Featured Post
নারীবাদ ও আজকের নারী - একটি মূল্যায়ন ।। সৌমিক ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নারীবাদ ও আজকের নারী – একটি মূল্যায়ন
সৌমিক ঘোষ
বর্তমানে 'নারীবাদ' সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে ।সাধারণভাবে বলা যায় যে নারীবাদ হল এমন একটি শক্তি যা নারীজাতিকে একটি আত্মসচেতন সামাজিক শ্রেনিতে পরিণত করেছে । নারীবাদ এমন এক তত্ত্ব যা নারীর সমানাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সমাজের যে কোন স্তরে প্রযোজ্য । যে কোন আর্থ–সামাজিক পরিকাঠামোতে নারী যেন তার নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে ।পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবহেলিত অবস্থান , পারিবারিক মূল্যবোধের বৈষম্য , কার্যকরী মতবিরোধ এর সমাধান সূত্র খুঁজে বার করতে আজকের দিনে 'নারীবাদ' চর্চা –এর সুফল হল বিভিন্ন গোষ্ঠী , সংগঠন , আলোচনা , মতামত-বিনিময় এর সুবাদে নারীকল্যাণে প্রশাসন সচেষ্ট ।
ইতিহাসের পাতায় ফরাসী বিপ্লবই (১৭৮৯) নারীবাদী আন্দোলনের শুরু ।চিরাচরিত বিধিনিষেধের গণ্ডী থেকে নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার কথা শোনা গেলেও তৎকালীন সমাজে গুরুত্ব পায়নি ।ফরাসি দেশে নারীদের জীবনরীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা ইউরোপের নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ে ।ডেনমার্কের কোপেনহাগেন-এ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে (১৯১০) ১৭টি দেশের ১০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ৮ই মার্চকে 'আন্তর্জাতিক নারীদিবস' হিসাবে পালনের প্রস্তাব নেওয়া হয় । ১৯১৪ সাল থেকে ৮ই মার্চ 'আন্তর্জাতিক নারীদিবস' হিসাবে চিহ্নিত
হয় ।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে সতীদাহ প্রথার বিরোধীতার মাধ্যমে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা ।এরপর নানান জাতীয় আন্দোলনে নারীদের সামিল হওয়া ও স্বতন্ত্র নারী সংগঠন গড়ে ওঠে । স্বাধীন ভারতে বাড়ির মধ্যে ও বাড়ির বাইরে মেয়েদের মর্যাদা বজায় রাখাই নারীবাদের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ।
বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারীরা জীবনের সকলক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার পেয়েছে ।এইসময়ে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন ।মধ্যযুগে ভারতীয় সমাজে বাল্যবিবাহের প্রচলন ও বিধবাদের পুনর্বিবাহে নিষেধাজ্ঞা নারীদের অবস্থার অবনতি ঘটায় ।মুসলমান সমাজে পর্দা প্রথা , রাজপুতগদের জওহর প্রথা , দেবদাসী প্রথায় যৌন নির্যাতন , বহু বিবাহ প্রথার প্রচলন নারীদের জীবনকে কলঙ্কিত করেছিল ।
আধুনিক ভারতে প্রথা অবলুপ্ত হলেও কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা আজও লাঞ্ছিত হন ।
ভারতের সংবিধান সব ভারতীয় নারীকে সাম্য(ধারা ১৪), রাষ্ট্রের দ্বারা কোন বৈষম্যের মুখোমুখি না হওয়া(অনুচ্ছেদ ১৫-১),সমান সুযোগলাভ(ধারা ১৬) এবং একই কাজের জন্য সমান বেতন(ধারা ৩৯-ডি ও ধারা ৪২) লাভের অধিকার দিয়েছে ।এছাড়াও সংবিধান ,- রাজ্য সরকার কর্তৃক বিধান প্রণয়ন মাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননা মূলক আচরণের বিরোধিতা(অনুচ্ছেদ ৫১-এ-ই ),নারীদের জন্য কাজকর্মের অনুকূল সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা ও মাতৃত্বকালীন সুযোগের ব্যবস্থা করা(ধারা ৪২);-সংস্থান রেখেছে ।
ভারতে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে নারীবাদী কাজকর্মের সক্রিয়তা বাড়ে । নানা আইন সংশোধন করা হয় । শিশুকন্যা ভ্রূণ হত্যা ,লিঙ্গ বৈষম্য ,নারী স্বাস্থ্য ,নারী নিরাপত্তা ,নারী শিক্ষা বিষয়ে নারী আন্দোলনের কর্মিরা একতাবদ্ধ হয় ।১৯৯০ সালে বেশ কিছু বিদেশী সংস্থার অনুদানে নতুন নারী-কেন্দ্রিক বেসরকারী সংগঠন গড়ে ওঠে ।২০০১ সালে নারী ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় নীতিটি ভারত সরকার অনুমোদন ও গ্রহণ করেন ।যদিও বিশ্বের নানা সমীক্ষায় ভারতে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে সাংখ্যমাণ যথেষ্ঠ উদ্বেগজনক ;- তবুও ২০১০ সালের ৯ই মার্চ রাজ্যসভায় 'মহিলা সংরক্ষন বিল' পাশ হয় ।
১৯৯২ সাল থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ শুরু হয় ।ভারতে নারী সাক্ষরতার হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে ।বিপুল সংখ্যক নানা বয়সের নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ
করছে ।গ্রামীণ ভারতে কৃষি এবং কৃষিসংক্রান্ত শিল্পে প্রায় ৯০ শতাংশ নারী শ্রমিক ।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ৪০ শতাংশ নারী কর্মরত ।২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার (সংশোধন) আইন পাশ হওয়ার ভারতীয় নারীরা ধর্ম , গোত্র , বৈবাহিক সম্পর্কের প্রথাগত জটিলতা ছাড়াই সম্পত্তির মালিকানা পেতে পারেন। বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি নারী রাজনীতিবিদ আছেন , ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম ।
তবুও ভারতীয় নারীদের উপর পারিবারিক , সামাজিক , রাজনৈতিক , ধর্মীয় , কর্মক্ষেত্রে – সর্বত্র নির্যাতন – ধর্ষণ , হত্যা লেগেই আছে । ১৮৬০ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর এখনও বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি । শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নতির পরেও বিধবাদের জীবনরীতি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি । ভারতে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী গার্হস্থ্য হিংসায় নির্যাতিত হন । ১৯৮০ সালে ফৌজদারী আইনে ৪৯৮ – এ ধারা অনুযায়ী 'একজন নারীর স্বামী বা স্বামীর আত্মীয় দ্বারা নির্যাতন –এর আইনি প্রতিকার' ব্যবস্থা করা হয় ।কিন্তু নারীবাদী আন্দোলনের কলঙ্ক ,- এই যে আজকের দিনে বহু বিধবা , চাকুরীরতা , শিক্ষিতা , একাকী নারী এই আইনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে্ন ও 'বিবাহ নামক প্রহসন' –এর মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে পুরুষদের কাছ থেকে পুলিশ , মামলা , অপমানে প্রচুর টাকা আদায় করছেন ।
ভারতে নারীদের প্রতি যে কোন শারীরিক , মানসিক বা যৌন নির্যাতনের প্রতিকার ব্যবস্থা থাকলেও পদ্ধতির জটিলতার জন্য বেশিরভাগ নারী অভিযোগ জানাতে অনাগ্রহী । আবার ভারতে যৌতুক সংক্রান্ত কারণে প্রতিদিন কিছু সংখ্যক নারী 'রান্নাঘরের আগুনে' মারা
যায় ,- যা আইনি জটিলতা , মামলা , পুলিশ , ঘুষ ও উপরমহলের চাপে নারীবাদী আন্দোলনকে উপেক্ষা করে ।শৈশব ,কৈশোর ,যৌবন ,পরিণত , বার্ধক্য , - সব বয়সকালেই নারী অবাধ নিপীড়নের শিকার । ঘরে – বাইরে নারী একা । সে সকলের দায়িত্ব পালন
করে ;- কিন্তু তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সকলেই এড়িয়ে যায় ।বিজ্ঞানের সহযোগিতায় নারী নিজেই গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ জেনে কণ্যা-ভ্রূণকে এই নির্মম পৃথিবীতে আসতে দেয় না ।
কারণ শহর – শহরতলি – গ্রাম সব জায়গাতেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় কেবলমাত্র
পুরুষ-ভ্রূণ স্বাগত ।আজও ভারতীয়দের মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসে 'ডাইনি' অপবাদে নারীদের যথেচ্ছ নিপীড়ন করা হয় । প্রশাসন ও নারীবাদী সংগঠন প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে সচেষ্ট থাকলেও প্রচুর নারীমৃত্যু ঘটছে ।
১৯৮৭ সালে 'নারীদের অশালীনভাবে উপস্থাপন (নিষিদ্ধকরণ)' আইন চালু হলেও সমাজ-মাধ্যমে আধুনিকতার ছোঁয়ায় স্বাধীন-নারীবাদী –"নারী" সমাজে পুরুষ দ্বারা আরও অবাধে যৌন হেনস্থা বা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে । কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন লাঞ্ছনা নিয়ন্ত্রনে ২০১০ সালে বিশেষ আইন চালু হয় ।
ভারতে বর্তমানে যত নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে – সে সম্পর্কে সব অভিযোগ নথিভুক্ত হয় না ; কারণ নির্যাতিতারা তাদের পরিবারের থেকে সমর্থন ও সহমর্মিতা না পাওয়ার আশঙ্কায়
ভোগে ।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে আজকের নারী শিক্ষা-তথ্য-তত্ত্ব-আইন-সংগঠন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে নিজ দেহসৌষ্ঠব , সৌন্দর্য্য , উন্নত মানসিকতা , মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ভীষন একা । এই একাকীত্বে সমাজে প্রকৃত নারী-জীবন সচেতনতা জানাতে পারে – "নারী তুমি বেঁচে থাকো নিজের মত , আর তোমার আধার থেকে সৃষ্ট 'আমাদেরও' আগলে রাখো" ।
=======================
সৌমিক ঘোষ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন