Featured Post
ছোটগল্প ।। সঞ্জীব সেন
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শিউলিদির কাছে শেখা
সঞ্জীব সেন
কিছুদিন ধরে শিউলিদির কথা খুব মনে পড়ছে, গ্রামের বাড়ি । পাকাপাকি ভাবে কলকাতা শহরে চলে আসার পর গ্রামে যাওয়াও হয়নি, জীবনের একটা সময় এসে মনে হয় জীবনটা আসলে একটা বৃত্ত। যেখান থেকে শুরু করেছি সেখানে ফিরে যেতে চায় মন । এতদিন কাজের ভিতর ব্যস্ততার ভিতর শৈশব ফেলে আসা পরিজন,এসব ভাবার অবসর হয়নি। লকডাউন থেকে এখন আনলক। ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে । করোনা আতঙ্ক বুকে নিয়ে লোক পথে নামছে । রুজি রোজগারে । কিছু লোকের চাকরি গেছে। কিছু লোক জীবিকা পালটে ফেলেছে । প্যারাটিচার থেকে কলা বিক্রেতা । যাইহোক এসব নিয়েই চলতে হবে । এই দেখুন সেই ঘুরে ফিরে করোনার কথায় ফিরে যাচ্ছি । আমি তো শিউলিদির কথা বলতে চাইছিলাম এতক্ষণ ।তবে শুনুন এখানে শিউলি শুধু একটা নাম নয় । তার চেয়ে বলা ভাল শিউলিদিদের কথা ।
তখন পাড়ার দাদারা রাজেশ খান্নাকে ছেড়ে বচ্চনের মত স্টাইল করছে । অবশ্য তখন কথাটা ছিল বচ্চন কাট ।ফাস্ট ডে ফাস্ট সো এ ইয়ারানা সিনেমা দেখতে গিয়ে হাউসফুল দেখে মুখচুন করে ফিরে এসেছে । তখন বাশবেড়িয়ার মত মফরসল শহরে নতুন সিনেমা আসত অনেক পরে । ততদিনে ইয়ারানা মারমার কাটকাট । দাদারা তখন সবাই বচ্চন । তখন 'সিনে এডভান্স' বলে সিনেমার পেপার আসত । তবে সেগুলো আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল । আমরা দেখতে চাইলে বলত ভাগ শালা । আগে আমাদের মত ফুল প্যান্ট পর তারপর । আর আমাদের আগ্রহ আরও বেড়ে যেত । তখন সব ইটালিয়ান সেলুন । মানে গাছের নিচে ইট পেতে দেওয়া । দরমার বেড়ার চেয়ার পাতা সেলুন ছিল একটাই মন্টার সেলুন । ওর দোকানে এই পেপার রাখত । জেনেছিলাম বাবার সঙ্গে গিয়ে। কিন্তু হাত দেওয়ার সাহস সয়নি । একটা ছবি ছিল ফ্রন্ট পেজে এখনও মনে আছে । মেয়েদের ব্লাউজের মত একটা পোশাক ফিতে দেওয়া ঝর্নার জলে বসে আছে । উপরে লেখা ছিল বিকিনী সুন্দরী জিনতামান । তখন বুঝেছি কেন দাদারা বারণ করে । তখন দুর্গাপুজোয় বাড়ি কালেকশনে দাদাদের সঙ্গে আমরাও সামিল হতাম । তবে বেপাড়া যাওয়ার আগে দাদারা ভাগিয়ে দিত ।শিউলি দি ছিল স্যারের মেয়ে আমার চেয়ে চারবছরের বড় । তখন নাইনে পড়ে। সবাই বলত শিউলি স্ট্যান্ড করবে । পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল । তখন মেয়েরা ঘরে ম্যাক্সি পড়ত না ফ্রক পড়ত । আর ফরসা পা নিয়ে কিতকিত কিম্বা কবাডি খেলত। দাদাদের বলতে শুনেছি শিউলিটা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠছে , দেখেছিস । তখন পল্টু দা মাঙ্কু দা হেসে উঠত । শিউলি দিই আমাকে বলত সখা । শিউলিদির বন্ধুরা পিয়ালিদি বিউটি দি বলত কৃষ্নসখা । আর তুই রাধা । আর হাসত । আমিও না বুঝে হাসতাম । শিউলিদিকে সিনে এডভান্স পড়তে দেখেছি । লুকিয়ে নেয়নি বা বারণ করেনি। বলেছে বাবাকে বলবি না,, আমিও বলিনি। শিউলিদি মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করল । স্টার মার্কস । আমি তখন সিক্সে পড়ি । সবার মুখে শিউলদির প্রশংসা। মায়েরা বলত শিউলির মত রেজাল্ট করতে হবে । তখন আমারও খুব গর্ব হত ।
আমি স্যারের কাছে পড়তে যেতাম । স্যার কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করত । স্যারের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে আমাদের বাড়ি। চার কাঠার উপর সামনে উঠোন ছিল বাগানে চালতা আর পেয়ারার গাছ ছিল । উঠোনে বন্ধুদের সঙ্গে কিতকিত খেলত । পিয়ালিদি বিউটি দি । মাঝেমধ্যে আমিও খেলতাম । স্যার মানে অশোক কাকা আর কাকিমা খুব ভালবাসত । শিউলিদির একটা ভাই ছিল । নাম ছিল রাজু। আমার চেয়ে বছর দুই ছোট । পড়াশুনা খেলা নিয়ে বেশ ভাল ছিল সেই দিনগুলো । শিউলিদি চালতা মাখা করত । আমিও খেতাম । শিউলিদি গাছে উঠে পেয়ারা পাড়ত । শিউলিদি তখন কলেজে পড়ত । উচ্চমাধ্যমিকেও ভাল রেজাল্ট । ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়ছে । আমি নাইনে পড়ছি । তখন বাশবেড়িয়ায় পরিবর্তন চলছে । পালটে যাচ্ছে সবকিছু । নতুন লোক আসছে । বাড়িতে বাড়িতে টিভি । ছাদে এন্টেনা । বাংলাদেশের বুস্টার । পরিবর্তন দরকার । পরিবর্তন আটকানো যায় না। ছোঁয়াচে রোগের মত । এটুকু বুঝতে পারতাম । শিউলি দি অনার্স পাশ করে এম এ পড়ছে । আমি এইচ এস । স্যারের হঠাৎ ম্যেসিভ হার্টাটেক । সময় দিল না । সকালে জানার পর সবার শোকের ছায়া । আমি তখন কোচিং এ পড়তাম । তারপর স্যারের জায়গায় চাকরি পেল শিউলি দি ।শিউলি শিক্ষিত ছিল বলে স্যারের পোস্টেই বহাল হল । শিউলিদি ব্যাল্ডেল থেকে ডেলি প্যশেনঞ্জারী করছে । প্রায় দুঘন্টার রাস্তা। আমি কলেজ করছি । দেখা হয় মাঝেমধ্যে । পুজো আসে। শরৎকাল । শিউলিফুল ফোটে। স্যারেদের উঠোনে ছড়িয়ে থাকে ফুল । শিউলিদির সময় হয় না । রাজু পড়াশুনা করল না । মাধ্যমিকের পর ভর্তী হয়েছিল । হায়ার সেকেন্ডারী দেয়নি । তখন থেকে আমি ব্যাঙ্কিং পরীক্ষা দিচ্ছি । ব্যাঙ্গে নতুন নিয়োগ হচ্ছে । ক্লাকশিপ পরীক্ষা গুলো দিচ্ছি । খেতে বসে একদিন মায়ের মুখেই শুনলাম । রাজু নাকি বিয়ে করছে । রাজু একটা মেয়ের সাথে প্রেম করত । জানতাম । মাকে বললাম ওই তো একটা চাকরি করে । শিউলিদি ঠিক করে দিয়েছে । বড়জোর হাজার তিন পায় । পারমেন্ট নয় । শাউলিদির কাছ থেকে জানতে পারলাম সব । বাসে যেতে যেতে । কদিন আগে শিউলিদিকে কাকিমা বলেছিল রাজুর জন্য একটা মেয়ে দেখত বিয়ে দিয়ে দিই । কাকিমা সব জানত । ঘটক ডাকা একটা নাটক । রাজু যে অর্পিতার সঙ্গে প্রেম করে সবকিছু আগে থেকেই জানত । ঘটক এসেছিল। এসে বলেছিল শিউলিদির কথা । শিউলির জন্য ভাল ছেলে আছে । মাস্টার । বললে দেখতে পারি ।কাকিমা কি একটা বলল ঘটক আর কথা বাড়ায়নি । জানি কাকিমা কি বলছিল । শিউলিদির বিয়ে হলে মাস গেলে মাইনেটা কি হবে ! শিউলিদিও বুঝিছিল! অর্পিতা যে বাড়ি চলে আসবে এতটা ভাবিনি ! আর কি হবে! খুব দুঃখ হয় জানিস ।সবাই সব লুকিয়ে যায় । কেমন যেন ভয় ভয়ে থাকে । আমি কি বাঘ না ভাল্লুক ! আমি বললাম শিউলিদি তুমি বিয়ে করবে না । তোমার বন্ধুরা সব বিয়ে করে নিল , শিউলি দি বলেছিল , ধর তুই একটা মরা পাখিকে আকাশে ছুঁড়ে দিলি আর একটা জ্যান্ত পাখিকেও ছুঁড়ে দিল । দেখলি মরা পাখিটা নিচে এসে পরল । আর জ্যান্ত পাখিটা উড়ে গেল । পাখিটা যে উড়ে গেল ওর ইচ্ছাতে আর আমি জ্যান্ত হলেও নিচেই এসে পড়লাম । মরা পাখিটার মত । এই ইচ্ছা আর অনিচ্ছের মধ্যে আটকে আছি আমি । বুঝলি । কিছুক্ষণ পর বলল চাঁদ যদি ভাবত যে ও নিজের ইচ্ছাতেই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে তাহলে সেটা কী ঠিক হত ! সেরকম আমাকে ঘোরাচ্ছে তাই ঘুরছি । আমার ফ্রি উইল নেই । মরা পাখিটার মত । জ্যান্ত হলেও সেই নিচে এসে পরতাম । আমাদের মত মেয়েদের ফ্রি উইল বলে কিছু হয় না । বাবার চাকরি করি না! এরপর আর কোন কথা বলতে পারিনি ।
পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে এলাম । ইউকো ব্যাঙ্কে চাকরি করছি । একটু আধতু লেখালেখি করছি । পত্রিকা কিনতে কলেজস্ট্রিট আসতে হয় । মাঝেমধ্যে করপরেশনের সামনে শিউলিদির সঙ্গে দেখা হয় । কোনোদিন সময় করে যাই শিউলিদির সাথে গল্প করতে । শিউলিদিকে দেখলে ছেলেবেলা মনে পরে যায় । ভাল লাগে দিনগুলোর কথা মনে পরলে । অনেকদিন পর শিউলিদির সাথে দেখা হল । পুজোবার্ষিকী তে গল্প বেড়িয়েছে শুনে বেশ খুশি হল ।বলল গল্পটা ফটোকপি করে পাঠিয়ে দিস সময় করে পড়ব । বলল অর্পিতা খুব খারাপ ব্যবহার করে । বলার মধ্যে বলেছিলাম পুজো আসছে বর্ষায় শিউলিগাছটার নিচে আগাছায় ভরে গেছে । কাল একজন আসবে কাজগুলো বুঝিয়ে দিস । বলল আমি পারব না । এই অবস্থায় কি করে বল! মাঝেমধ্যে অনেক কথা শোনায় । সেদিন আমি বলেছি আগে শুনতাম বাচ্চা আসলে কাজের মধ্যে থাকলে বাচ্চা সুস্থ সবল হয় মায়ের মুখেও শুনেছি । এখন দেখি উল্টো । তখন কিছু বলল না রাজু আসলে আনসান কথা শুনিয়েছে । আমি কটা বাচ্চা বার করেছি যে বিজ্ঞের মত কথা বলছি । কাথাতক সহ্য করা যায় বল । ইদানিং জমি নিয়ে পড়েছে অর্পিতার এক ভাই প্রোমটিং করে । এখন সে বুদ্ধি দিচ্ছে ফ্লাট করতে । কিন্তু আমি রাজি হয়নি । এই নিয়ে ডেলি ঝগড়া। আমি নাকি ভাইয়ের ভাল হোক চাইনি কোনদিন! ভয় দেখায় বাপের বাড়ি চলে যাব । থাকুক সম্পত্তি নিয়ে । বাবার চাকড়ি করেও এত ফুটানি ! রাজুটা হয়েছে ভেড়া ,কিছু বলে না । একদম লো ক্লাস ম্যেন্টালিটি। দেখতে পাই শিউউলিদির চোখে জল ।
সময়ের সাথে কাজের ব্যস্তস্তায় অনেকদিন দেখা হয়নি । সামনে পুজো আসছে । কলেজস্ট্রিট এসেছি । দেখি শিউলিদি এক-ব্যাগ পুজোর কেনাকাটা করেছে । বলল অর্পিতা আর কুমকুম জুতো কিনতে সোরুমে গেছে । কুমকুম বিরিয়ানি খেতে চাইছিল অনেকদিন । তাই নিয়ে এলাম । না বলে পারলাম না এতকিছুর পরেও। তুমি সত্যি ! শিউলি দি বলল কি করব বল । আমারই তো ভাই এর বৌ । ভাইঝি ! ফেরার পথে বাসে দেখলাম বেশ ফাঁকা । ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন বসে আছে । চোখে ঘুম লেগে যাচ্ছে অন্য দিন এমনটা হয় না । চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম হয়ত ঘুমিয়ে পরেছিলাম । দেখলাম বাশবেড়িয়া । স্যারেদের উঠান গঙ্গার ধারে কাশবন । শিউলিদি কিতকিত খেলছে । নাটমন্দিরে প্রতিবারের মত শিউলিদি এবারেও আগমনী গান গাইবে । স্যার বলছে আজ থেকে ছুটি আবার লক্ষী পুজোর পরের দিন । সেদিন কিন্তু পুজোয় কেমন কাটালি লিখে নিয়ে আসবি । নাটমন্দিরে ডাকের সাজে সেজে উঠছে মৃন্ময়ী মূর্তি । হ্যাঁচকা টানে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল । সামনে জ্যাম । পাশের লোকটা বলল পুজোর বাজার শুরু হয়েছে না এই শুরু হল! আবার চোখ বন্ধ করে ভাবলাম শিউলি দি বলত সবার ফ্রিউইল থাকে না বাবার চাকরি করি না ,বুঝলি!
===================
সঞ্জীব সেন
পানিহাটী গৌরাঙ্গ ঘাট রোড
পোস্ট পানিহাটী
কলকাতা114
7980188285
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন