বাংলাভাষা
প্রাণের ভাষা
ভাষা মাত্রই ভাবের বাহক। ভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাব ভাবনা, আবেগ ভালোবাসা, স্বপ্ন আশা, ব্যথা বেদনা প্রকাশ করতে পারি। যেহেতু আমি বাঙালী সেহেতু বাঙ্লা আমার মাতৃভাষা। মায়ের দুধের মতই বাংলা ভাষা আমার কাছে খুবই প্রিয়। বাংলা ভাষা আমার রক্তে মিশে আছে। বাংলা ভাষা আমার রক্তে ফাগুন কে ডেকে আনে।আমার রূপসী সোহাগী বাংলা মায়ের আদর মেশানো ভাষাতে কথা বলাতে কী অপরিসীম সুখ তা একমাত্র আমার মতো বাঙালিদের অনুভূতিতে ই ধরা পড়ে। এই বাংলা ভাষায় মা ডাকাতে কী যে আনন্দ! যেন বাংলা ভাষাতে একবার মা বলে ডাকলে ই সব যন্ত্রনা, ব্যথা, বেদনার লাঘব হয়। বাংলা ভাষায় আমাদের তৃষ্ণা মেটে। এই বাংলারই বনে বনান্তরে তৃনগুল্ম-লতা-পাতা সবকিছু দুলে ওঠে বাংলা ভাষার ই ছন্দময তালে। আমার এই বাংলার কুসুমিত বৃক্ষশাখায় পাখি, মৌমাছি, প্রজাপতি ও ভোমরা বন্ধুরা যে আনন্দ সঙ্গীত গায় তা তো এই বাংলাভাষাতেই।বনে বনে যে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি আর নদী নির্ঝরিনীর প্রবাহ সঙ্গীত সে তো আমাদেরই বাংলা ভাষার সুললিত শব্দ সঙ্গীত। নদীর মাঝি দাঁড় টানতে টানতে আনন্দে ভাটিয়ালী সুরে বাংলা ভাষায় গান গায়। চাষী চাষ করে মনের আনন্দে গান করতে করতে। এভাবেই তারা শ্রম জনিত ক্লান্তি অপনোদন করে।
উদাসী বাউল এই বাংলার মেঠোপথ বাইতে বাইতে একতারা বাজিয়ে বাংলা ভাষায় গান গায়। গ্রামের আম বন,জাম বন,তার বন পেরিয়ে ঘোমটা টানা মল পরা গ্রাম্য বধূর কলসী কাঁখে চলা সব ই বাংলা ভাষার ছন্দে বাঁধা। বাংলা ভাষায় যাদু আছে। ময়ূরকন্ঠী রাতের নীলে শুভ্র জ্যোৎস্না ধারায় স্নাত হয়ে গ্রামের নির্জন মেঠোপথ বেয়ে রাখাল বাঁশী বাজিয়ে বাংলা ভাষার মধুর সুরে গান গাইতে গাইতে যায়। যখন মনে করি অতীতে ও বর্তমানে বহু প্রথিতযশা শিল্পী, সাহিত্যিক,কবি এই ভাষার ই জন্য বিশ্ব বন্দিত হয়েছেন তখন গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। তখন আপনার মনে কবি অতুলপ্রসাদ সেনের কথায় বলে ফেলি-"মোদের গরব মোদের আশা আ -মরি বাংলাভাষা। আছে ক'ই এমন ভাষা এমন দুঃখ ক্লান্তি নাশা।' আমার এ হেন দুলালী বাংলা ভাষা জননীর অস্তিত্ব নিয়ে যখন আমাদের ই দেশের বিভিন্ন কোণ থেকে একটা কথা ভেসে আসে -বাঙলা ভাষা নাকি হারিয়ে যাচ্ছে, নাকি এই
ভাষার অস্তিত্ব বেশি নয়। তখন মনটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি,-বৃহত্তর
ক্ষেত্রে বাংলাভাষার পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তন মানে ভাষার হারিয়ে যাওয়া
তো নয়!তাই যত ই অভিযোগ করা হোক না কেন বাংলাভাষা বিদেশী ভাষার মিশেলে বিকৃত হচ্ছে,
জগাখিচুড়ী রূপ ধারণ করেছে, ক্রমশঃ পাল্টে যাচ্ছে বাক্যের বিন্যাস।
সমস্ত টালমাটাল অবস্থা কাটিয়ে কিন্তু বাংলাভাষা উপযুক্ত সঠিক রূপটি নিয়ে নেবে যা হবে সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলা ভাষার প্রাণের সঙ্গে যদি এদের যোগ না হয় তাহলে সেগুলো ও তো ছিটকে যাবে। কারণ ভাষা কার ও কুক্ষিগত নয়। তবে বিদেশী ভাষার কঠিন আবরণ ভেদ করে বিষয় বস্তুর স্বাদ গ্রহণে অসমর্থ হয়ে শিক্ষার্থী নিরুৎসাহ বোধ করে।কারণ একদিকে ভাষার প্রতিবন্ধকতা অপরদিকে বিষয়বস্তুর অধিগম্যতা শিক্ষার্থীদের অতি সহজেই বিব্রত ও বিভ্রান্ত করে তোলে, ফলে বহু সম্ভাবনাময় প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে।আর সেই সঙ্গে দেশের ও জাতির ভবিষ্যৎ আশা ভরসা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় শুধু মাত্র বিদেশী ভাষা মাধ্যমের জন্য। মুষ্টিমেয় দক্ষ আমলা ও কেরানীকুল গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন ইংরেজরা।ফলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি ডিপ্লোমার তকমাধারী হয়েছিল বটে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের মূল্যবান সম্পদ থেকে। বঞ্চিত হয়েছে সাহিত্য ও কাব্যকলার রস-সম্ভোগ থেকে। যেমন একসময় কেরানী তৈরীর উদ্দেশ্যে ইংরেজ প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসৃত হ ওয়ায় ডাক্তার-ছাত্র পুঁথি মিলিয়ে চিকিৎসা করে,বিদ্যা আর আয়ত্ব করতে পারে না।তাই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ডিগ্রিধারী মূর্খ কে দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন-'ওরা যে পরিমাণ ডিগ্রি পায়,সে পরিমাণ বিদ্যালাভ করে না।'এর মূলে রয়েছে সেই বিদেশী ভাষার দুরতিক্রম্য দুর্বোধ্যতা। তাই পুঁথিগত মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী হলেও প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে না। এই বিদ্যায় তাই মন ভরে না, প্রাণে সাড়া জাগায় না'।
তাই সবশেষে বলি, যে কোন ভাষার মৃত্যু মানে তার সংস্কৃতির মৃত্যু। আমার বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্ব-স্বপ্ন-আশা ও আকাঙ্ক্ষা। এই বাংলা ভাষার কখনো মৃত্যু হতে পারে না। বাংলা ভাষা চির শাশ্বত ও অমর।
----------------------:------------------
শেফালি সর, জনাদাড়ি, গোপীনাথপুর, পূর্ব মেদিনীপুর।৭২১৬৩৩।