নারীকে ঘিরে
এটা বললে নিশ্চয় বেশী বলা হবে না যে মানব প্রাণ সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে শরীর বা মনের দিক থেকে নারী দুর্বল ছিল। কিন্তু নারীকে নরের প্রয়োজন ছিল। আবার নরকেও নারীর। এই পারস্পরিক প্রয়োজন প্রাকৃতিক ভাবে বংশ প্রবাহকে রক্ষা করার খাতিরে। অর্থাৎ নর-নারীর পারস্পরিক প্রয়োজনবোধ অবশ্যই প্রাকৃতিক প্রয়োজনের নিরিখে। প্রকৃতি এই ব্যবস্থা করেছে প্রকৃতিকে নিজেকে রক্ষা করার তাগিদেই।
এছাড়াও আছে নারীর প্রতি নরের আবেগ আর আকর্ষণ। নর আর নারী এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন বা হৃদয়ের টান ঠিক কবে থেকে এসেছিল তা হয়ত বলা বেশ একটু শক্তই হবে। প্রথম দিকে হয়ত যৌনাবেগটাই প্রবল ছিল। আর এই তাড়নাতে নর নারীকে সর্বদা সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করত। হয়ত নারীকে সে কেবল তার সম্ভোগের বস্তু বলে ধরে নিত আর নিজের সম্পত্তির মত তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করত।
এই সুরক্ষার প্রয়াস অবশ্যই নিজের স্বার্থে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। একথা অবশ্যই অস্বীকার করার উপায় নেই যে যৌনতার আবেগ হল জগতের সবচেয়ে বড় আবেগ। অন্য সমস্ত আবেগকে হার মানিয়ে দেয় এই আবেগ। এই আবেগ যখন চরমে ওঠে তখন মানুষ পারিপার্শ্ব ভুলে যায়। ভুলে যায় সব যুক্তি তর্ক।
তাই এই আবেগ হল মানুষের আদিম আবেগ। এই আবেগ মানুষকে আচরণে এমন কী পোশাকেও করে তোলে সম্পূর্ণ আদিম। পৃথিবী যতই খাক পাকের পরে পাক, যতই তার ওপর পড়ুক সভ্যতার আবরণের পরে আবরণ, খুব সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মানুষ কিন্তু এই আবেগের কাছে নতি স্বীকার করবেই। কারণ যৌনতা জীবনের অতি স্বাভাবিক এক ক্রিয়াকর্ম। খাদ্য ও শ্বাসগ্রহণ আর মলমূত্র পরিত্যাগের মতই স্বাভাবিক ও নিয়মিত।
পুরুষ মানুষ তার শ্রেষ্ঠতম সম্পত্তির মত সুরক্ষিত করতে চাইত নারীকে। ধীরে ধীরে সে সৃষ্টি করতে লাগল নারীকে কেন্দ্র করে একটা সুরক্ষা বলয়। এই সুরক্ষা বলয় কোনও বস্তু দিয়ে গড়া নয়। নানা নিয়ম কানুনের নিগঢ়ে বাঁধা এই বলয় ভেদ করা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠল নারীর পক্ষে। বস্তুর বাধা অতিক্রম করা শারীরিক শক্তির কাজ। নিয়মের বাধা অতিক্রম করতে লাগে মনের শক্তি। এই দুই শক্তিই নারীদের প্রাকৃতিক ভাবেই কম। আসলে শারীরিক শক্তি কিন্তু মনের শক্তির থেকে অনেক কম হয়। সেজন্যে যুদ্ধের সময় প্রত্যেক পক্ষই গলাবাজি আর বৃথা আস্ফালন করে বিপক্ষের মনের শক্তিকে কমিয়ে দিতে চেষ্টা করে।
এইভাবে পুরুষ নিয়মের কঠিন থেকে কঠিনতর বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করে যেতেই লাগল। নানা ভয়ংকর কাল্পনিক পরিণতির কথা ভেবে নারী আর পরপুরুষের সঙ্গে মেশা তো দূরের কথা ঘরের চৌহদ্দির বাইরে যেতেও সাহস পেত না। এছাড়াও ছিল নানা আচার আর নানা প্রথার বাহুল্য যেগুলো একমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই মানা বাধ্যতামূলক ছিল।
সমাজ যতই এগিয়ে যাক, শিক্ষা আর সভ্যতার আলো যতই ছড়িয়ে পড়ুক, সেই আলো কিন্তু এসে পড়ত না সমাজের অন্দরমহলে। নারীর শিক্ষালাভ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ শিক্ষা লাভ করলে যুক্তি দিয়ে বাধা নিষেধের অর্থ জানতে চাইবে। মানতে চাইবে না বা প্রতিবাদ করবে।
পরিবারের ঘেরাটোপের বাইরে যাওয়া নারীর কাছে নিষিদ্ধ ছিল। নারীকে বোঝান হয়েছিল সে দুর্বল। আর তাই নিজেকে রক্ষায় তত পারঙ্গম নয়। পরিবার পুরুষ-প্রধান ছিল। পুরুষের নির্দেশই ছিল সব।
প্রথম দিকে উদ্দেশ্য যে মহৎ আর সৎ ছিল না তা বলা যায় না। এই নিষেধের বেড়াজাল ছিল যুক্তির সুতোয় বাঁধা। নারীদের পড়াশোনা করা বা জ্ঞানার্জনেও ছিল বিস্তর বাধা। তাই ঠিক আর ভুলের পার্থক্য নিরূপণ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ফলতই কয়েকটি মাত্র হাতে গোনা ব্যতিক্রম ছাড়া সমাজে পুরুষরাই এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। নারীরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একচুল এগোতে পারে নি তার থেকে। পর্দা শুধু মাত্র নারীর দরজা জানলাতেই নয়, মোটা পর্দার আড়ালে ঢাকা দেওয়া ছিল তার মন, মগজ আর ব্যক্তিত্ব। নারী মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও সে ছিল নিরুপায়।
ভোরবেলায় প্রথম যখন সূর্য ওঠে তার আগে চারপাশ বেশ অন্ধকার থাকে। সূর্য ওঠার পরে ধীরে ধীরে আলো বাড়তে থাকে আর অন্ধকার কমতে থাকে। মধ্যাহ্নে সূর্য যখন চলে আসে মাথার ওপর তখন ছায়া সবচেয়ে ছোট হয় আর সবচেয়ে বেশী জায়গা আলোকিত হয়। যত দিন যায় সমাজ সভ্যতার আলোকে বেশী করে উদ্ভাসিত হতে থাকে। শিক্ষা মানুষের মনে আরও বেশী করে আলোর জোগান দিতে থাকে।
শিক্ষা আর জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সমাজে সভ্যতা যত বেশী করে এগোতে থাকে, ততই এক শ্রেণীর মানুষ মানসিকতায় বেশী করে উন্নত হতে থাকে। সব মানুষের না হলেও কিছু মানুষের মনে মানবিক বোধ বাড়তে থাকে। আর তাঁরা এগিয়ে আসতে থাকেন সমাজ সংস্কারে। সমাজ সংস্কারের অর্থ সমাজের বুকে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা কুসংস্কারগুলোকে দূর করা। সে কাজ বড় সহজ নয়। সে কাজে এগিয়ে এলেন রামমোহন, বংকিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিক ও সমাজসেবী।
কুসংস্কার এক ধরণের নিরেট বিশ্বাস। এগুলো জগদ্দল পাথরের মত মানুষের মনে চেপে বসে থাকে। সংস্কার হয় যুক্তির নিরিখে। জ্ঞানের পরিধি যত বাড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে যুক্তির ধারও। কিন্তু কুসংস্কার গড়ে আর বেড়ে ওঠে অন্ধকার বিশ্বাসের স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে। এতে আবেগের আঠা থাকলেও থাকে না যুক্তির উত্তাপ। আগাছার মতই মনের জমির গভীরে শক্ত শেকড় গেড়ে ঢুকে বসে থাকে। অন্ধবিশ্বাস এতই কঠিন আবরণ সৃষ্টি করে মানুষের মনে যে সেই আবরণ ভেদ করে শিক্ষা আর জ্ঞানের আলো পর্যন্ত প্রবেশ করতেও পারে না ভাল করে।
সুতরাং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়। কুসংস্কারকে আগে কুসংস্কার এটা প্রমাণ করতে হয়। প্রচুর পরিমাণ জ্ঞান আহরণ না করলে সেটা সম্ভব নয়। আর কে না জানে প্রচলিত প্রথার অবসান ঘটাতে গেলে চারিদিক থেকে কত পরিমাণ বাধা আসা সম্ভব। একটা শক্ত আর মাটির গভীরে ঢুকে যাওয়া আগাছা তুলতে কী বিপুল পরিমাণ শারীরিক শক্তির প্রয়োজন সেটা যারা আগাছা পরিষ্কার করে তারা জানে। আর কুসংস্কারের আগাছা দূর করতে গেলে দরকার বিপুল পরিমাণ মানসিক শক্তি।
কুসংস্কার প্রসারের জন্যে অশিক্ষাই সর্বাগ্রে দায়ী। নারীরা অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকার ফলস্বরূপ তারা ডুবে ছিল কুসংস্কারের কুয়োতেও। নিজের মনের মধ্যে গড়ে উঠত না বিচার বিবেচনা। তাই কোনটা মানা উচিৎ আর কোনটা মানা উচিৎ নয় এ বিষয়ে তারা পুরুষের মতকেই প্রাধান্য দিত। বলা ভাল তারা প্রাধান্য দিতে বাধ্য হত। মহান ঈশ্বরচন্দ্র নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করালেন। তাঁর নারীশিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা ভীষণ ভাবে সফল হল। নারীদের অন্তরেও চেতনা এল। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ সেই বিচারের জ্ঞান তারা বেশ কিছুটা রপ্ত করতে পারল। তাতে কিন্তু সমাজের অবনতি ঘটে নি। ঘটেছে উন্নতিই। নারীরা এগিয়ে এসেছে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজের উন্নতিতে। এই বিষয়ে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি স্তম্ভ বিশেষ।
সেই বিপুল শক্তি ছিল রামমোহন, বংকিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখের। নাহলে রদ হত না সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহের মত কুপ্রথা। বিধবা বিবাহের মধ্যে দিয়ে প্রচলন হত না বাল্যবিধবাদের যন্ত্রণা অবসানের সুপ্রথা। একেবারে খাস অন্দরমহলের ভেতরের কথা, নারী হৃদয়ের নির্যাস টেনে এনেছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র। নারীর হয়ে তিনি বলেছেন অনেক কথা। নারীর কথা বলেছেন বংকিমচন্দ্র, বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আপামর নারীর উপলব্ধির জমিতে কলম নামাতে সমর্থ হয়েছেন শরৎচন্দ্র। তাঁর কলম নারীকে এঁকেছে কত সুন্দর, স্বাভাবিক আর সাবলীল ভঙ্গিমায়। তাছাড়াও তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী প্রভৃতি প্রোথিতযশা লেখক লেখিকারা নারীকে নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করতেন আর সেই সব চিন্তাভাবনার ফসল উঠে আসত তাঁদের কলমের ডগায়।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে কবি, সাহিত্যিক আর লেখকেরা কাব্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন নারীর দুঃখের কাহিনী, তাদের সমস্যা আর বাতলাতে চেয়েছেন সমাধানের পথ। সর্বদাই যে নারীরা দুঃখে থাকে বা লেখকেরা নারীদের দুঃখের ছবিই আঁকেন এটা ঠিক নয়। নারীরা সুন্দরী হয়, নারীরা গুণবতী হয়, নারীরা সুরসিকাও নয়। একটি নারী গোটা একটি সংসারকে ধরে রাখে। গাছ যেমন করে ফল, ফুল, ডালপালা আর পাতাকে ধরে রাখে ঠিক তেমন যত্নে। তাই স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বলতেন, একটি নারীকে শিক্ষিত করা মানেই হল একটি গোটা সংসারকে শিক্ষিত করা।
নারীকে সুরক্ষিত করা দরকার এই কথা অনেককে অসন্তুষ্ট করতে পারে। অনেকে এই কথাটা নিতে পারেন অন্য কোনও ভাবেও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়ে যাবে বংশধারা। এই বংশধারার প্রবাহে নারী এবং পুরুষের অবদান সমান সমান। কিন্তু নারীর অতিরিক্ত একটি মহান কাজ আছে। তা হল গর্ভস্থ সন্তানকে চল্লিশ সপ্তাহ ধরে নিজ জঠরে প্রতিপালন। নিজের পুষ্টি ভাগ করে পুষ্টি দিতে হয়, নিজের মধ্যে সুরক্ষা দিতে হয়, নিজের শ্বাসবায়ু ভাগ করে অক্সিজেন জোগাতে হয়। অর্থাৎ নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার অর্থ ভাবী জীবন ধারাকেই সুরক্ষিত করা। নারীকে রক্ষা করার ভাবনা বা ব্রত কিন্তু আজও বজায় আছে সমান ভাবে। তবে নারীকে কঠোর নিয়মে বেঁধে তাকে তাকে সুরক্ষা দেওয়া নয়, বরং নারীভোগীদের কঠোর আইনকানুনের বাঁধনে বেঁধে নারীকে সুরক্ষা দেওয়া।
নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টাকে কেবল মাত্র আক্ষরিক অর্থের মধ্যেই বেঁধে রাখলে চলবে না। এই সুরক্ষার আরও অনেক অর্থ আছে। এই সুরক্ষার অর্থ তার সম্মান, অধিকার আর মর্যাদাকে রক্ষা করা। নারীর সুরক্ষার অর্থ নারীকে সমাজের সব কাজে পুরুষের সঙ্গে এক প্রবাহে প্রবাহিত করার অধিকার দেওয়া। কোনও নারীই দুর্বল নয়। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, রণে কিংবা বনে অনায়াসে সে হেঁটে যেতে পারে পুরুষের পাশাপাশি—কখনও সহযোগী হয়ে আবার কখনও বা প্রতিযোগী হয়ে। তাকে নানা নিষেধের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার অর্থ সমাজকেই বেঁধে রাখার প্রয়াস। সুরক্ষার খাতিরে নারীকে যখনই আমরা বহন করতে চাইব নারীকে নারী তখনই নিজেকে পুরুষের বোঝা স্বরূপ জ্ঞান করবে আর আত্মগ্লানিতে ভুগবে। তাকে সুরক্ষার সবচেয়ে বড় পথ হল তাকে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করা।
এখন আমাদের সভ্যতার রথ অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। এটা অত্যন্ত সুখের কথা এই যে সভ্যতার এই উন্নত দিনে নারীও তার ক্ষমতা দেখাতে পারছে। শিক্ষাদীক্ষা, মনন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিল্প, কাব্য, সাহিত্য এমন কী মহাকাশ যাত্রায় পর্যন্ত নারী এগিয়ে চলেছে পুরুষের পাশাপাশি। এখনও কি আমরা নারীকে পাশে দিয়ে সমতালে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে চিন্তার কার্পণ্য দেখাব? সমাজের রথের চাকা মসৃণ ভাবে এগিয়ে যাক এখনও কি আমরা চাইব না?
=============================
DR. ARUN CHATTOPADHYAY
Mobile: 8017413028