ভাষা ভালোবাসা
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
অনির্বাণ সিগারেটটা সবেমাত্র একবার টেনেছে। হঠাৎ একটা গলার স্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পিছনে তাকায়। প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে কাউকে খুঁজছে। সবাই পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। অফিস থাকলে অনির্বাণও এমনি করেই ছোটে। সাপ্তাহিক ছুটি। কাজের থেকে সাময়িক বিরতি।
অনির্বাণ একটু ছুটি পেলে প্রকৃতির মাঝে গিয়ে বসে। কখনো বা পথ হাঁটে।অপরিচিত মানুষের ভিড়ে একটা পরিচিত মুখ খোঁজে। আজন্ম পরিচিত ভাষায় ভাবনা গুলো উড়িয়ে দিতে চায়।প্রচন্ড ভিড়েও খুঁজে বার করতে চাইছে কাউকে। না পরিচিত কেউ নয়। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিচিত পাবেই বা কোথায় ?
বহু আগে সরকার বাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রাস্তায় নয়, ঝাঁ-চকচকে একটা শপিং মলে।মলের কোণে ফোনে কথা বলছিলেন কারো সঙ্গে। একান্তে। আড়িপেতে অনির্বাণ শুনেছিল সেসব কথা কিছুক্ষণ। যেচে আলাপ করেছিল। সপ্তাহে বা মাসে ছুটে যেত তার কাছে। কাজের কথা ছেড়ে দুটো মনের কথা বলে আসতো। প্রিয় গান শুনে আসতো। সরকার বাবুর সংগ্রহে ছিল অনেক কিছুই। মাস আটেক আগে রিটায়ার হয়ে ফিরে গেছেন নিজের শহরে।
তারপর আর কারো সঙ্গে তেমন করে পরিচয় হয়নি।তাহলে কি নতুন পরিচয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়তে চলেছে অনির্বাণ। কিন্তু এবার যে মেয়ে ! কেমন করে আলাপ করবে ? কি বলে শুরু করবে ? স্কুল কলেজে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পা টলতো অনির্বাণের। ঘাম ঝরতো। স্কুলের বন্ধুরা ফার্স্ট গার্ল শান্তশ্রীর জন্মদিনে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। নিতে পারেনি অনির্বাণ। চ্যালেঞ্জ রাখতে পারেনি বলে গুনাগার দিয়েছিল।
স্কুলের বান্ধবী সুপর্ণাকে মনে ধরেছিল। মিষ্টিমুখ ছিপছিপে গড়ন। পড়া না পারলে দাঁড়িয়ে থাকতো। কষ্ট হতো অনির্বাণের। সাইন্স সেমিনারে কয়েকদিন একান্ত পেয়েছিল সুপর্ণাকে । ভেবেছিল কথাটা বলবে। বলতে পারেনি। শুধু আড়ালে কয়েকটা কবিতা লিখেছিল তাকে নিয়ে।
কলেজের প্রথম দিনেই শাশ্বতীর গজদন্ত হাসি মন ভরিয়েছিল অনির্বাণের। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ বড় নিখুঁত মনে হয়েছিল। বন্ধুরা কয়েক দিনের মধ্যেই জোড়া খুজে নিল। একাই থেকে গেলে অনির্বাণ। বলব বলব করেও বলতে পারে নি। সরস্বতী পুজোর রাতে ডেঁপো মার্কা ছেলে সমরেশের সঙ্গে ঘুরতে দেখেছিল শাশ্বতীকে।হয়তো কয়েক টাকার ফুচকা আর কয়েকটা গিফটের লোভে। কষ্ট হয়েছিল। ভীষন কষ্ট। চোখের জলে বালিশ ভিজেছিল রাতে।
কলেজের বন্ধুরা মেয়ে বলে রাগাতো। প্রমাণ করতে যায়নি যে সে তা নয়। বরং তাতে ভালোই হয়েছিল। বন্ধুরা পুরুষত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে বীর বিক্রমে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতো। অনির্বাণ শুধু পড়েছে। যথাসময়ে চাকরিও পেয়েছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ফাস্ট পোস্টিং ব্যাঙ্গালোর। বছর কয়েক হলো এখানে।
অফিস যাওয়া বা বাজার করার পথে কোনদিন বাংলা কথা শুনতে পায়নি। মাঝে মাঝে ভাবে বাঙালিরা বড় ঘরকুনো । রুই আর পুঁই এ বন্দী থেকে গেল সারা জীবন। বুকের দুঃখেও মুখ লাল করে।
না, মেয়েটা কিন্তু সেরকম নয়। ঠোঁট পালিশের বালাই নেই। অলংকার পরে নিজেকে রূপসী সাজার ব্যর্থ চেষ্টা করেনি। টানা টানা চোখ। বয় কাট চুল। টপ আর জিন্সে বেশ মানিয়েছে । মাথা থেকে পা পর্যন্ত কয়েকবার দেখে নেয় অনির্বাণ। না, কোন অঙ্গ শিথিল হয়ে যায়নি। টানটান আছে সব কিছুই। যে দেখবে সেই বলবে ঝাক্কাস।
নিজেই লজ্জায় পড়ে যায় অনির্বাণ। সে তো বিয়ের পাত্রী দেখতে আসেনি। চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন কি ? শুধু মনের মানুষের সঙ্গে দুটো মনের কথা বলতে চায়। বাংলার কথা বাঙালির কথা বলবে। সুযোগ হলে দক্ষিণী খাবার থেকে মাঝেসাঝে অব্যাহতি দিবে জীভটাকে। বাঙালির রান্না করা পদ খাবে।বুড়ো আঙ্গুলে তর্জনী ছুঁইয়ে বলবে দারুন হয়েছে।
অনির্বাণের চোখ চলে যায় তরুনীর পাশে বৃদ্ধার দিকে। মাথাভর্তি সাদা চুলের মাঝে সিঁদুরের রেখা। ঠিক সকালের সূর্যের মতো। সাজ পোশাক দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশ অভিজাত। বাংলা থেকে বহু দূরে দুই বাঙালিকে দেখে অনির্বাণের কৌতূহল বেড়েই চলেছে।
যেচে আলাপ করাটা পছন্দের নয় অনির্বাণের। কথা যে বলবে নিশ্চয়তা নেই। কথা বললে নিজেকে ভাববে গোপাল। না বললে ফাটা কপাল। সুখের না হোক স্বস্তির বিষয় আছে একটা। কথা না বললেও জানবে না কেউ। প্রেস্টিজ পাংচার হবে না।
হঠাৎ বৃদ্ধা বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে। দোকানের সামনে একটা চেয়ারে। হতভম্ব হয়ে যায় তরুণী। চারিদিকে আঁধার দেখে। গিজগিজ করা ভিড়েও একটা লোক খুঁজে পায় না।যাকে মনের কথা বলা যাবে। চিৎকার করে চলেছে "ঠাকুমা ঠাকুমা কি হলো ? কি হলো ?" কেউই এরকম একটা অবস্থার জন্য অপেক্ষা করেনি। দেখছে সবাই।কী হয়েছে বুঝতে পারছে না অনেকেই। ব্যস্ততায় বাড়তি ঝামেলা নেওয়ার ইচ্ছে নেই কারো। অনির্বাণ আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। দৌড়ে যায়।
-আমার পরিচয় বাঙালি। অনুমতি দিলে ঠাকুমাকে সামনের একটা হসপিটালে নিয়ে যাই।
সায় দেওয়ার জন্য মাথা নাড়তেও ভুলে গেছে তরুনী। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে অনির্বাণের দিকে। অনির্বাণ তখন আরও এক প্রস্থ এগিয়ে গেছে বৃদ্ধার দিকে।অনুমতি পেয়ে শুইয়ে দেয় এম্বুলেন্সে। তাকিয়ে দেখে তরুণীর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা বাগ মানছে না। ইচ্ছে করছিলো মুছে দেবে। সাহস হয়নি।তরুনীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলো "চিন্তা করবেন না আমি তো আছি।"
তরুণীর কানের কাছে, প্রানের কাছে কে যেন অনবরত বলে চলেছে 'আমি তো আছি'। ছোটোবেলায় স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতো মাঝে মাঝেই। অমনি মা মিস্টি গলায় বলে উঠতো আমি তো আছি। পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়তো। নিশ্চিন্তে। এই বিভুঁই প্রদেশে মা বাবা শুধু সাহস দিয়ে যায় ফোনের ওপারে।
বাড়ি পৌঁছে তরুণী কয়েক বার বলে- "আজ আপনি না থাকলে কি যে হতো ভাবতেও পারছি না।" কপালে হাত ঠেকিয়ে বৃদ্ধা বলে-"ওরে সবই তো দয়াময়ের দয়া। কার যে কোথায় গেহ, কার যে কোথায় দাহ ,তিনি ছাড়া আর কে জানেন ?"
তরুণী তখন দাঁড়িয়েছিল জানলার পাশে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নিম গাছটার দিকে। তার ডালে কপোত কপোতী মুখে মুখ ঠেকিয়ে কিছু বলছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে তরুণী। হয়তো বুঝতে পারছে না। হঠাৎ অনির্বাণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল "আজ তবে আসি।" তরুণী হয়তো এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। একটু এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে "তুমি না কি গান ভালোবাসো ? কই গান শুনবে না ?" তার ওষ্ঠ ও অধর কেঁপে ওঠে একইসঙ্গে। একটা দমকা হাওয়া এসে বন্ধ করে দিল দরজা জানালা। অমনি তরুণী অনির্বাণের হাতটা ধরে গেয়ে উঠলো "ভালোবেসে যদি সুখ নাহি/তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালোবাসা।"
=======================
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
নতুন বাঘমুণ্ডি রোড
ঝালদা, পুরুলিয়া
৭০০১৯১১৮১০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন