কি-রে,--কি ভাবছিস্?
তীরে বসে আমি কি শুধু তরঙ্গই গুণছি!
না-রে না!--যেটুকু নিজের ছিলো,
সেটুকু আলোর আড়ালে বিলিয়ে দিয়েছি!
বিনিময়ে শুধু- গলাধাক্কা!-- নিজের বলে আর কিছু নেই...
জানিস,--মাঝে মাঝে তোকে ভাবি!
তরঙ্গের বদলে তোকে গুণি...
এতোগুলো গ্রীষ্মের পরেও তুই বর্ষার চারাটির মতোই আছিস!
এতো বিয়োগের-ব্যথার পরেও তুই, দীঘির ধারে পদ্মটির মতো আছিস্--
শতদুঃখেও তোর নূতন সাজার যে প্রবৃত্তিটা
হৃদয়ে তোর আজও বনফুলে ধোয়া মেঘের মতোই আছে..
ইচ্ছে করে,-
তোর ঐ প্রবৃত্তিটা ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো করে
ললাটে মেখে নিই!
কি-রে,--তোর ঐটুকু আমায় দিবি?---যদি দিস্--
সমুদ্রের বুকে আকাশটা সরিয়ে বলতে তো পারবো-
আমারও নিজের বলে কিছু আছে।
যে তার বুকের ভরসা মাখিয়ে আমায় কমলতুল্য করে রাখে..
নাই-বা চুলে তেল পড়ল, নাই-বা দিনে আহার জুটল,
পাতার আড়ালে সে আমায় ফুটিয়ে ত রাখবে...
তোর ঐ প্রকৃতিটা আমার ললাট-শিকড়ে লেপে দে-না,--
যদি দিস্-
নয়নের কটাক্ষ, অধরের হাসি, হৃদয়ের ধৈর্য-
সব তার হাতে তুলে দেবো....
নাই-বা দিলো বেশভূষা,
তার অনির্বচনীয় গন্ধের ভিতর পুড়তে তো পারবো---
বলতে তো পারবো--আমার নিজের বলে কিছু আছে...
যেমন মেঘমধ্যে বিদ্যুৎ-মনমধ্যে প্রতিভা-শব্দমধ্যে সঙ্গীত----তেমনই
'মরণের ভিতর সুখ!
মেঘভাঙ্গা আলোর মতো সে মরণ!-- বড় মধুর--বড় শীতল!
সেখানে মাটি নেই-ঘর নেই-শব্দ নেই---কেবলি সর্বদা নূতন ফোটে!
তোর ঐটুকুর অভিমানে--আমিও অগ্নিগর্ভ হয়ে অল্প অল্প ফুটবো--
বলতে তো পারবো--আমার নিজের বলে কিছু আছে...
অতি মৃদু, অতি মধুর, অতি স্নেহময় কন্ঠে
একবার বল---তোর ঐটুকু আমার দু'পায়ে নুপুরের মতো বেঁধে দিবি....
নাই-বা রইল গোলাভর্তি ধান, পুকুরভর্তি মাছ--
দিনের শেষে মল্লিকাফুলের মতো একমুঠো অন্ন, কাঁচা কলায়ের দাল, আর
জঙ্গুলে-ডুমুরের দালনা....
জানিস্!---শব্দহীন রাতে যখন নিজই নিজেকে দেখি, চমকে উঠি অশনির মতো!
আরো বিভৎস হয়ে উঠি নিঃসাড় নিঃশ্বাসের যন্ত্রণায়!
তোর ঐটুকু পেলে-
গণ্ডে ঝরে পড়া সবকটি অশ্রু তার হাতে সঁপে দিতাম..
নাই-বা পড়লো কাজল চোখে
নিঃর্দীপ রাতে সাড়া তো পাবো তার!
কি-রে,----তোর ঐ স্পৃহাটুকু দিবি?--
বলতে তো পারবো--আমার নিজের বলে কিছু আছে..
জানিস্, তুই বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে--কেমন যেন একটা বনফুলের গন্ধ পাই!
মাথার উপর দোয়েল শিস্ দিতে দিতে উড়ে যায়- -
মনে হয়- নদীর কল কল শব্দে পাপিয়ার গান মিশে
তোর ঐ সুন্দরটা রচিত হয়েছে...
--তবু মন ভরেনা জানিস্,
মনে হয়- কুসুমের সাথে জ্যোছনা মিশে তোর ঐটা রচিত হয়েছে- -
চাঁদের স্পর্শে যেমন সমুদ্র হাসে-
চন্দনের স্পর্শে যেমন মন্দির হাসে
তোর স্নিগ্ধতার স্পর্শে আমিও হাসি--
হাসতে হাসতে ইচ্ছে করে, ক্লান্ত নারীত্বটুকু তার হাতে তুলে দিই!
পারবি?--তোর অশ্রুর ভিতর পূজোর থালায় যে প্রদীপটা জ্বলে-
ওর উষ্ণতা দিয়ে আমায় একটু মুছে দিতে!
বলতে তো পারবো- আমার নিজের বলে কিছু আছে.....!
এই দেখ,---আমি শুধু নিজের ইচ্ছেটাই বলে গেলাম,
তোকে এখনও জিজ্ঞাসা করিনি--
তুই কেমন আছিস্।
আচ্ছা এবার বল্--কেমন আছিস্ তুই?
কেন তুই এখনো ঘর বাঁধিসনি?---কি-রে?--
কেন এখনো সংসার করিসনি্?
বুঝেছি,--আমার প্রতি তোর খুব ঘৃণা হচ্ছে বল্?
কিন্তু বিশ্বাস কর!
আমাকে অযত্নে--অনিয়মে ভেঙ্গতে চেয়েছিল---
আমি কারু ইচ্ছার বলি হয়নি বলে, তার চিহ্ন বুকের ও-পিঠে...
কি-রে,--সপ্তসুরের ভিতর--জ্যোছনা-চন্দন-কুমকুমে মোড়া---যে পবিত্রতাটুকু রেখেছিস্
আমাকে ওটা দিবি!---
যদি দিস্---তোর রামধনু আর আকাশগঙ্গার তীরে বসে
আমি ভাঙ্গতে চাই...
যদি নিয়ম করে মৃদু মৃদু করে ভাঙ্গিস্-- তোর বুকের আলোছায়ায় অঙ্গ রেখে-
ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে চাই...
ভেঙ্গে খানখান হয়ে যেতে চাই...
শুধু একবার কিশোর বয়সের দৃষ্টিতে চেয়ে দেখ--
আমি এখনও সেই পুতুল খেলা কিশোরীটির মতোই স্নিগ্ধা আছি...