সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পথ ভিন্ন হলেও দুটোই আসলে নিজের আশ্রয় খোঁজে মানুষের মধ্যে। কিন্তু সাহিত্যের অজুহাতে বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে নয়, বরং কবি সৌরিন ভট্টাচার্য্যের লেখা কাব্যগ্রন্থ "দ্রাঘিমাভ্ৰষ্ট বর্ণমালা" একদিকে যেমন অকৃত্রিম বিজ্ঞানভাবনার হাতিয়ার হিসেবে উঠে এসেছে তেমনি অপরদিকে কবির দূরদৃষ্টতার পূর্ণপ্রকাশ পেয়েছে পরিপূর্ণ সাহিত্যভাবনার মধ্য দিয়ে।
কবি বয়সে নবীন হলেও ভাবনার গভীরতা প্রবল। প্রথম কাব্যগ্রন্থ অথচ গভীর-সৃষ্টিশীল চিন্তার হৃদয়গ্রাহী শব্দের বাঁধনটা বেশ শক্ত-
"অন্তহীন রাত্রি, কাব্যপল্লবের সুমিষ্টঘ্রাণ;
অজানা প্রকোষ্ঠে নিঃশেষিত রতির বিলাপ।।"
পরিচিতি যেমন জানান দেয় কবি সৌরিন প্রযুক্তিবিদ্যার সাথে যুক্ত, তেমনি কাব্যগ্রন্থটিতে তার শব্দচয়ন খুব দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে কবি অত্যন্ত আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ এবং দর্শন-রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের প্রতি তার গভীর দখলদারিত্বকে-
"এন্ডোমিডা নক্ষত্রের বেগনীপারের চিঠিতে
ভেসে আসে দূর আলোকবর্ষপরের গোপন সংকেত।"
"এককমাত্রা, যান্ত্রিক স্বতঃসিদ্ধতা, প্রযুক্তির অনুরাগে, বৈশেষিক বিপ্রতীপ,মনকল্পের দ্যোতনা, এন্ডোমিডা" ইত্যাদি নামকরণগুলি এতটাই বৈচিত্র্যময় ও রহস্যঘন যে অত্যন্ত সাবলীলভাবে কবিতাগুলি পাঠকহদয়কে গভীরভাবে আকৃষ্ট করবে-
"সুপ্ত ছিল বেদনা, গৃহকোণে বিরসবেলায়
তরুণী কিশোরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অভিসন্ধির,
উচ্চাকাঙ্ক্ষার, বিগত বাদলম্নাত দিনের অভিলাষে।"
আধুনিক কবি বটে কিন্ত আধুনিক কবিতার কঠিন শব্দজাল নয়, রূপকথার মোড়কও নয় বরং কবির লেখা প্রতিটি কবিতাই ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক, সময়োপযোগী ও সৃষ্টিশীল; প্রকাশিত পাদটিকাসমুহ কবির গভীর শব্দগুলোকে খুব সরলভাবে চিনতে ও বুঝতে সাহায্য করে পাঠককে।
"দ্রাঘিমাভ্রষ্ট বর্ণমালা"-র প্রতিটি কবিতা একাধারে যেমন কবির ভালবাসা-সাহিত্যময় জীবনদর্শনের নির্দেশক ঠিক তেমনি এর বিপরীতে তার বিবেচনাবোধ, মানবতাবাদ কিম্বা বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজবাদের বিশ্বাসের আয়না-
"কোনো সোনালী বিকেলে, ওক-দেবদারু মাখা ছায়াভরা আলোয়
কেঁপে উঠেছিল সভ্যতার ভিত, অজানা আশঙ্কার পরিহাসে।
সেইদিন; মুক্তি পেয়েছিল শত প্রেতযোনি, সম্মুখদুয়ারে;
তীব্র ভূকম্পনে দুর্গম সমাধি, প্রত্নতত্ত্বের নিস্তল গহ্বরে।"
নবীন এই কবির সাহিত্যভাবনাকে প্রশংসিত ও উৎসাহিত করতে একথা বলা যেতেই পারে যে সাহিত্যরসের মধ্যেই কিন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সেই চিরন্তন বিজ্ঞানকে প্রকাশ করেছিলেন-
'একটি অসীম ধারার যোগফল সসীম হতে পারে'।
আর তাই গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে এইই অভিব্যক্তি যে, আগামীদিনে কবি সৌরিন ভট্টাচার্য্যের লেখনী থেকে অসীম সংখ্যক কবিতার জন্ম হোক- যা শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নয়, সমগ্রতার খোঁজে দাবিদার হয়ে উঠুক অভিনব সৃষ্টির। কবিও দৃঢচেতা সেই বিশ্বাসে-
"জ্বলে উঠতে চাই, হংসরাজ খান্নার মত, অন্যায্য ক্রিয়া রহিতকরণে;
কেবল ভিন্নমত পোষণে নয়, সমদর্শী ন্যায্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠায়।"
সর্বোপরি,কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ "দ্রাঘিমাভ্রষ্ট বর্ণমালা"-র প্রতিটি বর্ণমালাই যে মুগ্ধতার বিচারে পাঠক হৃদয়কে বিদীর্ণ করতে বিন্দুমাত্র দিকভ্রষ্ট হয় নি তা বলাই বাহুল্য।।
=============
দ্রাঘিমাভ্রষ্ট বর্ণমালা
সৌরিন ভট্টাচার্য্য
চান্দ্রভাষ প্রকাশনী
জেড-৫২, পঞ্চসায়র, কলিকাতা ৭০০ ০৯৪
ফেব্রুয়ারি ২০১৮
প্রথম সংস্করণ
আইএসবিএন 978-93-5291-389-3
₹ ১০০/-
ভাস্বতী দেব
গোপালনগর,
দিনহাটা, কোচবিহার
ফোন নম্বর- ৮৫৮৩০১৭৬৭৫