আমি গর্বিত আমি তোমার অংশজাত, তুমি আমার 'মা',
তোমার স্নেহ-সুধায় সিঞ্চিত আমি, লালিত-পালিত করেছে তোমার জল-হাওয়া।
আমি গর্বিত আমার প্রথম হৃদয়মথিত শব্দ তুমি, আমার প্রাণের সেই ভাষা- যে ভাষা উচ্চারণে আজও শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা উজ্জীবিত হয়,
রক্তপ্রবাহের বেগ শত গুণ বৃদ্ধি পায়,
ক্ষিপ্র তেজে উড্ডীয়মান হয় বুকের বাম দিকের অলিন্দ-নিলয়।
আমি গর্বিত তুমি আমার মাতৃভাষা,
আমার আবেশ-আবেগ-আদর-সোহাগ- সবটা জুড়ে রয়েছে যার প্রথম ছোঁয়া।
আজও
একুশের প্রথম প্রভাতে উদিত সূর্যের অরুণ আলোয় প্রতিটি বাঙালির বুকে ধ্বনিত হয় সেই কালজয়ী মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী-
যা শুধুমাত্র গণঅভ্যুত্থান নয়, কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও নয়,
এ আমাদের ভাষার স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীন চেতনার অভ্যুত্থান,
যার তরে হারিয়েছি না জানি কত অরুণ বরুণ তরুণ সালাম-রফিক-বরকত এর প্রাণ।
'যা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'
আজও যা ইতিহাসের ফল্গুধারায় স্বমহিমায় প্রবাহী।
যেথায় রয়েছে অগণিত মানুষের বিজন অশ্রুবিন্দু, উৎপীড়নের হাহাকার
রয়েছে সেই বুটের হাড়-কাঁপানো ধ্বনি, চাবুকের ত্রাস
রয়েছে শতাব্দী কাঁপানো উল্লাস।
আমি গর্বিত সেই জাতি হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র যারা মায়ের মুখের ভাষার তরে সংগ্রামে অবতীর্ণ,
ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেমেছে রাজপথে,
অবলীলায় শহীদ হয়েছে মাতৃভাষার জন্য।
আমি গর্বিত সেই মাতৃভাষার তরে-
যে ভাষার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ,
পদাবলীর সুরে চন্ডীদাস,
উদ্ধত বিদ্রোহে আছেন কাজী নজরুল,
কখনো পল্লীর পথে-প্রান্তরে জসীমউদ্দীন জীবনানন্দ দাশ।
আমি গর্বিত সেই ভাষা উচ্চারণে, যে ভাষা আমার সত্ত্বা, আমার জাগরন, আমার প্রেম-প্রীতি, আমার লজ্জার আবরণ।
আমার শৈশবের প্রথম 'মা' ডাক, আমার আদর আবদার,
কৈশোরের চাঞ্চল্য, যৌবনের প্রথম প্রেমের পরশ কিংবা রঙিন স্বপ্নের পাহাড়।
তোমার সুরে আজও পল্লীগ্রামের লালমাটির পথে উদাস বাউলের একতারা বাজে-
উদার গৈরিক মাঠে সোনার ধান হাসে, বাতাসে প্রাণের সুর ভাসে
আজও তুমি চাষির হিম্মত, আধপেটা খেয়েও হাল ধরে নবান্নের আশে।
আজও এ-ভাষায় সুজন মাঝি গান গেয়ে দাঁড় টানে গঙ্গা-পদ্মার মাঝে।
তুমি শিকড়ের টান, মিলন-সংহতির ঐকতান, কখনো ঐতিহ্যের মেলবন্ধন,
তুমি কখনো কান্নার ভাষা, সংগঠনের উদাত্ত স্লোগান, কখনো বা তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন।
তুমি কখনো তপ্ত গ্রীষ্মে তৃষ্ণার জল, আবার কখনো মেঠোপথে অর্ধনগ্ন শৈশবের কোলাহল
আমি গর্বিত তোমায় কন্ঠে ধারণে।
তুমি সহজপাঠ, নকশী কাঁথার মাঠ, কখনও বা মনীষীর বাণী,
আবার কখনো সন্ধ্যার উঠানে ঝিঁ ঝিঁ র সুরের মাঝে- ঠাকুমার সজল চোখে একাত্তরের কাহিনী।
তুমি বুকের সুগভীর সেই প্রথম প্রেম, বসন্ত বিকেলে দখিনা বাতাসের সুখ-বিলাসী টানে-
প্রথম 'ভালোবাসি' বলেছি যে গানে,
তুমি কবির গান গল্প কবিতার ভাষা,
সৃষ্টির পাতায় চুঁইয়ে পড়া হাজার শব্দের আঁতুড়ঘর,
মনুষ্যত্বের প্রথম দীক্ষা যে ভাষার উচ্চারণে।
তাইতো সহস্র বছর ধরে, সহস্র বছর পরে, আজও তুমি একই রকম...
একমেব অদ্বিতীয়ম্
তোমারে প্রণাম, তোমারে প্রণাম।
---------------
নাম - মৈত্রেয়ী ঘোষ
ঠিকানা- বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, ৭৪২১০১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন