ধাক্কা
কার্তিকশেষে দু-দিন ধরে বেয়াড়া
ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির পরে আজই রোদ উঠেছে বেলার দিকে। শেষ-বিকেলে এই আধঘন্টা আগে
মেঘে আবারও বেশ ঘিরে ফেলেছিল আকাশ, কিন্তু কার যেন অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত
গম্ভীর মেঘ গায়ে গায়ে ঠেস দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে গেল পুরো দক্ষিণ আকাশ আর পশ্চিমের
দিকেও বেশ খানিকটাজুড়ে! যেন মেঘবরণ পাহাড়-প্রাচীর! ফালি-হয়ে-আসা সেই মেঘের আড়ালে
বাধ্যত-হারিয়ে-যাওয়া দিবাকরের হারিয়ে-যেতে-না-চাওয়া কী যে মন-কেমনিয়া রশ্মিপ্রভা!
আজ ওর আর এর প্রতিটি মুহূর্ত নিংড়ে নেওয়ার উপায় নেই। এই ট্রেনটা ধরতে না পারলে তার
আর মেয়েকে নিয়ে গানের মহলায় যাওয়া হবে না। পরের ট্রেন আবার এক ঘন্টার ধাক্কা! শেষ
অবধি শ্রীময়ীকে ছুটতে হবে মেয়েকে নিয়ে। দিগন্ত থেকে চোখ সরিয়ে আরও জোর লাগাল সুবীর
সাইকেলের প্যাডেলে।
ছোট মেয়ের আঁকার স্কুলে বার্ষিক
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। গান গাইবে মেয়ে। খুব অসুবিধা না হলে, দুই মেয়ের
আঁকা-নাচ-গান ইত্যাদির জায়গায় নিজেই নিয়ে যাওয়া-আসা করে সুবীর। এমনিতে আঁকা থাকে
শুক্রবারে, আজ রবিবার অনুষ্ঠানের মহলা।
অধ্যাপক ড. সুবীর হালদার।
মগরাহাট থানায় নিজের গ্রাম উড়েল-চাঁদপুর ও প্রতিবেশী গ্রামের স্থানীয় ভাষার প্রতি
অনুসন্ধিৎসা তার। ক্রমশ সেটা নিজের জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃত
হয়েছে, বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলের। পরে জেলার কথ্য ভাষা ও লোকসংস্কৃতিকে নিজের
গবেষণার বিষয় করে সে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে লেখাজোখাও করে। গ্রাম থেকে
শহর, সাধারণ থেকে সম্ভ্রান্ত - ভাষণের ডাক পড়ে বিভিন্ন সভায়।
বছর সাতেক হল সোনারপুরে ভাড়ায়
থাকে সুবীররা। থাকা শুরু তার বেয়াল্লিশ বছর বয়সে। বড় মেয়ে এখন একাদশ শ্রেণিতে
পড়ছে, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামেই পড়েছে সে। প্রথম প্রথম সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে
আসত সুবীররা। সপরিবার আসাটা এখন অত্যন্ত কমে এসেছে, তবে সুবীর সপ্তাহান্তে বাড়ি
আসে। চাষির ছেলে হিসাবে আজন্ম এত বছর গ্রামের জল-হাওয়া-মাটির সংস্পর্শে কাটলে,
জন্মগ্রাম টানবেই। বিশেষত গ্রামকে যারা ভালোবাসে তার মতো। তাছাড়া সুবীরের একান্ত
বিশ্বাস, নিয়মিত গ্রামসংশ্রব না থাকলে গ্রামীণ ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করলেও, তার প্রকৃত
ঘ্রাণ ম্লান হয়ে আসে। আজন্ম পরিচিত শব্দ, তার উচ্চারণ বা অর্থ যেন ক্রমশ দূরের হয়ে
পড়ে, সহজে আর ধরা দিতে চায় না! এই তো ক'দিন আগে। মগরাহাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
একজনের কণ্ঠে 'মেইদা, মেইদা' ডাক শুনে চমকে উঠল সুবীর, আরে, সেও তো তার মেজদাকে
'মেইদা' ডাকত! নিজের একদা-একান্ত উচ্চারণকে এইভাবে পুনরাবিষ্কার করতে হয়! অথচ
দেখছে মাঝেমাঝেই এটা হচ্ছে ইদানীং!
মগরাহাটের আজ হাটবার। হাটের
ভিতরে বেশ ভিড়। পাড়ায় পাড়ায় দোকানের এখন ছড়াছড়ি হলেও হাটবারে আজও হাটগুলিতে ভিড় হয়
যথেষ্ট। তার উপরে ওপার দিয়ে এই সময়েই একটা লরি ঢোকায় গাড়ি-ঘোড়া আর নড়তেই চায় না!
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল সুবীর, ট্রেনটা বুঝি আর হয় না! প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে
এমনিতেই ঘেমে গেছে, এর পর ট্রেনটা না পেলে ছোটাটাই মাটি!
উপায় না দেখে পাকা রাস্তা ছেড়ে
কড়াই-লঙ্কা-হলুদ ভাঙানোর দোকান ক'টির পাশ দিয়ে মুরগিহাটার ভিতর দিয়ে একমাত্র
বিকল্প অপ্রশস্ত পথে সাইকেল ঘোরালো সুবীর। ভাগ্যিস, আর একটু এগিয়ে গেলে আটকে পড়ত,
পেছিয়ে এ পথ ধরা যেত না! অনবরত ঘন্টি বাজিয়ে বাজিয়ে, ভাই-দাদা-কাকা করে সরতে বলতে
বলতে যতটা সম্ভব জোরে সাইকেলটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে সে।
ভিড়টা কাটিয়ে বেরোতেই দেখে ময়লা
লুঙ্গি আর জামা পরিহিত দুই কিশোর রাজ্যজয় করার আনন্দে ডগমগ দ্রুত হাঁটছে - কিংবা
বলা যায় ছুটছে! একজনের হাতে একটি খাঁচায় সদ্য কেনা চারটে টিয়া - হাঁটা বা ছোটার
মাঝে খাঁচাটা একবার করে তুলে দেখছে!
তাদের যারপরনাই খুশির ভাব দেখে
এত ব্যস্ততার মধ্যেও না বলে পারল না সুবীর, কী, পুষবে?
মুহূর্তে একজন দৃঢ়ভাবে বলল, না,
পালব।
সহসা কে যেন সজোরে এক ধাক্কা
দিল সুবীরকে!
পোষ মানানো আর পালন করার তফাতটা
কই এমন করে আগে মালুম হয়নি তো!
===========