ইচ্ছেদমন
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির শখ আফিফ এর। এমনিতেই সে সাহিত্যানুরাগী। তাই ছড়া,কবিতা লেখার পর তার কী যে আনন্দ অনুভূত হয় তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। সব সময় ছড়া,কবিতা লিখে নিজের বাবা,মা আর একমাত্র বড় ভাইকে শোনাত। তারা শুনেই আফিফকে বাহবা ও উৎসাহ দিতেন। এতে তার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। তার স্বপ্ন একদিন সে অনেক বড় সাহিত্যিক হবে,দেশে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় বিরাট অবদান রাখবে।
যাইহোক, যখন সে ৮ম শ্রেণিতে পড়ে তখন তার সুপ্ত প্রতিভার কথা স্কুলে ছড়িয়ে পড়ে। তাই তার বাংলা শিক্ষক আরিফ হাসান একদিন ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে তার একটি কবিতা পড়ে দেখলেন।
পড়া শেষে তিনি আফিফ এর সামনে এসে দাঁড়ালেন....
-- হুম! ভালো লিখেছো তবে হাত আরো পাকাতে হবে। শব্দের বানানের দিকে নজর রাখতে হবে। বাংলা একাডেমি বেশ কিছু বানান চেঞ্জ করেছে -ওগুলো দেখে নিও। আর বেশি বেশি অন্যদের লেখাও পড়তে হবে।
-- জি,স্যার। চেষ্টা করবো.. আরো শুদ্ধ করে লিখতে। আর বাসায় পড়ার জন্য স্কুল পাঠাগার থেকে নিয়মিত বই নিয়ে যাই,স্যার।
-- গুড,চালিয়ে যাও। আর সামনের বছরের শুরুতে স্কুল থেকে একটি সাহিত্য সংকলন বের হতে যাচ্ছে। আশা করি, তোমার লেখাকে বইয়ে ছাপার অক্ষরে দেখবো।
স্যারের মুখ থেকে এ কথা শুনে তার আর আনন্দে ধরে না। চেহারায় খুশির ঝিলিক বয়ে যাওয়া আফিফ অবাক কন্ঠে বললো..
-- সত্যিই স্যার! স্কুল থেকে ম্যাগাজিন বই বেরোবে! খুব খুশির খবর। কখন বেরোবে, স্যার ?
-- বললাম তো ! সামনের বছরের শুরুতে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির দিকেই। তুমি তোমার ভালো একটি কবিতা সেই সংকলনের জন্য সিলেক্ট করে রেখো কিন্তু।
-- ঠিক আছে, স্যার। আমি রাখবো।
যেই কথা সেই কাজ। আফিফ তার স্যারের কথামত কবিতা লেখার সুষম চর্চা চালিয়ে যেতে লাগলো। দিন যায়,মাস যায় -অবশেষে বেশ যত্নের সাথে একটি দেশাত্মবোধক কবিতা লিখল। আফিফ কৃতিত্বের সাথে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো। স্কুলের ম্যাগাজিন "প্রত্যাশা"তে তার লেখা কবিতা "আমার দেশ" যেন বইয়ের শুভ্র পাতায় নিকষ কালো অক্ষরে গ্রোথিত হলো। আফিফ তো ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে ৩৪ পৃষ্ঠায় তার লিখিত সেই কবিতা দেখতে পেয়ে মহাখুশি। এজন্য স্যারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। বন্ধুরাও তার কবিতার জন্য তাকে অভিনন্দিত করলো ও আনন্দ উল্লাস করলো ।
স্কুল ছুটির পর তৃপ্ত মনে বাসায় এসে ম্যাগাজিন খুলে তার কবিতা তার মা'কে দেখালো। তার মা কবিতা পড়ে খুশি হয়ে সদ্য ঘরে ঢোকা তার বাবাকে বললো..
-- ওগো,শুনেছো!
আলহামদুলিল্লাহ্! আমাদের ছেলের কবিতা এখন স্কুলের ম্যাগাজিনে এসেছে। ইশ! কত সুন্দর করে ছাপানো। ইনশাআল্লাহ, আমার আফিফ অনেক বড় লেখক হবে।
-- মাশাআল্লাহ! এ তো আনন্দের খবর।
-- হ্যাঁ, আফিফের বাবা। আফিফ যেন নিবিড়ভাবে সাহিত্যচর্চা করতে পারে,সেজন্য আমাদেরও তাকে খুব সাপোর্ট করা প্রয়োজন।
-- হুম,তা তো বুঝলাম তবে এদেশে তো "লেখালেখি "টাকে নেশা হিসেবে নেয়া যায় কিন্তু পেশা হিসেবে নেয়ার মত নয়।
তুমি তো জানোই.. বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির চাহিদানুযায়ী জাঁকজমকপূর্ণ ক্যারিয়ার বানিয়ে সবাই লোভনীয় পদ পেতে চাই।
-- তা তো বুঝলাম কিন্তু তাই বলে তার অদম্য সুপ্ত প্রতিভাকে তো আর গলাটিপে হত্যা করতে পারি না! আর তার লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ক্যারিয়ারও গড়তে থাকবে- এতে সমস্যা কোথায়,শুনি ?
-- সমস্যা তো ওখানেই, তোমার সমান্তরাল চিন্তাধারায়...!
-- মানে?
-- মানে হলো তোমার ছেলে না কি বিজ্ঞান না! ব্যবসায় শিক্ষাও না! সাহেব না কি মানবিক বিভাগ নিয়েই পড়ালেখা করবে !
আফিফ এর মা তখন আফিফ এর দিকে তাকালেন। বেচারা আফিফকে তখন বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো। তবুও ছেলেকে বললেন-
-- কেন বাবা? তুমি তো মেধাবী,ভালো ছাত্র। গেল জেএসসি পরীক্ষায় গণিত আর বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতেও বেশ ভালো করেছো। আর সেই তুমি কি না 'মানবিক' বিষয় নিয়ে পড়তে চাও! কেন?
-- আম্মু আমি আসলে 'বাংলা' বিষয় নিয়ে পড়তে চাই। এজন্যই "মানবিক" বিষয় নিয়ে এখন থেকে পড়তে চাইছি। এমনিতেই লেখালেখি করি বলেই আমার তো আরও সুবিধা হয়, মামণি।
-- তা তো বুঝলাম, বাবা। কিন্তু জীবনে চলবে কেমনে? "মানবিক" বিষয়ে পড়ে জব মার্কেটে তো ভালো চাকরী তো পাবে না।
আফিফ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো...
-- কেন পাবো না, আম্মু। ইনশাআল্লাহ পাবো।
তখন তার বাবাও নিজেদের ইচ্ছের কথা তাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিল-
-- দেখো,আফিফ! তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক বড় স্বপ্ন। আমাদের ইচ্ছে তোমাকে ডাক্তার বা আর্কিটেক্ট হিসেবে দেখা।আর কেনই বা দেখবো না! যখন তুমি একজন মেধাবী ছেলে।আর আমরা তোমাকে সাহিত্যচর্চায় করতে তো আর বাধ সাধছি না। আসল কথা হলো, তোমাকে সবদিকেই মানিয়ে নিতে হবে।
-- কেন,বাবা! কেন? যে মাতৃভাষা "বাংলা"র জন্য আমরা বুকের তাজা রক্ত দিলাম, যে মাতৃভাষা 'বাংলা'র জন্য ২১শে ফেব্রুআরি ভাষা দিবসটির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সারা বিশ্বের সমস্ত দেশ সে দিনটিতে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" পালন করছে, তাহলে সে 'বাংলা' কে কেন আমি আমার শিক্ষা জীবনে পছন্দের বিষয় হিসেবে নিতে পারি না? কেন আমাদের সুপ্ত ইচ্ছেগুলো এভাবে দমন করতে হয়?
আফিফ এর এমন নির্মোহ ন্যায্য প্রশ্নে উপযুক্ত কৈফিয়ত দিতে না পেরে ভাষাহীন ভাষায় ফ্যালফ্যাল করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে তার মা-বাবা।।
=======================
কাজী মুহাম্মাদ রাকিবুল হাসান
ফোন +৮৮০১৬৭০৪১৯২০৫