Featured Post
গুচ্ছকবিতা ।। তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
(১)
বাংলা তুমি কি ভুগছ হীনমন্যতায়?
বিষয়টা ছিল - 'দুরাবস্থায়, বাংলাতে কি বিজ্ঞানচর্চা?'
বিপক্ষে তার বলতে গিয়ে মিছেই কতো কথা খরচা।
অমন অনাবশ্যক বশ্যতায় আর পোষ্যতায়,
এখনো স্পষ্ট, লেগে দাসত্ব, বাংলা তোমার ও কশেরুকায়।
'কেদারা' সরিয়ে বসেছ 'চেয়ারে', 'যত্ন' সরিয়ে 'কেয়ারে',
'ভাগ করে' পাওয়া আনন্দগুলো কবে ঘুমিয়েছে 'শেয়ারে'!
ঔপনিবেশিক খোয়ারি তোমার কাটেনি এখনো বোধহয়!
এখনো না হলে বলো তবে আর কবে হবে বোধোদয়?
বিলাতি ভাষাকে উত্তম মেনে বেশ খুশি তুমি মধ্যমে!
শুধুই রাখোনি পৃথক ভাষাজ্ঞানে,
পরাশক্তিকে ছুঁতে চাওয়ার উদ্যমে,
অন্যতর প্রশাসনিক ভাষাকে এগিয়ে রেখেছো সসম্মানে,
নিজেকে হারাও অভিপ্রেত মিশ্রভাষার মাধ্যমে।
স্প্যানিশ আর জার্মান, যদিও তা ভাষাজ্ঞান, খাতির তো খুব করো,
হিন্দির সাথে সাপে-নেউলে, প্রায়শই লেগে পড়ো।
বিলাতি আগ্রাসনে, বাক্যগঠনে যেটুকু যা আছো পড়ে,
চাইছোনা হতে প্রতিস্থাপিত হিন্দি-বন্দি-ঘরে।
গোলামির শত নজির দেখিয়ে ঘৃণা হবে অনৈতিক!
হিন্দিও হূল ফোটাবেই রাজনৈতিক।
কে যে দাস কতো বড়, শুরু হবে তারও লড়াই, রাখবে বাজি,
বিকানোর আগে আদৌ কি কেউ হয়েছিলো গররাজি!
পূর্বনির্ধারিত বাক্যে, গোণা হবে কার কতোগুলো ইংরাজি।
না মেশালে তা, কাকে যে কতোটা অর্ধশিক্ষিত লাগে,
কার চ্যুতি হয় বেশি, দারুণ আবেগে, দুঃখ অথবা রাগে।
সাধারণ কথা বলতে গিয়েও কে বেশি হারায় শব্দ,
প্রভাবিত হওয়ার ভয় আছে কার বেশি,
এ কথাযুদ্ধে কে হবে আগেই জব্দ!
শেষ হবে রেষারেষি।
ও আমার ভালোবাসা, আমার মাতৃভাষা,
আধুনিকতার বেড়েছে প্রকোপ,
কতো শব্দের হয়েছে বিলোপ।
হীনমন্যতায় আছো না বিষণ্ণতায়?
কতোনা আঘাত পেয়েছো, সয়েছো আমার উদাসীনতায়!
যে মা আমায় গর্বে ধরে, যে মা কথাগর্ভে ধরে,
ক্ষণে ক্ষণে তাকে হারাচ্ছি এই আমিই, প্রতিদিন, প্রতিকথায়।
রুচি-অরুচিতে, উচিত-অনুচিতে, পাঠ্যসূচিতে, প্রথায়।
ফিরে এসো সব ভুলে যাওয়া শত শব্দ,
প্রগতিশীলের বর্জিত যতো শব্দ,
হুল্লোড়ে এসো নতুন শব্দ আরও,
ধার নেবোনাকো শব্দ অন্য কারো,
মুখস্থ, কণ্ঠস্থ, ঠোঁটস্থ হয়ে এসো,
বাঙালিজন্মে বাংলা প্রতিস্পর্ধা হয়েই এসো।
(২)
কাজ বাঁচানোর ভাষা, পেট চালানোর রাজনীতি
মাতৃভাষা বোঝার বয়সে শব্দকাতর মেয়েটি বিভ্রান্ত, অসহায়,
ভাষাজ্ঞানে নয়, মিশ্রভাষায় পরিবার কথা বলে।
কবিরা যতই মাতৃভাষা বাঁচানোর কথা লিখুক,
কবির আত্মীয়রাই যে বাংলাবিমুখ, এটুকু বুঝেছে সে।
ভাবমূর্তি বাঁচাতে উড়ো উড়ো ইংরাজি শব্দ ধরে -
মিশ্রণ বানিয়ে ঘুঁটে দিতে হয় কর্মক্ষেত্রে।
অবলা বাংলা শব্দগুলো বর্জিত হতে থাকে এভাবেই।
রাজনীতি বোঝার বয়সে ঘুমকাতুরে মেয়েটি বিভ্রান্ত, অসহায়,
মতাদর্শ আঁকড়ে বসে আছেন তার সেকেলে ঠাকুরদা।
দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব তিনি দেখেছেন, মতানৈক্য তিনি যুঝেছেন,
তবু নড়েননি দলীয় আনুগত্যজনিত স্থিতিজাড্যে, সরেননি।
দলবদলের হিড়িক দেখে কুণ্ঠিত ঠাকুরদা আর বাবার মধ্যে,
কোন দল, কোন দল করে চলে দিবারাত্র কোন্দল।
সময় বদলায়, জয় বদলায়, মন বদলায়, প্রয়োজন বদলায়,
ঘরের মধ্যেই অনেকগুলো ঘর হয়ে যায়,
পরনির্ভর বয়সে দুবেলা খেয়ে বাঁচতে চুপ হন ঠাকুরদা।
এখন আর কার্যালয়, কর্মসমিতি, জনপ্রতিনিধি বদলায় না,
বদলায় শুধু ঘরের রূপ-রঙ আর দলীয় পতাকা।
(৩)
ফেরা
দেখলাম মায়াস্বপ্ন এক,
প্রত্যন্ত গ্রামের এক শ্যামাঙ্গী মেয়ে-
বাংলায় বলছে সব কথা, অকুণ্ঠিত!
মুগ্ধ আমি তার পিছু ধাওয়া করছি-
অশ্রুত, অদেখা, অজানা শব্দগুলোর মানে জানতে।
আমি ইংরাজিতে পিছু নিয়েছি,
সে বাংলায় এগিয়ে চলেছে,
ধরি ধরি করেও পারছিনা ধরতে!
অর্জিত বিদেশি শব্দে, বর্জিত বাংলা শব্দগুলো-
হারিয়ে যেতে থাকে পিছনে দ্রুত।
তবু ওই গতিময়তার মধ্যেই যেটুকু-
আবছা নজরে আসে, কানে আসে-
তাতেই বিস্মৃত নামগুলোর পুনর্জন্ম ঘটে।
গ্রামের মাঠ, ঘাট, পুরনো বটগাছ, নদী, নৌকো, দীঘি, শালুক যেন-
কতো অভিমান নিয়ে প্রতীক্ষারত!
কোথাও কোথাও এক্কা দোক্কা, ইকির মিকির, চোর পুলিশ,
কোথাও কোথাও দল বেঁধে ডাং গুলি, কানামাছি, কুমিরডাঙা,
আবার ওদিকটায় মেয়েরা খেলছে বুড়ি বসন্ত, পাঁচঘুটিম, চু কিত কিত।
শাঁখের আওয়াজ, মুদিখানা, প্রদীপ, দোকানের আলোআঁধারি ফেলে-
থামলাম সাহেবদের পরিত্যক্ত কাছারির সামনে।
মেয়েটির সাথে যেন মুক্তিযোদ্ধা প্রপিতামহীর অনেক মিল!
জাতিস্মরের মতো মনে পড়তে লাগলো এক একটা বাংলা শব্দ।
(৪)
ভাষাস্মর
অতিমারির অবকাশে,
শৈশবের ভাষা ঠিক ঠিক মনে পড়ছে কিনা,
সে প্রচেষ্টায় উৎসুক প্রবাসী বাঙালি ভাবতে থাকে-
আজ, গতকাল, গত পরশু করে করে পিছোয় গতবছরে,
তারপর প্রৌঢ়তা, যৌবন হয়ে কৈশোর পেরোয়,
ভূমিষ্ঠ হয়ে যে ভাষায় প্রথম কেঁদেছিলো, 'মা' ডেকেছিলো,
তারপর জীবনায়নের অমোঘ নিয়মে, এ ভাষা, ও ভাষা কুড়োতে কুড়োতে-
থেমেছে যাতে সেখানে ঘন অন্ধকার, তা নিজের না অন্যের জন্য!
ভয় পায় সে, তাহলে এতদিন অন্যের কথায়, অন্যের শব্দে বাঁচছিলো!
অসন্তুষ্ট, দিশেহারা, আরও পশ্চাদপসরণে ব্যাকুল হয় সে।
পথপ্রদর্শক হতে চেয়ে কেউ হাত ধরেন অযাচিতভাবে!
তাঁকে দেখতে যেন মধুসূদন দত্তের মতো!
এই কি তবে পূর্বজন্ম! এ যে অবিভক্ত বঙ্গদেশ!
তবে কি শুধু সময়যাত্রাই ভাষা বাঁচানোর উপায়!
বাংলা-ভাষাস্পৃষ্ট হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে এক অবুঝ প্রজন্ম,
খাঁটি বাঙালি হয়ে জেগে উঠবার জন্য।
(৫)
মাতৃভাষাবিমুখ
কেতাদুরস্ত প্রেমপত্র লেখার তাগিদে,
ইংরাজি মাধ্যমে পড়া, পছন্দের বঙ্গললনার মুগ্ধতাপ্রার্থী,
বিলাতি ভাষায় শরণার্থী, বাঙলা মাধ্যমে পড়া ছেলেটি বুঝতোইনা-
প্রেমপত্রে বিলাতি ভাষাপ্রয়োগে অর্থান্তর হয়না,
বরং সে প্রেম পড়তে পারে ভবিষ্যতে অথান্তরে।
যেমন শিকড়বিমুখ উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য থাকে-
এক ভবিতব্য প্রতিবন্ধকতা,
তেমনি মাতৃভাষাবিমুখ প্রেমগুলোর বার্ধক্যের জন্য তোলা থাকে-
না ফিরতে পারার অসহায়তা।
(৬)
প্রয়োগবাদ
ওদিকে এগিয়েছি যতটা, এদিকে তুমি কি এসেছ ততটা?
ইংরাজি জেনেছি যতটা, জেনেছ ততটা বাংলা?
হিন্দি শিখেছি যতটা, ততটা বাংলা কি শিখেছ?
যে ভাবো হবে প্রেম?
আমি পড়বো তোমায়, তুমি আমায় পড়বেনা?
আমি ধরবো তোমায়, তুমি আমায় ধরবেনা?
(৭)
বাঙালির অতীত বিলাস
বাংলায়, সব লেখা হয়ে গেছে ভেবে-
যারা যৎসামান্য লিখতে পেরেছে,
সব বলা হয়ে গেছে ভেবে-
যারা যৎসামান্য বলতে পেরেছে,
তারা একজোট হয়ে অতীত-বিলাস-উৎসব পালন করে।
দর্শক হয়না, শ্রোতা হয়না, পাঠক হয়না,
পরিতৃপ্ত তারা শুধু তাদের বন্ধুবৃত্তেই।
তার বাইরে, স্বীকৃত হতে উৎসুক হলেও, স্বীকৃতি দিতে বাধে।
এমন আত্মতুষ্টির পালকি পালকি মনে যারা রওনা দিয়েছে,
তারা গন্তব্য পাবে বলে মনে হয়?
(৮)
মাতৃভাষা দিবসে যার বিবাহ, তাকে
রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়ার অজুহাতে ও অভিমানে,
যে প্রগতিশীল অপ্রবাসী বাঙালি-
ইংরাজিতে মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছে ধীরে ধীরে,
তার বিবাহে তাকে ইংরাজি থেকে বাংলা অভিধান উপহার দিয়ে এলাম।
উৎসর্গপত্রে দাগ কেটে দিয়েছিলাম,-
"দিলে, খাঁটি বাঙালির জন্ম দিও। পোশাকে না হোক, ভাষাতে"
জামা-কাপড়, বাসনকোসন, সোনা-দানার ভিড়ে যদি কখনো-
চোখে পড়ে, বাংলাকে মনে পড়ে-
(৯)
মাতৃভাষা দিবস
বলতে বলতে প্রায়শই যাঁরা বাংলা শব্দ খুঁজে পাননা,
বাংলা ভাঁড়ারে তেমন শব্দ নেই বলে যাঁর মনে হয়,
থাকলেও তবু খুঁজে দেখারও নেই সময়!
খুঁজেও যদিবা পান, বলার সাহস পাননা,
তাঁরাই পালন করতে গেছেন মাতৃভাষা দিবস,
শাল-পিয়ালের বনে।
বাংলা ভাষার কথা ওনাদের এইদিনে আসে মনে।
এইদিনটা শাড়ি আর পাঞ্জাবির।
হবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, মর্যাদায় যথোচিত,
অন্যের লেখা বাংলাপাঠেই হবে দিন অতিবাহিত।
অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথ আটকাবে-
আন্তর্জাতিক হতে চাওয়া বাসনাগুলো,
হবে পোশাকবদল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে অর্জিত বিদেশি শব্দগুলো।
(১০)
বাঙালি না বং?
নমস্কার, কে বলছেন, বং?
ঘণ্টার আওয়াজ? না হুঁকোর নল?
ও আগে বলবেন তো! বুঝলাম-
আপনি হলেন বঙ্গদেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ।
অ্যাঁ? সাবলীল বাংলা নয়!
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সাবলীল মিশ্রভাষায়।
তা দিয়েই আমায় ধরাশায়ী করবেন,
অবাঙালি শব্দে ক্ষত-বিক্ষত করবেন।
সমভূমির শান্তিপ্রিয় বাঙালি আমি, সহজেই দিই ধরা।
যদি মেনে নিই জিতে আছেন আপনিই, তবে-
এ চাটুকারিতার পরেও আমার চাকরি রবে কি অধরা?
............
Dr. Tathagata Banerjee
JINR, Joliot-Curie 6, Dubna, Moscow region, Russia-141980, WhatsApp: +91 9643261268;
e-mail: tathagata.iuac@gmail.com
Dr. Tathagata Banerjee
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন