Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

একুশে ফেব্রুয়ারি : মাতৃভাষার জন্য এক আপোষহীন সংগ্রামের স্বীকৃতি ।। প্রণব কুমার চক্রবর্তী






          একুশে ফেব্রুয়ারির কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে যায় - ভাষার জন্য একটি বিশেষ জাতির এক সংগ্রামের কথা । সেই সংগ্রাম হলোএক আবেগপ্রবণ , আপোষহীন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ! মাতৃভাষায় কথা বলা , ইস্কুল-কলেজে পড়াশুনা করা , অফিস-কাছারিতে কাজ করার ভাষার চিরায়ত অধিকারকে বজায় রেখে , তাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য আন্দোলন । স্থানীয় ভাবে জেগে ওঠা সেদিনের সেই আন্দোলন শেষপর্যন্ত দেশের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি , ছড়িয়ে পড়েছিল - বিশ্বের আঙিনায় । লাভ করেছিল আন্তজার্তিক স্বীকৃতি । আজ সেই একুশে ফেব্রুয়ারির পূণ্যলগ্নে আমরা একবার সেই মাতৃভাষা এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়ার চেষ্টা করবো ।
          সত্যি কথা বলতে - ভাষা সম্পর্কে কোনও সুষ্পষ্ট এবং অপরিবর্তিত সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত কোত্থাও লিপিবদ্ধ হয়েছে কিনা , আমার অন্তত জানা নেই । তবে , কাজ চালাবার মতো সংজ্ঞা হিসেবে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড: সুনীতি চট্টোপাধ্যায় , ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , ড: সুকুমার সেন প্রমুখের প্রদত্ত ভাষা সংক্রান্ত সংজ্ঞাগুলো একত্র করে বলা যেতেই পারে -" ভাষা হলো মানুষের মস্তিষ্ক জাত একটি মানবিক ক্ষমতা বা অর্থবাহী বাক্য সংকেত ( রূপায়িত ধ্বনি কিংবা লেখার আকরে ) রূপায়িত হয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে" । অর্থাৎ , ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের একটা অপরিহার্য্য বাহন । এটি প্রকৃতপক্ষে একটি সামাজিক সৃষ্টি এবং মানবিক আবিষ্কার , যা কিনা গোটা সমাজের অবচেতন মনের উদ্ভাবন ঘটাতে সক্ষম । প্রকৃতিগত ভাবেই মানুষ মানেই আবেগ , বিবেক এবং জ্ঞান - সম্পন্ন একটি প্রাণী । সে তার মনের ইচ্ছে , আকাঙ্খা এবং ভাব অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্য কোনও জীব জন্তুর থেকে অধিক সক্ষম , এবং সবকিছুর সে ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করে ।
          দেশ - বিদেশের বহু ভাষা বিজ্ঞানী , সমাজ বিজ্ঞানী এবং ভাষাবিদ বিভিন্ন দিক থেকে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে টুকরো টুকরো করে ভাষার সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন । সেগুলো সব একত্র করলে দাঁড়ায় - " ভাষা হলো সামাজিক ভাবে কাঠামোবদ্ধ একটি পদ্ধতি , .... অর্থবহ শব্দের ধরন , কথা এবং বাক্য থাকে । .... সাংস্কৃতিক উপাদানের একটি প্রতীক এবং শব্দ অর্থের একটি বিমূর্ত ব্যবস্থা , .... 
মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোনও একটি বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত , স্বতন্ত্র ভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টি ।.... মনুষ্য জাতি যে ধ্বনির দ্বারা বা ধ্বনির সমষ্টি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করে , সেটাই তার কাছে ভাষা ।
          ভাষার মতোই মাতৃভাষার ও কোনরকম পরিষ্কার সংজ্ঞা কোথাও লেখা নেই । শুধুমাত্র বলা আছে যে , মানুষ জন্মের পরে তার পিতা - মাতার বা আত্মীয়ের কাছে থেকে যে ভাষা শেখে , যে ভাষায় কথা বলতে সে সবথেকে পারদর্শী হয় , সেই ভাষাটিকেই সাধারণত তার মাতৃভাষা বলে । সুতরাং , মায়ের মুখের ভাষাই হলো একটি শিশুর কাছে তার মাতৃভাষা । সেটি তার ব্যক্তিগত , সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ ।  মাতৃভাষা একটি মানুষের কাছে সফলভাবে কথা বলা এবং কাজ করার সামাজিক ধরণটাকে প্রতিফলন ঘটাতে সাহায্য করে । অর্থাৎ , মানুষের মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো তার মাতৃভাষা । মানুষ তার ভাব , কল্পনা ,স্বপ্ন , চিন্তা , মনোভাব , ইত্যাদি নিজের মাতৃভাষায় যতটা সাবলীল এবং স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে , অন্য ভাষায় সেটা করতে পারে না ।
          ভাষার আবিষ্কার যে কবে হয়েছে সে সম্পর্কেও আজ পর্যন্ত কোনও সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও অনুমান করা হয়ে থাকে, মানব সভ্যতার ভিৎ গড়ার আগে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগেই ভাষার সূত্রপাত ঘটেছিলো । " আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম কথা বলতে শিখেছিল  তার সন্ধান করার জন্য ভাষা প্রেমিক মাইকেল রোজেন একটি দলকে নিয়ে সেটাই অনুসন্ধান করে দেখছেন । নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাগি টলারম্যানের মতে - পৃথিবীতে একমাত্র মানুষেরই ভাষা আছে ,... এবং কেমব্রিজের বিশিষ্ট নৃ বিজ্ঞানী রবার্ট কেলির মতে পৃথিবীতে যতো জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে - ভাষাই হলো তার মধ্যে সব থেকে কঠিন এবং জটিল । সম্প্রতি জীব বিজ্ঞানের বিবর্তনবাদের তত্ব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে , আমরা সবাই এসেছি আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে থেকে , .... মানুষের প্রাপ্ত জীবাশ্ম থেকে বৈজ্ঞানিকরা অনুসন্ধান করে জানাচ্ছেন যে , কথা হচ্ছে এক ধরনের শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া । এটা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই আমরা শব্দ তৈরি করে থাকি ।  জিন বিজ্ঞানীদের মতে - ভাষা প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিলো আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বছ আগে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষ হোমো-ইরেকটাশ এবং নিয়েন্ডার্থল গোষ্ঠীর দ্বারা । ....
          এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যে কত ভাষা জন্ম আর কত ভাষাই হারিয়ে গিয়েছে , তার হিসেব সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয় । ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট - "এ্যানালোগের" ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে ৪৬টি বর্ণমালা সহ প্রায় ৭১২২টি ভাষা জীবিত আছে , এবং প্রায় ২৫০০টি ভাষার রয়েছে লিখিত প্রক্রিয়া । পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশী মানুষ ( ৭৬০০ মিলিয়নের মধ্যে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন মানুষ ) মাত্র ২৩টি ভাষা ব্যয়ভার করে । এ পর্যন্ত পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা হারিয়ে গেছে সঠিক ভাবে বলা না গেলেও , বৃহত্তর সংস্কৃতি , বিশ্বায়নের কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্বচ্ছলতার করবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক সামাজিক ভাবে দুর্বল মানব গোষ্ঠীই তাদের শিল্প , সংস্কৃতি এবং ভাষাকে হারিয়ে ফেলেছে । এছাড়াও , ভাষা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ - স্বৈরাচারী শাসক কিংবা বৃহৎ শক্তিশালী গোষ্ঠীর ভাষা আগ্রাসন নীতি এবং কার্যকলাপ ।
          ইউনেস্কোর মতে - এই শতাব্দীতেই পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষাগুলোর একটা বিরাট অংশ ( প্রায় ২৫০০টি ভাষার ) অস্তিত্ব বিভিন্ন কারনে লুপ্ত হয়ে যাবে । আমাদের ভারতেই নাকি এইরকম প্রায় ১৯৭টি উপভাষা আছে !
          এক একটি ভাষা / উপভাষা এক একটি জনসমাজে ব্যবহৃত হয় । সেইসব ভাষাকে ঘিরেই এক একটা জাতির জাতিসত্ত্বা যেমন গড়ে উঠে , তেমনি বিকশিত , বিস্তারিত এবং প্রয়োজনে বিস্ফোরিত ও হয় । প্রত্যেক জাতির কাছে তার নিজস্ব ভাষার  একটা আবেগ এবং আত্মসম্মান জড়িয়ে থাকে । সেই ভাষা যখন বিপন্ন বা আক্রান্ত হয় , আগ্রাসনের মুখে পড়ে , আক্রান্তরা কিছুতেই আক্রন্তকরি কিংবা আগ্রাসনকারীকে সহ্য করতে পারে না । সেই আগ্রাসনের / আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ / প্রতিরোধ গড়ে তোলে । প্রয়োজনে তারা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতেও পিছু পা হয়না । আসলে , ভাষা হচ্ছে - জাতির প্রাণ , যা না থাকলে একটা জাতির মৃত্যু ঘটে । অবলুপ্ত হয়ে যায় একটা জাতির ইতিহাস , সভ্যতা , ঐতিহ্য , সাহিত্য এবং সংস্কৃতি । 
          এটা সত্য যে , বেশির ভাগ অত্যাচারী এবং স্বৈরাচারী শাসকদের একটা প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য - সংখ্যালঘু , দুর্বল এবং অধীনস্থ সমস্ত জাতিকে আগ্রাসন করা / আক্রমণ করা । কখনও সেই আগ্রাসনের / আক্রমণের চরিত্র হয় প্রবল
হিংসাত্মক এবং রক্তক্ষয়ী । আবার কখনও সেটা হয় ঠাণ্ডা মাথায় - অহিংস ভাবে , বিনা রক্তক্ষয় সূক্ষ্ম মগজ ধোলাই করে !
          ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে , সেই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হয় ভাষা , নাহয় ভাষার জন্য বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে । চীনের ঔপনিবেশিক রাজ্য তাইওয়ানের আদি বাসিন্দারা - হকোলো এবং হাক্কারা তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা মিন্নান , হাক্কা , অষ্ট্র-এশিয়ান , ইত্যাদিতে কথা বলতো । প্রায় শতাবদীকাল ধরে জাপানী ভাষা এবং চীনের মান্দারিন ভাষার ভাষা আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল । প্রথমে জাপানিদের এবং পরে চীনাদের হাতে । শেষপর্যন্ত বহু আত্মত্যাগ এবং প্রাণের বিনিময়ে ১৯৮০ সালে তাইওয়ান স্ববিনতা লাভ করলে ওখানকার মান্দারিন ভাষা আগ্রাসন বন্ধ হয়েছিলো । আমেরিকাতেও ওই একই ব্যাপার লক্ষ্য করা গিয়েছিল ।  ওখানে বহুকাল ব্যাপী নেটিভ আমেরিকান ভাষা নতুন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকর আগ্রাসনের শিকার হয়ে উঠেছিল । আমেরিকার নেটিভরা বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে সেই ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলো । বিশ বছরের লম্বা সেই ভাষা আন্দোলন ৩০শে অক্টোবর জয়লাভ করেছিলো এবং আমেরিকার নেটিভদের ভাষা আইনী স্বীকৃতি লাভ করেছিলো । কানাডার কুইবেক প্রদেশের আদিবাসীরা কুইবেক ভাষার প্রতি সেখানকার সরকারের ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বেশ জোরদার আন্দোলন সংগঠিত করেছিলো । ওই আন্দোলন চলাকালীন একসময় প্রশ্নও উঠেছিলো যে , কুইবেক প্রদেশে বসবাস কারীরা কানাডা থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে । শেষপর্যন্ত তাদের ওই দাবির সমর্থনে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিলো , এবং সেই গণভোট  কুইবেক আন্দোলনকারীরা পরাজিত হলে - ওই ভাষা আন্দোলন আস্তে আস্তে স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল । অনুরূপভাবে - দক্ষিণ আফ্রিকা , লাতভিয়া , বেলজিয়াম , বলিভিয়া , সার্বিয়া , ইত্যাদি দেশেও ভাষা আন্দোলন বেশ জোরদার ভাবে সংগঠিত হয়েছিলো ।
          দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা ( জুলু ভাষার ) আন্দোলনটা  ( রক্তাক্ত ১৬ ই জুন ) ছিলো আরও মারাত্মক , আরও রক্তাক্ত ! প্রচুর ছাত্রের - সরকারি মতে সংখ্যাটা ১৭৬ আর বেসরকারি মতে প্রায় ৭০০ জন ছাত্রের রক্তাক্ত মৃতদেহের স্তূপে দক্ষিণ আফ্রিযায় এসেছিলো জুলু ভাষার সরকারি অধিকার ।
          আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখা গিয়েছে । যেমন , তামিলনাড়ুর তামিল ভাষায় আন্দোলন , অন্ধ্রের তেলেগু ভাষা আন্দোলন , গোয়ার কংকাই ভাষা আন্দোলন , উড়িষ্যার কলাসি আর ওড়িয়া ভাষা আন্দোলন , কর্ণাটকের কন্নর ভাষা আন্দোলন , মনিপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরী ভাষা আন্দোলন , মিযো - খাসিয়া-নাগাল্যান্ড - ত্রিপুরা র ভাষা আন্দোলন , ইত্যাদি । এর পরেও রয়েছে আসামর বরাক উপত্যকার ১৮৬১ সালের এবং ঝাড়খণ্ডের মানভূমের ১৯৫৬ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন ।
এছাড়াও আমাদের কাছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ( বর্তমান বাংলাদেশের ) ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঢাকার রাজপথে ছাত্র এবং যুবকদের বুকের রক্তে লেখা বাংলা ভাষা আন্দোলন ।
          আজকের দিনে মাতৃভাষা দিবস বলতে আমরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ওপার বাংলার সেই ( মাতৃভাষা আন্দোলনকে ) বাংলা ভাষা আন্দোলনকে বুঝে থাকি , এবং আলোচনাও শুরু করি ঢাকার রাজপথে সেই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসকে নিয়ে । পাকিস্তানের সৈরাচারী সরকার সেই আন্দোলনে দমন করার জন্য ছাত্র যুবকদের উপরে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল । আমরা প্রতি বছরই অন্তর থেকে তর্পণ করি সেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের - রফিকউদ্দিন আহমেদ , আবুল বরকত , আব্দুল জব্বার , শফিউর রহমান , আব্দুল আলোয়াল , প্রমুখের )।
একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে , বিশ্বের প্রতিটা বাঙালির কাছে এই একুশে ফেব্রুয়ারি যেন একমাত্র মাতৃভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি পেয়েছে । এটাও সত্যি যে , ১৮৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনই একদিন যেমন পাকিস্তানের সৈরাচারী
তানাশহী সরকারকে বাধ্য করেছিলো - পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি মেনে নিয়ে বাংলা ভাষাকে ওই দেশের ( পাকিস্তানের ) রাষ্ট্রভাষা উর্দু ভাষার সাথে সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে , তেমনি পেরেছিলো ১৯৮৫ এবং ২০০০ সালে যথাক্রমে ইউনেস্কো এবং বিশ্বের রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে ।
          এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললে বোধ হয় খুবই অন্যায় করা হবে যে , বাংলা ভাষা শহীদদের  স্মরণের কথা উঠলেই আমরা কেনো যেন শুধুমাত্র ওপার বাংলার ভাষা শহীদদের নিয়েই টানা - হেঁচড়া করে থাকি ! ভুলে যাই এপারের এক রক্তাক্ত বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা - আসামের বরাক উপত্যকার সেই ১৯৬১ সালের উনিশে মের বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা ! বাংলাদেশের মতোই এই আন্দোলনেরও মূল দাবি ছিল - শুধুমাত্র অসমীয়া ভাষাই নয় ,বাংলা ভাষাকে রাজ্যের সহকারি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে ! বাংলা ভাষায় অধিকার রক্ষায় সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন ১৪ জন শহীদ । যেমন - কানাইলাল নিয়োগী , চণ্ডীধর সূত্রধর , সত্যেন্দ্র কুমার দেব , কুমুদরঞ্জন দাস , তরণী দেবনাথ , বীরেন্দ্র দেবনাথ , সুকোমল পুরকায়স্থ ,কমলা ভট্টাচার্য্য , হিতেশ বিশ্বাস ,শচীন্দ্রচন্দ্র পাল , জগন্ময় দেব , দিব্যেন্দু দাস , প্রমুখ ।
          ১৯৬১ সালের বরাক উপত্যকার সেই বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিলো - একটি রাজ্যের একটি বিশেষ অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আন্দোলন । আঞ্চলিক ভাষা আন্দোলনের চরিত্র । কিন্তু , ওপার বাংলার ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিলো - একটি জাতির - বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীর  মাতৃভাষার  উপরে উর্দু ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন । ওটা ছিল একটা সার্বজনীন জাতীয় আন্দোলনের আকার । সেই বাংলা ভাষাকে ( মাতৃভাষার অধিকারকে ) বাঁচিয়ে রাখার জন্য সৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে - "  জান কবুল আন্দোলন " । ওই আন্দোলন ছিলো মাতৃভাষার সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার এক সার্থক আবেগ তাড়িত আপোষহীন লড়াই । ধর্ম-নিরপেক্ষ ও ভাষাভিত্তিক জাতি গড়ার এক অপূর্ব বিশ্বশ্রেষ্ঠ আন্দোলন ।
          এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন মনের ভেতরে স্বাভাবিক ভাবেই উঁকি মারে - কেনো ওপার বাংলায় সামান্য একটা ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের মনে অমন একটা বাঙালি জাতিসত্ত্বা জেগে উঠেছিলো ? শুধুই কি পাকিস্তানের পশ্চিমী শাসকদের জোর করে উর্দুকে সারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার কারনে ? নাকি , অন্য কোনও কারণ ছিল ?
          এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের একটু ইতিহাসের পেছন দিকে ফিরে তাকাতে হবে । আমরা সবাই জানি ব্রিটিশরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করে এই দেশটাকে দুই ভাগ্যে ভাগ করে গিয়েছিল । একটা অখন্ড ভারতের পূর্বাংশ ( পূর্ব পাকিস্তান ) এবং পশ্চিমাংশ ( পশ্চিম পাকিস্তান ) , আর বাকিটা ভারতবর্ষ । অনেকেই বলে থাকেন যে , ইংরেজদের ওই দ্বি-জাতি তত্ত্ব এবং ভারত ভাগ হওয়ার ভেতর দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীজ নতুন করে বপন করা হয়েছিল ।
          পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা সাতানব্বুই ভাগ মানুষ ( হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ) নিজেদের বাঙালি বলেই আখ্যায়িত করতো এবং আজও করে । ওভার সকলেরই মাতৃভাষা হলো বাংলা । এক সময় তারা সবাই ওই অবিভক্ত ভারতের বাংলারই অধিবাসী ছিলেন । সংখ্যায় ছিলো প্রায় দশ কোটি ( যার মধ্যে প্রায় নয় কোটিই ছিলো বাংলা ভাষী বাঙালি )। ওই বিশাল সংখ্যক মানুষ স্বাধীনতার পরে তাদের মূল ভু খন্ড থেকে বিচ্যুত হয়ে অনাথ শিশুর মতো , যার শেষ সম্বল বলতে মাতৃভাষাকে ( বাংলা ভাষাকে ) সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছিল ঘোষণা মতো । ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকারের পূর্ব বঙ্গেও উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার অধ্যাদেশ জারি হতেই সেখানকার লোকজন , বিশেষ করে ছাত্র এবং যুবক সমাজ তাদের শেষ সম্বল মাতৃভাষাকে ( বাংলা ভাষাকে ) হারাবার চিন্তায় এবং ভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলো । প্রস্তুত হওয়া শুরু করেছিলো - মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা , স্বীকৃতি এবং আত্ম প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে একটা লড়াইয়ের জন্য , যা কিনা তাদের কাছে স্বাধীনতার লড়াই ছাড়া অন্য কিছু ছিল না । এবং সত্যি সত্যিই ওপার বাংলার বাঙালিদের সেদিনের সেই আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় স্বীকৃতিই ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল তাই নয় , ১৯৭১ সালের ওদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন ( স্বাধীনতার আন্দোলন ) ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল ।
          একুশে ফেব্রুয়ারি তাই শুধুমাত্র একটা ভাষা আন্দোলনই নয় , একটা জাতির জাতীয় চেতনার উত্থানের আন্দোলন , একটা জাতির মুক্তির আন্দোলনের দিশারী ।




================

 

প্রণব কুমার চক্রবর্তী
৩৭/১, স্বামী শিবা নন্দ রোড
চৌধুরীপাড়া
বারাসাত
কলকাতা - ৭০০১২৪
মোবাইল নম্বর - ৮৭৭৭৬৮৫৯৯২
হোয়াটস অ্যাপ নম্বর- ৯৪৩৩০২৮৫৮৫

 



 
       
          
          



মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩