google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re অণুগল্প : কৃষ্ণেন্দু পাল - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০

অণুগল্প : কৃষ্ণেন্দু পাল






।।গল্প হলেও সত্যি ।।




আজ ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল, ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল তিস্তা। তিনতলার এই ব্যালকনিটা থেকে এই আবাসনের অনেকটা দেখা যায়। চওড়া রাস্তা মাঝখানে, তার দুপাশে সারি দিয়ে কোম্পানির কোয়ার্টার্স বা ফ্ল্যাট, রাস্তার দুপাশে গাছের সারি , তার পরে দূরে ফুটবল গ্রাউন্ড দেখা যাচ্ছে, টেনিস কোর্ট, ভলিবল কোর্ট, তারপর কমপ্লেক্সের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে ছোটবড় পাহাড়ের উঁকিঝুঁকি। ঝাড়খণ্ডের রাজরাপ্পায় সি. সি. এল কলোনি, ছোট নিরিবিলি শহর । আসানসোল থেকে এখানে বিয়ের পর এসে উঠেছিল তিস্তা , তারপর কখন যেন ভালবেসে আপন করে নিয়েছিল শহরটা কে ও নিজেও জানেনা।

এখন ভোর পৌনে ছটা প্রায় , তিস্তা তাকিয়ে দেখল সুমিত্রাদি নীচে ঝাঁটা হাতে মন দিয়ে সামনের রাস্তা টা ঝাড়ু দিচ্ছে, শুকনো পাতাগুলো তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলছে। সুমিত্রাদিকে যত দেখে তত অবাক হয় তিস্তা , আজ বাদে কাল কলোনির সুইপার পোষ্ট থেকে অবসর নেবে ও , কিন্তু আজও কেমন নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজ করে যাচ্ছে । 'ও ..সুমিত্রা দি ' ডাকল তিস্তা ব্যালকনি থেকে , প্রথমে শুনতে পায়নি সুমিত্রাদি। আর একবার ডাকায় মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল সুমিত্রা, তারপর ফ্ল্যাটের নীচে এসে হাসি মুখে বলল "কেমন আছ বহু ? কোনো কাজ আছে তো বলো আভি , পাখানা বাথরুম সাফা কোরতে হবে কি?"

তিস্তা বলল "না না সব পরিষ্কার আছে ,দুদিন আগেই তো করলে।" তিস্তার মায়া পড়ে গেছে সুমিত্রাদির ওপর বলল "কাল রাতের রুটি আছে, খাবে ? চা করছি এসে নিয়ে যাও "
"কেন খাব না বহু, দাও, ওউর তো একদিন, কালহি তো হামার রিটায়ারমেন্ট আছে ।আর তো তুমার সাথে দেখা হোবে না।" বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোনা মুছল সুমিত্রা । সুমিত্রা দির ওপর তিস্তার মায়া অমূলক নয় , গত দশ বছরে একদিনও মানুষ টা কে ছুটি নিতে দেখেনি , যখন যা বলেছে হাসি মুখে করেছে , মুখে কোনো কথা নেই। তিস্তার অবাক লাগে এই দশ বছরে কোনোদিন সুমিত্রাদি কে জিজ্ঞেস করা হয়নি ওর বাড়ির কথা , কে আছে না আছে , শুধু জানে স্বামী অন- সাইট মারা যাওয়ায় নিরক্ষর সুমিত্রাদির কপালে এই সুইপারের চাকরিটি জুটেছিল। তিস্তা যখন যেমন পারে পুরোনো শাড়ি, খাবার এসব দেয় ওকে , হাসি মুখে নিয়ে যায় সুমিত্রা দি । আরও ভালো লাগে এই জন্য যে কোনো চাহিদা নেই এই মহিলার। এই সুমিত্রাদি কাল চলে যাবে ভাবতেই খারাপ লাগছিল তিস্তার।

গ্রুপ -ডি সুইপারের পোষ্ট হলেও অফিসের তরফ থেকে আবাসনের ক্লাবঘরে একটি ছোট্ট বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। লোকজন খুব কম , বেশিরভাগ ই অফিসের । তিস্তা একটা সাড়ে তিনশো টাকার ছাপা শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে বসে আছে , আজকের দিনে এইটুকু উপহার ঐ মানুষ টিকে দিতে চায়। প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে সুমিত্রাদি আজ একটা সাদা-নীল পাড়ের নতুন শাড়ি পরে এসেছে , তিস্তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল । মঞ্চের মাঝখানে সুমিত্রাদিকে বসানো হয়েছে জোর করে , 'সাহাব' দের পাশে চেয়ারে বসতে লজ্জা পাচ্ছিল সুমিত্রাদি। আশেপাশে অফিসের বড়বাবুরা। এক এক করে সবাই সুমিত্রাদির কর্তব্যনিষ্ঠার কথা বলে যাচ্ছেন, তিস্তা দেখছে সুমিত্রাদি চুপ করে মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে। তিস্তা ভেবে পাচ্ছিল না , কখন দেবে শাড়ি টা । সুমিত্রাদি কে অফিসের তরফ থেকে উপহার গুলি দেওয়া হচ্ছিল, সাকুল্যে পঞ্চাশ জন লোক বসে আছে। সুমিত্রাদিকে কিছু বলতে অনুরোধ করা হল বিদায়ের দিনে ।

আঁচলের কোনায় চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন সুমিত্রাদি , এই সময়ের হুটারের আওয়াজ করতে করতে তিনটি গাড়ি পর পর এসে দাঁড়াল ক্লাবঘরের দরজায়। সবাই অবাক হয়ে গেল , যখন প্রথম লাল বাতি লাগানো গাড়ি থেকে পুলিশ প্রোটেকশন এ নেমে এলেন সিওয়ানের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্র কুমার । তার পিছনের গাড়ি গুলি থেকে পর পর আরো দুজন সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি, গট গট করে তারা ক্লাবে ঢুকে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। কি হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না , কিন্তু সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং ডি.এম বলে কথা। ডি.এম মহেন্দ্র কুমার মঞ্চে উঠেই যেটা করলেন তা দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। এ কী করছেন উনি ? সামান্য সুইপারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম? তার পর যা হল যেন ভাষায় প্রকাশ করার অতীত। সুমিত্রা দেবী জড়িয়ে ধরলেন ডি.এম মহেন্দ্র কুমার কে , ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন । কেউ কিছু বুঝতে পারছে না! পরের আরো দুজন ব্যক্তি ও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরলেন সুমিত্রাকে । মাইক টা টেনে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ডি.এম মহেন্দ্র কুমার কথা বলা শুরু করলেন আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল সবাই ।

"হ্যাঁ , আপনাদের সুইপার দিদি সুমিত্রা দেবী আমাদের মা । আমি মহেন্দ্র কুমার , সিওয়ানের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ওনার ছোটো ছেলে, আমার মেজদা ধীরেন্দ্র কুমার হলেন একজন চিকিৎসক, আর আমার বড়দা বীরেন্দ্র কুমার একজন রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের বাবা মারা যাওয়ার পর মা ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে আমাদের পড়িয়েছেন । সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন পড়াশোনায় । বলতেন বেটা তোকে আমার সাহাবদের মতো বড়ো হতে হবে । আমরা কিন্তু মাকে নিরাশ করিনি , মায়ের কষ্টের দাম দিয়েছি আমরা , আজ আমরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা মাকে কতদিন বলেছি মা , আর এই কাজ কেন করছ তুমি ? মা উত্তর দিয়েছেন যে কাজ করে তোমাদের এতো বড়ো করেছি , আজ অবস্থা ভালো হওয়াতে সেই কাজ ছাড়ি কি করে ? এই কাজ মায়ের কাছে অনেক দামী আর প্রিয় । মার থেকে শিখেছি কোনো কাজই ছোটো নয় , সবারই এটা শিক্ষণীয়।"

তিস্তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল , হাতের শাড়িটা কে কোথায় লুকাবে ভেবে পাচ্ছিল না । সুমিত্রাদি কে তখন মাইকটা দেওয়া হয়েছে । কিছু বলতে পারছিলেন না , ত্রিশ বছর সুইপারের কাজ করা সুমিত্রাদি, অনেককষ্টে বললেন হাতজোড় করে , " সাহাব আমার ছেলেরাও তোমাদের মতো সাহাব ।" সবাই হাততালি দিয়ে উঠল ।

সুমিত্রাদি মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছে , তিস্তা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে । সবাই কে অবাক করে দিয়ে সুমিত্রা দি তিস্তার সামনে এসে দাঁড়াল , "এই বহু , আমার শাড়িটা দিবি না? " হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুমিত্রাদি , তিস্তা এই প্রথম জড়িয়ে ধরল সুমিত্রাদিকে , ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল , অনেকদিন পর মায়ের স্পর্শ পেল যেন।

=== সমাপ্ত ===

কৃষ্ণেন্দু পাল 
Hill View Park (South) 
                 Asansol  
                 PIN :713304 
                 West Burdwan
                 WB 
Phone no. 9832161689