দীপেনের সাথে সেদিন দেখা হলো সত্যপ্রিয়ের, বলল - কেমন আছেন স্যার? বেশ রোগা লাগছে। শরীর ভালো আছে তো?
সত্যপ্রিয় বললেন - কোথায় আর তেমন ভালো! ঐভাবেই চলছে আর কি!
দীপেন চিন্তিত মুখে বলে- স্যার কি ডাক্তার দেখাচ্ছেন?
সত্যপ্রিয় - ভবেশ ডাক্তারকে দেখাচ্ছি।
- একজন বড় ডাক্তার দেখান স্যার।
- ভবেশ ডাক্তারকেই বরাবর দেখাই।
দীপেন - স্যার আপনি আগের মত সুস্থ ঝলমলে থাকবেন এটাই আমরা চাই। স্যার আপনি যে গমগমে কণ্ঠে আপনার ক্লাস ভরিয়ে দিতেন, সেটা আজও ভুলতে পারি না । চতুর্দশপদী কবিতাবলী যখন পড়াতেন স্যার! "হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন" কিংবা "যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে" আহা আজও কানে বাজে। এমন চমৎকার বাংলার ক্লাস আমরা আর পাই নি স্যার। আপনি বলতেন বাংলা ভাষায় ওজস্বিতা এনে দিয়েছেন মধুকবি। আমরা বাংলাভাষাকে তখনই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এর পেছনে আপনার খুব ভালো ভূমিকা আছে স্যার।
সত্যপ্রিয় হেসে বলে - আমার নয়, মধুকবির।
- না স্যার, আপনার। মধুকবিকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আপনি। স্যার, আমি বলি কি, কলকাতা চলুন ডাক্তার দেখিয়ে আসবেন, আমি নিয়ে যাব স্যার।
- সে ইচ্ছে করলে আমি তো একাই যেতে পারি, শরীর তো এতটা খারাপ হয়ে যায়নি!
- না স্যার, আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ভালো দেখে একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান দেখিয়ে নেওয়াটা খুব জরুরী । তারপর হয়তো খানিকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা দেবে, সেটা করিয়ে নেবেন।
- আচ্ছা, সে হবেখন, ও নিয়ে তুমি ভেবো না।
- না স্যার আমিই নিয়ে যাব আপনাকে। আপনি যাবেন না কিছুতেই, সেটা আমি বেশ জানি!
দীপেনের কথাটা কথার কথা ছিল না। সে সত্যপ্রিয়ের বাড়ি এলো অতঃপর। প্রায় জোর করেই কলকাতা নিয়ে যাবার জন্যে সত্যপ্রিয়কে নিয়ে ট্রেনে চড়ে বসল। সত্যপ্রিয়ের বড় একটা বাইরে যাওয়া হয় না। ট্রেন যখন ছুটছে গাছগাছালি ঘরবাড়ি নদী জলা পুকুর মাঠ প্রান্তর লোকজন যখন ছুটে ছুটে যাচ্ছে তখন মনটাও ছুটছিল আর মনে হচ্ছিল কত কতদিন কোত্থাও যাওয়া হয় নি। জীবনটাকে আটকে রেখে দিয়েছেন তিনি এক মহৎ পরিসরে। সেখানে পৃথিবীর আলো হাওয়া রোদ্দুর সব থমকে আছে।
দীপেন বলে - কেমন লাগছে স্যার?
-খুব ভালো।
-আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্যার।
দীপেনের সাথে মাঝেমাঝে দেখা যে হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে এইবার সে স্যারকে ডাক্তার দেখাবেই, একটা অভাবনীয় জেদ তার, অবাক হয়েছেন সত্যপ্রিয়, ভালোও লেগেছে খুব । ট্রেনে একটি অন্ধ ভিখারি গাইছে - "বাঁশী শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি...." খুব সুন্দর কণ্ঠ। একটি বাচ্ছা ছেলে লজেন্স বিক্রি করছে, আচার লজেন্স, সাথে একটি বৃদ্ধ লোক। মানুষের বড় কষ্ট, চোখ মেলে চারপাশ দেখলে বুকের ভেতরটা টনটন করে।
দীপেন সত্যপ্রিয়কে লক্ষ্য করছিল। তাঁদের খুব প্রিয় স্যার। বাংলার শিক্ষক ছিলেন। চমৎকার পড়াতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রতি স্যারের খুব দুর্বলতা ছিল। এখনও স্যারের বাড়িতে পুরো একটি ঘর জুড়ে মধুকবি বিরাজ করছেন। ঘরের ভেতর কবির একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে,এছাড়া মেঘনাদ বধকাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, ব্রজাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা কাব্য থেকে কবিতার উদ্ধৃতি তুলে নিয়ে এমন চমৎকার অলঙ্করণ করেছেন গোটা কক্ষটিকে যে না দেখলে কোনও ধারণা করা যায় না। এজন্যে অনেকে সত্যপ্রিয় স্যারকে মধুপ্রেমী স্যার বলে ডাকে। স্যার সেটা জানেন, ভেতরে ভেতরে হয়তো খুশিই হন এই নামে, হয়তো গর্ববোধ করেন। ইদানিং স্যারের দেহটা যেন দ্রুত ভাঙ্গছে। দেখাশোনা করার জন্যে হরিপদ নামে একজন বয়স্ক লোক আছে বটে, কতদূর স্যারের যত্ন করতে পারে সে, কে জানে! স্যারের স্ত্রী গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হতে চলল। একমাত্র ছেলে অনেকদূরে থাকে, এদেশে নয়, কোনদেশে থাকে ঠিক জানে না দীপেন। অনেকদিন হলো আসেনি বলে শুনেছে। স্যার সত্যি খুব একা। স্যার খুব রোগা হয়ে যাচ্ছেন। দ্রুত দেহটা ভাঙ্গছে। হরিপদ সেদিন বলছিল স্যার নাকি খেতে চান না। আরও কী যেন বলতে চেয়েছিল হরিপদ, কিন্তু বলেনি, একটু রহস্যজনকভাবেই চুপ করে গেছে। কলকাতা যেতে রাজি ছিলেন না, প্রায় জোর করেই আনতে হলো। একজন নামী ডাক্তারের সাথে অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে।
-বিকেলে ফিরতে বেশ রাত হবে দীপেন?
-হ্যাঁ স্যার। চাইলে আজ রাতে থেকেও যেতে পারেন। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। মৌ এর বাড়িতে থাকতে পারবেন। আমি বলেছি মৌ - কে। ও একটা ফ্ল্যাটে একাই থাকে। চাকুরি করছে। কোনও চিন্তা নেই স্যার। আপনি তো জানেন মৌ আপনাকে কতটা শ্রদ্ধা করে।
-কিন্তু আমি আজ থাকতে পারব না দীপেন। যে করেই হোক ফিরতে হবে। হ্যাঁ, মৌ তোমার বোন, খুব ভালো ছাত্রী ছিল। তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কী অগাধ টান! "মেঘনাদ বধ কাব্যে" র প্রথম সর্গ একদিন টানা মুখস্থ পড়ে গেল।
"সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি
বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে হে দেবি অমৃতভাষিণি
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি পদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষকূলনিধি
রাঘবারি?"
-স্যার আপনার কণ্ঠস্বর আগের চাইতেও অনেক বেশি স্বচ্ছ, জোরালো। আমার খুব আশ্চর্য লাগছে স্যার। - দীপেন সত্যিই হতবাক। স্যার দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছেন কিন্তু তাঁর কণ্ঠে যেন জাদুকরী মোহ ঝরে পড়ছে। দীপেন অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছে। সত্যপ্রিয় এক আশ্চর্য রহস্যময় হাসি হাসলেন।
কলকাতায় ডাক্তার দেখানো হলো। বেশ কিছু টেস্ট দিয়েছে ডাক্তার। অবিলম্বে টেস্ট করাতে হবে। এরমধ্যেই মৌ এসে হাজির। স্যারকে সে তার বাড়িতে নিয়ে যাবেই। সব টেস্ট করিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে তারপর ডাক্তার যদি বলেন তবেই বাড়ি ফেরা, অর্থাৎ চিকিৎসাপর্ব শেষ করিয়ে ফেরা। এ ক'দিন মৌ ছুটি নেবে, দীপেন ফিরে যাবে। কিছুতেই রাজি নন সত্যপ্রিয়, তবু মৌ এর কাছে হার মানতে হলো। দীপেনও সেদিন থেকে গেল।
রাত যত বাড়ছিল স্যার ততই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলেন। মৌ তো কথা বলতে চায়। সত্য স্যারের সাথে তার কত কথা জমে আছে, অথচ স্যার চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছেন। দীপেন একবার ডাকল - "স্যার?" - কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। মৌ ডাকল - "স্যার?" - উঁহু, কোনও উত্তর নেই। স্যার তেমনি ধ্যানস্হ। মৌ স্যারের জন্যে বেশ ভালো কিছু পদ রান্না করেছে, কিন্তু ইনি তো কথাই বলছেন না, একটা হেলান দেওয়া চেয়ারে সেই থেকে যে বসেছেন বসেই আছেন। এমনি সময় ফোন এল হরিপদর," দীপেনদাদা, দাদাবাবু কী করছে? ঠিকঠাক আছে কি? " - পরিস্থিতিটা খুলে বলায় হরিপদ যেন চমকে উঠল। - "দাদাবাবুকে রেখে দেওয়া আপনাদের ঠিক হয়নি। রাতে তো দাদাবাবু ও ঘরেই থাকে মধুকবির সাথে। দুজনায় কথাবার্তা হয়। কতবছর হলো দাদাবাবু কোত্থাও যায়নি। মধুকবির শেষ জীবন নিয়ে দাদাবাবু কীসব লেখালেখি করছে। মধুকবি রোজ রাতে আসে। শেষকালটা কবির খুব কষ্টে কেটেছে, তোমাদের সত্যপ্রিয় স্যার ওনাতেই মজে আছে। ওকে আটকে রেখো না। আজ রাতটা যদি ঠিকঠাক কাটে তো আগামীকাল ওকে নিয়ে ফিরো।
-স্যার? - মৌ বেশ গাঢ় গলায় সত্যপ্রিয় স্যারকে ডাকল। আচমকা স্যার তাকালেন। স্যারের অবয়ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে যেন কোনও এক প্রতিচ্ছায়া। মৌ ক্রমাগত শিহরিত হচ্ছিল, আর দীপেনের ভেতরটা এক পূর্ণ অনুভবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল।
..........……...................................................
বিজয়া দেব।
ঠিকানা
225, Purbachal Road North
Kolkata 700078.
.
.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন