এক সাধারণ মেয়ের জীবন যুদ্ধ
ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, মেয়েদের এটা করতে নেই। ওটা করতে নেই। গুরুজনেরকথা মেনে চলতে হয়। আর ও কত কি? মা বলতো, মেয়ে হয়েছ যখন অনেক কিছু ই সহ্য করতে হবে মা। গুরুজনের মুখে মুখে চপা করিস না। আমি ও তাই শুনতাম। মা যা বলত,তাই মানতাম। মাকে ও দেখে এসেছি ছোটো থেকে, কোনো দিন তর্ক করে নি। যৌথ পরিবারের ছোটো বউ আমার মা। জ্যাঠামশাইই হেড ওফ দ্যা ফেমিলি। তার কথায় শেষ কথা। সবার খাইয়ে তবেই খেতে বসতো মা। তাতে ও শান্তি নেই। সব কাজ একা ই সামলে আমাদের পড়াতে বসানো, বাড়ির সবার যত্ন নেওয়া সব করতে হতো।অথচ মায়ের কপালে জুটতো,হাঁড়ির তলায় পরে থাকা সামান্য ভাত আর তরকারি। কেউ খোঁজ ই নিত না খাওয়া হলো কিনা? আমার মা আমার আদর্শ।
মায়ের এই কষ্ট যন্ত্রনার প্রতিবাদী কন্যা হয়ে রুখে দাঁড়ালাম।
মাসের শেষে বাবার পুরো মাইনা তুলে দিত জ্যাঠুর হাতে। তা থেকে হাত খরচ বাবদ বাবার হাতে দিত। পূজায় আর জামা আনতে পারত না বাবা। বলত,তোর মামারা পাঠায় তো প্রতি বছর। মায়ের তর্ক করার অধিকার ছিল না। আমি যত দিন যায়,বুঝতে শিখি। এভাবে চুপচাপ সহ্য করলে, দিনদিন অত্যাচার বেড়ে যাবে।
মুখ তুলে বলে ছিলাম, সবার নতুন জামা,কাপড়। আমার আর আমার মায়ের জন্য কোথায় জ্যাঠু?
শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে বলেছিল,মুখে মুখে তর্ক করতে শিখিয়েছ ছোটো বৌমা? এ মেয়ে বড় হলে তাহলে কি হবে? ধরা কে সরা জ্ঞান করবে। মা একটু ধমক দিয়ে চুপ করতে বলতো।
মুখে যাই বলুক, জ্যাঠু সেদিন বুঝে ছিল, এ মেয়েকে দমিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের জন্য ও শাড়ি, জামা এনেছিল।
যাইহোক তারপর শুরু হলো আমার স্কুল জীবন। একটু দেরি হলে ই জ্যাঠুর ধমক। বাড়ির মান সম্মান বলে কি কিছু নেই। সব সময় শাসন আর হুকুম। আধঘন্টা হেঁটে যেতে হতো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছিলাম না। গার্লস স্কুলের প্রথম হতাম। সেই নিয়ে ও মজা করতে বাকি থাকল না। মেয়েদের স্কুলে প্রথম মানে ই তো ছেলেদের স্কুলের ২০ জনের পরে নাম। এ মেয়ে ফাস্ট ক্লাস পাবে বলে মনে হয় না।
এত তাচ্ছিল্য! আমার মনে জেদ চেপে গেল। পারতে ই হবে। মেয়ে বলে কি এত টা অবহেলা? দিন রাত পরিশ্রম করে প্রথম বিভাগে যথেষ্ট ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করি। তখন প্রথম বিভাগে পাশ করাটাই কষ্টের।
আমার রেজাল্ট দেখে পাড়া শুদ্ধ লোক, এমনকি জ্যাঠু ও মনে মনে মেনে ছিল,এমেয়ে সাধারণ নয়।
কিন্তু তারপর কি হবে? উচ্চমাধ্যমিক পড়তে যেতে হবে ২ঘন্টার পথ। পায়ে হেঁটে, তারপর অটো, বাস চেপে যেতে হবে দূরের স্কুলে। আবার আপত্তি।মেয়েছেলে একা একা এত দূর যাবে স্কুলে? বাবাকে জানিয়ে দিল জ্যাঠু,আর পড়তে হবে না। ভালো ছেলে দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করে দে।
সাইকেল চড়া শিখেছিলাম, হাঁটা পথ সাইকেলে যাবো বলে। স্কুলে যাওয়াটা ই অনিশ্চিত যার,তার কপালে কি সাইকেল জোটে? আবার প্রতিবাদ। আমি পড়ব। যে ভাবেই হোক পড়া ছাড়ব না। জেদ চেপে গেল। আমি পড়ব ই।
বাবা,জ্যাঠামশাইকে বুঝিয়ে রাজী করাল। ভালো স্কুলে ভর্তি হলা। শুরু হলো পথ চলা। যে মেয়েটা এত দিন সীমাবদ্ধ গন্ডীর ভেতর ছিল,আজ থেকে শহরে একাকেই যেতে হবে স্কুল।
কোনো রকম মুখে কিছু গুজে শাড়ি পরে দু দিকে বেনি করে যেতে হবে স্কুলে। প্রথম প্রথম শাড়ি পরে গাড়ি উঠতে ই ভয় পেতাম। শক্ত করে আঁচল টা বেঁধে নিতাম কোমরে। সময় মতো পৌঁছাতে না পারলে স্কুলের বাইরে আধ ঘন্টা শাস্তির ব্যবস্থা।
একপ্রকার ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যেতাম স্কুলে।
মাঠের পথ। গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা। দুধারে তাল খিরিশ বাবলার লাইন। একদিকে খাল অন্য দিকে সবুজ মাঠ। সেই অপরূপ গাঁয়ের মেঠো পথ ধরেই আমার স্কুলের রাস্তা। গা ছমছম করত।একা ফিরতে। তবু ক্রমশ এই পথ ও আমার ভালো বন্ধু হয়ে গেল। পথের ধারে থাকা নিত্য পশু পাখিদের সাথে ভাব জমে গিয়েছিল।
তবু একদিন এই পথ অচেনা হয়ে গেল। ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা।
এমনই এক দিন মেঘলা দিনে ফিরছি। বিদ্যুৎ এর ছলকানি। টিপটিপ বৃষ্টি। ব্জ্রাঘাতের পর বজ্রাঘাত। জোরে আরও জোরে পা চালালাম। মনে হলো কেউ একজন পিছু নিয়েছে। পায়ের শব্দে তরতরিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল।হঠাৎ
পিছন দিক থেকে চেপে ধরল। নোংরা হাতের স্পর্শে সারা শরীর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ঠিক তখনই চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে উঠল।কোথা থেকে এত শক্তি পেলাম। জানি না। সর্ব শক্তি দিয়ে দু'হাতে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিলাম। মাথায় ছিল কাঁটা ক্লিপ। খুলে নিয়ে গেঁথে দিলাম ওর মুখে। হাতে ছিল ছাতা। তাই দিয়ে ই উত্তম মধ্যম। দৌড়ে পালিয়ে গেল পিছন দিকে। ক্লান্ত শরীরে গ্রামের কাছাকাছির এসে যখন পৌছালাম, শুনতে পেলাম মাইকে সেই সুর। ইয়াদেবী সর্ব ভূতেসু ----। আসছে মহালয়া। বুঝলাম পূজা আসছে। তার ই আগমনী বার্তা।
এমনি করে ই লড়তে লড়তে ভালোভাবে পাশ করলাম উচ্চমাধ্যমিক, তারপর ট্রিচার্স ট্রেনিং । আবার পড়া বি এ ভর্তি হলাম। পড়াটা আমাকে শেষ করতেই হবে। কিছুদিনের মধ্যে বাবা অসুস্থ হয়ে পরল।ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলাম।
একদিন কলেজ থেকে ফিরছি। বাড়ি ভর্তি লোক। জানতে পারলাম আমার দেখাশোনা। মাথাটা গরম হয়ে গেল। মা বুঝিয়ে শান্ত করল। দেখলে ই কি আর বিয়ে হচ্ছে। একটু বস না মা। বাড়িতে এসেছে অতিথি। নইলে তোর জ্যাঠু যে রাগ করবে। তোর বাবা অসুস্থ। এ নিয়ে আর অশান্তি করিস না।
বসলাম। ইন্টারভিউ দিতে। গাদা গাদা প্রশ্ন। যেন পাকাপোক্ত চাকরির ব্যবস্থা।
কিন্তু যখন ই বলল,বিয়ের পর আর পড়া যাবে না। বাড়ির বউকে চাকরি করতে দেওয়া হয় না। তখন ই আমার প্রতিবাদী মন আবার গর্জে উঠল।
স্বনীর্ভর হতে হবে।স্বাবলম্বী হতে ই হবে। মুখের ওপর জবাব এ বিয়ে মানব না।
বাড়িসুদ্ধ লোক অসন্তুষ্ট। না, আর পিছু ফিরে তাকাব না।
দিন দিন বাবার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চলেছে। আমি তখন ফাস্ট ইয়ার সবে। কলেজ করে বাবাকে দেখে ফিরতে আরও রাত। পড়ায় মন বসত না। বাবা জানতো,আমি অসুখ শুনে ভয় পাবো। কোনো দিন ও বলত না, আমি ভালো নেই। সব সময় বলত, তুই পড়ায় মন দে। আমি ভালো আছি। তোর পাশে আছি। তোকে দিদিমনি হতে ই হবে।সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাতো,আমার মেয়ে দিদিমনি হবে। ও আমার গর্ব। হ্যাঁ, আজ আমি স্কুলের দিদিমনি। কিন্তু বাবার আর দেখে যাওয়া হলো না।
এক নিষ্ঠুর ভাগ্য লিখন। তখনও পড়ছি ফাস্ট ইয়ার। আমার দাদু মারা গেল যে শুক্রবার হার্ট এটার্ক করে, ঠিক তার তিন দিন পর মা যখন দাদুর কাজ করতে ব্যস্ত বাড়িতে। সেদিন ই পুলিশ খবর নিয়ে এলো, বাবা আর নেই।
আমার মা আর দিদিমা এক সাথে সাদা থানে ঢেকে গেল। মামা-ভাগ্নের এক সাথে কাছা কাপড় নিয়ে শ্রাদ্ধের কাজ করতে হলো। একে ই বলে বিধাতার নিষ্ঠুর নিয়ম।
আমার ভাই এর তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে।
নিজেকে শক্ত করলাম। বাজার করা, ভাইকে শান্ত রাখা, মাকে ভালো রাখা,সবটাই আমার ঘাড়ে।
নিজের আর কাঁদার সময় ছিল না। বাথরুম টা ই বেছে নিয়েছিলাম নিরাপদে একটু কান্নার। বাবার আশির্বাদ নিয়ে ই আবার এক যুদ্ধ।
এম এ পড়া আর হলো না। বি এ পাশ করে, ভায়ের পড়ার ব্যবস্থা করে দিলাম। তখনও সরকারি চাকরি পাই নি। তাই কিছু অর্থের জন্য নিজে একটা প্রাইভেট স্কুলে যোগ দিলাম।সঙ্গে টিউশন করে ফিরতে রাত হতো। সংসার টা চালাতে হবে।
তারপর ও শুরু হলো পাড়া প্রতিবেশির গঞ্জনা। এত বড় মেয়ে, পাড়া গাঁয়ে থাকলে যা শুনতে হয় আর কি। কেন বিয়ে দিচ্ছে না? একটু রাত করে বাড়ি ফিরলে ই কানাকানি শুরু হয়ে যেত। এ মেয়ে নিশ্চয় কারো প্রেমে মজেছে।
এক কান দিয়ে ঢোকাতাম। আর এক কান দিয়ে বের করে দিতাম।তবু মায়ের মন তো। চিন্তায় ভেঙে পরল।
বাধ্য হয়ে ই মাস্টারি পাওয়ার আগে ই বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হলো।
অবশ্য তারপর দিদিমনি হলাম।আমার পরিবার ও আপন করে নিল।
এখন আমি পরিপূর্ণ সংসারী নারী। যদিও অসাধারণ হতে পারিনি। তবু লড়াই আজ ও চলছে।এ লড়াই চলবে। আমার স্বপ্ন পূরণের লড়াই। এখন লড়াই সাহিত্যের জন্য। আমার লেখা আমার প্রাণ।
স্কুল বাড়ি সামলে সংসার ছেলেমেয়ের দেখা শোনা করে যে টুকু সময় পাই। সব দিক সামলে তবে ই একটু নিজের জন্য সময় পাই। তাতেও পদে পদে বাধা। মনের তাগিদে লিখি। এ লেখা আমার ভালোবাসা। এখানে ও আপত্তি। বাড়ির মেয়ে বউ নাকি এভাবে একা একা বাইরে গেলে বাড়ির নাকি সম্মান চলে যাবে। সাহিত্যচর্চা করবে বাড়ির বউ? অনেক রাত জেগে লিখতে হয়। শুনতে হয় গঞ্জনা, অপবাদ। কলঙ্কিত করা কি এত ই সহজ। যত ই ঝড় আসুক কলম চলবে। একটা মেয়ে থেকে নারী হয়েছি। সাধারণ কি অসাধারণ জানি না। তবে লেখিকা হবার স্বপ্নটা আমাকে প্রকৃত নারী করে তুলেছে। যাই ঘটে যাক। লেখা আমি ছাড়ব না। একজন সাধারণ মেয়ে থেকে প্রতিবাদী নারী হয়ে উঠতে এ লড়াই চলবে সারাজীবন।
এ,লড়াই আর থামবে না। আমি নারী,সাহিত্য আমার প্রেম।
আমাকে পারতে ই হবে। জীবন যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। এভাবে ই হয়ে উঠব প্রকৃত নারী।
আমি এক সাধারণ নারী।
===০০===
অঞ্জনা গোড়িয়া
গ্রাম- ভগবানপুর