Featured Post
নারীর সূচিতা ভাবনা ও আমরা ।। আব্দুস সালাম
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
নারীর সূচিতা ভাবনা ও আমরা
আব্দুস সালাম
নারীর সূচিতা এবং পবিত্রতা নিয়ে আবহমানকাল ধরে গড়ে উঠেছে রক্ষণশীল মূল্যবোধ। এই বিংশ শতাব্দীর যুগেও সমহারে তার প্রয়োগ আমরা উপলব্ধি করি। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তার সবিস্তার অব্যাহত। এই একপেশে মূল্যবোধ মানুষকে করে তুলেছে স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক ও অবিবেচক।অথচ পাশ্চাত্য ভাবধারায় এর বাছবিচার অনেক কম। প্রাচ্য দেশে মূলত ,আমাদের দেশে স্বার্থপরতার পরিমাণ নিঃসন্দেহে তুলনাতিত।আকর সাহিত্য রামায়ণ যদি আমরা দেখি তবে দেখতে পাই রাবণ দ্বারা অপহৃতা সীতা কে রাম নিজ ঘরে আনলেও তাকে সুখে অবস্থান করতে দেয়নি।আমাদের স্নার্ত বিধান এবং হাঁচি - পাঁজির অনু শাসিত সমাজ সূচিতা নামক বস্তু কে খুব বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। গ্রীক প্রজারা হিলেম এবং টিউটন প্রজারা ব্রুনহিলন্ডের সূচিতা নিয়ে কোনরূপ কানাকানি করেনি।
রামায়ণের কাহানি সূত্র যদি ধরে নেই তবে আমরা এখনো নৈতিক মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারিনি। সীতার যে সমস্যা রামায়ণে চিত্রিত হয়েছে তা এ কালের পরিপ্রেক্ষিতে তার রূপ টা হয়তো আলাদা কিন্তু ভেতরের কাঠামোর বিশেষ বদল ঘটেনি । রাম সীতা উদ্ধার করে তার প্রাণাধিকার প্রতি যে আচরণ করেছেন তা যে কোন সাধারণ মানুষের মনে সহানুভূতির আঁচড় কাটে । লঙ্কা তে রাবন কে পরাজিত করে রাম যখন জয়ী হলেন এবং সীতা উদ্ধার হল তারপর সীতাকে বিধান দিলেন "অশোক বন থেকে অবগুন্ঠিত হয়ে সমুদ্রের ধারে হেঁটে এসে উপস্থিত হবেন" এমন এক আদেশ শুনে লক্ষণ , হনুমান, সুগ্রীব, বিভীষণ এমনকি পার্শ সহচর বৃন্দ বিস্মিত হয়ে যান । নিঃসন্দেহে এরূপ আচরণ সীতার পক্ষে এমনকি সমগ্র নারী জাতির পক্ষে একান্তই অবমাননাকর । এতে তার কি দোষ ! অপহৃতা হলেন তাদের ভুলে আর আর খেসারত গুনতে হচ্ছে তাকে। হায় ভগবান নিয়তির কি পরিহাস। ভগবান রামের এত ভালোবাসা গেল কোথায় ? মনে প্রশ্ন জাগে । সহচরবৃন্দ অবাক নয়নে চেয়ে আছেন । মেলশ্যাভিনিষ্ট সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা যে কত নিরুপায় তা দিনের আলোর মতো পরিস্কার । সীতা মা যখন কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন তখন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো রাম তাকে বলছেন, "আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি শুধু বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্য, এখন তোমার উপস্থিতি আমার কাছে চক্ষুশূল। কোন তেজস্বী পুরুষ কখনোই পরের ঘরে বাস করা রমণীকে গ্রহণ করতে পারে না । তোমাকে আর স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে কখনোই ঘরে রাখতে পারি না ।" হায়রে রমণী ভাগ্য-- যার অপদার্থতার জন্য এমন পরিণতি হলো তার কোন দোষ হলো না, সমস্ত দায় এসে পড়ল স্ত্রীর উপর । হায়রে সামাজিক বিধান। একবারও কেউ সীতার মনের খবর জানার চেষ্টা করল না। পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে তার খেলার পুতুল হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে। রামের সামাজিক নৈতিকতার যে বিকট রূপ প্রকাশিত হয়েছে তাতে একবিংশ শতাব্দীর যুগেও আবহমানকাল ধরে লোকে তাকে মান্যতা দিয়ে আসছে ।
অপহৃতা নারী তার সূচীতাকে ধরে রাখতে পারলেও লোকাপবাদ তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । সীতার মত নিঃশব্দে প্রতিবাদ জানাতে কতো নারী যে ধরিত্রীর কোলে লীন হয়ে গেছে তার হিসেব কে রাখে । নারী যদি স্বেচ্ছায় অপহৃতা হয়, নিজের কামনা বাসনাকে তৃপ্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা নেয় তবে সে টা তার দোষ । কিন্তু নারী তার স্বামীর সাথে থাকতে থাকতে যদি কোনো দুর্বৃত্ত তাকে অপহরণ করে ও তার সুচিতা নষ্ট করে তবে তার কি দোষ? স্বামীর অপদার্থতাই এখানে মূল বিচার্য হওয়া উচিত ।অপহৃতা যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন স্বামী ভুলে যায় তার অপদার্থের কথা, অকর্মণ্যতার কথা । স্ত্রীর উপর দোষারোপ করে ঢেকে দেয় তার ব্যর্থতা । সীতা মা তার পতি দেবতার অসহনীয় কথাবার্তা শুনে ধরিত্রী কোলে লীন হয়ে যান ।
এই সমাজে ফিরে আসা অপহৃতার জন্য আমরা দরজা খোলা রাখি না । ওরা তখন হয়ে যায় সমাজের চোখে অন্য মানুষ, অপহৃতা, অপহৃতা, ধর্ষিতা, ধর্ষিতা! যেহেতু সুচিতা অন্য পুরুষের নষ্ট করেছে তাই সমাজে তার স্থান নাই। তাই এখন অন্যের রক্ষিতা হয়ে কিংবা কোন মাসীর খপ্পরে পড়ে গণিকালয় তাকে থাকতে বাধ্য করা হয় । অপহৃতা ,ধর্ষিতার মানসিক যন্ত্রণার কথা একবারও উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না । অপহৃতা রমণীকে মার্গগামী বলতে দ্বিধা করি না । কেবল কালাতিপাত করার জন্য ঐ সকল রমণীকে হয় রক্ষিতা কিংবা স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য করা হয়। ঐ সকল পুরুষ নারীকে অবলীলাক্রমে ভোগ করে তাদের যৌন তৃষ্ণা নিবারণ করে, বিবেক তাদের আলোড়িত হয় না । অন্য নারীকে যথেচ্ছভাবে ভোগ করতে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে উপবাসী থাকতে হয় । তার মনের দিকে খেয়াল থাকে না । আবার উপবাসী নারী যদি তার যৌবন অন্য পুরুষকে লুটে নিতে দেয় তবে নারীর কী দোষ? সমাজ বিচার করে দেখুক । আমরা পুরুষ, তাই নারীকে যথেচ্ছভাবে ভোগ করার অধিকার আমাদের আছে । তোমরা তো মানুষ নও তোমরা নারী। তাই তোমরা তোমাদের সূচিতা আঁচল দিয়ে সুরক্ষিত করে রাখ। এতে তোমাদের মন যতই ক্ষতবিক্ষত হোক না কেন সমাজের তাতে কিছু এসে যায় না । তোমরা তো মানুষ নও তোমরা ( মানসী) নারী।
শ্লেভিনিষ্ট মূল্যবোধই আমাদের বিবেককে তাড়িত করে চলেছে। ঘরে ফেরা নারীদের আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। আর বাড়িমুখী হলে তাদের জন্য আমরা দুয়ার খুলেও রাখি না । তখন নারীদের আত্মহত্যা অথবা গণিকালয় অবস্থান করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না । যদি সমাজ জানতে পারে মেয়েটি অপহৃতা ধর্ষিতা তাহলে তার যতদিন না পর্যন্ত মরণ হচ্ছে ততদিন সে সমাজে অপাংক্তেয়। তাকে আমরা ভালো চোখে কখনোই দেখিনা, দেখার চেষ্টা ও করি না ।
একবিংশ শতাব্দীতে যতই আমরা নারী-পুরুষের সমানাধিকার মেনে নিই না কেন পুরুষশাসিত সমাজে শুদ্ধ সুচিতা নামক কথাটি সমাজে এমন ভাবে লেপ্টে আছে যে, এর থেকে নিস্তার পাওয়া বা পরিত্রাণ পাওয়া অতি দুরহ কাজ বলে মনে করি । সীতা মায়ের ধরিত্রী লিন হওয়ার চাইতেও জীবনধারণ করা অনেক বেশি ভয়াবহ কাজ তাতে কোন সন্দেহই নেই । সীতা সমাজে যে অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিলেন তা তার সুচিতা রক্ষিত আছে তার পরীক্ষা দিতে নয় বরং এটা তার নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা । মণিপুরে নগ্ন মিছিল ফ্রান্সে নগ্ন মহিলা মিছিল হল পুরুষশাসিত সমাজের প্রতি বিদ্বেষের ভাষা। সীতা মা হলেন আমাদের মহিলা সমাজের প্রতিবাদী প্রতিভূ। যিনি স্বামীর কাছে আদৃতা হয়েও তিনি বাস করে এলেন অন্য পুরুষের ঘরে।
শ্লেভিনিষ্ট সমাজ-ব্যবস্থায় মেয়েরা যে কত অসহায় তা আমরা প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই। ফ্যানের সঙ্গে শাড়ী বেঁধে ঝুলে পড়া, গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগানো, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া , বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া, রেল লাইনে মাথা মাথা দেওয়া ,এগুলো সবই সমাজের সূচি বিধান এবং মেয়েদের নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায় অথচ স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে এটা প্রতিবাদের ভাষা। দুর্বলের প্রতিবাদের ভাষা । এই ভাষা হৃদয়ঘটিত অবমাননার ভাষা। শুধু এই বোধ টুকু যদি আমাদের আসে ও উপলব্ধি করি তবে জানতে পারবো একটা মানুষ কতখানি নির্যাতিত হলে আত্মহননের পথ বেছে নেয় । তাই সীতা মা সেদিন পুরুষশাসিত সমাজের প্রতি বিদ্রোহ করে বলেছিলেন দেবী মাধবী( ধরিত্রী) তুমি আমাকে কাছে টেনে নাও।
হায়রে পুরুষশাসিত সমাজ। পৌরুষতার কি বহিঃপ্রকাশ। পৌরুষতার অহমিকায় আমরা ধর্ষণ করি , ধর্ষণ করে খুন করি। মুখে এসিড ছুড়ে দিই । পৌরষত্ব জাহির করি । নারীদের কোন অহংকার নেই, কোন গর্ব নেই। বুক ফুলিয়ে তারা কিছু করতে পারবে না, কেননা তাদের সুচিতা নষ্ট হবে যে। যদি সমাজ জানতে পারে মেয়েটি অপহৃতা বা ধর্ষিতা তাহলে তার যতদিন না পর্যন্ত মরণ হচ্ছে ততদিন সে সমাজে অপাঙক্তেয়।
একবিংশ একবিংশ শতাব্দীতে যতই আমরা নারী-পুরুষের সমানাধিকার মেনে গর্ব করি না কেন পুরুষশাসিত সমাজে শুদ্ধ সুচিতা নামক কথাটি এমনভাবে গ্রথিত হয়ে আছে যে এর থেকে নিস্তার পাওয়া অতীব দুরূহ কাজ। সীতা মায়ের ধরিত্রীর বুকে লীন হওয়ার চাইতেও জীবনধারণ করা অনেক বেশি ভয়াবহ। নারীর অসহায়ত্ব নিয়েও সাহিত্যের আঙিনায় পুরুষদের দাপাদাপি দেখি। পুরুষেরা নারীর মর্মবেদনাকে কাজে লাগিয়ে পুরুষশাসিত সমাজের মুখোশ খোলার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তাদের খেসারতও দিতে হয়েছে অনেক। যেমন তসলিমা নাসরিন কে দেশ ছাড়তে হয়েছে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা জৈব নামক গল্পে দেখি ধর্ষিতা নারীর কত মর্মবেদনা। অন্তর্দহনে তারা জর্জরিত । সমাজে তারা বেঁচে থাকে অন্যের অনুকম্পার পাত্রী হয়ে। সব সময় তাকে তাড়া করে বেড়ায় সুচিতা । সমাজের চোখে সে লাঞ্ছিতা অপমানিতা । কথায় কথায় তার জন্য প্রাপ্য অপমান মন্ডিত কথাবার্তা । তাকে বেঁচে থাকতে হয় করুণার প্রার্থী হয়ে, এর জ্বালা যে কতখানি মর্মান্তিক কেবলমাত্র সেই বোঝে যে ধর্ষিত হয়েছে । অপহৃত নারীদের নিয়ে অনেকে তাদের হীন মনোবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে সূক্ষ্মভাবে সমাজের চোখে সে মহান পুরুষ সাজতে চেয়েছে । কিন্তু যে নারী তার কাছে পালিত হচ্ছে কেবল সেই বোঝে তাকে নিয়ে কি খেলা খেলছে ভদ্র সমাজ । লোকের চোখে ধূলো দিয়ে কেমন মহান সেজে বসে আছে । মমতাজ উদ্দিনের লেখা (কি চাহ শঙ্খচিল) নাটকে তার স্বামী, স্ত্রী রওশনকে কিভাবে অর্থনীতি হাতিয়ার করে তুলেছে। তাঁর জাজ্বল্য প্রমাণ আমরা দেখতে পাই অহরহ সমাজের বুকে । সুপ্রাচীনকাল থেকে নারী কে ধর্ষিত হতে হয় আর পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে । পুরুষের তৈরি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে তার বিচার হয় । বিচার করার জন্য কোন নারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না । আর নারীকে সেই দণ্ডের বিধান মেনে চলতে হয়। নির্যাতিতা নারীর নির্যাতন আসে মূলত আপনজনেরই কাছ থেকে।
আমরা চাই আমরা যেন নির্যাতিতার প্রতি সহানুভূতিশীল হই। তবেই পুরুষ-নারীর মিলিত ধারায় সমাজ সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে।
নজরুলের কথায়-----" এবিশ্বের যা কিছু মহান, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।।"
======০০০======
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন