মাতৃভাষার একক আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন বলতেই আমরা বুঝি ১৯৫৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন অথবা ১৯৬১ সালের ১৯শে মে ভারতের শিলচরে ভাষা আন্দোলনের কথা। এই দুই আন্দোলন, তার উদ্যোক্তা, সংগঠক, অংশগ্রহণকারী বা স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় শহীদদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা, মর্যাদা, ভালবাসা আর আবেগ মাথায় রেখেও বলতে পারি এই ভারতের বুকে বিশেষভাবে বাংলায় মাতৃভাষার জন্যে এক লড়াই চলেছিল দীর্ঘকাল পূর্বে আর দীর্ঘকাল ধরে। অধুনা আন্দোলনগুলো স্বাধীন ভারতে অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলেও ভাষার সেই আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে আর আমাদের এই বাংলায়। আর অবশ্যই ছিল এক একক আন্দোলন অর্থাৎ একজন গোঁয়ার পন্ডিত ব্রাহ্মণের দ্বারা সংঘঠিত।
অনেকেই হয়ত বুঝতে পারছেন কার কথা আমি বলতে চাইছি। যারা বুঝতে পারছেন না তাদের বলি এই একক আন্দোলনকারী আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং এই বাংলার সুসন্তান পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি জন্মেছিলেন প্রায় দুশ বছর আগে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২ই আশ্বিন, ১২২৭) তদানীন্তন হুগলী জেলা আর বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক অতি দরিদ্র ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ পরিবারে।
পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা মাতা ভগবতী দেবী যে খুব বিখ্যাত কোনও ব্যক্তি ছিলেন তাও নয়। বা মেদিনীপুরের বীরসিংহ নামের গ্রামটিও যে খুব বিখ্যাত ছিল তা নয়। কিন্তু গাছের পরিচয় যেমন ফলে, তেমনি এই দুই মানুষকে আমরা চিনি ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্রগর্বী দুই জনক-জননী হিসেবে। সেদিনের সেই অখ্যাত শহর বীরসিংহকে চিনি এই মহান মানুষটির পবিত্র জন্মস্থান হিসেবে।
তাঁর বিস্তৃত জীবনকাহিনী লিখতে এই প্রবন্ধ কিন্তু নয়। এই প্রবন্ধ শুধুমাত্র মাতৃভাষা প্রকাশে, প্রচারে আর বিস্তারে তাঁর অনন্যসাধারণ ভূমিকার কথা বলতে। বিদ্যাসাগর ছিলেন মেধাবী, অসাধারণ স্মৃতিধর, অধ্যবসায়ী, কষ্ট-সহিষ্ণু, কোমলহৃদয় আর মানবতাবাদী। মাত্র ষোল বছর বয়েসে ১৮৩৬ সালে সাহিত্য দর্পণ, কাব্য প্রকাশ ও অন্যান্য কঠিন অলংকার শাস্ত্র শেষ করেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করার জন্যে তাঁকে রঘুবংশম, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, মৃচ্ছকটিক প্রভৃতি পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে দেওয়া হয়। ১৮৩৯ সালে মাত্র ঊনিশ বছর বয়েসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এবং বিরাট কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণও হন। এবং ল কমিটি তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করেন।
শিক্ষায় সার্বজনীনতা আন্দোলনঃ
বিদ্যাসাগরের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে অবশ্যই বলতে হবে শিক্ষাবিস্তারে তাঁর স্মরণীয় ভূমিকার কথা। কারণ ভাষা হল শিক্ষার বাহন। শিক্ষার প্রয়োজনেই মানুষের কাছে ভাষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়।
সেই সেকালের কথা যখন শিক্ষা নামক বস্তুটি সর্বসাধারণের নাগালের বাইরে ছিল বলতে গেলে। গরিব তো বটেই সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীও প্রয়োজন ছাড়া পড়াশোনা করতে পারত না বা করার সুযোগ পেত না। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর মাত্র একুশ বছর বয়েসে ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৪৬ সালে ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যে তিনি পাঠ্যসূচীতে বেশ কিছু দীর্ঘকালীন পরিবর্তন আনেন। এর আগে সংস্কৃত কলেজে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদেরই প্রবেশাধিকার দেওয়া হত। তিনি ছিলেন এই মতের বিরুদ্ধে। তিনি বলতেন, শিক্ষার অধিকার উঁচুজাত, নীচুজাত, মহিলা, পুরুষ নির্বিশেষে সকলের থাকা উচিৎ। শিক্ষায় অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
১৮৫৫ সালে নিযুক্ত হলেন বিশেষ শিক্ষা পরিদর্শক হিসেবে তাঁর পূর্বপদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। শুধু শিক্ষাগ্রহণ ও পান্ডিত্ব অর্জনেই তাঁর কর্মজীবন আবদ্ধ ছিল না। যে বিদ্যা তিনি অর্জন করেছিলেন তা সমগ্র সমাজের বুকে ছড়িয়ে দেওয়াই মূল লক্ষ ছিল তাঁর। শিক্ষাবিস্তারে তাঁর ভূমিকা মনে রাখবে সমগ্র বাঙালী সমাজ।
নারীশিক্ষার বিস্তারঃ তখনকার দিনে নারী ছিল পর্দানসীন। তাই শিক্ষায় অধিকাংশ নারীরা ছিল ব্যাত্য। মুষ্ঠিমেয় খুব অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া আর কোনও নারীর ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনও স্থান ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, নারীরাও মানুষ। সুতরাং অন্য সব মানুষের মত নারীদেরও শিক্ষার অধিকার থাকা দরকার। নারীরা যত অধিক মাত্রায় শিক্ষিত হতে পারবে তত উন্নত ভাবে তারা সংসারের সেবা করতে পারবে।
এরপর তাঁর প্রচেষ্টায় ইংরেজদের সহায়তায় কোলকাতায় স্থাপিত হল 'হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়'। এই বিদ্যালয় যা বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত তার প্রথম সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এরপর তিনি গ্রামাঞ্চলে নারীশিক্ষা বিস্তারে সচেষ্ট হন। তাঁর অনলস প্রচেষ্টায় ১৯৫৮ সালে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বিদ্যাসাগর জানতেন গ্রাম ডুবে রয়েছে অশিক্ষার অন্ধকারে। আর তার চেয়েও অন্ধকারে ডুবে আছে গ্রামের মেয়েরা। শুধুমাত্র অজ্ঞতাই নয়, নারীরা নানা কুসংস্কারের বশীভূত হয়েও শিক্ষায় অনাগ্রহী ছিল। গ্রামে মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারের আগে তাদের মনের এই অজ্ঞতা দূর করে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাই তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন নিজের মায়ের নামে নিজের গ্রামেও মেয়েদের জন্যে তিনি স্থাপন করলেন 'ভগবতী বিদ্যালয়'। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মেয়েদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এত দ্রুত বিস্তার ভাবা যায় আজকের এই উন্নত দিনেও?
শিক্ষা সংস্কার ও মাতৃভাষার সরলীকরণ প্রয়াসঃ
বিদ্যাসাগর অন্তর দিয়ে বুঝেছিলেন সমাজের উন্নতি ঘটাতে গেলে শিক্ষাকে পৌঁছে দিতে হবে সকলের মধ্যে। আর শিক্ষা সর্বজনগ্রাহ্য একমাত্র তখনই হবে যখন শিক্ষা হবে সহজবোধ্য। তিনি এও বুঝেছিলেন কঠিন সংস্কৃত ভাষা সাধারণের পক্ষে দুরূহ। আর তাই শিক্ষা একটি বিশেষ উচ্চমেধা ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে সীমিত হয়ে থাকছে। এছাড়াও তাঁর প্রচেষ্টার আগে পর্যন্ত নারীরাও প্রায় অশিক্ষিত ছিল বা কম শিক্ষিত ছিল। তাদের পক্ষেও জটিল সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা আয়ত্ত করা খুব কঠিন ব্যাপার। না পেরে তারা হয়ত আবার শিক্ষার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়বে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করাই হচ্ছে এর একমাত্র সমাধান। তিনি শিক্ষাকে সংস্কৃতের কঠিন জটাজাল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনায় সহজ ভাষায় লিখলেন বর্ণপরিচয়। সংস্কৃতের কঠিন খোলস ছেড়ে সহজ এক লিপিতে আবির্ভূত হল বাংলা হরফ। আজ আমরা যে লিপিতে সব কাজ করছি তা বিদ্যাসাগরের প্রবর্তিত লিপি।
শিক্ষাকে সহজবোধ্য আর সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার লক্ষে বাংলায় লিখলেন পাঠ্যপুস্তক। তখন পাঠ্যপুস্তক বেশীর ভাগ ছিল সংস্কৃত এবং অন্যান্য বিদেশী ভাষায় লেখা। প্রচুর পরিশ্রম করে তিনি এগুলি সহজ ভাষায় বাংলায় অনুবাদ করলেন আর নিজেও লিখলেন বেশ কিছু। এইভাবে কাজ করায় ছাত্রদের মধ্যেও পড়ায় উৎসাহ এসে গেল। অনেকেই বিশেষভাবে উচ্চশিক্ষায় উন্মুখ হত না শুধু এই ভাষামাধ্যমের গুরুগাম্ভীর্যের জন্যে। এখন সেই বাধা দূর হল বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায়।
ভাষায় বিদ্যাসাগরের অবদানঃ
আজকের আধুনিক বাংলা ভাষাও প্রকৃতপক্ষে এই মহামানবের অবদান। সারা ভারতের সঙ্গে তখন বাংলাতেও সংস্কৃতের আধিপত্য ছিল। কিন্তু সাধারণের তা নাগালের বাইরে ছিল। একথা ঠিক যে সংস্কৃত ভাষা অত্যন্ত উন্নত, সনাতন, সাবলীল এবং শ্রুতিমধুর। কিন্তু তবু তা সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে পারছিল না। বেশীর ভাগ মানুষ এই জটিল ভাষাটি আয়ত্ত করতে অসমর্থ হত। তাই তাদের পক্ষে অনেক মূল্যবান ঐতিহ্যপূর্ণ বইও পড়ে আয়ত্ত করা সম্ভব হত না। আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃতের পরিবর্তে সূচনা করলেন এক সহজ সরল বাংলা ভাষার। খটমট সংস্কৃত হরফের বদলে আনলেন সহজ বাংলা হরফ ও বর্ণমালা। বারটি স্বরবর্ণ আর চল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে গঠিত হল এই নতুন বাংলা বর্ণমালা। এই বর্ণমালায় তিনি রচনা করলেন প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। এই দুই ভাগেই কিন্তু সরলমতি মানুষকে শিক্ষার মধ্যে দিয়ে নানা উপদেশও দিয়ে গেছেন। সবচেয়ে বড় উপদেশ রয়েছে তাঁর ঐ ভুবনের কান কেটে দেওয়ার গল্পের মধ্যে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে 'To stich in time saves nine.' অর্থাৎ অপরাধকে কখনও প্রশ্রয় দিয়ে বাড়তে দিতে নেই। অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে হয়। নাহলে বেড়াল বাঘ হতে পারে কেঁচো কেউটে হতে পারে। সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ হল সমস্যার আসল সমাধান। এই উপদেশ যেমন ছোটদের তার চেয়ে অনেক বেশি বোধহয় বড়দের। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ অবশ্যই সহজ ও সুন্দর তবে তা বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পরের ধাপ।
বাংলা সাহিত্যের সরলীকরণঃ
সংস্কৃতের সেই জটিল স্রোতঃস্বিনী থেকে বাংলা গদ্যকে সহজ, সরল আর মর্মস্পর্শী করে এক নতুন ধারায় প্রবাহিত করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এমন কী সাহিত্যেও সেই ভাষা প্রতিফলিত হল। সেইজন্যে তাঁকে অভিহিত করা হয় আধুনিক বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক হিসেবে। আজ বাংলা ভাষা এক স্বাধীন ও স্বাবলম্বী ভাষা। দিনে দিনে তা হচ্ছে আরও বেশী উন্নতই নয় হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্য। এমন এক সময় ছিল যখন আমরা যে ভাষায় লিখতাম তার চেয়ে একটু অন্য ভাষায় কথা বলতাম। প্রথমটি ছিল লেখ্য ভাষা আর দ্বিতীয়টি হল কথ্য ভাষা। কথ্য ভাষার তুলনায় লেখ্য ভাষা ছিল একটু কঠিন। ক্রম বিবর্তনের পথ ধরে ভাষা কিন্তু আজ একটাই। এই লেখ্য ভাষার ঘটছে অবলুপ্তি আর সমস্ত স্থানটি দখল করে নিয়েছে এই কথ্য ভাষা। আজ যে ভাষায় আমরা চিন্তা করি, সেই ভাষাতেই কথা বলি আর এমন কী লিখিও। তাই জ্ঞানের পথে ভাষা এখন আর অন্তরায় নয়। শিক্ষার জগতে ভাষাই হল মূল মাধ্যম। তাই শিক্ষাসংস্কারের ব্রতী হয়ে প্রথমেই ভাষাসংস্কারের উদ্যোগী হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্তে প্রবাহিত করে ধরণীকে শস্যশ্যামলা করে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হয়েছিলেন সকল মর্তবাসীর। আর ঈশ্বরচন্দ্র ভাষার স্বর্গ সংস্কৃত থেকে আধুনিক বাংলা ভাষাকে বাংলার মাটিতে এনে বাংলার সাহিত্যকে করলেন উর্বর শস্যশ্যামলা।
বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন ভাষার উন্নতিতে সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য। তাই সংস্কৃত ছেড়ে বাংলায় সাহিত্য রচনায় তিনি প্রয়াসী হন। এর মধ্যে বেশ কিছু ছিল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ। 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' তাঁর অনন্য কীর্তি। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই পঁচিশটি গল্প শুধু চিত্তাকর্ষক তাই নয় উপদেশাত্মকও বটে। এগুলি শুধু বাচ্চাদের কাছেই প্রিয় নয় বড়দের কাছেও সমান প্রিয়। ভাবা যায় না এগুলি যদি বাংলায় অনুদিত না হয়ে সংস্কৃততেই পড়ে থাকত তবে কত হাজার হাজার কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত হল এই সুস্বাদু রসপানে।
এ ছাড়াও শকুন্তলা, সীতার বনবাস, রামের রাজ্যাভিষেক প্রভৃতি বহু গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে সংস্কৃত বুঝতে অক্ষম সাধারণ মানুষকে এই মূল্যবান কাহিনীগুলির রসাস্বাদন করিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। তাছাড়া রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি পুস্তকগুলির সংস্কৃত থেকে বাঙ্গলায় অনুবাদ করে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছেন। সবাই স্বীকার করবেন সমাজের উন্নতিতে এই সমস্ত কাব্যগুলি অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিৎ।
লিখেছেন বোধোদয়, কথামালা, আখ্যান মঞ্জরী, উপক্রমণিকা, শব্দমঞ্জরী, রত্নপরীক্ষা ইত্যাদি। ব্যাকরণ কৌমুদী লিখেছেন সহজে বাংলা ব্যাকরণ আয়ত্ত করাবার উদ্দেশ্যে। তিনি জানতেন ঠিকভাবে ভাষা আয়ত্ত করতে গেলে ঠিকভাবে ব্যকরণ আয়ত্ত করতে হয়। ব্যাকরণ ভাষাকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে বেঁধে রাখে। না হলে যে খুশি যেমন খুশি যখন খুশি যেভাবে খুশি ভাষাকে উপস্থাপিত করতে চাইবে নিজস্ব নিয়মে আর ভাষা এক ছন্নছাড়া রূপ নেবে।
শুধু সংস্কৃত থেকে বাংলায় নয়, ইংরেজী থেকেও মূল্যবান বইগুলি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ইংল্যান্ডের মহাকবি সেক্সপিয়ারের 'কমেডি অফ এরর্স' অবলম্বনে 'ভ্রান্তিবিলাস' প্রহসনটির রচনা। এটি পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়ে সফলতার সঙ্গে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে।
উপসংহারঃ
বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, একরোখা আর স্পষ্টবাদী। ইংরেজীতে একটা কথা আছেঃ "To call a spade a spade". ভয়, প্রলোভন বা অন্য যে কোনও প্রভাবে প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি খুন্তিকে কখনও চামচ বলেন নি। নিরহঙ্কারী এক প্রকৃত পণ্ডিত ব্যক্তি, মাতৃভক্ত এক সন্তান, কোমল হৃদয়ের এক যথার্থ মানবতাবাদী মানুষ, অসহায়ের সহায়, গুণী মানুষের গুণমুগ্ধ, সাহসী, স্পষ্টবক্তা আর কোন অভিধায় যে তাঁকে অভিহিত করা যায় তা জানিনা। তবে তিনি ছিলেন বাঙ্গালীর গর্ব, সারা ভারতের গর্ব। আমাদের সমাজ তাঁর কাছে ঋণী, নারীসমাজ আজ তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ, শিক্ষা-সংস্কৃতি আর সাহিত্য জগত তাঁর স্পর্শে ধন্য। প্রাতঃস্মরণীয় এমন এক মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন আমাদের অনেক কাছের মানুষ কিন্তু মাথার ওপরে তাঁর স্থান।
পার্থিব আত্মার বিলুপ্তিঃ
১৮৯০ সালের ২৯শে জুলাই এই মহামানব মহাপ্রয়াণের পথে পাড়ি দিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর অমূল্য কীর্তিগুলির মধ্যেই আজও বেঁচে আছেন আমাদের মধ্যে। আর তাই থাকবেন অনন্ত কাল ধরে।
==================================
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
Mobile 8017413028