
গীর্জার সব রাস্তাই খোলা,
বাংলা মানে কফিহাউস-গড়ের মাঠ-
নিকনো তুলসী তলা।
বাংলা মানে লোকগীতি-বাউল-ঝুমুর
জারি-সারি-ভাটিয়ালি,
বাংলা মানে এক সম্প্রদায়ের উৎসবে
অন্যের গলাগলি।
বাংলা মানে টুসু-ভাদু-বনবিবি
গাজী-পিরের জাগরণ,
বাংলা মানে যুগে যুগে
পরিব্রাজকের শান্তিনিকেতন।
বাংলা মানে নদী-পাহাড় পশু-পাখির
নিরাপদ আশ্রয়,
বাংলা মানে জাতি-ধর্ম-বর্ণের
এক অপূর্ব সমন্বয়।
বাংলা মানে প্রতিবাদী মন,
হৃদয়তন্ত্রে দেশাত্মবোধের গান
বাংলা মানে মাতৃভাষা আন্দোলনে
বীর শহীদদের আত্মবলিদান।
---------------------------------------------------------
Tapan Kumar Maji, Court more, Asansol,
----------------------------------------------------------