বেশ কয়েক বছর থেকেই দেখে আসছি পাশের বাড়ির প্রতিবেশী আমাদের সকলের প্রিয় আশি উর্ধ্ব কালা ঠাকুমার সঙ্গে ওনার বাড়ির আধুনিকা শিক্ষিত বৌমার একেবারেই বনিবনা হয়না!
আসলে উনি ঠিক শহুরে আদপ কায়দায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না!
বছর ছয়েক শহরের বাড়িতে আসলেও চলনে, বলনে, এখনো সেই গ্রামের ছাপ!
ওনার ছেলে শৈলেনকাকু উনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী, বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই।
কালা ঠাকুমা যখন সন্তানের স্বপ্ন একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন হঠাৎ ই বিয়ের পঁচিশ বছরের মাথায় মা হন।
তারপর আকস্মিক ওনার স্বামী হার্ট ফেল করে মারা যান এক ঝড় জলের রাতে!
চোখের সামনে স্বামীর অকাল মৃত্যু! আকস্মিক গভীর শোক ওনার শ্রবণ শক্তিটুকু কেড়ে নেন!
তখন শৈলেন কাকু মাত্র তিন বছরের।
অনেক কষ্ট করে মাঠে চাষাবাদ করে , গাছের ফল বিক্রি করে ছেলেকে লেখাপড়া শেখান।
আর, আজ ওই ছেলে বৌমাই শাশুড়ি মাকে গাঁইয়া বলে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যান না!
দিনরাত্রি পাঠ পড়ান শহুরে আদপ কায়দায় কি করে চলতে হয়, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কি করে কথা বলতে হয়, ইত্যাদি! ইত্যাদি! ।
তাতে অবশ্য ওনার কানে কিছুই ঢোকেনা!
উনি ওনার মতোই লো, লা, খাবুনি, যাবুনি, সবুজ কে হালি, কলা কে রম্বা, লুচি কে নুচি, আরশোলা কে আঁশলা , স্নান কে নাওয়া, নদী কে লদী, এই ভাবেই কথা বলতেই থাকেন।
আমাদের কিন্তু খুব মজাই লাগে, ওনার কথা শুনতে। ওনার হাতের নাড়ু খেতে প্রায়ই ওনার কাছে যাই।
উনি আমাদের পাড়ায় সবার কালা ঠাকুমা।
ওনার পাঁচ বছরের নাতি ঋজু, ঠাম্মার কথা শুনে শুনে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে একই ভাষায় কথা বলে,
তার ফলে ঠাকুমার আধুনিকা শহুরে বৌমাকে স্কুলে, পার্কে , পার্টিতে, সকলের কাছেই লজ্জায় পরতে হয়! আর ওই নিয়েই যত অশান্তি ! আর তারই জন্য বেশ কয়েকদিন ঋজুকে ওর ঠাম্মার কাছে যেতে দেয়না ওর মা!
শৈলেনকাকু আর কাকিমা দুজনে উঠে পরে লেগেছেন কালা ঠাকুমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবেন।
কিন্তু সহজ সরল ঠাকুমা তার কিছুই জানেননা!
ওনার বৃদ্ধাশ্রমে যাবার ঘটনাটা যখন মায়ের মুখে শুনলাম খুব কষ্ট পেয়েছিলাম,
বেশ কয়েকদিন যাবৎ কালা ঠাকুমাদের বাড়ি থেকে কোনো চিৎকার ভেসে আসছে না!
বুকটা ভারী হয়ে এল ভেবে যে একটি সহজ সরল বয়স্কা বৃদ্ধা মানুষকে শুধুমাত্র তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার জন্য , পরিবারের মেকি শহুরে আধুনিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার জন্য বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যেতে হলো! কি দোষ তার ছিল?!
--- মানুষটা নানান প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছে!
আর আজ সেই অমানুষ ছেলে বৃদ্ধা মায়ের মায়া মমতা ত্যাগ করে শহুরে সুন্দরী বউয়ের কথা মতো মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিল?!
ছি! ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে এই মানুষগুলোর কথা!
চাইনা এই রকম আধুনিকতা! যে আধুনিকতা মাতৃভাষাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়!
হঠাৎ করে পেছন থেকে মায়ের ডাক, মা হাঁপাতে হাঁপাতে আমার পড়ার ঘরে এসে বলে - মিতি তাড়াতাড়ি বাইরে চল, বিনি মাসিমার দেহ এক্ষুনি শ্মশানে নিয়ে চলে যাবে!
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা!
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মা কথা বলার অবস্থায় নেই, দুচোখ জলে ভরে গেছে! সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নিচে নেমে গিয়ে দেখি -
আমাদের পাড়ার সকলের কালা ঠাকুমা অর্থাৎ বিনি ঠাকুমার থেঁতলানো রক্তাক্ত দেহটা শৈলেন কাকুদের গেটের পাশে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা! পুলিশকে বলতে শুনলাম - উনি ওনার একমাত্র ছেলে শৈলেনবাবু কে দেখার জন্য রাত্রিতে লুকিয়ে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পালানোর সময় লরিতে থাক্কা খান! উনি যেহেতু কানে শুনতে পেতেন না তাই গাড়ির হর্ন শুনতে পাননি!
চলে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় হাসিখুশি কালা ঠাকুমা! তাঁর গাঁইয়া মাতৃভাষাকে বুকে জড়িয়ে বাংলা মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লেন। ভালো থেকো ঠাকুমা, ভালো থেকো তোমার সোনার বাংলায়। পল্লী মায়ের বুকে।
===========================
শ্রাবন্তী সামন্ত
তারকেশ্বর ,হুগলি , পশ্চিমবঙ্গ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন