ভাষা মানুষের সর্বোত্তম সৃষ্টি, একথা বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। বৈজ্ঞানিক সমস্ত আবিষ্কারের কথা মনে রেখেও মানুষকৃত সম্পূর্ণ নিজস্ব বৌদ্ধিক উন্নয়নের অন্যতম স্বাক্ষর হিসাবে ভাষার উল্লেখ বোধহয় অযৌক্তিক নয়।
SIL international , 2009 এর সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীতে ৬৯০৯ টা ভাষায় মানুষ কথা বলে। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা মাত্র ২৩টি ভাষায় কথা বলে।
বিশ্বের ১৪৬ টিরও বেশি দেশে মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। ভাষার দিক দিয়ে ইংরাজি বর্তমানে পৃথিবী তে ১ম স্থানে রয়েছে। পৃথিবীর ১০৬ টি দেশের প্রায় ৩৮ কোটি মানুষ আছে যারা তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যাবহার করে থাকে। তবে সারা পৃথিবীতে ১১৩ কোটির বেশি মানুষ বর্তমানে ইংরেজি ভাষাতে কথা বলে থাকে।
পৃথিবীতে কথা বলার জন্য ২য় সবচেয়ে বেশি যে ভাষা ব্যাবহার করা হয় তা হল-মান্দারিন বা ম্যান্ডারিন। এ ভাষায় কথা বলে চীনের প্রায় ১১১ কোটিরও বেশি মানুষ। পৃথিবীর মোট ২৯ টি দেশে এ ভাষায় মানুষ কথা বলে থাকে। চিনের মোট জনসংখ্যার ৯০% (১২৮ কোটি) এর বেশি মানুষ শুধুমাত্র উ-চাইনিজ ও মান্দারিন ভাষাতে কথা বলে থাকে।
পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম ভাষা হল হিন্দি। পৃথিবীর ৫ টি দেশ তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে হিন্দিকে ব্যবহার করে থাকে। হিন্দি ভাষা মূলত ভারতে বেশি ব্যাবহার হলেও অন্যান্য দেশ মিলিয়ে প্রায় ৬১.৫৪ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে।
ভারতের ১৩০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশে ৬১.২ কোটি মানুষ হিন্দি ভাষাতে কথা বলে, এবং এদের মধ্যে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ যারা তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে হিন্দি ব্যাবহার করে থাকে।
পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম ভাষা স্প্যানিশ। পৃথিবীর ৩১ টি দেশ তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে এই ভাষা ব্যবহার করে আসছে। পৃথিবীর মোট ৩১টি দেশের প্রায় ৫৪ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে থাকে। এদের মধ্যে শুধুমাত্র স্পেন এবং অন্যান্য দেশের ৪৬ কোটির বেশি মানুষ স্প্যানিশ কে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে থাকে এবং অবশিষ্ট প্রায় ৮ কোটি মানুষ স্পানিশকে তাদের ২য় ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে।
১৫ থেকে ১৮ শতকে ইংরেজ উপনিবেশ এর পাশাপাশি আফ্রিকা এবং উত্তর ও মধ্য আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাবস্থা গড়ে উঠার কারনে এ ভাষার প্রসার এত ব্যাপক ভাবে ঘটেছে। বর্তমান আমেরিকার কিছু অঞ্চল (টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ মেক্সিকো) একসময় মেক্সিকোর অধীনে থাকার কারনে এখানে কিছু স্প্যানিশ ভাষাভাষীর দেখা পাওয়া যায়।
এশিয়ার একমাত্র ফিলিপাইনে কিছু স্প্যানিশ ভাষার ব্যাবহার দেখা যায়। অবাক করা বিষয় হল স্প্যানিশ ভাষা ইউরোপ কেন্দ্রিক হলেও, সেখানকার বেশির ভাগ ভাষাভাষী এটাকে তাদের ২য় প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করতেই বেশি ভালোবাসে।
ভাষার দিক দিয়ে ৫ম ও ৬ ষষ্ঠ স্থানে আছে যথাক্রমে ফ্রেঞ্চ এবং আরবি। পৃথিবীতে ফ্রেঞ্চ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৭.৯৮ কোটি। কিন্তু মজার বিষয় হল, মাত্র ৮ কোটিরও কম মানুষ এ ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যাবহার করে, এবং বাকি ২০ কোটির বেশি মানুষ তাদের ২য় প্রধান ভাষা হিসেবে ফ্রেঞ্চ ব্যাবহার করে।
আরবি ভাষা ব্যবহারকারির সংখ্যা ২৭.৩৯ কোটি, যার মধ্যে শুধুমাত্র সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যর আরব দেশ গুলো প্রধানত আরবি ভাষাতে কথা বলে থাকে। এ ছাড়া কিছু মুসলিম দেশ এখন আরবি ভাষা ব্যবহার করছে।
পৃথিবীতে ৭ম প্রধান ভাষা হল বাংলা। বর্তমানে বাংলা ভাষাতে ২৬ কোটি ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কথা বলে। সাধারনত বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা বাঙালিরা বাংলা ভাষাতে কথা বলে থাকে। সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
জনপ্রিয় ভাষার তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, ইংরেজি হল প্রধান জনপ্রিয় ভাষা এবং এটা এতটাই জনপ্রিয় যে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনা করলে এটা মান্দারিন ভাষা কে পেছনে ফেলে দিয়েছে, মান্দারিন শুধুমাত্র চিনের উপ-ভাষা হবার কারনে এ ভাষা মূলত কিছু অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং এটি ইংরেজি থেকে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
পৃথিবীর ৮৮% এর বেশি মানুষ তাদের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করলেও প্রায় বেশির ভাগ মানুষেরই একটি ২য় প্রধান ভাষা থাকে, এবং ২য় প্রধান ভাষা হিসেবে ইংরেজি কে বেছে নেয়ার কারনে ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয়তা অন্যান্য ভাষা থেকে অনেক বেশি।
কিন্তু ভাষা কি অমর? জন্ম নেওয়া সব ভাষাই কি এখনও বেঁচে-বর্তে আছে? এর উত্তর হল, না! ২০১৩ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রতি ১৪ দিনে পৃথিবী থেকে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন হারিয়ে গেছে আন্দামানের বো ভাষা, ক্রোয়েশিয়ার 'ডালমাশিয়ান' ভাষা, টাসমানিয়ার 'টাসমানিয়ান' ভাষা, নিউ মেক্সিকো ও টেক্সাসের ' লিপান' ভাষা, প্রাচীন চিনের 'খিতান' ভাষা প্রভৃতি। এই ভাষাগুলো হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গেছে ওই ভাষায় কথা বলা মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক চিহ্ন। ঔপনিবেশিকতা, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কোনো ভাষার বিলুপ্তির অন্যতম কারন।
আবার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদাহরণ ও আছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন( তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, বর্তমান বাংলা দেশ), ১৯শে মে-র ভাষা আন্দোলন ( শিলচর, আসাম) এই সবেরই উদাহরণ বহন করে। যদিও বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শিলচরের ১৯শে মের (১৯৬১) আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্য আছে। পূর্ব-পাকিস্তানে দ্বিজাতি তত্ত্বের চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রনীতিকে না মেনে, ধর্মকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে ভাষাকে জাতীরতাবোধের বাঁধন করে সংঘটিত হয়েছিল বাহান্নর আন্দোলন, যার চরম পরিণতি ঘনিয়ে এনেছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারি। আবার বরাক উপত্যকায় ১৯শে মের হত্যালীলার পিছনে ছিল সেখানকার বাংলাভাষী মানুষের ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বহুভাষিক চরিত্রের সম্মান রক্ষার লড়াই, যে কারনে অনেক অসমীয়াভাষী মানুষও সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন অসমের বহুভাষিক চরিত্র রক্ষা করার ব্রত নিয়ে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যাপক হীরেন গোঁহাই, ছাত্রনেতা উদ্ধব বর্মণ। আশির দশকে প্রাণ দিয়েছিলেন মদন ডেকা, মাধব বর্মণ।
ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টাল তাঁর 'ল্যাঙ্গুয়েজ ডেথ' বইয়ের ভূমিকাতে লেখেন ' Language death is real, Does it matter? Should we care? ' এ প্রশ্ন এখন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশেষত বাংলা ভাষার বর্তমান প্রবাহ আমাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যদিও একথা বলা যাবে না, যে বাংলাভাষা অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারন, বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীতে কথ্য ভাষার নিরীখে বাংলাভাষা সপ্তম স্থানে আছে, পৃথিবী জুড়ে পঁচিশ কোটির বেশি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলেন।
কিন্তু আশঙ্কা অন্যত্র। চাকরীর ভাষা হিসেবে ইংরেজির আগ্রাসন আগেও ছিল, এখনও আছে। বর্তমানের রাজনৈতিক সমীকরণ হিন্দি ভাষাকে জাতীরতাবোধের মাপকাঠি ধরে অন্য ভাষার উপরে চাপানোর চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে নাগরিক উন্নাসিকতা যুক্ত হয়ে বাংলাভাষা একটা বিকৃত রূপ পাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় চিন্তার। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোস্যাল মিডিয়া প্রভৃতিতে অসংখ্য লেখালিখি চলছে, তবে সেই লেখার মধ্যে বহুক্ষেত্রে বাংলা ভাষাটাকে বেশ করে দুমড়ে-মুচড়ে ও দেওয়া হচ্ছে। আবার শুধু লেখাপত্রে নয়, কথ্য বাংলাতেও এই ভাষার বিকৃতি দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। যেমন বলা হচ্ছে, " I hope কি আমি ভালো স্কোর করবো ', 'আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম but ...' ,' আপনি কি ডায়াবটিক' ধরনের একটা জগাখিচুড়ি বাংলাভাষা। টেলিভিশনে প্রচলিত 'সিরিয়াল' নামে বিনোদন অনুষ্ঠান গুলোতে গ্রাম্য ভাষার নামে যে অবনির্মান নিরন্তর ঘটে চলেছে তাকে আটকায় সাধ্য কার? পরবর্তী প্রজন্মের মুখে যে ভাষা লালিত হচ্ছে তার নাম, বাংরেজি বা বাংলিশ এমনকি হিংলা বা বান্দিও হতে পারে। এ সত্যিই চিন্তার বিষয়!
তবে, এই চিন্তার সঙ্গে কিছুটা আশাও আছে। সেই আশা জাগিয়ে রাখছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর বাইরে বাংলাভাষার চর্চা। সারা বাংলা জুড়ে জন্ম নেওয়া 'লিটল ম্যাগাজিন ' -- গুলো এই ভরসা যোগায়। এছাড়া বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজও ভাষার চর্চায় লাগাতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর আছে গ্রাম বাংলার মানুষ, যাঁরা এখনও ইংরেজি-বাংলা-হিন্দির মিশেল ভাষাটা বহুলাংশে জীবনচর্চার বাইরেই রেখেছেন। বাংলা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা আঞ্চলিক বাংলার চলিত বা কথ্যরূপ এখনও গতিশীলতা হারায়নি -- এটাও একটা আশার কথা। কলকাতা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চার প্রলোভন সত্ত্বেও বাংলার গ্রামে, গঞ্জে, মফস্বলেও কিন্তু ভাষা সাহিত্য চর্চা থেমে নেই। এটাও আশার কথা।
বাংলাভাষা বাস্তবিকই একটি সমৃদ্ধ ভাষা। সদর্থক চিন্তায় বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার মিশ্রণ ভাষার পরিধি বাড়াতে সাহায্য করেছে, একথা অস্বীকার করার কোনও যুক্তি নেই। তবু শব্দের স্রোতে যে জঞ্জালগুলো ভেসে আসছে, সেগুলো বর্জন করে বাংলাভাষাকে নির্মল, সুন্দর এবং গর্বের ধন করে তোলার দায় আমাদের সবার, সে দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে।
===============================
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
Mob: 9163812351
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন