নারীশক্তি : স্বদেশী আন্দোলনের বাঙালি কিছু জ্যোতির্ময়ী
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
নারী শক্তি সমাজের মৌলিক এবং সার্বিক পরিবর্তনে পুরুষের পাশাপাশি একটা সমান্তরাল শক্তি । একটা আন্দোলন । শ্রেণী ,ধর্ম এবং বর্ন নির্বিশেষে সমগ্র নারী সমাজকে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপযুক্ত শিক্ষিত করে , তৈরি করে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে ও উন্নয়নে সামিল করাটাই এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দ্যেশ্য । এই সংগ্রামের জন্য সারা বিশ্বের মহিলারা ( বিশেষ করে স্ত্রী জাতিরা ) সমানে আন্দোলন এবং লড়াই করে চলেছেন । আমাদের দেশ ও এই ব্যাপারে খুব একটা পিছিয়ে নেই । ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের - বিশেষ করে আমাদের এই অবিভক্ত বাংলার মহিলারা আমাদের দেশের স্ত্রী শক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ , উজ্জ্বল জ্যোতির্ময়ী ।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিযুগে বাঙালি নারী জাতি তাদের চিন্তা ভাবনা এবং কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তি এবং ভারত মাতাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে , স্ত্রী শক্তি শুধুমাত্রই একটা সহায়ক শক্তিই নয় , একটি প্রত্যক্ষ সমান্তরাল শক্তি যা কিনা সমগ্র মানব জাতিকে উদ্বুদ্ধ এবং জাগ্রত করে , জোর কদমে এগিয়ে যাওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে ।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার শিক্ষিত মহিলাদের মনে একটা নতুন ভাবনা এবং চিন্তার উদয় ঘটেছিল । তারা সেই আগের অহিংস স্বদেশী আন্দোলনের মিছিল সত্যাগ্রহ এবং ধর্নায় বসবার শুধুমাত্র সংখ্যা বারাবার মাথা হিসেবে নিজেদের মনে করতে আর রাজি হচ্ছিল না । তারা আর বিশ্বাস রাখতে পারলো না নিজেদের অহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহায়ক হিসেবে কাজ করার তত্ত্বে । সব মহিলাদের বেশিরভাগই স্কুল কিংবা কলেজে পড়া ছাত্রী , অথবা উচ্চ শিক্ষিত মহিলা । উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তৎকালীন পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বিপ্লবী সংগঠনের মত দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহিলাদের সংগঠিত করে সমন্তরাল স্ত্রী শক্তির উন্মেষ ঘটাতে শ্রেণি ধর্ম এবং বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদের আরো সক্রিয় করে তুলতে এবং পুরুষদের সাথে অস্ত্রহতে সঙ্গী হওয়ার ভঙ্গিতে স ব্রিটিশ রাজ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে । এই কাজে সেই সময় যারা সবথেকে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন বলাবাহুল্য তাদের বেশিরভাগই ছিলেন তদানীন্তন চট্টগ্রাম আর মেদিনীপুরের মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরের কন্যা এবং মহিলারা ।
চট্টগ্রামের কন্যাদের অবদান ,:
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠা বাঙ্গালীদের বাংলা ভাগ /বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পেক্ষাপটে সেদিন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেশজুড়ে আন্দোলনের ঢেউ তুলেছিলেন , বিপ্লবীরাও ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না । প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সব ছোট ছোট মহিলা সংঘ দিপালী সংঘ ( সংগঠক লীলা নাগ ) ছাত্রী সংঘ (সংগঠক কল্যাণী দাস) শক্তি মন্দির এবং রাষ্ট্রীয় মহিলা সমিতির নামের দুটি সংগঠন (সংগঠক লতিকা ঘোষ ) ইত্যাদি । বলাবাহুল্য এইসব সংগঠনের মাধ্যমে বাংলার নারী এবং মহিলাদের একদিকে যেমন বিপ্লবী ঘরানার কাজকর্মের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা শুরু করেছিলেন তেমনি তৎকালীন বিপ্লবী ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলো অনুশীলন যুগান্তর এবং হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি নেতাদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন কর্মসূচি নির্ধারণ করা শুরু করেছিলেন । যেমন কর্ণ লতিকা ঘোষ এর রাষ্ট্রীয় মহিলা সমিতি জাতীয় কংগ্রেসের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলেও বেশিরভাগ সময়ই তিনি তৎকালীন বিপ্লবী গোষ্ঠী বারীন ঘোষ যুগান্তর দলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন ।
932 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবের তৎকালীন বাংলার গভর্নর জ্যাকসন সাহেবকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন বীণা দাস এবং ন বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , বীণা দাস যে পিস্তলটি দিয়ে জ্যাকসন সাহেবকে গুলি করেছিলেন সেই পিস্তলটি ওকে যোগান দিয়েছিলেন অন্য আর একজন মহিলা বিপ্লবী নাম কমলা দাশগুপ্ত ।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা বিপ্লবী মাস্টারদার আস্থাভাজন ।কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকার সময়েই বিপ্লবী ভাবধারা এবং কাজকর্মে তার হাতে খড়ি ।১৯৩২ সালে বিপ্লবী সূর্যসেনের নির্দেশে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন এই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার । বলা হয়ে থাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা শহীদ ।ছাত্রী সংঘের শক্তির চেতনায় তার বিপ্লবী বড়দিদি কল্যাণী দাস এর সহচর্যে লালিত হয় পরবর্তীতে সভাপতি বিপ্লবী কল্পনা দত্তের সহায়তায় প্রীতিলতা মাস্টারদার বিপ্লবী সংগঠনের যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে জন্ম নিয়া এই অগ্নিকন্যা মাত্র ২১ বছর বয়সেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ।
কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামের আরোও এক বীরাঙ্গনা । মাত্র 17 বছর বয়সেই মাস্টার যার সাথে বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন ,এবং গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে দণ্ডিত হয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে আত্মগোপন করে মাস্টারদার অবর্তমানে যতদিন ফেলেছেন তিনি বিপ্লবীদের পরিচালিত করে গিয়েছিলেন ।
মেদিনীপুরের মহিলাদের অবদান :
তদানীন্তন মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহরের পাঁচগাছিয়ার মেয়ে সিন্ধুবালা মাইতির পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না ।১৯২২ সালে জন্ম এবং ছোটবেলা থেকেই সে দেখতো বাবা মহেন্দ্র মাইতিকে দেখতো যে সে তার নিজের গ্রামে/ অঞ্চলের ব্রিটিশ প্রতিরোধ বাহিনীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতে । বাবা নিজে কোনদিন এই ব্যাপারে মেয়েকে উৎসাহিত না করলেও সিন্ধু বালা শেষ পর্যন্ত সেই পথে হেঁটেছিলেন এবং সব ব্যাপারে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিল তারই গ্রামের এক অতি সাধারণ মহিলা নাম স্বর্ণ লতা মন্ডল ,তার এক দূরের সম্পর্কের আত্মীয় প্রবোধ কুমার মাইতি। সময় বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। মাত্র 10 বছর বয়সেই সিন্ধু বালা বড়দের সাথে কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে যোগদান করেছিলেন । তোমাকে বলা হতো মেদিনীপুরের মহিলা স্বাধীনতা সচেতনতার দূত । জীবনে বহু আন্দোলনে যোগদান করে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছিলেন । সেই সময় পুলিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে তিনি যে কতটা প্রতিবাদী চরিত্র ছিলেন সেটা তৎকালীন কাঁথি থেকে প্রকাশিত কংগ্রেস বার্তা নামক পত্রিকায় একটি উদ্ধৃতি দেখেই পরিষ্কার বোঝা যায় বোঝা যায় - " ধন্যি কুমারী সিন্ধু বালা ,তোমার আদর্শ কণ্ঠিবাসিকে নতুন শক্তিতে অনুপ্রাণিত করো নারী যে অবলা এবং দুর্বল নয় সেটা ঠারে ঠারে দেশবাসী বুঝতে পেরেছিল । সিন্ধুবালার ঘটনায় নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল ।
মাতঙ্গিনী হাজরা : মেদিনীপুরের এই বীরাঙ্গণা মহিলা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম মহিলা শহীদ যিনি গান্ধী বুড়ি নামে খ্যাত ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশের গুলি লাগা সত্ত্বেও মাতঙ্গিনী হাজরা কাছে কংগ্রেসের তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে বন্দেমাতারাম ধনী দিতে দিতে তমলুক থানা কে ব্রিটিশ মুক্ত থানা করার জন্য দখল নিতে গিয়েছিলেন । বাংলা বাহুল্য ওই অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন । ১৮৭০ সালের ১৯শে খবর তমলুক থানার হুগলি গ্রামে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে তার জন্ম ।সংসারের আর্থিক অনটন এবং তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক গ্রামীণ সামাজিক ব্যবস্থার কারণে তার লেখাপড়া শেষ হয়ে ওঠেনি । খুব ছোট বয়সেই তার বিয়ে হয়েছিল । সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । মাত্র 18 বছর বয়সেই তার বৈধব্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। ১৯০৫ সাল থেকে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং বিভিন্ন আন্দোলনে - অসহযোগ আন্দোলন , আইন অমান্য আন্দোলন , ভারত ছাড়ো আন্দোলন , ইত্যাদিতে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার ও কারাবরণ করেন ।
১৯৪২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর একাত্তর বছর বয়সে মেদিনীপুর শহরে ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় প্রায় সহস্রাধিক মহিলা কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক এবং মহিলা সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে তিনি তমলুক থানা দখল করতে গিয়েছিলেন , কিন্তু সেদিন তিনি সেই কাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি । মাতঙ্গিনী হাজরার সেদিনের ঐ বীরত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেইসময় তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের কাগজ "বিপ্লবী"তে লেখা হয়েছিল - মহান নেত্রী বলে উল্লেখ করে ।
অনেক ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার এইসব মহিলাদের আত্মহত্যা এবং রক্ত মাখানো কার্যকলাপ পরবর্তীকালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল ।ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গলের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর একটি মহিলা ব্রিগেড রানী ঝাঁসি রেজিমেন্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বসবাসকারী প্রায় ১৫০০ জন মহিলা - জাতি-ধর্ম এবং বর্ণ নির্বিশেষে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন ।
জেনো আমাদের দেশে আবার সেই নারী শক্তির অংশগ্রহণ এবং জাগরণ বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ।
ঠিকানা :
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
৩৭/১, স্বামী শিবা নন্দ রোড
চৌধুরীপাড়া
বারাসাত
কলকাতা - ৭০০১২৪
মোবাইল নম্বর - ৮৭৭৭৬৮৫৯৯২
হোয়াটস অ্যাপ নম্বর- ৯৪৩৩০২৮৬৮৫
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন