আশার জিওন কাঠি
কলকাতা হাইকোর্টের দুঁদে উকিল দিবানাথশঙ্কর সন্ধেবেলায় নিজের লাইব্রেরীতে বসে তার দৈনন্দিন লেখালেখির কাজ করছিলেন।আজ ২১ফেব্রুয়ারি।সারাজীবন ওকালতি করলে কি হবে তিনি একজন সাহিত্য মনস্ক মানুষ। পেশার খাতিরে ইংরেজী হিন্দি দুটো ভাষাতেই তিনি যথেষ্ট দক্ষ, তবে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তার টান ও ভালোবাসা দুটোই বেশি।তাঁর সামনে বাংলাভাষা নিয়ে কেউ কুমন্তব্য করলে বা তার অপপ্রয়োগ করলে তিনি বেশ রুষ্টই হন।বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি , একাল ও সেকালের লেখকদের তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে তিনি গুটি কয়েক বই ও লিখেছেন যা বিদগ্ধ সাহিত্যিক মহলে যথেষ্ট সমাদৃত। দিন দুয়েক আগে দিবানাথ বাবুর বাড়িতে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান ছিলো।অনুষ্ঠান মানে ওই আর কি , তাঁদের তিরিশ তম বিবাহবার্ষিকী।তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে । তারাই চাইছিলো আর তাদের গর্ভধারিণী তাঁর দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গিনীর এতে প্রচ্ছন্ন মদত ছিলো । তিনি অর্ধাঙ্গিনীর খুশির কথা ভেবে আর আপত্তি করেন নি।মনোরমা তার সুযোগ্য সহধর্মিনী।আর অনেকদিন বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান ও হয় নি। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে।মেয়ের তো বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগে, যেবার তাদের ২৫তম বিবাহবার্ষিকী ছিলো।তাদের বিবাহবার্ষিকীর দিনই মেয়ের বিয়ের দিন ছিলো ।তাই আলাদা করে নিজেদের ২৫তম আর পালন করা হয় নি।
অনুষ্ঠানে তাঁদের কিছু আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত জন উপস্থিত ছিলেন। সারা সন্ধ্যের অনুষ্ঠানটি বড়ো উঁচুতারে বাঁধা ছিলো। ইদানিং কালের বলিউডি হিন্দি গানের তীব্র সুরমুরচ্ছনা সঙ্গে সেইরকম ই নাচ তাকে বড়ো বিক্ষিপ্ত ও অপ্রস্তুত করে তুলেছিলো। তিনি এমনিতে স্বভাব গম্ভীর। কাল থেকে আরও বেশি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন।আসলে ভিন্ন প্রদেশে দীর্ঘদিনের অধিবাসী হয়ে তার শ্বশুরবাড়ির তরফের লোকজনদের রুচি ও সংস্কৃতির ধারা ই কিছুটা পাল্টে গেছে। এতে অনাবশ্যক রাগের কারণ হয়তো নেই। কিন্তু দিবানাথ এইধরণের নাচ গান কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। বাঙালীর বাঙালিয়ানা কে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে চলতি প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ঘোর বিরোধী তিনি।
মিতালী ডেকেই চলেছে- 'এই দিদি আয় না।আমাদের সাথে নাচবি।তুই তো এককালে ভালোই নাচতিস।তোদের জন্যই তো আয়োজন।জামাইবাবুকেও ফ্লোরে ডেকে নিয়ে আয়।'
মনোরমা শঙ্কিত হন।মনোরমা কয়দিন ধরে বেশ খুশিই ছিলেন।তিনি স্বামী ভাগ্যে গৌরবান্বিতা।তাঁদের দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার অহেতুক আদিখ্যেতা না থাকলেও নীরব প্রতিশ্রুতির মিষ্টত্ব ছিলো।দিবানাথ আপন কাজের জগতে চিরকাল ব্যস্ত থাকলেও মনোরমা ও তার সংসারকে কখনোই অবহেলা করেন নি।বিবাহবার্ষিকীর আয়োজনে তাঁর পূর্ণ সমর্থন পেয়ে মনোরমা আরও বেশি স্বামীর নীরব ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েছিলেন।কিন্তু কালকের সন্ধ্যেই উঁচুতারে বাঁধা অনুষ্ঠানে তিনিও কিছুটা হতচকিত।আসলে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা তাঁর বাবারবাড়ির তরফের আত্মীয়রাই মূলতঃ উদ্যোগ নিয়ে করেছিলেন।ছেলে মেয়েরাও ছিলো সাথে। আজকাল তো অনুষ্ঠান ছাড়া আত্মীয়স্বজনদের তো তেমন যাওয়া আসা থাকে না।অনেকদিন কেউ তো আসে নি।তিনিও সংসার ছেড়ে আজকাল যেতে পারেন না।যতদিন যাচ্ছে সংসারে যেন বেশি জড়াচ্ছেন।মনোরমা বুঝতে পারছিলেন দিবানাথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে এসব মেলে না।তিনি স্বামীর মনোকষ্টের কারণ হতে চান নি।
'আঙ্কেল ভেতরে আসবো।'--
ছোটশালীর মেয়ে অনিনীতা দরজায় দাঁড়িয়ে। বেশ মিষ্টি দেখতে।কিন্তু পোশাক আশাক !যাক।
'এসো ' দিবানাথ গম্ভীর হয়ে বললেন।পেছন পেছন বড় শালার ছেলে নিখিল ও ভগ্নীপতি ঢুকলেন। দিবানাথের কপালে ভাঁজ।আবার আজ সদলবলে আগমন। অ তিথি ভগবান ঠিক ই ,কিন্তু--
অনি এসেই তার লাইব্রেরীর বই এর তাক গুলো দেখতে লাগলো।ভগ্নীপতি রাকেশ কালকের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা তুললো।সেই ফাঁকে অনিনীতা আর নিখিল কোনো বই নিয়ে আলোচনা জুড়েছে দেখলেন।কিছুক্ষন পরেই অনি এসে বললো-
' আঙ্কেল এই সপ্তাহটা কলকাতাতেই থাকবো পিসিমনির বাড়িতে বেহালাতে । তোমার লাইব্রেরী থেকে 'আনন্দমঠ' টা আমায় ধার দেবে ; যাওয়ার আগে মাসিমনির সাথে তো দেখা করতেই আসবো , তখন ফেরৎ দিয়ে যাবো।অনেক দিন হয়ে গেল বইটা পড়া।ভাবছি আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।বর্তমান ছাত্রসমাজে রাজনীতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে ' আনন্দমঠ ' আর একবার পড়তে পারলে ভালো হতো।
দিবানাথ পুলকিত হলেন।কিছুটা উৎসুক।এই মেয়ে 'আনন্দমঠ' পড়বে। তিনি কিছুটা হাস্যচ্ছলেই বললেন --
'দিতে পারি , তবে তার আগে এসো আমরা একটু গল্প করি।'
মনের গোপনে কোথাও নবীনা আধুনিকাকে মেপে নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো প্রবীণ প্রাচীনের।
তারপর ধীরে ধীরে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত প্রায় এগারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘদিনের কাজের মেয়ে ললিতা এসে ডাকলো-- 'দাদা বৌদিমনি তোমাদের খাবার টেবিলে ডাকছে। রাত অনেক হলো।এবার চলো।'
নিখিল আর অনিনীতার সাথে সময় যে কিভাবে কেটে গেলো দিবানাথ বুঝতেই পারেন নি।খাবার টেবিলে আজ বেশ আলাপমুখর ছিলেন দিবানাথ।মনোরমা বেশ অবাক হলেন।কিন্তু সকলের সামনে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস প্রকাশ বা দিবানাথের সঙ্গে অকারণ বাক্যালাপের জাল বোনার অভ্যেস তার কোনকালেই নেই।তিনি চিরটিকাল সংযত ধীরস্থির।বাপের বাড়িতেও তিনি সবার বড়ো ছিলেন।শ্বশুর বাড়িতে তো প্রথম থেকেই শাশুড়ির কড়া তত্বাবধানে অনুশীলিত।
রাত্রে সব কাজকর্ম মিটিয়ে মনোরমা ঘরে ঢুকলেন। আড়চোখে দেখে নিলেন স্বামীর মতিগতি।না কালকের থমথমে মুখ আজ আর নেই।সেখানে বেশ প্রসন্নতা বিরাজ করছে।মনরোমা প্রতিদিনের অভ্যেস মতো রাতে শোওয়ার আগে স্বামীকে একগ্লাস জল আর ওষুধ দিলেন।জলটা হাতে নিয়ে দিবানাথই প্রথম বললেন,- বুঝলে মনো,
'আজ সারা সন্ধ্যে অনি আর নিখিলের সাথে গল্প করে বড়ো ভালো লাগলো।ছেলেমেয়ে দুটো মন আর মননে যথেষ্টই প্রগতিশীল ও আধুনিক।তাবে পুরাতন সংস্কৃতি , সংস্কার ও সর্বোপরি নিজের মাতৃভাষার প্রতি টান ও গভীরতা আমাকে অবাকই করে দিয়েছে।তাদের আজকের গ্লোবাল সমাজের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় তাই সবদিকেই তারা চৌখস। অনি ও নিখিল দুই জনেরই বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট দখল।তারা দুজনেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নিয়মিত পাঠক।অনি তো বললই -- ' আঙ্কেল যে সোমা আজ আমাদের বাস সেইমতো তো আমাদের বিবর্তিত হতে হবে নইলে যে আমরা 'প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ ' থেকে বাইরে চলে যাবো। তবে এটাও ঠিক গোঁড়া শক্ত না থাকলে বৃক্ষ হতে পারবো না, আগাছা হয়ে থেকে যাবো।কি সুন্দর কথা। কতো সাবলীল অথচ কি গভীর।
বড়ো ভালো লাগছে মনো জানো আমাদের আধুনিক প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে ভাবছে। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চর্চা করছে। এখন বাঙালী গ্লোবাল তাই ভাষাও নতুন থেকে নতুনতর রূপ পাচ্ছে।এই ভালো মনো। গতি থমকে যাওয়া মানেই মৃত্যু।বাংলা ভাষার নদীতে প্রাণের জোয়ার নিয়ে ঢেউয়ের দোলা দিক এরা।নইলে যে গতিহীন নদীর মতো ভাষাও যে মৃত হয়ে যাবে। মনোরোমার হাতটি ধরে ধূর্জটিবাবু বিড়বিড় করে বলে ওঠেন--
"বেঁচে থাক মোর মাতৃভাষা
স্বপ্ন আশা ভালোবাসা
আ মরি বাংলা ভাষা। "
স্বপ্ন বিশ্বাস দিবানাথবাবুর স্পর্শের ছোঁয়ায় মনোরোমার ও মনের গভীরে ছড়িয়ে পড়ে।